#মধুমাস
#পর্ব_৩৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শ্যামা শব্দ করে টেবিল থেকে মাটিতে পড়ে যায়।এক থাপ্পড়েই ঠোঁট কেঁটে র,ক্ত আসে।ফাতেমা বেগম হিং,স্রবাগিনীর মতো শ্যামাকে চেপে ধরে বললো,
“মোবাইল! মোবাইল পেয়েছিস কোথা থেকে?কে দিয়েছে?”
শ্যামা হাফসাফ করে,এমন করে চেপে ধরাতে শ্বাস নেয়াতে ব্যাঘাত ঘটে।চোখ উলটে আসতে চায়।ফাতেমা বেগম মেয়েকে ছেড়ে দেয়।
“কে দিয়েছে?”
শ্যামা ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়।এমন অবস্থায় ধরা পড়েছে যে আর লুকিয়ে কোনো লাভ নেই।সে বললো,
“ফিরোজ।”
“কবে দিয়েছে।”
শ্যামা মিথ্যা বললো,
“গতোকাল।”
“তুই এখনো ফিরোজের সাথে সম্পর্ক রেখেছিস এটা ভাবতেই অবাক লাগছে।”
শ্যামা চুপ করে থাকে।কিন্তু ফাতেমা বেগম চুপ থাকেনা এলোপাতাড়ি মা,রতে থাকে,
“কি মুখ দিয়ে কথা আসে না?”
শ্যামার আর্তনাদ,না মা,রার আকুতি কোনো কিছুতেই উনার মন নরম হয় না। কিছুক্ষণ পরে শ্যামাকে আর চিৎকার এবং নড়াচড়া করতে না দেখে উনি নিজেই থামে।হাত দিয়ে গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে আহাজারি করে চিৎকার করে বললো,
“ও রিপন রে!আমি আমার শ্যামারে মে,রে ফেলেছি।ও রিপন।”
স্বপন ইসলাম আর রিপন এসে অবস্থা দেখে পরিস্থিতি কি তা বুঝতে পারে।এমন শান্ত হয়ে যাবার পরে এই ঝড় যেনো সবাইকে অবাক করে দিয়ে যায়।রিপন এগিয়ে শ্যামাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।শান্তা পানি আনতে ছুটে যায়,সে শ্যামাকে দেখতে না পারলেও বারবার শ্যামার এমন করুন পরিনতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে।বুঝতে পারে শ্যামার জন্য বুকে মায়া জন্মেছে।
টেবিলের উপর মোবাইলটা দেখে সবাই মূল কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হয়।এতো শাষণের পরেও মেয়ে এক কদম পিছায়নি!এই মেয়েকে অন্য কোথাও কি করে বিয়ে দেবে?স্বপন ইসলাম বললো,
“কালকের মধ্যে ওই অবাধ্য সন্তানকে আমি আমার বাড়ি থেকে বিদায় করতে চাই।আমি আজকেই পাত্র খুঁজে আনবো।”
উনার কথায় কেউ কোনো কথা বলেনা।শ্যামা তখন পিটপিট করে তাকাচ্ছে।বাড়ির আবহাওয়া যে সাহারা মরুভূমির মতো উত্তপ্ত তা চোখ না খুলেই বুঝতে পারে।তার জন্য এবার দ্বীগুন তোড়জোড় করে পাত্র দেখা হবে অথচ সে বিবাহিত।আচ্ছা বিয়ের কথা প্রকাশ করে দেয়া কি উচিত? এতে কি ভালো হবে?কিন্তু এতো বড়ো একটা কথা ফিরোজের সিদ্ধান্ত ছাড়া জনসম্মুখে প্রকাশ করা ঠিক হবে না,কিংবা এখনো সময় আসেনি।
সবাই চলে গেলেও শান্তা যায় না।শ্যামার মাথার পাশে বসে বললো,
“শ্যামা! তোর কি বেশী খারাপ লাগছে?”
শ্যামা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।শান্তা আরো কিছু বলাতে শ্যামার কান্নারা দলা পাকিয়ে গলা ঠেলে বেড়িয়ে আসে।শান্তার কোমড় জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠে,আস্তে করে বললো,
“ভাবী।ফিরোজকে ছাড়া আমি সত্যিই বাঁচবোনা।তুমি সবাইকে বুঝাও।”
শান্তার খারাপ লাগে।ভালোবাসায় কি এমন যা,দু আছে যে সবাই এমন পাগল হয়ে যায়!সে কখনো প্রেম করেনি তাই এই যাদুবলের শক্তি বুঝে না।আসলে যে প্রেম করে সেই বুঝে এর মর্ম,নাকি সবাই তাদের দিকটাই বুঝে।
“আমার কথা কেউ শুনবেনা।”
শ্যামা নিজেও তা জানে।এখন ফিরোজকে খবর দেয়া জরুরি।সে উঠতে চায়।শান্তা বললো,
“কি?”
“আমার মোবাইলটা।”
“তোর ভাই নিয়ে গিয়েছে।”
শ্যামা আবার শুয়ে পরে।শান্তা বললো,
“এতোই যখন ভালোবাসিস তাহলে এখানে পরে না থেকে ফিরোজের কাছে চলে যাচ্ছিস না কেনো?”
“পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছো?”
“হ্যাঁ।”
শ্যামা চুপ করে বসে থাকে,পালানোর হলে তো সেই কবেই পালাতো।হঠাৎ কোথা থেকে ফাতেমা বেগম ছুটে আসেন।হাতে একটা কাঁচের শিশি।
শ্যামাকে দেখিয়ে বললো,
“এইবার যদি বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা পাকাস তাহলে আমি আর তোর আব্বা এই বি,,ষ খেয়ে ম,,রে যাবো।তারপর তুই শান্তিতে বিয়ে বসিস।”
মায়ের কথায় শ্যামা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।নিজেকে এতো অসহায় লাগে।শরীরের যন্ত্রণায় চোখ বুজে আসে,বন্ধ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ফোটায় ফোটায় পানি,যে পানির সাথে মিশে আছে হাজারো কষ্ট।
ফিরোজ সব শুনেছে।সে এতোক্ষণ ফোনের লাইনে ছিলো।শ্যামার আর্তনাদ তার বুকটা ছিদ্র করে দিয়েছে।যে করেই হোক মেয়েটাকে নিজের কাছে আনতেই হবে।সে এখন বাড়ির পথে ছুটে যাচ্ছে।তার আব্বাকে যেভাবেই হোক রাজী করাতে হবে।
বাড়ি এসে দেখে স্বপন ইসলাম সোফায় বসে স্ত্রীর সাথে কি নিয়ে যানো আলাপ করছে।ফিরোজকে দেখে দুজনেই তাকায়।অতিরিক্ত টেনশনের কারণে তার চেহারার লাবন্যটা হারিয়ে গেছে,মানষিক চাপ যেনো ফর্সা মুখ ফুড়ে প্রকাশ পাচ্ছে।ফিরোজ কিছু না বলে সোজা মোহাম্মদ আলীর পায়ের কাছে বসে।ফিরোজের এমন কাজে দুজনে অবাক হয়।মোহাম্মদ আলী কিছু বলার আগে ফিরোজ বললো,
“আব্বা!আপনি কি চান না আমি বেঁচে থাকি?”
ছেলে যে খুব টেনশনে আছে তা বুঝতে কষ্ট হলোনা,উনার পায়ের কাছে বসে মিনতি করছে মানে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।
“কি হয়েছে?তুই আমার ছেলে আমি কেনো চাইবো তুই ম,,রে যা বল।”
“যদি চান বেঁচে থাকি তাহলে শ্যামাকে আমার কাছে এনে দিন।”
এই কথাটা বলতে বলতে ফিরোজের গলা ধরে আসে।
“কি বলছিস?”
“আমি শ্যামাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারি না আব্বা।ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে,অন্যকোথাও বিয়ে হলে আমি ম,রে যাবো।”
স্বপন ইসলামের বুকটা মুচড়ে উঠে।ফিরোজ উনার প্রথম সন্তান।এই সন্তানের মুখেই প্রথম বাবাডাক শুনেছে।অনেকদিন যাবত শ্যামাকে নিয়ে ফিরোজের আবদার উনি উপেক্ষা করে গিয়েছে ফিরোজের কষ্ট দেখেও দেখেননি,অতি আদরের সন্তানের চাওয়া অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখেছে এই সব করেছে ফিরোজের ভালোর আশায়,আসলে কোনো বাবা মা তার সন্তানের খারাপ চায় না,ভালোটাই চায়।উনিও ভালোটাই চেয়েছিলেন কিন্তু হলো কি?ছেলে এই মেয়ের জন্য পা,গলপ্রায়।ঠিকমতো খায় না, বাড়ি আসে না,এমনকি বাবা ছেলের মাঝে আগের মতো আলাপও হয় না,এটাকে ভালো করা বলে?ভালো করতে গিয়ে কি খারাপ করে ফেললেন?উনি ফিরোজের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার গাল বেয়ে পানির রেখা।ছেলে কি কাঁদছে?পুরুষ মানুষ সামান্য কষ্টে কাঁদেন না উনার ছেলে কাঁদছে তাহলে সে কঠিন সময়ে আছে।
“তুই কি আসলেই শ্যামাকে বিয়ে করতে চাস!”
“চাই।”
“দেখ,তোর লাইফে এর চেয়েও ভালো কেউ আসতে পারে এই যোগ্যতা তোর আছে।”
“আমি ভালো কাউকে চাই না।এই মেয়েকেই চাই।”
“আচ্ছা।”
“আপনি স্বপন কাকার কাছে গিয়ে বলেন।”
“কি বলবো?”
“উনার মেয়েকে নিজের পুত্রবধূ করে নেবেন।”
রোজিনা বেগম হিসহিস করে বললো,
“কতো শখ।আপনি এর কথা শুইনেন না।”
স্বপন ইসলাম রোজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
“তুমি চুপ থাকো।যতো নষ্টের গোড়া তুমি।মহিলা মানুষ মহিলার মতো থাকবে,এতো পকপক করো কেনো?”
মোহাম্মদ আলী উঠে রুমে চলে যায়,রোজিনা বেগম অন্যদিকে চলে গেলে ফিরোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্লোরে বসে থাকে।
ঘরের এক কোনে দাঁড়ানো ফারিয়া তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।সে সবচেয়ে বেশী তার ভাইকে ভালোবাসে।এই ভাইয়ের এমন ভঙ্গুর দশা তার সহ্য হয় না।সে এগিয়ে আসে হাটুমুড়ে বসে ভাইয়ের পাশে।ফারিয়াকে দেখে ফিরোজ বললো,
“আমার জীবনে কোনো সুখ নেই,কেউ চায়না আমি সুখী হই।”
“তুমি সুখী হবে ভাইয়া।”
“কিভাবে হবো?শ্যামাকে না পেলে সুখী হবোনা।ওর মতো ভালো আমাকে কেউ বাসবেনা।”
“আব্বা বোধহয় মেনেছে।”
“কিভাবে বুঝবো? চল আবার আব্বার রুমে যাই।”
ফিরোজ চাইলে শ্যামাকে নিয়ে আসতে পারে,কারো সাধ্যি নেই আটকানোর কিন্তু সে চায় সম্মান,বউ সম্মানের জিনিস এমন কাজ করে বউয়ের সম্মান কমানোর কোনো মানে হয় না।তাইতো তার আব্বার কাছে মিনতি করা,উনাকে মিনতি করে যদি মানানো যায় তাহলে মিনতি করতে সমস্যা কি তারই তো আব্বা।সে চাইলে বিয়ের কথাটা প্রকাশ করে সবাইকে ধরাশায়ী করাতে পারে কিন্তু সে চাচ্ছে সবাই যদি এমনি মেনে যায় তাহলে এই গোপন কর্ম গোপন থাকুক তা আর প্রকাশের দরকার কি!সে আবারো তার আব্বার কাছে যায়।প্রিয়তমাকে সসম্মানে ঘরে তুলার জন্য একটু বেহায়া,নিলজ্জ হওয়াই যায়,তাছাড়া শ্যামা যা সহ্য করছে তার কাছে এগুলো কিছুইনা।মোহাম্মদ আলী কিছু একটা ভাবছিলেন ছেলে মেয়েকে দেখে বললো,
“কি?”
ফিরোজ বললো,
“আব্বা,”
“আমি বুঝেছি।”
ফারিয়া মোহাম্মদ আলীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আব্বা,আমাকে নিয়ে কেউ তোমাকে কথা শুনালে কি তোমার খারাপ লাগতো না?কিন্তু তুমি স্বপন কাকাকে অপমান করেছো।এবার গিয়ে সব মিটমাট করে নাও।আমার ভাইটা সারাজীবন কষ্টে আছে এবার একটু সুখের দেখা পেতে দাও।”
মোহাম্মদ আলী নিজেও জানে স্বপন ইসলামকে উনি বেশ অপমান করেছেন কিন্তু তখন অহংকার এ অন্ধ ছিলেন এতোকিছু ভাবার সময় হয়নি।এখন মনে হচ্ছে জল গুলা না করে আগেই পানি পান করার দরকার ছিলো তাহলে আর এতোকিছু হতোনা।উনি ফিরোজের দিকে তাকায়।
“তুই কি চাস আমি প্রস্তাব নিয়ে যাই?”
ফিরোজ মাথা নাড়ে।মোহাম্মদ আলী বললো,
“যা,কালকে দুপুরে শ্যামাদের বাড়িতে যাবো।”
ফিরোজ খুশী হয়ে তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে,এবার মোহাম্মদ আলী আর কুট,নৈতিক হাসি হাসে না বরং ছেলের খুশীতে নিজেও খুশী হয়।
পরের দিন সকালে মোহাম্মদ আলী হরেক রকম ফলমূল এনে বাড়িতে রাখে।ছেলে যেখানে নিজের সুখ খুঁজে পায় সেখানেই যাক,সংসার সে করবে তাহলে উনি কেনো বাধা দেবে?এই বোধটা আসাতেই তার ভালো লাগছে।তাই হাসিখুশি মুখেই সব কাজকর্ম করছে।কিন্তু মনে মনে ভাবছে স্বপন ইসলাম কিনা আমার অপমান করে দেয়।
বারোটার দিকে সবাই শ্যামাদের বাড়ির উদেশ্যে বেরিয়ে পরে।আগেরবার ফিরোজ তার আব্বাকে একা একা পাঠিয়ে ভুল করেছিলো তাই এবার আর সে ভুল করতে ইচ্ছুক না।মোহাম্মদ আলীর সাথে ফিরোজ,বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আর থানার এসপি যাচ্ছে।ফিরোজের ইচ্ছে কোনোভাবেই যেনো উনারা না করার সুযোগ না পায়।এসপি ফিরোজকে চিন্তিত্ব মুখ দেখে বললো,
“ফিরোজ ভাই,এতো চিন্তা করছেন কেনো?মেয়ে যেহেতু পছন্দ হয়েছে তাহলে আর চিন্তার কিছু নেই।উনারা আপসে মেয়ে না দিলে উঠিয়ে নিয়ে আসবো,আপনার জন্য পুলিশ থেকে না হয় একটু গু,ন্ডামি করলাম।”
উনার কথায় উপস্থিত সবাই হু হু করে হেসে উঠে।
চলবে…….
#মধুমাস
#পর্ব_৩৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
দুপুরে যে পাত্রপক্ষ শ্যামাকে দেখতে আসবে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।পাত্র স্বপন ইসলামের প্রাক্তন ছাত্র,সে মোটামুটি সবই জানে,তাই এইবার আর বিয়ে ভাঙ্গার কোনো কারণ নেই।স্বপন ইসলাম উনাদের অপেক্ষায় আছেন।তখনি আগমন ঘটে মোহাম্মদ আলীর।উনাকে দেখে মুখের ভাব কঠিন হয়,মুখে কিছু কথা চলে এলেও তা মুখ ফুটে বলেনা কারণ উনি একা নয় উনার পাশে সাবেক চেয়ারম্যান আর ওসি সাহেবও এসে দাড়িয়েছেন।আর এ সব কিছুর কালপ্রিন্ট যে সে হাতে ফলের প্যাকেট নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।চেয়ারম্যান সাহেব স্বপন ইসলাম আর রিপনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার স্বপন ভাই!ভেতরে যেতে বলবেন না, নাকি?”
স্বপন ইসলাম ভদ্রতাসূচক হাসে।রিপন তার আব্বার মনোভাব বুঝতে পেরে জলদি বললো,
“আসেন কাকা,ঘরে আসেন।”
স্বপন ইসলাম চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়,এইসময় উনি মোহাম্মদ আলীকে আশা করেননি।এসেছে এসেছে আবার সাথে লোক ধরে নিয়ে এসেছে।যেনো না ফিরাতে পারে।
উনাদের মতো ফাতেমা বেগম আর শান্তাও অবাক।ফিরোজের দেয়া ফলমূল আর মিষ্টান্নের বাহার দেখে মনে হচ্ছে আজকে রাজী না করিয়ে যাবে না।দুজনেই চিন্তায় আছে।
রিপন কি বলবে কিংবা এইমুহূর্তে তার কি বলা উচিত তা বুঝতে পারছে না।চেয়ারম্যান সাহেব পরিবেশ হালকা করতে গলা খাকারি দিয়ে বললো,
“রিপন!তোমাদের বাড়িতে কেউ আসার কথা নাকি?”
রিপন যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।
“হ্যাঁ।আমার ছোটবোনকে দেখতে আসার কথা। ”
“তার বোধহয় আর দরকার নেই।”
রিপন চুপ করে থাকে।মোহাম্মদ আলীর এতো খারাপ লাগছে যে উনি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।স্বপন ইসলামকে করা অপমানগুলো যেনো গায়ে শুলের মতো ফুটছে।স্বপন ইসলাম কোনো কথা না বলে চলে যাওয়াতে যেনো অপমানের ঘা আরো গভীর হয়।নিজের বিবেক তার ভুলগুলো যেনো হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।এতোটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হয়নি,কোনো বাবাই চাইবেনা মেয়ে প্রেম করুক কিংবা বাবা মায়ের অবাধ্য হোক কিন্তু উনি এই সবগুলো দোষ স্বপন ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন অথচ উনি সম্পূর্ণ নিরপরাধ।এখন কি করা যায়?উনাকে দেখে যা মনে হলো সহযে মানবেনা।মোহাম্মদ আলী রিপনকে বললো,
“রিপন শোন।”
রিপন বিষ্ময়ে উনার দিকে তাকায়।বর্তমানে তাদের ঘরে বসে থাকা মোহাম্মদ আলীর কন্ঠস্বর খুবই নরম অথচ মাস কয়েক আগে উনিই এই বাড়িতে অহংকারী কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন।তাকে তাকাতে দেখে মোহাম্মদ আলী বললো,
“আমরা এখানে আসার কারণটা নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পেরেছো?”
রিপন মাথা নেড়ে বললো,
“জ্বী।”
“স্বপন ভাইকে ডাকো,কথা বলি। ”
ওসি সাহেব বললো,
“মনে রাগারাগি না রেখে সরাসরি কথা বলে সমাধানে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। যাও তোমার বাবাকে ডাকো।”
রিপন দ্রুত তার আব্বার রুমে যায়।তার পিছুপিছু ফাতেমা বেগম আর শান্তাও যায়।স্বপন ইসলাম রাগে কিড়মিড় করছে।রিপন গিয়ে বললো,
“আব্বা আপনাকে ডাকে।আসেন।”
উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“শ্যামারে আমার কাছে আন,আমি ওরে এখন জ,বাই করবো।”
“মাথা ঠান্ডা করেন আব্বা,এখন এসব বলে কি লাভ?মেয়ে বিয়ে দেবেন না?এই কয়মাস কি কম চেষ্টা করেছেন? একটা ছেলেপক্ষ কি রাজী হয়েছে?”
“এতো অপমানের পরে ওই বড়োলোকের সাথে আত্মীয়তা করার প্রশ্নই আসে না। ”
“আচ্ছা করেন কি না করেন সেটা পরে দেখা যাবে, এখন আসেন।”
“তুই যা।আমি যাবোনা।”
“আব্বা জেদ করেন না তো।”
“যা,আর একটা কথাও বলবি না।”
রিপন নত মস্তিষ্কে বেরিয়ে যায়।ফাতেমা বেগম এতোদিন মেয়েকে কম মা,রেননি,কম বুঝাননি কিন্তু মেয়ে যানো এক কথায় আটকে আছে।এতোদিন যা হওয়ার হয়েছে এখন যেহেতু ছেলের বাবা নত হয়ে মেয়ে নিতে এসেছে তাহলে আর না করার কি দরকার?মেয়ের রিজিক থাকলে যাবে।এতোদিন তো বিয়ে দেয়ার জন্য কম চেষ্টা করা হয়নি আর কেন বিয়ে হয়নি এটা সবারই জানা তাহলে আর কি করার আছে?মেয়েকে মানাতে পারলে না হয় অন্যকথা বলা যেতো কিন্তু মেয়ে যে ফিরোজ বলতেই রাজী!ফিরোজের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত।কিন্তু ফিরোজের আব্বা যে উনাকে।অপমান করেছে এটা ঠিক এতোটা না বললেও পারতো।উনি বললেন,
“শোনেন,উনারা বসে আছে।”
“থাকুক।”
“আপনি না গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।”
“সব নষ্টের মূল তুমি,মা হয়ে মেয়েকে সামলাতে পারোনি।”
“এসব বলে লাভ কি?যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।”
“আমি যাবো না।আর মেয়েও বিয়ে দেবো না।তোমার মেয়ের ইচ্ছে হলে বলো এখনি চলে যেতে।”
“কি বলেন এগুলা?সসম্মানে নিতে এসেছে ভালো লাগছে না?নাক কান কেটে চলে গেলে ভালো লাগতো?”
“চলে যাক।”
“এতো কথা বইলেন না।ছেলের বাবা মাথা নত করে এসেছে,আসেন।”
“কিসের নত করা?ওই লোকটা খুব খারাপ হয়তো ছেলের চাপে পরে এসেছে পরে আসল রূপ বেরোবে।”
ফাতেমা বেগম চুপ করে থাকে।স্বামীকে নড়ানো সম্ভব না বুঝে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিপনকে বিমর্ষ মুখে আসতে দেখে সবাই বুঝতে পারে স্বপন ইসলাম আসেনি।সবাই চুপ করে বসে থাকে।কিছুক্ষণ পরে মোহাম্মদ আলী উঠে দাঁড়ায়।
“তোমার আব্বার রুম কোনটা?”
রিপন অবাক হলেও তা প্রকাশ করে না।হাত দিয়ে তার আব্বার রুম দেখিয়ে দেয়।
“স্বপন ভাই,আসবো।”
ফাতেমা বেগম দরজা খুলে দেয়।স্বপন ইসলাম দাড়িয়ে যায়।মোহাম্মদ আলী যে সোজা রুমে চলে আসবে তা কল্পনাও করেননি।
মোহাম্মদ আলী নিজের অহংকার দূরে রেখে এগিয়ে যায়।
“ভাই,আগে যা বলেছি;করেছি সব ভুলে যান,আমার ভুল হয়েছে,শ্যামাকে আপনার কাছে নিজের মেয়ে করে নিতে এসেছি,ফিরিয়ে দেবেন?”
স্বপন ইসলাম চুপ করে থাকে।মোহাম্মদ আলী আবার বলেন,
“আমার ছেলেটা জনমদুঃখী।মা চলে যাওয়ার পরে ছেলের কথা ভেবে আবার বিয়ে করলাম কিন্তু সে দুঃখই পেলো।সারাটা জীবন ছেলের দুঃখ দেখেই গেলাম।সে এখন তার সুখ হিসেবে শ্যামাকে চেয়েছে।আমি নিজেও দেখেছি শ্যামাকে ছাড়া ফিরোজ কতো ভঙ্গুর।আমি আমার ছেলের সুখ নিতে চাই ভাই।আবারো বলছি আগে যা বলেছি আমার ভুল হয়েছে।আমার ক্ষমা করে দিন।”
স্বপন ইসলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এই মানুষটাই তেজী গলায় কঠিন কথাগুলো বলেছিলো আর আজকে মনে হচ্ছে সব পালটে গিয়েছে।উনাকে কিছু না বলতে দেখে মোহাম্মদ আলী স্বপন ইসলামের হাত ধরে বললো,
“মেয়েটাকে দিয়ে দেন ভাই,আমি সারজীবন ঋণী থাকবো।”
স্বপন ইসলাম আর শক্ত থাকতে পারে না।মাথা নেড়ে বললো,
“চলেন।”
দুজনকে একসাথে আসতে দেখে সবাই খুশী হয়।চেয়ারম্যান সাহেব বললো,
“তা স্বপন ভাই আপনার মেয়ের জন্য আমার ছোটভাই ফিরোজকে কেমন লাগে?”
স্বপন ইসলাম চোখ ঘুরিয়ে ফিরোজের দিকে তাকায়।ফিরোজ আত্মবিশ্বাসী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ভালোই।”
“তাহলে আমরা কথা আগাই?”
“জ্বী।”
ওসি সাহেব বললো,
“কিসের কথা আগানো,মেয়ে না দেখে কথা আগায় কিভাবে?”
রিপন গিয়ে শ্যামাকে নিয়ে আসে।
ঘরে পরার সাধারণ কাপড়েও শ্যামাকে সুন্দর লাগছে।অতিরিক্ত মা,রার কারণে মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।এতোক্ষন রুম থেকে সব শুনেছে, সব দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে সমাধান চেয়েছে।দুরুদুরু বুকে চুপটি করে চেয়ারে বসে থাকে।মোহাম্মদ আলী পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে শ্যামার হাতে গুজে দেয়,ছেলের পছন্দের মেয়েকে খালি হাতে দেখবেন কি করে?ফিরোজ বারবার তাকাচ্ছে,মে রে মেয়েটার কি হাল করেছে সেটাই ভাবছে।
মোহাম্মদ আলী বললো,
“তাহলে আগামী মাসের এক তারিখে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হোক,ওইদিন শুক্রবার,সবার সুবিধা হবে।”
ফিরোজ বললো,
“না,কালকের পরের দিনও শুক্রবার আমি ওইদিনই বিয়ে করবো,এতো লম্বা তারিখের দরকার নেই।”
ফিরোজের নিলজ্জতায় সবাই অবাক হয়।শ্যামা লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়,এখনো তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্নে আছে কিন্তু ফিরোজের নির্লজ্জ কথায় মনে হচ্ছে বাস্তবেই আছে।ফিরোজের কথা শুনে মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকায়।ফিরোজ তার আব্বার চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে বললো,
“শুভ কাজে দেরী করা ভালো না আব্বা।”
চেয়ারম্যান সাহেব রসিক মানুষ উনি ফিরোজের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে।মুহূর্তেই উনার হাসির রেশ উপস্থিত সবার ঠোঁটের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।স্বপন ইসলাম বললো,
“তাহলে।সামনের শুক্রবারেই বিয়ে।”
ফিরোজ উঠে যায়।চুপচাপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।অবশেষে তার রানীকে জয় করার পথে।খুশীতে ডান চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা গরম পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে।রুমে শ্যামার বুকটা ভার লাগে,চোখ জ্বালা করে ফিরোজের মতোই পানির রেখা গালে নামে।
চলবে…….