মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-১৬

0
1114

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৬ ( প্রথমাংশ )

কাবার্ডের সম্মুখে চিন্তিত বদনে দাঁড়িয়ে হৃদি। সুক্ষ্ম চাহনিতে পোশাকসমূহ অবলোকন করে চলেছে সে। কখনো ডানে, কখনো বামে। ওপর নিচও বাদ নেই। চারিদিকে তুষারের ন্যায় শুভ্রতা। সবই শ্বেত রঙা। ভিন্নতা কোথায় তন্মধ্যে!

” ধ্যাৎ! সবই সাদা রঙের। এতে এতো বাছবিচারের কি আছে? একটা নিলেই হলো। হুঁ। ”

আর কালক্ষেপণ না করে একটি সাদা রঙের পাঞ্জাবি বের করলো হৃদি। কাবার্ডের পাল্লা বন্ধ করে পাঞ্জাবিটা রাখলো বিছানায়। এরপর এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের ধারে। রিস্ট ওয়াচ, ওয়ালেট, রিমলেস চশমা সবটাই হাতের নাগালে গুছিয়ে রাখলো। সে মুহূর্তে ক্ষীণ শব্দে উন্মুক্ত হলো ওয়াশরুমের দ্বার। জলে ভেজা শরীরে বেরিয়ে এলো ইরহাম। ডান হাতে তোয়ালে যা চালনা করে চলেছে ভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে। শুষে নিচ্ছে প্রতি বিন্দু জলকণা। দ্বার উন্মোচনের শব্দ কর্ণপাত হতেই পিছু ঘুরে তাকিয়েছিল হৃদি। তবে তা আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দীর্ঘকায় বলিষ্ঠদেহী মানবের সিক্ত গাত্র তার হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করলো। অক্ষিদ্বয় হলো অবাধ্য বেসামাল। দ্রুততার সহিত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মেয়েটি। এখনো ধুকপুকানি অনুভূত হচ্ছে অন্তঃপুরে। উফ্ কি এক শিরশিরানি অনুভূতির বহর! এদিকে দৃষ্টিপাত না করে ভেজা চুল মুছে তোয়ালে হাতে বেলকনিতে গেল মানুষটি। মেলে দিলো সুষ্ঠু রূপে। অতঃপর প্রবেশ করলো কক্ষে। কাবার্ডের ধারে অগ্রসর হতেই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো মেয়েলি রিনিঝিনি স্বর,

” পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। ”

পদযুগল থেমে গেল। কৌতুহলবশত বিছানায় তাকালো মানুষটি। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো বিছানায় রাখা সফেদ পাঞ্জাবি। অধরকোলে অতি সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠলো বোধহয়। ধীরপায়ে বিছানার ধারে গেল ইরহাম। হাতে নিলো পাঞ্জাবি। অতঃপর জড়িয়ে নিলো সুঠামদেহে। এবার তার পানে ঘুরে দাঁড়ালো হৃদি। এতক্ষণ ভিন্ন দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মানুষটির উদোম বক্ষপটে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চায়নি সে। চায়নি কোনোরূপ নাম না জানা অনুভূতিতে আবিষ্ট হতে। হৃদি ড্রেসিং টেবিল হতে চশমা, রিস্ট ওয়াচ এবং ওয়ালেট নিয়ে স্বামীর নৈকট্যে উপস্থিত হলো। অপ্রত্যাশিত একের পর এক আচরণে চমকিত ইরহাম। যদিওবা তা চেহারায় পরিলক্ষিত হচ্ছে না। হাতে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিস বাড়িয়ে দিয়ে হৃদি কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,

” কাবার্ডে আপনার সাইড তো পুরোটাই সাদা। ভিন্ন কালারের একটাও পাঞ্জাবি দেখলাম না। এ কেমন কথা? হবু এমপি বলে অন্য রঙ ব্যান করে দিয়েছেন? ”

হৃদির হাতে থাকা রিস্ট ওয়াচ নিজ কব্জিতে গলিয়ে নিলো মানুষটি। জবাব না পেয়ে অধৈর্য স্বরে শুধালো মেয়েটি,

” কি হলো? বলুন। রাজনীতি করেন বলে অন্য রঙ পড়া নিষিদ্ধ? ”

পকেটে ওয়ালেট পুরে শান্ত কণ্ঠে বললো,

” এমন কিছু নয়। ”

” তাহলে? বিধবার মতো শুধুই সাদা পড়েন কেন? কত সুন্দর সুন্দর রঙের পাঞ্জাবি আছে। দাঁড়ান। আগামী সপ্তাহে শপিংয়ে যাওয়ার প্লান আছে। তখন আপনার জন্য ঝাঁকানাকা কিছু পাঞ্জাবি নিয়ে আসবো। একদম স্টাইলিশ ডিজাইনের। ”

চশমা হাতে নিয়ে প্রশস্ত আরশির সম্মুখে দাঁড়ালো ইরহাম। চুলে হেয়ারব্রাশ চালনা করতে করতে গম্ভীর স্বরে আপত্তি জানালো,

” প্রয়োজন নেই। ”

” আপনার না থাকতে পারে। আমার আছে। চোখের সামনে একটা মানুষ সারাক্ষণ বিধবার বেশে ঘুরবে আর আমি তা দেখে যাবো? নো। নেভার। আমি শীঘ্রই কিছু ডিজাইনিং পাঞ্জাবি কিনে আনবো। ”

হেয়ারব্রাশ রেখে চোখে চশমা পড়ে নিলো ইরহাম। কার রিং সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সে কক্ষ হতে প্রস্থান করলো। যাওয়ার পূর্বে সালাম দিতে ভোলেনি অবশ্য। হৃদি সালামের জবাব দিয়ে ডিভানে বসে পড়লো। অসন্তুষ্ট বদনে বিড়বিড় করে উঠলো,

” রষকষহীন একপিস! ”

কমলা এবং বাদামী রঙের মিলনমেলায় সজ্জিত রেস্তোরাঁটি। এর অভ্যন্তরটি অত্র এলাকার অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্ন। রেস্তোরাঁয় ঢুকলেই একটি বড় কাঠের বোর্ডে তাদের ট্যাগলাইন ‘ ইট রাইট, থিংক রাইট ‘ আগত অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। কাঠের বোর্ড হতে দৃষ্টি সরিয়ে বিপরীতে বসা মানবীদের পানে তাকালো ইনায়া। বাদামি রঙা টেবিলের দু প্রান্তে বসে সে এবং তার বান্ধবীরা। কোলে আরামদায়ক ভঙ্গিতে রাখা তাদের কলেজ ব্যাগ। ইনায়া হাসিমুখে বললো,

” অনেকদিন পর তোদের সাথে রেস্তোরাঁয় আসা। তাই না? ”

” হাঁ রে। লাস্ট বোধহয় মাস দুয়েক আগে এসেছিলাম। ”

ইনায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আরেক বান্ধবী বললো,

” আগে প্রায়ই আসা হতো। এখন আর হয় না। হবে কি করে? আমাদের ইনু তো এখন কিপ্টে হয়ে গেছে। ”

” মোটেও নয়। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাই আসা হয়নি। ” বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো ইনায়া।

” তাই নাকি? তাহলে ভাবীর সাথে যখন ঘুরতে যাস তখন অসুবিধা হয় না? ”

ইনায়া অবাক চাহনিতে তাকালো বন্ধুরূপী সহপাঠীর দিকে। মেয়েটা বরাবরই এমন। কোথায় কখন কি বলতে হয় জানা নেই। ইনায়া কিছুটা অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,

” ভাবী আর তোরা নিশ্চয়ই এক নস? আর ভাবীর সাথে রোজ রোজ বের হই নাকি? অত সময় কোথায়? শুধুমাত্র উইকেন্ডে বের হই। তা-ও অল্প সময়ের জন্য। আম্মুর অনুমতি নিয়ে। ওকে? ”

মেয়েটা কিছু বলতে উদ্যত হতেই আরেকজন তাকে থামিয়ে দিলো।

” আরে ভাই থাম তো। এ-ই ইনু। সে-ই কখন অর্ডার দেয়া হয়েছে। এখনো আসছে না কেন? ”

” এসে পড়বে। ধৈর্য ধর পেটুক রানী। ” হেসে বললো ইনায়া।

অবশেষে খাবার উপস্থিত। মোমো, পাস্তা এবং রিফ্রেশিং জুস। সবার জন্য। ট্রিট দিচ্ছে ইনায়া। খাবার দেখে সকলের খিদে যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ফটাফট কয়েকটা ছবি ক্লিক করলো এক বান্ধবী। সবাই মিলে সেলফিও তুললো। অতঃপর শুরু হলো ভোজন পর্ব। খাওয়ার ফাঁকে মাঝেমধ্যে ইনায়ার দৃষ্টি স্বভাবতই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দৃষ্টি আঁটকে গেল প্রবেশদ্বারে। রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করছে এক মানব, সঙ্গিনী রয়েছে এক মানবী। হাসাহাসিতে মাতোয়ারা দু’জনে। ওর পাশ কাটিয়ে গেল তারা। তবুও লক্ষ্য করলো না মানবটি। বসলো ইনায়াদের টেবিল হতে দু টেবিল পেছনে। তাই ওদের আর দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। যা অসহনীয় ঠেকছিল। যাতনা হচ্ছিল বুকে। তাই তো বিপরীত দিকে বসে থাকা বান্ধবীকে নম্র কণ্ঠে অনুরোধ করলো ইনায়া,

” দোস্ত তুই একটু আমার সাথে সিট এক্সচেঞ্জ করবি? ”

” এক্সচেঞ্জ করবো? কেন কি হয়েছে? এনি প্রবলেম? ” বান্ধবী উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলো।

” আসলে কেমন সাফোকেশন হচ্ছে। একটু এখানে বস না। ” দুঃখী বদনে বললো ইনায়া।

বান্ধবী এতেই গলে গেল। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পরিবর্তন হলো দুজনের সিট। ইনায়া বসলো বান্ধবীর স্থানে। এখান থেকে দু টেবিল পরে বসে থাকা মানবের পৃষ্ঠদেশ দৃশ্যমান। স্পষ্ট রূপে দেখা মিলছে মানবীর মুখখানি। যার অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। দু’জনে কথোপকথনে লিপ্ত। তাদের হাসিমুখ, খুশিময় আভা ইনায়ার বুকে তীরের ন্যায় বি দ্ধ হচ্ছিল। র-ক্তক্ষরণ হচ্ছিল অন্তঃপুরে। মেয়েটি খেতে পারছিল না। বারবার ওদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছিল। গলদেশে আঁটকে যাচ্ছিল পাস্তার ছোট ছোট টুকরো। ভেজা ভাব অনুভূত হচ্ছে চক্ষে। আর সইতে পারলো না কিশোরী ইনায়া। ত্বরিত ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো। বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে বললো,

” তোরা খেয়ে নে। আমি যাচ্ছি। শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না। বিল পে করে দিচ্ছি। ”

” হেই ইনু! শরীর বেশিই খারাপ লাগছে? আমি সাথে আসবো? ”

” না রে। আ’ম ফাইন। তোরা এনজয় কর। আসছি।‌ আসসালামু আলাইকুম। ”

বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে নিলো মেয়েটি। বন্ধুদের ভোজনের মূল্য পরিশোধ করে দ্রুত পায়ে রেস্তোরাঁ হতে বেরিয়ে গেল। যার জন্য এমন আচরণ সে কি আদৌ টের পেল এতসব?

প্রভাতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! ফজরের সালাত আদায় করে হাঁটতে বেরিয়েছে দাদি, নাতবউ এবং পুত্রবধূ স্কো*য়াড। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর পুষ্প বাগানে নজরকাড়া পরিবেশ! ইস্ট ইন্ডিয়া রোজবে, হিবিস্কাস, গোলাপ, রোজ, ডালিয়া, জেসমিন, গাঁদা, ডেইজি প্রভৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ নয়ন জোড়া। হালকা ঝিরিঝিরি পবন শিহরিত করছে তনুমন। দাদির হাত ধরে ধীরজ পায়ে হেঁটে চলেছে হৃদি। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিচ্ছে একেকটি ফুল। তন্মধ্যে বেশকিছু ভেষজ ফুল রয়েছে। যাতে সন্তুষ্ট হলেন রাজেদা খানম।

” বাহ্! নাতবউ তো ম্যালা কামের আছোছ। যেমন কইছিলাম হ্যার থে আরো সুন্দর ব্যবস্থা করছোছ। ”

প্রশংসা শুনে কে না খুশি হয়! হৃদিও খুশি হলো। প্রসন্ন কণ্ঠে বললো,

” যাক দাদিমা! তোমার পছন্দ হয়েছে। আমি তো চিন্তায় ছিলাম। ”

” চিন্তা! কিয়ের চিন্তা? ” ভ্রু কুঁচকে তাকালেন দাদি।

হৃদি গম্ভীর মুখ করে মৃদু স্বরে বললো,

” পছন্দমতো না হলে যদি দুলারি বা রিনা খান হয়ে যাও? ”

অপ্রত্যাশিত জবাবে হতভম্ব রাজেদা খানম। আচমকা উনি সশব্দে হেসে উঠলেন।

” ফা জি ল মাইয়া। আমারে ভয় দেহাছ? তোরে ধইরা পি’ডান দরকার। ”

ভীত নয় বরং বিনোদন পেয়ে হেসে উঠলো হৃদি। মালিহা এতক্ষণ ফুল গাছের যত্ন নিচ্ছিলেন। ওদের হাস্য কলরব শুনে উনি হাতের কাজ থামিয়ে এগিয়ে এলেন। কাছে এসে প্রশ্ন করলেন,

” কি ব্যাপার মা? এত হাসছেন যে? ”

” হেইডা তোমার মাইয়ারে জিগাও বউ। ছে”মড়ি বহুত দুষ্টু আছে। ”

হৃদি গর্বিত ভঙ্গিতে বললো,

” আজ জানলে? আমি তো জন্মসূত্রে বাঙালি দুষ্টু। ”

মালিহা মৃদু হেসে ওর কানের পিঠে চুল গুঁজে দিলেন। হৃদি মুচকি হেসে দাদিকে নিয়ে বাগান জুড়ে হাঁটতে লাগলো। এসে দাঁড়ালো একটি ফুল গাছের নিকটে। গাছে থাকা শুভ্র রঙা ফুলগুলোকে দেখিয়ে বললো,

” দাদি এই ফুলটা চেনো? ভালোমতো দেখে বলো তো। ”

রাজেদা খানম তীক্ষ্ণ চাহনিতে অবলোকন করে চলেছেন ফুলগুলো। অনেকটা সময় ধরে গবেষণা করেও ব্যর্থ। চিনতে পারলেন না।

” কি? পারলে না? স্বাভাবিক। এটা ভিন্ন জাতের ফুল। ইস্ট ইন্ডিয়া রোজবে। এই ছড়ানো, ঝোপঝাড় ছয় থেকে দশ ফুট লম্বা এবং পাঁচ থেকে আট ফুট চওড়া পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এটা সাদা, মোমযুক্ত গ্রীষ্মের ফুল বহন করে এবং তরঙ্গায়িত প্রান্তের সাথে আয়তাকার পাতা রয়েছে যা উপরে গাঢ় সবুজ এবং নীচে ফ্যাকাশে সবুজ। ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ডের কিছু অংশের স্থানীয় এই গাছটি বিকাশ লাভ করে যেখানে তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে থাকে। ”

” বুঝছি বুঝছি। এইডা হইলো গা ভারতী গো ফুল। ”

হৃদি সশব্দে হেসে বললো,

” শুধু ওদের নয়। আমাদের দেশেও জন্মে গো দাদি। ”

” হয় বুঝছি। এহন চল। ওই গোলাপ গাছের ধারে। ”

” চলো। ”

বৃদ্ধা দাদির হাত ধরে ধীরপায়ে এগোতে লাগলো হৃদি। বলতে লাগলো কত কি! স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে মালিহা। মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলেন এ দৃশ্য। উনি ভুল কাউকে পছন্দ করেননি। একদম সঠিক মানুষকেই পছন্দ করেছেন।

প্রতীক বরাদ্দের পর মুহূর্ত হতেই প্রার্থীদের পদচারণায় মুখর গোটা দেশ। দেশের আনাচে কানাচে চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শো, সর্বত্র নির্বাচনী আলাপচারিতা। ভোটারদের কাছে টানতে নানা কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন প্রার্থীরা। ডিজিটাল প্রচারণা, বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী গান, গণসংযোগ, পরিচিত তারকাদের নিজেদের পক্ষে প্রচারে নামানো, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিসহ সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ফেসবুকে পেজ খোলাসহ প্রার্থীদের লাইভ করার মাধ্যমে এবারের প্রচারে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে পিছিয়ে নেই ইরহাম চৌধুরী নিজেও। সকাল হতে গভীর রাত অবধি চলছে প্রচারণা। এমপি পদপ্রার্থী ইরহাম চৌধুরীর বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজগর সাহেব। স্বাভাবিক ভাবেই যা বেশ মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। তবুও দমে যাচ্ছে না মানুষটি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

শুক্রবার আজ। ছুটির দিন। মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে প্রচারণা অভিযানে নেমে পড়েছে ইরহাম। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় সেরে নিয়েছে দুপুরের ভোজন। সেখানে নির্বাচন বিষয়ক টুকটাক কথাবার্তা হলো। অতঃপর ভোজন পর্ব সম্পন্ন করে লম্বা এক মিছিল বের হলো রাজপথে। অসংখ্য দলীয় কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যমণি শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটি। যার চোখেমুখে উদ্দীপনা, অদম্য এক চেতনা। অন্তরে এক ক*লুষতা বিহীন সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন। দেশনায়ক নয় বরং পথপ্রদর্শক হিসেবে তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করাই তার মূল লক্ষ্য। অপরাজেয় স্বপ্ন। মানুষটির প্রতিটি কদমে অনুপ্রাণিত হচ্ছে তরুণ সমাজ, দেশবাসী। সঙ্গ দিচ্ছে বিশ্বস্ত সহচরেরা। তার মুখনিঃসৃত দৃঢ় বাক্যে হারানো স্বপ্ন পূরণের আশা দেখছে নগরবাসী। সে স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কি? নাকি অমানিশার ঘোর আঁধারে তলিয়ে যাবে!

মিছিল চলাকালীন সময়ে পথচারীদের হাতে বিলি করা হয়েছে অগণিত লিফলেট। ঢেউটিন মার্কায় ভোট চেয়েছে ইরহাম চৌধুরী। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। বিকেলের নিউজে সম্প্রচার করা হয়েছে মিছিলের অংশবিশেষ।

জনবহুল শহরে তখন রাত্রি নেমেছে। আঁধারে তলিয়ে গোটা শহর। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতের ঘরে। ছোটোখাটো এক চায়ের দোকানে বসে ইরহাম। বিপরীত দিকে বসে বিশ্বস্ত সহচর সাহিল এবং দলের দু’জন ছেলে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে মানুষটা। মনোযোগ সহকারে শুনছে সাহিলের কথা। সহসা পকেটে থাকা মোবাইলটি বেজে উঠলো। বিপ বিপ শব্দে সৃষ্টি হলো আলোড়ন। কথোপকথনে বাঁধা পেয়ে থেমে গেল সাহিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পকেট হতে মোবাইল বের করে হাতে নিলো মানুষটি। ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত হলো কলার আইডি দেখে। বিলম্ব না করে ত্বরিত কল রিসিভ করলো সে।

” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৬ ( শেষাংশ )

অমানিশায় ছেয়ে বসুন্ধরা। নিত্যদিনের চেয়ে আজ সামান্য দেরী করে বাড়ি ফিরেছে ইরহাম। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে একজন পরিচারিকা বদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করে দিলো। গৃহে প্রবেশ করলো অন্যমনস্ক মানুষটি। বড় বড় কদম ফেলে লিভিংরুমে সোফায় বসে থাকা মালিহার পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। সালাম আর দিলো না। তাকালো না অবধি। খেয়াল করেনি নাকি? এহেন আচরণে মালিহা কিছুটা অবাক হলেন বটে। এমনটা তো কখনো হয় না। দেখা হলেই গম্ভীর ছেলেটা কথা না বলুক অন্তত সালাম দিয়ে রুমে যায়। তবে আজ! ছেলেটা ঠিক আছে তো? অসুস্থ নাকি! মাতৃহৃদয় তো। উনি দ্রুত দোতলায় ইনায়ার কক্ষে অগ্রসর হলেন। গেলেন সেথায় উপস্থিত হৃদির কাছে। নিজেই ছেলের কাছে যেতেন। তবে গেলেন না। ছেলে এখন বড় হয়েছে। বিবাহিত। ঘরে সহধর্মিণী আছে। কখনো কখনো ওনাকে ছাড় দিতে হবে। ছেলেকে বরং ছেলেবউ দেখে নিলো। বিশেষ প্রয়োজনে উনি গেলেন নাহয়। হৃদিকে কক্ষে পাঠিয়ে দিয়ে চিন্তিত বদনে সোফায় বসলেন মালিহা। উৎকণ্ঠিত ওনার কোমল হৃদয়।
.

চিন্তিত চিত্তে কক্ষে প্রবেশ করলো হৃদি। প্রবেশ করে চমকালো বেশ! আঁধারে তলিয়ে গোটা কক্ষটি। এ কেমন কাণ্ড! হৃদি আন্দাজ মোতাবেক সুইচবোর্ডের ধারে গেল। আলোকিত হলো কক্ষটি। কেটে গেল আঁধার। হৃদি ওয়াশরুমের দ্বার এবং বিছানায় তাকালো স্বভাবত। মানুষটি অনুপস্থিত। তবে! এবার কক্ষের বাঁ পাশে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো স্বামীর অবয়ব। ডিভানে দেহ এলিয়ে দিয়েছে মানুষটি। পাঞ্জাবি, পাজামা সব পূর্বের ন্যায়। বাহির থেকে যেমন এসেছে তেমনই। শুধুমাত্র চশমা নিখোঁজ। বিছানায় অবহেলিত রূপে পড়ে আছে সেটি। হৃদির চিন্তা আরো বৃদ্ধি পেল এমনতর অবস্থা দেখে। ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে এলো সে। দাঁড়ালো স্বামীর কাছ ঘেঁষে। চক্ষু বুজে শায়িত ইরহাম। ডান হাতটি ঠাঁই পেয়েছে নয়ন জোড়ার ওপরে। বিন্দু বিন্দু স্বেদজলের অস্তিত্ব শুভ্র পোশাকে লেপ্টে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। হয়েছে টা কি? উৎকণ্ঠিত মনোভাব লুকোতে না পেরে হৃদি থেমে থেমে মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো,

” শুনছেন? আপনার কি শরীর খারাপ করছে? ”

জবাব এলো না। পূর্বের ন্যায় দেহ এলিয়ে মানুষটি।

” দুর্বল লাগছে খুব? লেবুর শরবত কিংবা ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসবো? ”

এবারো জবাব এলো না। তাই নিজের মতো ভাবনা সাজিয়ে দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো হৃদি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো।

” হাঁ রে মা! কি হয়েছে? ইরু ঠিক আছে তো? শরীর খারাপ করছে? ”

হৃদি তাকে আশ্বস্ত করতে অধরকোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,

” বঙ্গ মাদার। রিলাক্স। উনি একটু দুর্বল। এই যা। আমি এখুনি লেবুর শরবত বানিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে উনি দু মিনিটের মধ্যেই চা’ঙ্গা হয়ে যাবেন। ”

পুত্রবধূর বাচনভঙ্গি দেখে হেসে উঠলেন মালিহা। শান্ত হলো ওনার উচাটন করতে থাকা হৃদয়।

” আচ্ছা বাবা আচ্ছা। তাহলে দেরী কিসের? চটাপট লেবুর শরবত নিয়ে যা। আমার ছেলেটা অপেক্ষা করছে তো। ”

হৃদি মুচকি হেসে কিচেনে প্রবেশ করলো। স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্তুত হলো লেবুর শরবত। বেশ সুঘ্রাণ বেরিয়েছে। খেতে নিশ্চয়ই তৃপ্তিকর লাগবে। নিজ কর্মে নিজেই সন্তুষ্ট হলো মেয়েটি। ঠাণ্ডা লেবুর শরবত নিয়ে কিচেন হতে বেরিয়ে এলো। পা বাড়ালো কক্ষের পানে। কক্ষে প্রবেশ করে একদফা হতাশ হলো। গোমড়ামুখো মানুষটা এখনো দেবদাসের মতো বসে। একে নিয়ে আর পারা গেল না। ওর মতো পকপক মুরগির কপালে কিনা শেষমেষ বোবা মোরগ জুটলো! আফসোস! হৃদি স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালো। মোলায়েম স্বরে ডাকলো,

” শুনছেন? এই যে লেবুর শরবত। খেয়ে দেখুন। রিফ্রেশ লাগবে। ভালো ঘ্রাণ বেরিয়েছে। মজাদার স্বাদ। ”

এতক্ষণে মুখ খুললো মানুষটি। গম্ভীর স্বরে আদেশ প্রদান করলো,

” একাকী সময় কাটাতে চাইছি। লিভ মি অ্যালোন। ”

” সে নাহয় যাচ্ছি। কিন্তু শরবতটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে। ”

চক্ষু হতে হাত সরিয়ে নিলো ইরহাম। তাকালো সহধর্মিণীর পানে। আঁতকে উঠলো হৃদি। নভোনীল চক্ষু জোড়ায় অসীম ক্রো’ধের বহ্নি শিখা। চোখের সাদা অংশে র’ক্তিম আভা। অভ্যন্তরীণ অবস্থা যে বেশ ভ-য়ঙ্কর তা বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়েটির। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে দু পা পিছপা হলো। হাতে থাকা ঠাণ্ডা গ্লাসটি ঈষৎ কম্পিত হলো। মায়ায় ভরা আঁখি যুগলে দেখা মিললো ভীতির। ডিভান ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। এলোমেলো কেশে হাত বুলিয়ে এক কদম অগ্রসর হলো। অত্যধিক রাশভারী কণ্ঠে বললো,

” একবার বললে কথা কানে যায় না? মেলোড্রামা করছো? ধরম পত্নী সাজার শখ হয়েছে? ”

একসঙ্গে তিনটে প্রশ্ন। কণ্ঠে এতখানি গাম্ভীর্য বিদ্যমান যে শিরায় শিরায় কাঁপন ধরে যাচ্ছে। টগবগিয়ে লম্ফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ডটি। স্বয়ংক্রিয় ভাবে জবাব দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললো মেয়েটি। ইরহাম আরো দু কদম এগিয়ে একদম মুখোমুখি দাঁড়ালো। নয়নে নয়ন স্থির রেখে কঠিন স্বরে বলে গেল,

” রঙঢঙ করছো কার সামনে? ইরহাম চৌধুরীর সামনে? অ্যাজ ইফ আই কেয়ার অ্যাবাউট ইট? হা? ”

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন বাণে জর্জরিত মেয়েটি মৃদু স্বরে শুধালো,

” আ মি রঙঢঙ করি? ”

উঁচু কণ্ঠে ক্ষি প্ত ভঙ্গিমায় ইতিবাচক সম্মতি জানালো ইরহাম,

” হাঁ করো। রঙঢঙ নয়তো কি? ”

পিছু ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে ইরহাম বললো,

” দুনিয়াটা রঙ্গমঞ্চ পেয়েছে সব। যে যা খুশি করে যাবে। বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। কেউ নেই। ”

শেষোক্ত দু শব্দ জোর প্রদান করে উচ্চারণ করলো। অক্ষিকোল ভিজে উঠলো মেয়েটির। লালাভ রঙ মেখে চোখের সফেদ অংশে। সহসা ওর দিকে ঘুরে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো ইরহাম,

” এই যে তুমি। বিয়ের আগে কি বলেছিলাম মনে নেই? সব ভুলে খেয়েছো? তাহলে শেষবারের মতো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ডোন্ট ইয়্যু ডেয়ার ইন্টারফেয়ার ইন মাই লাইফ। সে অধিকার তোমাকে এখনো দিইনি। ”

হাতে থাকা গ্লাসটি শক্ত করে আঁকড়ে হৃদি ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

” সামান্য এক গ্লাস শরবত এনে আমি আপনার জীবনে ইন্টারফেয়ার করে ফেলেছি? তাহলে আ-আপনি? আপনি কি আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার করেননি? ”

ইরহাম তখন বিপরীত দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হৃদি বলে গেল,

” আমি নাহয় মাঝেমধ্যে আপনার সঙ্গে দুষ্টুমি করে থাকি। তাই বলে আপনি কখন কোথায় যান, কি করেন, কার সঙ্গে মেশেন কখনো জানতে চেয়েছি? চাইনি। কারণ আপনার মতো আমিও এই বিয়েটা নিয়ে সিরিয়াস নই। বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চেয়েছে। আপনায় পছন্দ করে জামাতা বানিয়ে ফেললো। ব্যাস। এতটুকুই। ”

ভিন্ন আরেক সত্যি প্রকাশ করলো না মেয়েটি। দুঃখে জর্জরিত তার অন্তঃস্থল। অবরোধ হয়ে আসছে কণ্ঠনালী। চিনচিনে ব্যথা ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। তবুও ভাঙা স্বরে বলে চলেছে,

” আমি কিন্তু কখনোই আমার সীমা লঙ্ঘন করিনি। কিন্তু মনে করে দেখুন। আপনি কি করেছেন। বিয়ের পর প্রথমবার আমার বাড়িতে গিয়ে আমার পছন্দের ছবিগুলো ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিলেন। কতগুলো কথা শোনালেন। আমি কেমন ওড়না পড়ে বাহিরে যাবো সেটাও ঠিক করে দিলেন। তখনো ডায়লগ ঝাড়লেন। আমি যেন একটুখানি সওয়াব কামাই তাই দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে আমায় একটু একটু করে নামাজে অভ্যস্ত করলেন। কেন? এসবে আপনার কি স্বার্থ? আমি বেপর্দায় চলি কিংবা বেনামাজী হই তাতে আপনার কি? আমি তো আর আপনার প্রকৃত সহধর্মিণী কিংবা মনের মানুষ নই। তাহলে কেন আমার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে থাকেন? ”

ওষ্ঠ ফাঁক করে ঘনঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে কোনোরূপ সামলানোর চেষ্টা করলো হৃদি। দমবন্ধকর লাগছে। ভগ্ন হৃদয়ে সে মৃদু কণ্ঠে বললো,

” আজ আমার জীবনের অন্যতম বড় একটা ভুল করেছি একজনকে ক্লান্ত ভেবে তার অতিরিক্ত খোঁজখবর নিয়ে। ভেবেছিলাম ইন্ট্রোভার্ট মানুষটি নিজের অসুবিধা বলতে নারাজ। তাই নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি এজন্য এত শুনতে হবে। কত তকমা পেতে হবে। যাই হোক। আ’ম স্যরি এতদিনের কুকীর্তির জন্য। হৃদি শেখ আজ আপনায় কথা দিচ্ছে হবু এমপি সাহেব। তার দ্বারা আপনাকে আর কখনো বিন্দুমাত্র বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। নিশ্চিন্তে থাকুন। ”

আর’ক্ত নয়ন বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। দ্রুততার সহিত হাতের উল্টো পিঠে তা মুছে নিলো। এ মানুষটিকে মূল্যবান অশ্রু দেখাতে নারাজ সে। বড় বড় কদম ফেলে ওয়াশরুমের পানে এগিয়ে গেল মেয়েটি। উন্মুক্ত দ্বার দিয়ে লেবুর শরবত পুরোটা ফেলে দিলো। শূন্য গ্লাস হাতে বেরিয়ে গেল কক্ষ হতে। একটিবারের জন্যও পিছু ঘুরে তাকালো না। তাকাবে কার জন্যে! ওই নি-ষ্ঠুর মানবের জন্য!
.

রাতের ভোজন পর্বে আজ বড্ড শান্ত ডাইনিং এরিয়া। যেমনটি মাস দুয়েক পূর্বে থাকতো। ডিনারে দু’জন অনুপস্থিত আজ। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ইরহাম চৌধুরী। এজাজ সাহেব প্রথমে অবাক হয়েছিলেন এত নীরবতা অনুধাবন করে। পরক্ষণে উপলব্ধি করলেন এসবের মূল হেতু কি। হৃদি মেয়েটা আজ নেই। সে থাকলে একাকী কত বকবক করতে থাকে। সঙ্গ দিতে তখন বাকিরাও টুকটাক কথা বলে। এভাবেই রমরমা হয়ে যায় পরিবেশ। আজ মেয়েটার অনুপস্থিতিতে সব নীরব, শান্ত। পূর্বের ন্যায় শৃঙ্খল। তবুও কেমন দৃষ্টিকটু লাগছে। কিছু অনুপস্থিত- এ কথাটা যেন মনে বি দ্ধ হচ্ছে বারংবার। এজাজ সাহেব এসবে পাত্তা না দেয়ার প্রয়াস জারি রাখলেন। মুখে নিলেন সবজি পুরে রাখা রুটির টুকরো।

” হাঁ মা। ওদের খাবারটা আমি আলাদা করে বেড়ে রেখেছি। হৃদি ঘুম থেকে উঠলে খেয়ে নেবে। ”

মালিহার কণ্ঠে ঘোর কেটে গেল এজাজ সাহেবের। শুনতে পেলেন রাজেদা খানম বলছে,

” আর তোমার পোলা? হ্যায় খাইতো না? ”

” স্টাডি রুমে কাজ করছে মা। পরে খেয়ে নেবে। ”

” কি যে এত কাম! আল্লাহ্ জানে। ” অসন্তোষ ভাব পরিলক্ষিত হলো ওনার মুখশ্রীতে।
.

অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটি। বিছানার এককোণে জড়োসড়ো হয়ে শায়িত এক রমণী। তার পৃষ্ঠদেশ ছেয়ে কৃষ্ণবর্ণ কেশে। মাথার নিচে নেই বালিশের অস্তিত্ব। বিছানা চাদরের এক টুকরো প্রবল ভাবে মুঠোবন্দী। দুমড়ে মুচড়ে দুঃখ উপশম করছে কি? ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে তার কোমল কায়া(দেহ)। কেশের পাতলা আস্তরণ লুকিয়ে রেখেছে যন্ত্রণাদায়ক মুখখানি। নোনাজলে ভিজে যাচ্ছে বিছানার একাংশ। নোনতা জলকণা লেপ্টে মুখে। অতি ক্রন্দনের ফলস্বরূপ বেদনা অনুভূত হচ্ছে গলদেশে। চিঁ’ড়ে যাচ্ছে বুঝি কণ্ঠনালী। মনোবেদনা মিশ্রিত সে ক্রন্দনের ফোঁপানি ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে। হিমশীতল এক পরিবেশ। পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আঁধারিয়া রজনীতে হৃদি নামক এ রমণীর ক্রন্দন কারোর কর্ণপাত হলো না। অতিথি কক্ষের বদ্ধ দ্বারের মধ্যে চাপা রইলো সবটুকু। তার পীড়ন, দুঃখিনী হাল সবটুকুই…

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে