#মধুরেণ_সমাপয়েৎ
#১২তম_পর্ব
কাজী সাহেব তার কাছে বিয়ের সব কথা বলে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি কি এই বিয়েতে রাজী, রাজী থাকলে বলুন কবুল
তখন প্রণয় কানে কানে এসে কিছু একটা বলে সাফওয়ানকে। প্রণয়ের কথাটা শুনেই সাফওয়ান বলে উঠে,
– সত্যি?
– হু, মাত্র সুহানা বললো
কাজী সাহেব পুনরায় একই কথাই বললেন,
– আপনি কি এই বিয়েতে রাজী, রাজী থাকলে বলুন কবুল
মুচকি হেসে সাফওয়ান বলে উঠে,
– কবুল
সবাই একসাথে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠে। ইফাদ এক কোনায় দাঁড়িয়ে ম্লান হাসি হেসে বেরিয়ে যায়। রাতের একা আকাশে আজ তাকে একাই হাটতে হবে। নিজের সামান্য দায়িত্বহীনতার জন্য সবচেয়ে দামী জিনিস যে হারিয়ে ফেলেছে সে। আয়াতের প্রতি তার ভালোবাসাতে বুঝি অনেক বড় ফাঁক থেকে গেছে, তাইতো আজ সে অন্য কারোর হয়ে গেছে। সেদিন তাই স্পষ্ট তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো আয়াত।
সেদিন,
– জানো তো কতোটা ভালোবাসি তোমায়, সাফওয়ান যদিও আমাকে সব বলেছে তবুও তোমাদের বিয়ের কথাটা শুনে পাগল পাগল লাগছিলো। সরি বাবু, আর হবে না সরি।
নিজের থেকে ইফাদকে সরিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায়, ইফাদের চোখে চোখ রেখে বলে,
– সেদিন যখন আমার তোমাকে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো তুমি তখন আমার পাশে ছিলে না ইফাদ, ফোন হারিয়েছিলো কিন্তু পৃথিবীর উপর থেকে ফোন তো শেষ হয়ে যায় নি। অথচ তুমি আমাকে একটা বার জানাও নি। আমি পাগলের মতো তোমায় খুজেছি। আমি তোমাকে দোষ দিবো না ইফাদ। তোমার সাথে সেই মূহুর্তে যেটা জরুরি মনে হয়েছে তুমি করেছো। কিন্তু আমি তোমায় আর ভালোবাসি না ইফাদ। এতোদিন আমি কনফিউশানে ভুগেছি কেনো আমি বারবার সাফওয়ান ভাই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি। আজ আমার কাছে সেটা পানির মতো পরিষ্কার। আমি তাকে ভালোবাসি, প্রচুর ভালোবাসি। থ্যাংক উ আমার সামনে আবার আসার জন্য। নয়তো আমি নিজের মনকে বুঝতেই পারতাম না। ভাবতাম, ভুল করছি; কনফিউজড থাকতাম। কিন্তু আজ আমার কনফিউশান ক্লিয়ার হয়ে গেছে। থ্যাংক উ। তুমি অনেক ভালো একটা মানুষ; আজ যদি তোমার সাথে আবার জড়িয়ে পড়তাম তবে সেটা তোমার বা আমার কারোর জন্যই ভালো হতো না। কারণ আমি তোমার স্বচ্ছ থাকতাম না। আমার মনে তো এখন অন্য কারোর রাজত্ব। আমাকে ক্ষমা করে দিও ইফাদ। আই এম সরি। আই এম সরি। কিন্তু আমি সাফওয়ান ভাইকে ভালোবাসি। প্রচুর ভালোবাসি, সরি।
বর্তমান,
ইফাদের চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। সে যে আজ নিঃস্ব, তবে একটাই সান্তনা আয়াত তাকে ঠকায় নি। তার কাছে নিজেকে স্বচ্ছ রেখেছে। এখন মন তো কখন কাকে নিজের সিংহাসনে বসিয়ে দেয় কেউ জানে না!
রাত ১২টা,
খুব তোড়জোড় করে শেষমেশ বাসর ঘরে ঢুকার সুযোগ পেলো সাফওয়ান। ঘরে ঢুকে দেখলো, মোমের আলোয় ঘরটাকে নতুন বউ এর নেয় সাজানো হয়েছে। খাটটা পুরো সাদা আর লাল গোলাপের মোড়া, এর মাঝে লাল শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে এক রূপবতী বসা। চাদের আলো জানালার ফাক দিকে ঘরে ভেতর উপসে পড়ছে। রুপবতীটি যে সাফওয়ানের মায়াবতী। যার নেশায় আজকাল সে মত্ত থাকে। ধীর পায়ে আয়াতের পাশে গিয়ে বসে। সাফওয়ানের উপস্থিতি আয়াতের হার্টবিট বাড়িয়ে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তার। আলতো করে তার হাতে নিজের হাত রেখে মজার ছলে সাফওয়ান বলে,
– ইফাদ, চলে গিয়েছে। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো ওর সাথেই চলে যাবে। সমস্যা নেই আমি একটা লয়ারের সাথে কথা বলে ছ মাস পর আমাদের ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করে ফেলবো
-………
আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে আলতো হাতে ঘুমটা সরায় সাফওয়ান। দু হাতে আয়াতের মুখ আলতো করে ধরে উচু করে সে। আয়াতের চোখে পানি চিকচিক করছে। আয়াতের চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– তুমি তো এটাই চেয়েছিলে, তবে আজ চোখে পানি যে?
– আপনি কি সত্যি বুঝেন না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেন?
কাঁপা কাঁপা গলায় আয়াত বলে উঠে।
– কি বুঝবো? তুমি যদি বুঝিয়ে না বলো বুঝবো কিভাবে?
– সব কিছু বলে বুঝাতে হয়।
– হয় বই কি! কিছু জিনিস বলে করে বুঝাতে হয়। এতোদিন তো তুমি যা বলেছো আমি তাই বুঝেছি। দেখো না বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলেছো, আমি সেটার চেষ্টা করেছি। ঢাকা যেয়েই উকিলের সাথে….
কথাটা শেষ না হতেই সাফওয়ানের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো নিজ ঠোঁট জোড়া দিয়ে। ঘটনার আকর্ষিকতায় সাফওয়ানের মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। আয়াতের পক্ষে এমন একটা সাংঘাতিক কাজ করা সম্ভব এ যেনো ধারণার বাহিরে ছিলো সাফওয়ানের। বেশকিছুক্ষণ পর সাফওয়ানের ঠোঁট জোড়াকে মুক্তি দেয় আয়াত। শাড়ির আঁচলটা মাজায় বেধে সাফওয়ানের কলার চেপে ধরে রাগী গলায় বলে,
– আরেকবার যদি ডিভোর্সের কথা শুনেছি তো দেখবেন আমি করি। ফাজলামি পাইছেন? এতো যখন আমাকে অপছন্দ তাহলে সেই রাতে কেনো আমাকে বলেছিলেন ভালোবাসি? ইফাদের সাথে চলে গেলে খুশি হতেন বুঝি। আপনি কি ভেবেছেন এতো সহজে আপনাকে মুক্তি দিবো। সারাজীবন এভাবেই আমাকে সহ্য করতে হবে। আর মরে গেলে ভুত হয়ে আপনার ঘাড়ে চেপে বসবো কিন্তু আমার থেকে আপনার নিস্তার নেই।
বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে আয়াতের। প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার। লোকটা এমন কেনো? যদি দূরে ঠেলে দেবার ইচ্ছা ছিলো তবে কেনো কাছে টেনে নিয়েছে। সাফওয়ান মুচকি হেসে হ্যাচকা টানে তাকে বুকে আগলে ধরলো; কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
– এবার নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে এসেছো। এবার যদি তুমি চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়বো না। এইভাবে শক্ত করে নিজের কাছে রেখে দিবো।
– সত্যি? তাহলে এতোক্ষণ যে
– ওইটা একটা ছোট্ট শাস্তি ছিলো, আমাকে এই তিনদিন কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমি তো সত্যি সত্যি বিয়েটা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; কিন্তু আজ যখন প্রণয় কানে কানে বললো, তুমি নিজ থেকে ইফাদকে ফিরিয়ে দেবার কথা সুহানাকে জানিয়েছো আমার ওশান্ত মন শান্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই দেরি না করে কবুলটা বলে দিয়েছি।
– আপনি খুব খারাপ।
– এখনো তো কিছুই দেখাই নাই এখনই খারাপ হয়ে গেলাম?
– আমি কিচ্ছু দেখবো না
– তা বললে তো হবে না এখন সে অনেককিছু দেখার বাকি রয়েছে
– কি?
– আসো আমার সাথে।
বলেই কোলে তুলে নিলো আয়াতকে। সাফওয়ানের রুমের ভেতরে একটি ছোট স্টোর রুমের মতো জায়গা রয়েছে যেখানে সাফওয়ান বাসায় থাকতে ড্রয়িং করতো; যাকে সে তার কল্পনারাজ্য বলে। তার সকল সৃষ্ট সকল শিল্প সেখানে মজুত। আয়াতকে কোলে করে তার কল্পনারাজ্যে নিয়ে যায় সে। একটি চেয়ারে তাকে বসিয়ে সামনে থাকা সকল ড্রয়িং বোর্ডের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। আয়াতের চোখ যেন বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। সব গুলো ক্যানভাসে তার পোর্ট্রেইট। রংতুলির আচড়ে আকা এক একটি জীবন্ত আয়াত তার সামনে। অজান্তেই নোনা জলের ভিড় জমেছে চোখে তার। এখনই চোখগুলো তাদের মুক্তি দিবে যেনো। ধরা গলায় বলে উঠে,
– আপনি তো বলেছিলেন আমার চেহারা ক্যানভাসে তুলার যোগ্য নয়।
– নয় ই তো, তাই তো শুধু ক্যানভাসেই থাকবে এই চিত্র।
– তাই বুঝি?
– হু, তাই তো। এই সারপ্রাইজটা তোমাকে দেওয়ার ছিলো
বলে আয়াতের কপালে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ দেয়।
– আজ রাতে তোমাকে ভালোবাসার অধিকার দিবে আয়াত?
– আমি তো মানা করি নি।
– তবে একটু বেহায়া হতে দোষ নেই বলো।
বলেই পুনরায় কোলে তুলে নেয় আয়াতকে। আয়াতকে বিছানায় শুইয়ে রুমের মোম গুলি নিভিয়ে দেয় সে। রাতের নীরবতা, চাদের কালো সাক্ষ্ণী হলো তাদের মধুর মিলনের। কিছু আর্তনাদ, কিছু উষ্ণ নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে সুখ কুড়াতে ব্যস্ত তারা। আজ তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।
তিন বছর পর,
হাসপাতালের ওপারেশন থিয়েটারের বাহিরে পায়চারি করছে সাফওয়ান। টেনশনে শ্বাস আটকে যাচ্ছে তার। আয়াত এবং তার পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত। বারবার সান্তনা দিচ্ছেন রামিম সাহেব। কিন্তু কিছুতেই সাফওয়ানকে শান্ত করতে পারছেন না তিনি। আজ যে আয়াতের ডেলিভারি, এক ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো কোনো খবর নেই। এমনিতেই আয়াতের অবস্থা সিরিয়াস ছিলো, আর্লি লেবার পেইন উঠেছে মাত্র সাত মাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে সাফওয়ানের। থিয়েটারে ঢুকার আগে আয়াত বলেছিলো,
– যদি এবার ফিরে না আসি, তবে জেনে রেখো খুব ভালোবাসি তোমায়।
কথাটা মনে করতেই চোখ ভিজে আসছে সাফওয়ানের। ঠিক তখনই ডক্টরের আগমণ ঘটে, ছুটে গিয়ে কাছে যেতেই প্রথম প্রশ্ন ছিলো,
– আয়াত কেমন আছে ডক্টর?
– কংগ্রেচুলেশন, আপনার জমজ মেয়ে হয়েছে।
– আচ্ছা, আয়াত কেমন আছে?
– নার্স মেয়েদের নিয়ে আসছেন, আপনার মেয়েরা প্রিম্যাচ্যুর কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।আপনি কি খুশি নন মি. সাফওয়ান?
– আরেহহ ধুর, আমার ওয়াইফ কেমন আছে সেটা বলেন? দম আটকে যাচ্ছে আমার।
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন, একটু উইক। এক সপ্তাহ রেস্ট করতে হবে।
ভয়ে ভয়ে ডাক্তার বলে কথাগুলো। আয়াত ঠিক আছে শুনতেই সাফওয়ান খেয়াল করলো, ডাক্তার বলেছিলো তার মেয়ে হয়েছে তাও জমজ। খুশিতে পাগল প্রায় হয়ে গেছে সে। নার্স যখন মেয়েদের নিয়ে এসেছে, সাফওয়ানের কাছে মনে হয়েছে ছোট দুইটো আয়াত তার কাছে নিয়ে এসে নার্স। দুজনকে একসাথে কোলে নিয়ে নিলো সে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুখী ব্যক্তি সে।
তিন ঘন্টা পর,
আয়াতের জ্ঞান ফিরলে দেখে সবাই ঝুকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সবার মাঝে সে তার সাফওয়ানকেই খুজে যাচ্ছিলো। ধীর কন্ঠে শারমিন বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
– সা…সাফ…ওয়ান
– ওইযে আসছে।
সবার পেছন থেকে সাফওয়ান বেরিয়ে এলো, নার্সরা একে একে দুই মেয়ে আয়াতের পাশে রাখে। আয়াতের চোখে পানি চিকচিক করছে। ভেবেছিলো হয়তো এই খুশি তার দেখা হবে না। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলে সাফওয়ান আলতো হাতে আয়াতকে উঠে বসিয়েছে। বাচ্চাগুলোর একজনকে আয়াতের কোলে দিয়ে আরেকজনকে নিজের কোলে নেয় সে। আয়াতের পাশে বসলে আয়াত ধীরে তার মাথাটা সাফওয়ানের কাধে এলিয়ে দেয় আর বলে,
– কার মতো হয়েছে বলো তো?
– তোমার মতো, থ্যাংক ইউ ফিরে আসার জন্য।
– আল্লাহ চেয়েছেন তাই ফিরে আসতে পেরেছি, তুমি খুশি তো।
– খুব খুব খুশি। তবে আমরা আর এই বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাববো না।
– কেনো?
– আমার দম বন্ধ লাগছিলো তোমাকে ছাড়া। যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি কি করতাম তখন? পাগল হয়ে যেতাম সত্যি বলছি।
– তুমি সত্যি পাগল।
– ওদের নাম কি রাখবে?
– ভাবি নি
– আমি বলি আল্পনা এবং কল্পনা
– ধুর এই আধ্যাত্মিক নাম আমি রাখবো না।
– কেনো সুন্দর তো
– না বলেছি, মানে না
– আমি ওদের বাবা
– তো?
– মানে কি!!
এভাবেই আবার খুনসুটিতে মেতে উঠলো আয়াত এবং সাফওয়ান। তাদের জীবনে এই অধ্যায়ের মধুরেন সমাপয়েৎ ঘটেছে। তাদের ভালোবাসার মধুরেন সমাপয়েৎ ঘটেছে। থাকুক তারা তাদের মতো সুখে আজীবন
||সমাপ্ত||
মুশফিকা রহমান মৈথি