ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর মোবাইল গুঁতোগুঁতি করতে করতে অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। এই বাজে স্বভাবটা কিছুতেই দূর হচ্ছে না বা সেসব নিয়ে আমি ভাবিও না। সকালে ঘুম ভাঙলে বালিশের তলে আপনা আপনি হাত চলে যায়। আর রাতের বেলা ঘুমুতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে রাখা মোবাইলটা নিয়ম করেই বালিশের তল থেকে হাতে চলে আসে।
বুয়া এসে বেল টিপে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এরপর দীর্ঘ সময় অলস বিছানায় গড়াগড়ি খাই। ছুটিরদিন থাকলে তো কথাই নেই। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে দুপুর পেরিয়ে কখনো কখনো বিকেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে সূর্য। ব্যাচেলর জীবনের এই এক মিশ্রিত বিষয়—না ভালো না মন্দ। তবে অভ্যেস। বুয়া এসে কাজকর্ম সেরে চলে গেল। দুধ গরম করে দিয়ে গিয়েছিল। দুধ আর কর্ন দিয়ে নাস্তা সেরে ফের বিছানায় এলাম।
বিছানার এক কোনায় হরিশংকর জলদাসের ‘প্রস্থানের আগে’ বইটা পৃষ্ঠা খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছি। এখনো অর্ধেকের বেশি বাকি। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। বেশ চমৎকার মলাট। তারচেয়েও বড় কথা গল্পটা জেলে সম্প্রদায়ের এক যুবকের উত্থানের। পড়তে পড়তে হরিশংকর জলদাসের নিজের জীবনের ছাপ অনেকটাই পাচ্ছি। জানি না শেষ পর্যন্ত গল্প কোথায় গিয়ে শেষ হয়। অবশ্য আমার অনুমান ভুল হতে পারে। কারণ লেখকেরা একটা সূত্র পেলে সেটার আগাগোড়ায় রঙ মিশিয়ে একটা বর্ণিল কাহিনী দাঁড় করিয়ে ফেলে। এখানেই আর দশজনের চেয়ে লেখকেরা অনন্য, যেটা আমি পারি না। শুধু পড়ে যাই।
অবশ্য এই উপন্যাসে কোনো বর্ণিল কাহিনী নেই, রয়েছে পাতায় পাতায় সাদা-কালো জেলে জীবনের উত্থান-পতন আর সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার গল্প। নেড়েচেড়ে বইটা যেখানে ছিল সেখানেই ভাঁজ করে রেখে দিলাম। এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না। রাতে টানা শেষ করে ফেলব।
জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডিগবাজি খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। ফেসবুকে লগ ইন করে স্ক্রল করছি। স্ক্রল করতে করতেই একসময় বিরক্ত লাগা শুরু হলো। মানুষের জীবনটা এই এক মোবাইলের ভেতর ঢুকে গেছে। যেন জীবন হয়ে গেছে জি বাংলা না হয় স্ক্রলময়। ফেসবুক থেকে বেরিয়ে একটা অনলাইন পোর্টালে লগ ইন করলাম। দিনের শুরুর ঘটনাগুলো এক নজর দেখে নেওয়াও অভ্যাসের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদ স্ক্রল করতেই পোর্টালের মাঝের একটা খবরে চোখ আটকে গেল—‘মধ্যরাতে কামরাঙ্গীর চরে কিশোরী ধর্ষিত’।
দ্রুত খবরটায় ক্লিক করলাম। কামরাঙ্গীর চরে গত রাত সাড়ে ১২টা ১টার দিকে এক কিশোরী সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। ভোরে পুলিশ উদ্ধার করেছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। কিশোরীর বয়স ১৫ হবে। নাম উল্লেখ নেই। ছবির জায়গায় কামরাঙ্গীরচরের একটা মানচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
খবর শেষ করতে না করতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। কেমন যেন অদ্ভুত শীতলতা এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলল। মেরুদণ্ড দিয়ে প্রবেশ করে গভীর শীতলতা যেন বিবশ করে ফেলল আমায়। এক বোধহীন অনুভূতি, যেটা শব্দে বর্ণে প্রকাশ করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই। ধর্ষণের খবর এখন পত্র-পত্রিকার নিত্য খবরের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু এই খবর আমাকে ভেতর থেকে টেকটোনিক প্লেটের মতো নাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমার করণীয় কী? কিছুই বুঝতে পারছি না।
গতকাল রাতে বাইক নিয়ে হাতিরঝিল হয়ে বাসায় ফিরছিলাম। বৃহস্পতিবার হাতিরঝিলে তেমন ভিড় থাকে না। আজও ছিল না। কিন্তু মহানগরের ওভারব্রিজ থেকে নামতেই একটা জটলা চোখে পড়ল। প্রায়ই এমন ভিড় কারণে অকারণে চোখে পড়ে। কখনোই ভ্রুক্ষেপ করিনি। কিন্তু এই ভিড়টা আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। বাইক থামিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম—আসলে ঘটনা কী! রাস্তার এপাশ থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাইক একদিকে পার্ক করে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে ভিড়। বয়স ১৫-১৬ হবে। দেখে ভদ্র ঘরের মেয়েই মনে হলো। মানুষজন জিজ্ঞেস করতেই একেকজন একেক রকম তথ্য দিচ্ছে। অসামাজিক কাজ করেছে মেয়ে। দীর্ঘ সময় ধরে নানা রকম বিচার শালিস চলেছে মনে হলো। কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না কেউ। ভিড়ের মধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে ২০-২২ বছরের কয়েকজন যুবক। সাথে কয়েকজন মুরব্বি গোছের লোকজনও রয়েছেন। এরা সবাই সম্ভবত মধুবাগ বা তার আশেপাশের বস্তিতে থাকে। এদের মধ্যে থেকে দুই-একজন যুবক হালকা চিল্লিয়ে ভিড় কমাতে বলছে।
আমি কাছাকাছি যাওয়ার আগেই মেয়েটাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তারপর চলে যেতে বলা হলো। কিছুই বুঝলাম না।
‘ভাই কী হয়েছে?’
নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হলো। বাক্যটা মনে হয় বেশ জোরেই বলে ফেলেছি। মেয়েটাও আমার দিকে ঘুরে তাকাল। টিনেজ মেয়ে। একদম সরল চেহারা। কিন্তু এই আলো আঁধারিতেও মেয়েটি যে আতঙ্কিত তা অনুমান করতে অসুবিধা হলো না। মনে হলো প্রেমিক বা স্বজনের সাথে ঘুরতে এসেছিল। কিন্তু সাথে তো কেউ নেই। অসামাজিক কোনো কাজের সাথেই সে যদি জড়িয়ে থাকে তাহলে সে একা কেন? যার সাথে ঘটনা সে কোথায়? এসব প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাওয়ার আগেই দুজন যুবক এগিয়ে এল। কালো কুচকুচে গায়ের বরণের এক যুবক বলল—‘ভাই খারাপ মেয়ে।’
‘খারাপ মানে? না বললে বুঝব কী করে?’
সম্ভবত আমাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে এরা। অফিস থেকে ফিরছিলাম। প্যান্ট শার্ট ইন করা আমার। চেহারাতেও আমার একটা ভদ্রলোক টাইপের বিষয় রয়েছে। হয়তো এই কারণে বা জোরে কথা বলার কারণেই হোক সবার দৃষ্টি আমার দিকে এখন। অপর যুবক বলল—‘এই মাইয়া প্রাইভেট গাড়িতে কইরা তিনজনের লগে আইছিল আকাম করতে। এই মাইয়া আরেক বুড়াব্যাটা বাইরে বইসা তামাশা দেখতাছিল। বাকি দুইজন গাড়ির পিছনে আকাম করতাছিল, এই হইলো গিয়া ঘটনা।’
‘আকাম মানে?’
‘মানে ভাইজান আপনারে বুঝায়ে বলতে হইব?’
‘না ঠিক আছে, কিন্তু এই মেয়ে একা কেন?’
‘এলাকার পোলাপাইন যখন আইসা জিজ্ঞাসা করতেছিল গাড়িতে কারা? কী করে, তখন এই মাইয়া এই বেঞ্চে বইসা আছিল। সাথে ওই বুড়া ব্যাটা আছিল। তারাও রঙ শুরু করত। আমাগো কুনো কথার উত্তর দিতাছিল না। তখন আমাগো পোলাপাইন বুইঝা ফালায় পিছনের সিটে পোলা মাইয়া দুইজন রঙ্গ করতাছিল। তখন আমরা কাহিনী জিগাইলাম এই মাইয়ারে, এই মাইয়া উলটাপালটা কথা কয়। অ্যার মধ্যে বুড়াব্যাটা গাড়িতে কারা আছে দেখাইতে চাইয়া গাড়ির ভিতর ঢুইকা সাথে সাথে স্টার্ট দিয়া গাড়ি নিয়া টান মাইরা পালাইয়া যায়, আমরা ধরতে পারি নাই। এহন কন কী করমু?’
ছেলেটা গলায় জোর এনে টেনে টেনে কথাগুলো বলছিল। বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছিল না। তবে এতটুকু বোঝা গেল চারজন একটা প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছিল। এরমধ্যে এই মেয়েটাও ছিল। কিন্তু বেকায়দায় পড়ে মেয়েটাকে রেখে তারা দ্রুত সটকে পড়ে। আমি একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম—‘তাহলে এখন মেয়েটাকে কী করবেন?’
‘কী আর করমু করার কিছু নাই। এই মাইয়ারে ছাইড়া দিলাম। চইলা যাইব এহন।’
বাম হাতের কবজি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখলাম রাত পৌনে বারোটা। এই সময় একা এই মেয়ে কোথায় যাবে? নাকি এই ছেলেরাই ভিড় থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। পরে নিজেরা বদ মতলব আটবে। আমি বললাম—‘কিন্তু ভাই এইভাবে একটা মেয়েকে এত রাতে ছেড়ে দিলে সে কিভাবে যাবে?’
‘তাইলে কী করমু? আমরা রাইখা দিমু?’
এক শুটকো মতো ছেলে মুখের ওপর ছুড়ে মারল বাক্যটা। মেয়েটা এক কোনে গিয়ে প্রায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দৃষ্টি আমার দিকে, এতক্ষণ মেয়েটা কী ভয়ঙ্কর মানসিক চাপের মধ্যে দিয়েই না যাচ্ছিল, মনে হলো আমার। আমি বললাম—‘না আপনাদের মধ্যে কেউ একজন মেয়েটাকে বাসে তুলে দিয়ে আসেন। যাতে মেয়েটা অন্তত নিজের বাসায় ঠিকঠাক চলে যেতে পারে।’
আমার কথা শুনে মুরুব্বি গোছের একজন এগিয়ে এলেন। চেহারায় হতদরিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। সম্ভবত রিকশা-ভ্যান চালান। ‘বাবা তুমি তো মটর সাইকেল নিয়া আইছো, মাইয়াটারে তুমি নিয়া একটা বাসে তুইল্লা দাও।’
মুরুব্বীর কথা শেষ হওয়ার সাথেই ‘হ হ হ ঠিক ঠিক’ টাইপের সমর্থন সমস্বরে চলে এলো। কিন্তু আমি কিভাবে মেয়েটাকে বাসে তুলে দেব। যদি ঝামেলা হয়। তারমধ্যে আমাকে বাসায় ঢুকতে হবে। দারোয়ান সর্বোচ্চ ১২টা পর্যন্ত এলাউ করে। অন্তত আমার জন্য এই বাড়তি সুবিধা। এখন এই মেয়ের দায়িত্ব নিতে গেলে তো বাসায় ঢুকতে পারব না। কী এক ঝামেলার মধ্যে পড়া গেল।
সবাই প্রায় জোর করেই মেয়েটাকে আমার বাইকে তুলে দিল। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই বাইক স্টার্ট দিলাম। বাইক চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করলাম—‘বাসা কোথায় তোমার?’
‘কামরাঙ্গীচর।’
‘বলো কী! সে তো অনেকদূর, এত রাতে এখানে এসেছো কেন?’
‘আমি আসছিলাম কাজিনের সাথে। কাজিনের সাথে তার জিএফ ছিল। আর ড্রাইভার। আসার সময় আম্মাকে বলে নিয়ে আসে যে আমাকে ঘুরাতে নিয়ে যাচ্ছে। আম্মাও কিছু বলেনি। আমি ভাবলাম, হাতিরঝিল দেখা হয় নাই। কাজিনের সাথে গাড়িতে গেলে দেখা হবে।’
‘তোমার মা রাজি হয়ে গেলেন, আর তুমিও?’
‘সে আমার খালাত ভাই। তাই আম্মা কিছু বলে নাই। আমরা বের হইছিলাম বিকালে। কে জানত এত রাত হবে।’
‘ঘটনাটা আসলে কী, খুলে বলো তো?’
বাইকের গতি এভারেজ রেখে চালাচ্ছিলাম, যাতে মেয়েটার কথাগুলো বোঝা যায়। মেয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা বলছে। নাকি বাতাসের কারণে গলা কেঁপে যাচ্ছে—ঠিক স্পষ্ট না। মেয়েটার উচ্চারণ শুদ্ধ।
‘সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসে ওখানে বসছিলাম। মানে আমার কাজিন তার জিএফরে নিয়ে কী যেন কথা বলবে তাই আমাকে ওই বেঞ্চটায় বসতে বলল। একটু পর ড্রাইভারও বাইরে এসে বসল। আমি তো জানি না গাড়িতে কী কথা বলবে তারা। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর কতগুলো ছেলে এসে গাড়ি ঘিরে ধরে। এরপর ড্রাইভার গাড়িতে ঢুকে দ্রুত টান মেরে চলে যায়। আমি একাই পড়ে যাই…’
মেয়েটা এক নাগাড়ে বলে থামল। বুঝে গেছি আসলে ঘটনা কী। এখন এই মেয়েকে কিভাবে বাসে উঠিয়ে দিই? এফডিসি মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। কোনো বাস নেই। মাঝে মধ্যে কিছু ভারী ট্রাক শব্দ করে চলে যাচ্ছে। বাইক টান মেরে সার্ক ফোয়ারার কাছে চলে এলাম। সোনারগাঁও হোটেল ঘেঁষে বাইক রেখে কয়েক মিনিট ওয়েট করলাম। কামরাঙ্গীর চরের দিকে যাওয়ার মতো কোনো যানবাহন নেই।
‘বাস তো নেই, এখন কী করবা?’
‘ভাইয়া প্লিজ আপনি আমারে রেখে আসেন না, প্লিজ…’
‘তুমি পড়ালেখা করো?’
‘জ্বি।’
‘কিসে পড়ো?’
‘আমি এইবার এসএসসি দিব।’
কথা শেষ হতে না হতেই একটা যাত্রাবাড়ীগামী বাস চলে এলো।
‘এই বাসে উঠলে কি তুমি যেতে পারবা?’
‘আমি এই বাস থেকে কই নামব?’
‘আমিও তো জানি না কই নামবা।’
‘তোমার বাসায় ফোন দাও।’
‘আমার কাছে তো ফোন নাই, আমাকে তো ফোন দেয় নাই বাসা থেকে।’
উফফ! কেমন যেন রাগ লাগতেছে। কেন এই মেয়ে রাতে আসছিল? আর কাজিন শালাটাও কেমন কাপুরুষ, নিজের খালাত বোনকে এভাবে বিপদে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়! উবার ঠিক করে দেব কিনা ভাবছি। এইসময় একটা সিএনজি রিকশা কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল।
‘এই কামরাঙ্গীর চর যাবেন?’
‘কামরাঙ্গীর চরের কোন জায়গায়?’
মেয়েটা আমার দিকে একটা অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জায়গার নাম বলল।
‘হ যামু, সাড়ে তিনশো পড়ব।’
‘তিনশো নিয়েন, যান।’
‘মামা এই রাতেই, আর বিশ টাকা দিয়েন…’
আমি মেয়েটাকে উঠে যেতে বললাম। ওয়ালেট থেকে তিনশো বিশ টাকা বের করে সিএনজিওয়ালাকে দিয়ে বললাম, বাসার কাছেই যেন নামিয়ে দেয়। মেয়েটার হাতে একটা আমার কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে ফোন দিতে বললাম। মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ধন্যবাদ না কী যেন একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করল। শব্দ করে সিএনজি বেরিয়ে গেল। সিনএজির শব্দে সেটা স্পষ্ট শোনা গেল না। মধ্যরাতের ঢাকা, অদ্ভুত ঢাকা। নিজের মনে মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাইক টান মেরে কলাবাগান হয়ে মোহাম্মদপুরে চলে এলাম। বাসায় এসে গোসল করে খেয়ে হরিশংকরের বইটায় ডুবে গিয়েছিলাম। আর কিছুই মনে ছিল না। মনে ছিল না মেয়েটা ফোন দেয়নি। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
বিছানা থেকে লাফ মেরে উঠে পড়লাম। মেয়েটাকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখন সেখানেই যেতে হবে। পাঁচতলা থেকে দ্রুত নেমে পার্কিং থেকে বাইকটা নিয়ে রওনা দিলাম। আজ শুক্রবার, রাস্তায় তেমন কোনো জ্যাম নেই। শাহবাগ হয়ে মেডিকেলে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। ইমার্জেন্সির কাছে বাইকটা তালা মেরে রেখে দ্রুত দোতলায় চলে এলাম। বুক ধক ধক করছে। বুঝতেছি হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে। আর ভেতর থেকে যেন কেউ বলে উঠছে—দিব্য, কাজটা ভালো করোনি তুমি, পারতে মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে। রেপড কেসের ভিক্টিমাইজদের কোন কেবিনে রাখা হয় আমার তো জানা নেই। একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি ভ্রু কুঁচকে চলে গেলেন। উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করলেন না।
আচ্ছা আগে তো ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে মনে হয় নেওয়া হয় ভিক্টিমকে। হন্তদন্ত হয়ে নেয়ে ঘেমে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সামনে এলাম। কিন্তু লাভ হলো না। এখান থেকে কোনো ভিক্টিমের তথ্য কেন দেবে তারা? একজনকে পাওয়া গেল, তিনি জানালেন, এমন একটা কেস আসছিল ভোরের দিকে। এর বাইরে বেশি কিছু তিনি জানেন না।
হতাশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলাম। যেন এক পরাজিত মানুষ আমি, বিধ্বস্ত। যদি গতরাতে মেয়েটাকে এগিয়ে দিয়ে আসতাম, সেক্ষেত্রে আমার দেরি হতো, কিন্তু এমন ঘটনা তো আর ঘটত না। এই অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। পকেটে ফোন বেজে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ফোনটা হাতে নিই। অচেনা নম্বর। রিসিভ করব না করব না করেও সবুজ বাটন টেনে কানে লাগালাম।
‘হেই ভাইয়া কেমন আছেন?’
রিনরিনে এক মেয়েলি কণ্ঠ। এখন ভাইয়া-টাইয়ার জবাব দেওয়ার সময় নেই। যেতে হবে মেডিকেল কলেজের পুলিশ ফাঁড়িতে। যেহেতু পুলিশ কেস, ওখানেই তথ্য পাওয়া যাবে। পুলিশে ছুঁলে তো অনেক ঘাঁ। কী হবে হোক। নিজের বিবেকের নিকট স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে না পারলে বেঁচে থাকাটাই গ্লানিকর। গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
‘ভাইয়া কথা বলছেন না কেন?’
‘কে আপনি?’
‘আমি মিলি।’
‘সরি, কোন মিলি… চিনতে পারছি না…’
‘এই অল্প সময়েই ভুলে গেলেন, ওই যে আমাকে গতকাল রাতে হেল্প করলেন… রাতে আম্মু বকাঝকা করেছে, তাই ফোন দিতে…’
পরের শব্দগুলো আর কানে ঢুকল কিনা মনে নেই। শুধু মনে হলো বুকের ওপর শত শত টনের চেপে থাকা পাথরটা নেমে গেল।
লেখা- মাহতাব হোসেন (Mahatab Hossain)