#মধুমাস
#পর্ব_৩৫
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শান্ত পরিবেশে উৎসবের আবেশের কলরবে চারদিকে মুখরিত,প্রত্যেকে তুমুল ব্যস্ত।স্বপন ইসলামের একমাত্র মেয়ের বিয়ে আজবাদে কাল, তারিখ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়ে গিয়েছে। প্রথমে না মানলেও একমাত্র মেয়ে বলে কথা আয়োজনের হইহই রইরই পরে গেছে।স্বপন ইসলাম বিয়ে নিয়ে নাখোস থাকলেও আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি।ছেলের পক্ষ থেকে মেয়ের জন্য শাড়ি গহনা পাঠানো হয়েছে, স্বপন ইসলামও পিছিয়ে নেই ফিরোজের জন্য মানানসই সেরোয়ানী এনে পাঠিয়েছে, মেয়ে যেহেতু বিয়ে দেবে তাহলে আর মন কষাকষি রেখে লাভ কি?মেয়েকে তো কম বুঝাতে চায়নি,মেয়ের সুখ মেয়ে খুঁজে নিয়েছে,ভবিষ্যতে কখনো কোনো সমস্যা হলে বাবা মাকে কিছু বলতে পারবেনা,দোষ দিতে পারবেনা।যেহেতু মেনেই নিয়েছেন আর মন খারাপ করে লাভ কি এর চেয়ে ভালো অনুষ্টান ওই-ভাবেই এগিয়ে যাক যেভাবে ভালো হয়।
ফাতেমা বেগমের মন খারাপ। মেয়েকে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিয়ে দিতে পারেনি বলে আক্ষেপ হচ্ছে।আল্লাহ ভালো যানে মেয়েটার কপালে কি আছে, একে তো ফিরোজ নেতা মানুষ তার উপর ঘরে সৎ মা।প্রেমে অন্ধ হয়ে মা বাবার কথা শুনলো না।ফাতেমা বেগম মন খারাপ করলেও তা দূরে রাখার চেষ্টা করেন,কালকে মেয়ের বিয়ে আজকে এভাবে মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না।ফাতেমা বেগম শ্যামার রুমে যায়,শ্যামা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।
“শ্যামা!”
শ্যামা মায়ের দিকে তাকায়।মুহূর্তেই চোখে পানির দেখা মিলে।প্রিয় মানুষকে সারাজীবনের জন্য আপন করে পাবে এটা ভাবলে যেমন খুশী লাগছে তেমনি বাবা মাকে ছেড়ে যেতে মন বিষন্ন হচ্ছে,চোখে পানি আসছে।মাকে দেখে যেনো জলন্ত আগুনে তুষ পড়লো যে এমনি দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।ফাতেমা বেগম হেসে বললো,
“গোসল করে নে।”
“এখনি করছি।”
এতোদিন সবাই মিলে মেয়েটাকে কম মা,রেননি,আজকে শ্যামার ফ্যাকাসে মুখটা দেখে যেনো খারাপ লাগলো,ভিষণ মায়া হলো।
“কিছু খাবি?”
“না। ”
ফাতেমা বেগমের চোখ উপচে পানি পরার আগে উনি সেখান থেকে চলে যায়।শ্যামা ফ্যালফ্যাল করে মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শান্তা যেনো পুরোপুরি বদলে গেছে।যেই মেয়ে ননদকে চোখের দেখা সহ্য করতে পারতো না সে কিনা নিজ হাতে সব করছে।উৎসবে তার কোনো খুশীর কমতি নেই সবার আগে তৈরি হয়ে গিয়েছে।ছুটাছুটি করে সব করার জন্য ব্যস্ত।
রিপন জানে ফিরোজ কেমন ছেলে,এক ক্লাসে লেখাপড়া করেছে যে।মনে মনে নাখোস থাকলেও সব দায়িত্ব সুনিপুণ ভাবে করে যাচ্ছে।বোনের বিয়েতে যেনো কিছুর কমতি না থাকে সে ব্যাপারে কড়া নজর।শ্যামাকে গায়ে হলুদের সাজে স্টেজে তুলা হয়েছে,একে একে সবাই কনেকে হলুদ ছুঁয়িয়ে দিচ্ছে।শ্যামা তার পরিবারের সকল সদস্যের মুখভঙ্গিমা দেখে মনে মনে বললো,
‘একদিন খুব সুখী হয়ে সবার ধারনা বদলে দেবো।প্রমান করে দেবো ফিরোজ খুব ভালো ছেলে,তোমাদের মেয়ে কোনো বাজে ছেলের ক্ষপ্পরে পড়েনি।’
মোহাম্মদ আলীর প্রথম ছেলের বিয়ে।কোনোকিছুতে ঘাটতি রাখা চলবে না।ফিরোজ তার বোনকে সাথে নিয়ে বিয়ের যাবতীয় শপিং করে এসেছে।
ফিরোজ বিছানায় সোজা হয়ে বসে আছে।সন্ধায় গায়ে হলুদ হবে।সে এসব করতে মানা করেছিলো কিন্তু কে শুনে কার কথা ফারিয়া এসব করবেই।ফিরোজের গায়ে হলুদে শ্যামার ভাবিসহ আরো অনেকেই আসে।তারা যাওয়ার সময় ফিরোজের বাড়ি থেকেও কিছু মানুষ যায়।সাথে ফিরোজও যায়,হলুদের সাজে রানীকে দেখতে কেমন লাগছে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।যদিও গ্রামের বাড়ি তার যাওয়া নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েছে সে এসবে পাত্তা দেয়নি।বিয়ে মানুষের জীবনে একটাই সুতরাং মানুষের কথা শুনে পিছু হটার মানে হয় না।
কালকে মেয়েটাকে কেমন মনম,রা লাগছিলো ভাবতেই ফিরোজের মন খারাপ হচ্ছে।এ-ই পর্যন্ত দুজনে ঠিকমতো একমিনিটও কথা বলতে পারেনি,মেহমানের টিটকারি,হট্টগোলে কথা বলা হয়নি।সে শ্যামাকে বলেছিলো তাদের সাথে শপিং এ যেতে কিন্তু সে যায়নি।শুধু শ্যামা তার কাছে আসুক তারপর সব কষ্ট,আ,ঘাত মুছে দেবে,সর্বোচ্চ সুখী করবে তার রানীকে।সে মনে মনে দোয়া করছে যেনো ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যায়, আর কোনো ঝামেলার সূত্রপাত হয়ে যেনো বিয়ে না ভাঙ্গে এই তার কামনা।
শ্যামাদের বাড়ীতে ফিরোজকে দেখে সবাই হইহই করে উঠে।শ্যামার মুখে রাজ্যের খুশী ভর করে।অজানা কারণে একরাশ লজ্জা গাল ছুঁয়ে যায়।ফিরোজ সবার হাসিঠাট্টা উপেক্ষা করে শ্যামার কাছে গিয়ে বসে।চোখ ফিরিয়ে প্রিয়তমার দিকে তাকায়,শ্যামাও তাকায়,ফিরোজকে এতো সুন্দর লাগছে যে শ্যামা বরাবরবে মতো আবারো হোচট খেয়ে নাক মুখ থুবড়ে প্রেমে পরে।ফিসফিস করে বললো,
“আপনার প্রেমে বারবার পরছি,এমন সুদর্শন হতে কে বলেছে?প্রতিবার প্রেমে পরতে পরতে যদি আমিই ম,রে যাই তাহলে ভালো হবে?”
ফিরোজও আস্তে করে বললো,
“তোমাকে এমন করে মা,রতে না পারলে কেমন প্রেমিক হলাম?”
শ্যামা চুপচাপ বসে থাকে।শ্বাস ভরে নেয় ফিরোজের গায়ে মাখা সুগন্ধির সু-ঘ্রাণ।ফিরোজ শ্যামার মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
“হলুদে একদম হলুদপরী লাগছে।ইচ্ছে করছে এখনি একটু আদর দিয়ে দিতে।”
শ্যামার অধরে ফুটে উঠে লাজুক হাসি।
“আপনি খুব দুষ্টু হয়ে গেছেন।”
“সব বর’ই তো দুষ্টু হয়। ”
“চুপ।”
ফিরোজ দুষ্টু হেসে বললো,
“আচ্ছা।আসল কথা হবে বাসর ঘরে।”
“আল্লাহ!এ কিসের পাল্লায় পরলাম?”
“মধুরাজার পাল্লায়।”
“আপনি পাগল।”
“তোমার জন্য সুন্দরী।”
স্বপন ইসলাম আর ফাতেমা বেগম স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনকে একসাথে সুন্দর লাগছে,মানিয়েছে মাশাল্লাহ।ফিরোজ দেখতে বড়োই সুদর্শন এতোদিন তাদের চোখে যেনো এতোবড়ো রূপ চোখে পরেনি,আজকে দুজনেই ভাবছেন ফিরোজ সুন্দর পুরুষ।মেয়ের সুখী সুখী হাসোজ্জল চেহারা যেনো উনাদের মন ভালো করে দেয়।
রাত বারোটার দিকে মোহাম্মদ আলী,চেয়ারম্যানকে নিয়ে স্বপন ইসলামের বাড়িতে আসে, সাথে ফিরোজও আসে।সে তার আব্বাকে একা এই বাড়িতে আসতে দিতে নারাজ তার এখনো মনে হয় কোনো ঝামেলা হয়ে যাবে তাই রিক্স নেয়ার দরকার নেই।এতো রাতে আসার মূল কারণ হচ্ছে বিয়েতে কতো দেনমোহর হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি কালকে বিয়ের সময় এসব নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে এখনি আলোচনায় বসা ভালো।
মোহাম্মদ আলী বলেন,
“দেনমোহর কতো হলে ভালো হয়?”
স্বপন ইসলাম চুপ করে থাকেন।রিপন বললো,
“আপনারা কতো চাচ্ছেন?”
চেয়ারম্যান বললো,
“ইসলামি হিসাবে ফিরোজের ইনকাম অনুযায়ী দেড় লাখ টাকাই ধার্য করা ঠিক হবে।”
মোহাম্মদ আলী বললো,
“তাহলে দেড় লাখই হবে।”
স্বপন ইসলামের মুখ অন্ধকার হয়ে আসে।
“এতো কম?আজকাল বিয়েতে এতো কমে দেনমোহর হয় নাকি?”
“বিয়েতে দেনমোহর কম হলেই আল্লাহ খুশী হয়,বরকত দেন।”
শ্যামার বুক ধুকপুক করে।এই মূহুর্তে সে কোনো বিপদ চায়না।দেনমোহর কমে তার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তার আব্বা কেনো রাজী হচ্ছেনা? দেনমোহরে কি সুখ হয় ?সে তার আম্মাকে বললো,
“আম্মা,দেনমোহর তো ঠিকই আছে।আব্বাকে রাজী হয়ে যেতে বলো।”
ফাতেমা বেগম চোখ পাকিয়ে বললো,
“তুই চুপ থাক।কি বুঝিস তুই?দেনমোহর একটা মেয়ের খুটি,এমনিতেই তো প্রেমের বিয়ে।”
শ্যামা চুপ করে আবার পুরুষদের দিকে তাকায়।ফিরোজকে গম্ভীর লাগছে,নাকের পাটাতন ফুলে উঠছে।শ্যামা আৎকে উঠে,ফিরোজ কি রেগে যাচ্ছে,এখন রেগে যাওয়া মানেই সমস্যা।শ্যামা মনে মনে আল্লাহকে ডাকে।
স্বপন ইসলাম মোহাম্মদ আলীর কথা মানতে নারাজ।
“দেনমোহর পাঁচ লাখ হবে,আমার এটাই ইচ্ছা।”
মোহাম্মদ আলী বিষ্ফোরিত চক্ষু মেলে তাকিয়ে থাকে।
“আপনার মাথা ঠিক আছে? ”
“জ্বী।”
“যদি এতো টাকায় রাজী না হই?”
স্বপন ইসলাম কঠিন গলায় বললো,
“তাহলে বিয়ে হবেনা,এই মজলিসেই আমি আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছি!”
চলবে……
#মধুমাস
#পর্ব_৩৬
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
মোহাম্মদ আলী পাথরের মতো স্থির চোখে স্বপন ইসলামের দিকে তাকিয়ে থাকে।গমগমে কন্ঠে বললো,
“কি বলছেন বুঝে বলছেন তো?”
“বুঝেই বলেছি।”
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকায়।ফিরোজ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো হয়তো তার আব্বার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে।চেয়ারম্যান সাহেব দেখলেন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে তাই উনি বললেন,
“কালকে বিয়ে আর আজকে যদি সামান্য দেনমোহরের জন্য বিয়ে ভেঙ্গে যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে ভেবেছেন?”
স্বপন ইসলাম গো গো করে বললো,
“আজকাল এই টাকা সবাই দেয়,এই সংখ্যা তো বেশী না।”
রিপনকে ডেকে নিয়ে ফাতেমা বেগম বললো তার আব্বাকে এই রুমে পাঠাতে রিপন এসে বললে স্বপন ইসলাম উঠে যায়।
ফাতেমা বেগম ভ,য়ে ভ,য়ে বললো,
“এতো টাকা চাওয়ার কি দরকার?”
স্বপন ইসলাম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“কি দরকার!ভবিষ্যতের কথা বলা যায়?”
রিপন বললো,
“আব্বা ঠিকই বলেছে,ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে।”
শ্যামা দুই হাতে মেহেদী লাগিয়ে চুপচাপ তাদের কথা শুনছিলো,এবার সে বেশ বুঝদার গলায় বললো,
“কিসের ভবিষ্যত!আমি কি বিয়ে করবো আবার ছেড়ে আসার জন্য?”
মেয়ের চটাং চটাং কথায় স্বপন ইসলামের মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু কালকে বিয়ে তাই তিনি কিছু বলেন না।ফাতেমা বেগম বললো,
“ছেড়ে আসার কথা বলেনি কিন্তু দেনমোহর বেশী হলে শক্ত হয়,উল্টাপাল্টা করার আগে ভাববে।”
শ্যামা অবাক হয়ে তার আব্বা আম্মার মন মানসিকতা দেখছে।উনারা এখনো সেই আগের যুগেই পরে আছে।
“এই দেনমোহর এর জন্য কখনো সংসার টিকে না।যারা ছেড়ে যাওয়ার তারা বেশী হলেও ছেড়ে যাবে। আর এমনো অনেক সম্পর্ক আছে কম টাকায়ও সংসার টিকে।আমার এসবে কোনো সমস্যা নেই।”
রিপন তেড়ে এসে বললো,
“পাকনামি করবি না।”
শান্তা বললো,
“খারাপ বলেছে কি?দেনমোহরে কি সুখ হয়?কই আমাদের দেনমোহর যে এক লাখ টাকা আমাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি।”
স্বপন ইসলাম চিন্তায় পরে যায়।যদিও রাগের মাথায় বলেছেন বিয়ে ভেঙ্গে দেবেন কিন্তু উনি নিজেই এটা ভালো করে জানে যে এই মূহুর্তে বিয়ে ভাঙ্গা সম্ভব না।শ্যামা তার আব্বার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।সে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবে যে ফিরোজ কিছু বলছে না।কেউ না জানুক তারা দুজনে তো জানে তাদের বিয়েতে কতো দেনমোহর হয়েছিলো।হোক’না ওটা লুকিয়ে বিয়ে কিন্তু বিয়ে তো।ফিরোজ কেনো ওই সংখ্যাটাই বলছে না?সবাই দেনমোহররের ওই সংখ্যা শুনলে নির্ঘাত অবাক হয়ে যাবে।শ্যামা ফিরোজের অপেক্ষায় আছে,তার কান ফিরোজের কন্ঠের বাক্যবাণ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
ফিরোজ তার আব্বাকে বললো,
“আব্বা বিয়ে করবো আমি একবারও কি দরকার ছিলো না আমাকে জিজ্ঞেস করা যে কতোটুকু সামর্থ আছে কতো টাকা দিতে পারবো?”
চেয়ারম্যান সাহেব বললো,
“তা ঠিক।আপনি ফিরোজকে জিজ্ঞেস করেননি?”
“না।”
ফিরোজ বিবস কন্ঠে বললো,
“আগে বলতেন তাহলে তো আর এতো কথা হতোনা,আমারও একটা ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে,সামর্থের ব্যাপার আছে।”
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা তোর ইচ্ছা মতোই বলে দে,পরিশোধ করবি তুই,তুই’ই বল।”
তখন স্বপন ইসলাম আসে।এসে বললো,
“আপনারা কতো চাচ্ছেন?”
ফিরোজ আর শ্যামার বিয়ে সবার অগোচরে হয়েছে।আর ওই বিয়েতে যা দেনমোহর ধার্য করা হয়েছে,এখনো তাই হবে। কেউ কথা বলার আগে সে বললো,
“দশ লাখ।”
সবাই চমকে যায়।মোহাম্মদ আলী অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়।স্বপন ইসলাম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে।শুধুমাত্র শ্যামাই স্বাভাবিক কারণ সে জানতো এই টাকাই দেনমোহর ধার্য করা হবে।মোহাম্মদ আলী বললো,
“কি বলিস?”
“হ্যাঁ,দশ লাখ’ই।কালকে বিয়ের আগে শ্যামার নামে একাউন্ট করে টাকা জমা দিয়ে তারপর বিয়ে করবো।”
স্বপন ইসলাম সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।মোহাম্মদ আলী এখনো অবাক হয়ে আছেন।এতো টাকা দেনমোহর দেয়ার কি দরকার?উনি আর কথা বাড়ালেন না।নিজের মতামতে যা ইচ্ছা করুক,ছেলে বড়ো হয়েছে তার নিজস্ব মতামত আছে,এখনো উনার কথায় চলবে এটা ভাবা ভুল।উনি স্বপন ইসলামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি! কথা বলেন না কেনো?আমাদের মন বড়ো আছে,দেনমোহরের উপর ভিত্তি করে তো আর মেয়ে নিচ্ছিনা,আমরা মেয়ে নিবোই।এইবার বলেন বিয়ে ভাঙ্গবেন।”
স্বপন ইসলাম বললো,
“বিয়ে ভাঙ্গবো বললেই কি ভাঙ্গতাম নাকি,ওটা তো কথার কথা ছিলো।কালকে সময়মতো সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।”
সবাই চলে যাওয়ার সময় ফিরোজ শ্যামাকে ডাকে।
“কালকে সকালে তৈরি থেকো।”
শ্যামা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
ফিরোজ এদিক সেদিক তাকিয়ে আস্তে করে বললো,
“এটাই তোমার শেষ ব্যাচেলার নাইট।এরপর আর কখনো একা থাকার সুযোগ পাবে না ম্যাডাম।”
“একা থাকতে চাই না।”
“একা রাখবোও না।”
পরের দিন সকালে শ্যামাকে নিয়ে ফিরোজ ব্যাংকে যায়।শ্যামার নামে একাউন্ট করে দশ লাখ টাকা রাখে।শ্যামা বললো,
“পরেও এসব করা যেতো।”
“না যেতো না।”
“কেনো?”
“এখনি করলাম কারণ তোমার আব্বা আম্মার যেনো মনে না হয় যে আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ঠকে গেলো কিংবা আমার থেকে ভালো ছেলে পেতো।”
শ্যামা হাসে।ফিরোজ তার থেকেও বেশী ভাবে।সে জানে কি পেয়েছে,হোক একটু কষ্ট কিন্তু সুখের রাজ্য যে ফিরোজের কাছে।
দুপুরে বরযাত্রী আসে।সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়।কাজী যখন শ্যামাকে বিয়ে পড়াতে যায় উনি এক পর্যায়ে বললো,’বলো মা কবুল।’
তখন শ্যামা ফিক করে হেসে দেয়।এমন করে কবুল সে আগেও বলেছে তাই এখন বলতে হাসি পাচ্ছিলো যা চেপে রাখতে পারেনি।এক পুরুষকে দুইবার বিয়ে।শ্যামার হাসির শব্দে সবাই হইহই করে উঠে।মেয়ের নিলজ্জতার পসরা সাজায়।একেক জনের মুখে একেক কথা।হাসির কারণ শ্যামা তো আর বলতে পারছেনা সে চুপ করে বসে আছে।শান্তা সবার কথায় বিরক্ত হয়,দারাজ গলায় বললো,
“ওর বিয়ে বলেই তো হাসছে।ভ্যাভ্যা করে কাঁদলেই বোধহয় আপনাদের ভালো লাগতো!এমন সুখের দিনে কেউ কাঁদে নাকি?আজব!”
কিন্তু এই হাসিমুখের শ্যামাই যাওয়ার সময় চিৎকার করে কাঁদে।পরিবারের সাথে এমন কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যায়।এতোদিন শ্যামার সাথে সবাই খারাপ আচরণ করলেও এখন কষ্ট হচ্ছে।শ্যামার কান্না দেখে ফিরোজেরও খারাপ লাগে।মেয়েদের জীবনে এটাই বোধহয় সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিদায়,যে মেয়ের এই মূহুর্ত আসেনি সে কখনো এর জ্বলন,পোড়ন অনুভব করতে পারবেনা।
শ্যামাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়েছে।ফিরোজ রুমে যেতে পারছেনা ফারিয়া রুমে যাওয়া নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।ফিরোজ জানে ফারিয়া কি করছে।ফারিয়া বাসর সাজাচ্ছে,আর এই ব্যাপারটা ভেবে সে খুব খুশী।বিয়ে করেছে বাসর ঘর সাজানো না থাকলে কেমন না!তার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি,নিজের বাসর ঘর সাজানোর কথা কিভাবেই বা বলে।
কিন্তু ছোট ভাইবোন থাকতে বোধহয় এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।ফারিয়া আর তামিম দুজনেই উৎসাহের সহিত সাজাচ্ছে।
শ্যামা একা একা বসে আছে।রোজিনা বেগম রুমে গিয়ে বসে আছে,আসার পর একটু দেখা দিয়ে সেই যে চলে গিয়েছে আর আসেনি।ফিরোজ চুপচাপ বসে থাকা বউটার দিকে তাকায়।আজকে তার আম্মা থাকলে বউ নিয়ে কি আহ্লাদ করতো,বউকে কখনোই একা একা বসিয়ে রাখতো না,এই মূহুর্তে নিজের মায়ের অভাববোধ করছে কিন্তু তার মা যে খারাপ ছিলো তাই মায়ের প্রসঙ্গ ভুলতে চায়।শ্যামার দিকে তাকায় শ্যামা এখনো মন খারাপ করে বসে আছে।ফিরোজ মন খারাপ শ্যামাকে দেখে,একটু পরেই সে মন ভালো করে দেবে,হাসাবে।
সুন্দর গোছানো রুমে শ্যামা বসে আছে।এর আগেও অনেকবার সে এইরুমে এসেছে কিন্তু এবার এসেছে সম্পূর্ণ নিজের পরিচয়ে।আজকে থেকে এই রুম তার,এখানেই সুখে দুঃখে প্রিয় পুরুষের সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।আজকে এই রুমে এসে তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।ফুলের বিছানায় লাল লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।ফিরোজ ফ্রেশ হচ্ছে।কিছুক্ষণ পরে ফিরোজ এসে সোজা শ্যামার সামনে বসে।শ্যামা কিছু বুঝে উঠার আগে ফিরোজ শ্যামাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি খায়।তারপর উঠে বসে, সুন্দর করে হাসে।ফিরোজের এমন কাজে শ্যামা হতবাক।নিজের কাপড়, সাজ ঠিক করে নেয়,লোকটার জন্য এই ভারী লেহেঙ্গা পরে বসে আছে,উনি মন ভরে দেখবে বলে আর উনি কি করলো?সে বললো,
“এটা কি হলো? ”
ফিরোজের হাসি প্রসস্ত হয়।
“বাসর রাতে বউ নিয়ে এমন ফুলের বিছানায় গড়াগড়ি না খেলে হয় নাকি?”
ফিরোজের মুখের মুগ্ধ করা হাসি আর দুষ্টু কথায় শ্যামা হেসে উঠে।তারপর অভিনয় করে বসে,মোহনীয় চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
“সুন্দর।”
“শুধু সুন্দর?”
“রানীর মতো।”
শ্যামা হেসে বললো,
“তুমি আমার রাজা।”
ফিরোজ শ্যামার কোলে শুয়ে পরে আজকে কোনো ভয় নেই,চলে যাওয়ার তাড়া নেই,কারো আসার কথা নেই।
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
শ্যামা নিচু হয়ে ফিরোজের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“বিশ্বাস হচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
শ্যামা আর ফিরোজ একে অপরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ বললো,
“শ্যামা আমার এতো খুশী লাগছে যে ইচ্ছে করছে চিৎকার করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেই।”
ফিরোজ উঠে বসে।
“তুমি কাপড় পালটে নাও।খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই!”
শ্যামা ফ্রেশ হয়ে আসে।টকটকে লাল সুতি শাড়ি পরে বেরিয়ে আসে।ফিরোজ বিছানায় বসে তারই অপেক্ষায় ছিলো।স্নিগ্ধ,রূপসী স্ত্রীকে দেখে বুকটা বেশামাল হয়,চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়।শ্যামা ফিরোজের এমন নেশালো ঘোর লাগা চোখের দৃষ্টি দেখে লজ্জা পায়।মুচকি হেসে বিছানার কাছে দাঁড়ায়।ফিরোজ তখনো তাকিয়ে আছে।শ্যামা বললো,
“কি দেখেন?”
“বউ দেখি।”
“এতো দেখার কি আছে?”
“ভাবছি।”
“কি?”
“বাসর রাতে বিড়াল মা,রতে হয় কিভাবে মা,রবো সেটাই ভাবছি।”
“তো কি ভাবলেন?”
“এতো সুন্দর বউয়ের সামনে বিড়াল মা,রতে পারবো না।”
শ্যামা হেসে বললো,
“বাসর রাত তো চলে গেছে।”
ফিরোজ মাথা নেড়ে বললো,
“অসম্ভব,আজকেই বাসর।ওইদিন ভ,য়ে ভ,য়ে ছিলাম।তাছাড়া বিছানায় ফুল ছিলো না ফুল ছাড়া কি বাসর হয়?আসো সোনা ; ফুলের বিছানায় বসো।”
শ্যামা আস্তে করে উঠে বিছানা থেকে সরে টেবিলের কাছে চলে যায়।সে কিছুই ভুলেনি।দুষ্টু কথা,দুষ্টু ছোঁয়া সব মনে হলে এখনো গা কেঁপে উঠে।শ্যামার কাজে ফিরোজ হেসে বিছানায় গড়াগড়ি খায়।
“এতো ভ,য় পাও?”
“একটুও ভ,য় পাই না।”
“তাহলে ছুটাছুটি করছো কেনো?”
শ্যামা কথা বলে না।ফিরোজ উঠে দাঁড়ায় শ্যামার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বললো,
“শ্যামা,আমার সোনা।শোনো।
সারাজীবন নারী নিয়ে আমার বিতৃষ্ণা ছিলো ভেবেছিলাম কখনো বিয়ে করবো না সেইভাবেই জীবন চলছিলো কিন্তু তুমি আমার মন চুরি করে সেখানে নিজে দখন নিলে,আমাকে পাগল বানিয়ে ঠিকই ভালোবাসা আদায় করে নিলে।তারপর আমি বুঝলাম যে এই শ্যামাপাখিকে ছাড়া আমার চলবে না।একদম বুকের মধ্যিখানে স্থান দিলাম,পাখি কি আমার বুকে থাকবে?কথা দিচ্ছি খুব ভালোবাসবো,খুব ভালো স্বামী হওয়ার চেষ্টা করবো।”
শ্যামা ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ এতো সুন্দর করে কথা বলে যে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না।ফিরোজ বললো,
“একটু জড়িয়ে নেই?”
শ্যামা কাছে এসে প্রিয়তমা স্বামীর কাছে নিজেকে সপে দেয়।ফিরোজ শ্যামাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।।
“আজকে একটুও ভ,য় লাগছেনা।”
“আমারো।”
শ্যামা ফিরোজের দিকে তাকালে দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠে।লুকানো বিয়ের কথা জানতে পারলে আরো সমস্যা হতো,অথচ কেউ জানতে পারেনি।দুজন দুজনের দিকে তাকায়,মুখে কথা না হলেও চোখে হাজারো কথা হয়। দুষ্টু ফিরোজ মিষ্টি শ্যামাকে নিয়ে কোনো ভ,য় ছাড়া পাড়ি জমায় ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্রে।ফিরোজের দুষ্টু ছোঁয়ায় শ্যামা খিলখিল করে হাসে।
চলবে…