#মধুমাস
#পর্ব_২৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ বেহায়া হয়ে যায়।তেমনি অতী রাগী আত্মসম্মানী ফিরোজ বেহায়া হয়ে তার আব্বার কাছে বারবার যায়।
“আব্বা আপনি আমাকে এক কথা বলে শ্যামাদের বাড়িতে গিয়ে আরেক কথা বলেন কেনো?”
মোহাম্মদ আলী ছেলের শুকনো মুখটার দিকে তাকায়।
“তুই বোধহয় আমার কথা কিংবা কাজের অর্থ বুঝতেছিস না।”
“আপনি আমার মন বুঝেন না কেনো?এতোদিন বিয়ে করিনা এই কারণে ঘ্যানঘ্যান করেছেন এখন বিয়ে করতে বলেছি তাতেও সমস্যা?”
“আমার পছন্দমতো বিয়ে কর মানা করিনা তো।”
“সংসার করবো আমি তাহলে আপনার পছন্দে বিয়ে করবো কেনো?সংসার কি আপনি করবেন?”
“তাহলে তো ভালো কথা।”
“আমি শ্যামাকেই বিয়ে করবো।”
“আমি মানি না।”
“আপনাকে মানতেই হবে।”
“না মানলে কি করবি?”
“বিয়ে করে ঘরে তুলে ফেলবো।”
★★★
ফাতেমা বেগম ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ এক সাপ্তাহ হতে চললো শ্যামার জ্বর কমেছে কিন্তু শরীর বেশ দুর্বল আর মুখটা কি ফ্যাকাসে লাগছে।এই কয়িদিন যে মা,র খেয়েছে জন্মের পরে আর কখনো এমন মা,র খায়নি,তাইতো নাজুক শরীর আর নিতে পারেনি।নুয়ে পড়েছে।ডাগর ডাগর চোখের নিচে কালি জমেছে।ফাতেমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।
স্বপন ইসলামের অতী আদরের মেয়ে শ্যামা।ধমক ছাড়া কখনো গায়ে হাত তুলেনি।মেয়েকে মে,রে নিজের রুমে গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন।শ্যামার এই ব্যাপারটা জানার পর থেকে সারাক্ষণ মনম,রা হয়ে থাকেন।ফিরোজের ক্ষপ্পরে পরে আদরের মেয়ে বাদরের রূপ ধারন করেছে।আর এই রূপই উনার সহ্য হচ্ছে না উনি চায় উনার মেয়ে সারাজীবন উনার কথায় চলুক,বাবা হিসেবে এইটুকু তো চাইতেই পারে।
ফিরোজের সাথে বিরোধ থাকলেও মেয়ে যেহেতু পছন্দ করেছে উনি বিবেচনা করে দেখতেন কিন্তু মোহাম্মদ আলীর নাকেমুখে করা অপমানের ঘা সারাদিন খুচায়।বিয়ের আগেই যদি উনার এই ব্যবহার থাকে তাহলে বিয়ের পরে কি হবে তা খুব সহযেই অনুমেয় করা যায়।স্বপন ইসলামের আত্মসম্মান প্রবল।ফিরোজের কাছে উনি কোনোদিন মেয়ে দেবে না দরকার হলে মে,রে গুমতী নদীতে ফেলে দেবে তাও ওইমুখো হবে না।ফিরোজকে নিজের জামাতা হিসেবে মানা অসম্ভব।রিপনকে বলে ভালো ভালো সমন্ধ যোগার করে ফেলেছে।কালকেই একপক্ষ দেখতে আসবে।শ্যামাকে নিয়ে উনি বেশ চিন্তিত্ব।মেয়েটা না আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে।এমনিতেই প্রচুর কঠিন হয়েছেন,নিজের সভাব থেকে সরে মেয়েকে আ,ঘাত দিয়ে ঠিক করতে চেয়েছেন কিন্তু মেয়ে যেনো প্রতিজ্ঞাবাদ্ধ কোনোভাবেই ফিরোজ নামের ঘুনেপোকা মাথা থেকে সরাবে না; তাই এবার ফাতেমা বেগমকে পাঠিয়েছেন ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে যেনো আর কোনো ঝামেলা না করে।
কারো হাতের মোলায়েম স্পর্শ পেয়ে শ্যামা চোখ মেলে তাকায়।ফাতেমা বেগম শ্যামার মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।
“আম্মু শরীর ভালো লাগছে?”
কতোদিন পরে মায়ের আদরমাখা কথা শুনে শ্যামার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে,চোখ ভরে উঠে পানিতে।সে মাথা নেড়ে বললো,
“ভালো।”
ফাতেমা বেগম মেয়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।শ্যামার গাল বেয়ে পানির চিকন নালা নেমে যায়।ফাতেমা বেগম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
“শ্যামা একটু কথা বলবো উঠে বস।”
শ্যামা উঠে বসে,বুঝতে পারে তার আম্মা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে।
ফাতেমা বেগম বললো,
“তোর আব্বার কথা একবার ভাব, মানুষটা অসুস্থ।তুই এমন করলে উনি যেকোনো মূহুর্তে হার্ট অ্যাটাক করবে।তুই কি তাই চাস?”
বুদ্ধিমান শ্যামা বুঝতে পারে কথা কোনদিকে যাবে।ফিরোজের প্রসঙ্গ আসবে ভাবতেই পেট ঘুরঘুর করে উঠে।শ্যামা তার মায়ের দিকে তাকায়।বাবা মাকে সে কতোটা ভালোবাসে সেটা কখনো কাউকে বুঝাবার না কিন্তু ফিরোজকেও তো ভালোবাসে,বাবা মায়ের ভালোবাসা এক রকমের আর ফিরোজের ভালোবাসা আরেক রকমের।কোনটা রেখে কোনটা জয় করবে তা শ্যামার মাথায় কুলায় না।সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“না মা আমি তা চাই না।”
“তাহলে এমন পাগলামি করছিস কেনো?”
“আম্মা।আমি ফিরোজকে ভালোবাসি।”
“উঠতি বয়সে মেয়েদের এমন একটু আকটু ভালো লাগা আসেই।কিছুদিন পরে ঠিক ভুলে যাবি।”
শ্যামা লাজ লজ্জা ভুলে মাথা নিচু করে বললো,
“তুমি জানো না আম্মা আমি উনাকে কতোটা ভালোবাসি।”
ফাতেমা বেগম মেয়ের নির্লজ্জতায় অবাক হয়।
“আমরা তোর বিয়ে দেবো।বিয়ে হলে দেখবি এই ছেলেকে ভুলতে সময় লাগবে না।”
শ্যামা মাথা নাড়ে।
“ফিরোজকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।”
“তোর আব্বার কথা ভাব।তোকে নিয়ে উনার কতো স্বপ্ন।”
“ফিরোজের সাথে বিয়ে হলেও তো সব স্বপ্ন পূরণ হবে।”
“না।ফিরোজ তোর জন্য ঠিক না।”
“ঠিক।আম্মা তুমি দেখো আমি ফিরোজের কাছে খুব সুখী হবো।”
“ফিরোজের কাছে সুখী হবিনা।দেখবি আমরা যেখানে বিয়ে দেবো সেখানেই সুখী হবি।”
“এমনো তো হতে পারে তোমরা যেখানে বিয়ে দিলে সেখানে আমি সুখী হলাম না,কয়দিন পরেই ডিবোর্স হয়ে গেলো।”
“তুই এতো ভাবছিস কেনো?
শ্যামা চুপ করে থাকে।ফাতেমা বেগম বললো,
“কালকে তোকে দেখতে আসবে।আমি আর তোর আব্বা চাই তুই আর কোনো ঝামেলা না করিস।দয়া করে আমাদের মান সম্মান রাখিস শ্যামা।”
শ্যামা মায়ের কোমড় আঁকড়ে ধরে।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।বিয়ে!দেখতে আসা!ফিরোজকে ছাড়া বিয়ে কোনো ভাবেই সম্ভব না।এসব ভাবলেই দুনিয়াটা ভূমিকম্পর ন্যায় কেঁপে উঠে,বুকের যন্ত্রণা তীব্র হয়,শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।বাবা মা নিজেদের দিকটা দেখার পাশাপাশি যদি সন্তানের মনের দিকেও তাকাতো তাহলে কতোই না ভালো হতো।ফাতেমা বেগম স্তব্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।এতো মা,রের পরেও ভালোবাসার নাম মুখ থেকে সরানো যায় না।কি আছে এই ভালোবাসায়? যার জন্য জানের পরোয়া করেনা।শ্যামা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“আম্মা।আম্মা গো আমি সত্যি ফিরোজকে ছাড়া বাঁচবো না।”
“বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আম্মা এসব বললে আমি ম,রে যাবো আম্মা।”
ফাতেমা বেগম উঠে দাঁড়ায়।
দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করে চলে যায়।শ্যামা মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।ইচ্ছে করছে ফিরোজের কাছে চলে যেতে কিন্তু কোনো রাস্তা খোলা নেই যে।আর ফিরোজও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেনো?সে কি তার মধুরানীকে ভুলে গেছে?শ্যামা ম,রা মানুষের মতো বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে থাকে।এখন মনে হচ্ছে ভালোবাসার ফা,সি গলায় না পড়ালেই ভালো হতো এখন না পারছে ম,রতে না পারছে বাঁচতে,অসহ্য দহনে বুকের পাখি ছটফটায়।
এই সাত দিন ফিরোজ শ্যামার সাথে দেখা করতে পারেনি।ডাঙ্গায় উঠা মাছের মতো ছটফট করে দিন কাটাচ্ছে।দেখা করার জন্য কতোবার যে চেষ্টা করেছে তার হিসেব নেই কিন্তু প্রতিবার রিপন নাহয় তার আব্বা সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।ফিরোজ তার আব্বাকেও মানাতে পারছেনা।সে খবর পায় কালকে শ্যামাকে দেখতে আসবে।নিজের আত্মসম্মান ভুলে দ্রুত পায়ে শ্যামাদের বাড়িতে যায়। বসার ঘরে শ্যামা ছাড়া সবাই উপস্থিত,কিছু নিয়ে হয়তো কথা বলছে।ফিরোজকে দেখে রিপন রেগে যায়।
“তোর এতো বড়ো সাহস!আবারো এসেছিস।”
ফিরোজ তাড়াতাড়ি বললো,
“কাকা আমাকে কিছু বলতে দেন।”
স্বপন ইসলাম রিপনকে থামায়।গম্ভীর গলায় বললো,
“বলো কি বলবে।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্বপন ইসলামের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“কাকা আপনার মেয়েটারে আমার নামে দিয়ে দেন না কাকা।কথা দিচ্ছি সুখে রাখবো।”
স্বপন ইসলাম উশকো খুশকো চুলের ফিরোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ আবারো বললো,
“আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ে আমার কাছে থাকলে যতোটা ভালো থাকবে অন্য কোথাও এতোটা ভালো থাকবে না।আব্বার যা বলেছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।দয়া করে শ্যামাকে আমার থেকে দূরে সরাবেন না,আপনারা চাইলে আমরা সুখে থাকতে পারি।”
স্বপন ইসলাম বললো,
“তোমার বলা শেষ?”
ফিরোজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
“কাকা..”
স্বপন ইসলাম বললো,
” বলা শেষ হলে যেতে পারো।”
ফিরোজ এগিয়ে এসে স্বপন ইসলামের হাত ধরে কাতর গলায় অনুনয় করে বললো,
“এমনটা করবেন না প্লিজ।এই সুখটুকু আমাকে ভিক্ষা দিন।”
স্বপন ইসলাম হাত ছাড়িয়ে নেয়।
“ফাজলামি পেয়েছো?তোমার আব্বা এসে অপমান করে যাবে তুমি এসে মেয়ে চাইবে।কি! কি সমস্যা তোমাদের?বেরিয়ে যাও।যাও।”
এতো আবদার-মাখা কথায়ও কারো মন গললো না।ছলছল চোখে ফিরোজ তাকিয়ে থাকে।একে একে সবাই চলে যায়।এক নামকরা নেতা যার হুংকারে সবাই কেঁপে উঠে তাকে প্রেয়সীর জন্য এতোটা অসহায়বোধ করতে হচ্ছে,নিজের মানসম্মান খুয়াতেও দ্বিধা করছে না।ফিরোজ মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।শ্যামা বোধহয় তার গলার স্বর শুনেছে তাইতো জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখেই চাপা কান্নায় ফুপিয়ে উঠে।ফিরোজ এগিয়ে যায়,বিষন্ন মুখে হাসার চেষ্টা করে। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে শ্যামার হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
“শ্যামা! এই মেয়ে কাঁদো কেনো?”
শ্যামা গ্রিলে গাল লাগিয়ে দেয়।ফিরোজ গালে হাত স্পর্শ করে বললো,
“আমার মধুরানী এতো কাঁদবে কেনো?আমি আছিনা সব ঠিক করে দেবো।”
শ্যামা ব্যাকুল গলায় বললো,
“তোমার কাছে যাবো।”
“হ্যাঁ।আসবে।আমি ব্যবস্থা করছি।”
দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“ভালোবাসি মধুরানী।”
শ্যামা কিছু বলার আগেই তার দরজা খুলে যায় আর ফিরোজ সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়।
এর পরের দিন শ্যামাকে দেখতে আসে।পাত্র পক্ষ মেয়ে দেখে জানায় তারা সিদ্ধান্ত রাতে জানাবে।সন্ধ্যা হলে শ্যামা তার আব্বার রুমে যায়।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ ফুলে গিয়েছে।স্বপন ইসলাম চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলো।শ্যামা উনার সামনে গিয়ে পা আঁকড়ে ধরে বললো,
“আব্বা।”
স্বপন ইসলাম শান্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিছু বলবি।”
শ্যামা মাথা নাড়ে কিন্তু কান্নার জন্য কথা বলতে পারে না।বহুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের লজ্জা ভুলে বললো,
“আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিও না আব্বা।”
“আর কিছু বলবি?”
“আমি ফিরোজকে ভালোবাসি।”
“কিন্তু এই ছেলে তোর জন্য ঠিক না।আমার উপর বিশ্বাস রাখ আমি তোকে এর চেয়ে ভালো বিয়ে দেবো।রানীর মতো থাকবি।”
“আমি রানী হতে চাই না।”
স্বপন ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,
“আমার দিকে তাকা।”
শ্যামা তাকালে উনি বললো,
“আমি তোর বিয়ে অন্য কোথাও দেবো।”
“না।”
“মা বাবার সম্মান রাখবিনা?”
“আমার দিকটা একটু দেখো আব্বা।”
মেয়ের নির্লজ্জতা,বেহায়াপনা,অবাধ্যতায় স্বপন ইসলাম রেগে যান।চিৎকার করে বললো,
“ফাতেমা ওরে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।আমি ওরে কখন কব,র দিয়া ফেলি ঠিক নাই।”
ফাতেমা বেগম শ্যামাকে টেনে রুমে নিয়ে যায়।
পরের দিন সকালে শ্যামার কলেজ থেকে ফোন আসে।ইংরেজি শিক্ষক জরুরীভাবে কলেজে যেতে বলেছে।ফাতেমা বেগম কিছুতেই শ্যামাকে যেতে দেবে না কিন্তু উনি নিজেই স্যারের সাথে কথা বলেছে স্যার বলেছেন জরুরী কিছু কিন্তু একা তো ছাড়া যাবে না,যদি পালিয়ে যায়।তারপর ঠিক করা হলো শান্তা তার সাথে যাবে।দুজনে মিলে কলেজে যায়।শান্তা কমন রুমে বসে আর শ্যামা তার ইংরেজী শিক্ষকের কাছে যায়।
ইংরেজি শিক্ষক শহিদুল শ্যামাকে দেখে হাসে।তারপর হাতের ইশারায় সাথে আসতে বলে।
শ্যামা বুঝতে পারে না এখন জরুরী কি কাজ থাকতে পারে।কলেজের পেছনের দিকে একটা বড়ো গুদামঘর আছে যেখানে মাসিক পরিক্ষার সব খাতা,পুরোনো বই রাখা হয়।উনি শ্যামাকে ওখানে নিয়ে দাঁড় করায়।শ্যামা অবাক হয়ে বললো,
“স্যার এখানে কেনো?”
তখনি স্টিলের দরজা খুলে উদয় হয় তার রাজা।মধুরানীর মধুরাজা!
স্যারকে উপেক্ষা করে শ্যামা ফিরোজের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।প্রিয় মানুষটার বুকে যেতে পেরে সুখে,উচ্ছাসে শ্যামার শরীর কেঁপে যাচ্ছে।ফিরোজ কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“শ্যামা আমাকে বিয়ে করবে?”
শ্যামা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“করবো।”
“তাহলে চলো।”
ফিরোজের কথায় শ্যামা মাথা তুলে তাকায়।ফিরোজ ছাড়াও এই রুমে কাজী সহ এখন গোটা সাতেক মানুষ উপস্থিত।সবগুলোই ফিরোজের বন্ধু।শ্যামা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়।
ফিরোজ বললো,
“রাজী?”
শ্যামা বললো,
“এভাবে?”
“এভাবেই করতে হবে।ভালো মানুষ হয়ে সবার মন রেখে তোমাকে জয় করতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেউ তো কথা রাখলো না,না আমাদের মন বুঝলো।একবার বিয়ে করে নিলে আমাদের কেউ আর আলাদা করতে পারবে না কিন্তু একবার যদি আলাদা হয়ে যাই তাহলে সারাজীবন এই কষ্টের বুঝা বইতে হবে।আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবোই না।আপাতত কাউকে জানাবো না।যদি সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করতে পারি তাহলে এই বিয়ের খবর কেউ পাবে না।আর সবাই যদি না মানে তাহলে এই বিয়েটা প্রকাশ করবো।”
শ্যামা জানে আজকে যদি ফিরোজের কথা না মানে তাহলে আর কখনো হয়তো দেখা হবে না,আপন করে পাওয়া হবে না।মূহুর্তেই শ্যামা জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয়।সে মাথা ঝাকিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করে বললো,
“রাজী।”
ফিরোজ শহীদুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শহীদুল দরজা আটকে দে।”
শ্যামা ভাবে এই প্রথম হয়তো কোনো শিক্ষক তার ছাত্রীর পালিয়ে বিয়েতে সহযোগিতা করছে।
কাজী সব আগেই তৈরি করে রেখেছিলো তারপর শ্যামা আর ফিরোজ কাগজে সিগনেচার দেয়।সারাটাক্ষন ফিরোজ শক্ত করে শ্যামার হাত ধরে রেখেছে।আর এই সবটা সময় শ্যামার মনে হয়েছে সে স্বপ্নে আছে,যেকোনো সময় স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।সে কাঁদছে,সুখে নাকি অন্য কারণে তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
বিয়ের পরে যখন সবাই চলে যায় তখন ফিরোজ বললো,
“আজকে খাতা কলমে তোমার হলাম কিন্তু এই মন জানে আরো কতো আগে এই মধুরাজা পুরোপুরি তার মধুরানীর হয়ে আছে।”
চলবে….
#মধুমাস
#পর্ব_২৮
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শান্তা আড়চোখে শ্যামার দিকে তাকায়,মেয়েটা এমন থম মে,রে আছে কেনো?ও কি ভেবেছিলো শান্তাকে ফাঁকি দিয়ে নাগরের সাথে দেখা করবে!তা তো হলোনা শান্তা সারাটাক্ষন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো।শ্যামা শহীদুল স্যারের সাথে গিয়েছে আবার উনার সাথেই ফিরে এসেছে সুতরাং নাগরের সাথে দেখা হওয়ার কোনো চান্সই নেই।শান্তার খুব আনন্দ লাগে।সে শ্যামার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“তুই কি ভাবিছিলি,ফিরোজের সাথে দেখা করবি?আমি থাকতে তা সম্ভব না,আম্মা আমারে বুঝেই পাঠিয়েছে।”
আজকে কি হয়ে গেলো!
শ্যামা এখনো ধাক্কাটা সামলে নিতে পারেনি।আকস্মিক হয়ে যাওয়া বিয়েটায় যেনো শ্যামার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সুখ দুঃখের মাঝামাঝি অবস্থান করছে।শরীর মৃদু কাঁপছে।শান্তার কথায় হাসার কথা কিন্তু শ্যামা হাসে না,শান্তা নাকি তাকে দেখা করতে দেয়নি পাহারা দিয়েছে কিন্তু সে জানে না ;তার এই সুচারু পাহারার মাঝেই দেখার চেয়েও ভ,য়ংকর কাজ করে ফেলেছে।শ্যামার কথা বলতে ইচ্ছে করে না সে চুপচাপ বসে থাকে।তার কাছে এখনো সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে যেনো কেউ ডাকলেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে।শ্যামার নিজেকে কেমন হালকা লাগছে।সে এখন ফিরোজের বউ।হোকনা গোপন বিয়ে,গোপন সম্পর্ক কিন্তু সে তো জানে ফিরোজ সারাজীবনের জন্য তার,মধুরাজা শুধুমাত্র তার মধুরানীর।সে গোপনে নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে।
শান্তা ভ্রু কুঁচকে ঝগড়াটে ননদের দিকে তাকিয়ে থাকে।শ্যামা প্রতিবাদ করেনি, এটা যেনো বেশ আশ্চর্যের কাজ।শ্যামা তার বইগুলো পরম যত্নে বুকে আগলে রেখেছে।শান্তা বললো,
“বইগুলো এভাবে রেখেছিস কেনো?চিঠি মিঠি আছে নাকি?”
শ্যামা হকচকিয়ে যায় কিন্তু সাহস করে শান্তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“নাও,চ্যাক করো।”
শান্তা মাথা ঘুরিয়ে নেয়।শ্যামার প্রাণপাখি আরেকটু হলে উড়ে যেতো।বইগুলো এমন করে বুকে চেপে রাখার কারন হলো,এই বইয়ের মাঝে একটা বই ফিরোজের দেয়া,সেই বইয়ের ভেতরে একটা মোবাইল আছে।আর মোবাইলের মাপে বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে জায়গা করা হয়েছে।উপর থেকে কখনো বুঝা যাবে না যে ভেতরে মোবাইল আছে।যেহেতু ফিরোজের সাথে যোগাযোগের কোনো রাস্তা নেই সুতরাং এটাই ভরসা।
বাড়ি এসে শ্যামা শুনতে পায় পাত্রপক্ষ না করে দিয়েছে।শ্যামা অজু করে যোহরের নামাজে বসে।নামায শেষে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়ে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করে।মোনাজাতে ডুকড়ে কেঁদে উঠে।জ্ঞানী শ্যামা জানে সে যা করেছে তা সম্পূর্ণ ভুল কিন্তু সে নিরুপায় ছিলো।এই খবর বাবা মায়ের কাছে গেলে উনারা তাকে আস্ত রাখবেনা আর নিজেরাও খুব কষ্ট পাবে।কিন্তু শ্যামা কি করবে?প্রেমে পাগল মনকে তো আটকানো যাচ্ছিলো না পাগলের মতো বাবা মায়ের কাছে নিজের মানুষটাকে ভিক্ষা চেয়েছে কিন্তু কেউ তার কথা শুনেনি,তাকে বোঝার চেষ্টা করেনি।পরপর দুই দুটা খুশীর খবর শুনে শ্যামা খুশী হয়।প্রাণভরে আল্লাহর কাছে দোয়া চায় যেনো এই বিয়ের কথা জানার আগেই তার আব্বা আম্মা আর ফিরোজের আব্বা নরম হয়।
শ্যামা নামায পড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমায়,অনেকদিন পরে এতো শান্তি মনে শ্যামা ঘুমাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠে মনে পড়ে সে বিবাহিত।আজকে তার বিয়ের প্রথম দিন,সে ফিরোজের স্ত্রী।শ্যামা লজ্জায় বালিশে মুখ গুজে নেয় যদিও ফিরোজ তার কাছে আসতে পারবেনা কিন্তু শ্যামা লজ্জা পায়।
ফাতেমা বেগম বললো,
“শান্তা ও কি কোথাও যাওয়ার জন্য বলেছিলো?”
“না আম্মা।”
“তুমি খেয়াল রেখেছো তো?”
“হ্যাঁ আম্মা।আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
ফাতেমা বেগম নিশ্চিত হন।একটু আগে মেয়েকে দেখে এসেছেন,ঘুমাচ্ছে।ফিরোজের ভূত মাথা থেকে নেমে গেলেই হয়।
শহীদুল ফিরোজের ছোট।ইংরেজীতে ভালো বলে কলেজে চাকরী পেয়েছে অবশ্য ফিরোজ একটু সুপারিশ করে দিয়েছিলো,শহীদুলের সাথে ফিরোজের আলাদা একটা সম্পর্ক,শহীদুল ছোট হলেও দুজনের খুব মিল।তাইতো আজকে ফিরোজ মনের গোপন বাসনা জানানোর পরে সে আপত্তি করেনি,রিক্স হলেও সহযোগিতা করেছে।সারদিন ফিরোজ ক্লাবে কাজ করেছে।ইদানীং মানসিক টেনশনের সাথে কাজের চাপও বাড়ছে।দুটোয় তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে।সারাদিন কাজ করে কাটিয়ে দিলেও সন্ধার পরে শুরু হয় নতুন এক অশান্তি।শ্যামা নামের পাখির কাছে যাওয়ার জন্য শরীরের প্রতিটা নিউরণ আন্দোলন করে উঠে।সদ্য বিবাহিত বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করে।আজকে তাদের বিয়ের প্রথম রাত হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি এতোটাই জঘন্য যে চোখের দেখাই দেখতে পারছেনা।এতো অশান্তি তার এর আগে কখনো লাগেনি। ফিরোজ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে, শ্যামার মেসেজ পাঠানোর কথা কিন্তু পাঠাচ্ছে না কেন?
রাত দশটা।ফাতেমা বেগম লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।শ্যামা আগেই শুয়ে পড়েছে। উনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই গরমে কাথা গায়ে দিয়েছিস কেনো?”
শ্যামা কাথা সরিয়ে মাথা বের করে বললো,
“শীত লাগছে আম্মা আবার মনে হয় জ্বর আসবে।”
ফাতেমা বেগম আর কোনো কথা না বলে ওই পাশে ফিরে ঘুমিয়ে যায়।উনার নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ কানে আসলে শ্যামা মোবাইলটা হাতে নেয়।সুইচ অন করে নেট চালু করে কানে হেডফোন লাগায় তারপর ফিরোজকে ফোন দেয়।ফিরোজ বলেছে সে ফোন দিলে শ্যামা মেসেজ করবে আর ফিরোজ কথা বলবে।ফিরোজ রিসিভ করলে শ্যামা মুচকি হাসে লেখে,
“আসসালামু আলাইকুম,মধুরাজা।”
শ্যামার মেসেজ পেয়ে ফিরোজ হেসে খুশী খুশী গলায় বললো,
“ওয়ালাইকুম সালাম বিবিজান।”
শ্যামা হাসে।ফিরোজের গলার স্বর এতো ভালো লাগে যে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে,প্রেমে পড়লে বুঝি সবই ভালো লাগে।আজকে দু’জন কাছে থাকলে পা,গলের পা,গালামি দেখতে পারতো।
“ভালো আছেন?”
ফিরোজ হেসে বললো,
“একটুও ভালো নেই,বউ কাছে না থাকলে বিবাহিত পুরুষরা ভালো থাকতে পারে না।”
শ্যামা হাসে তার ফাঁকে কাথা সরিয়ে তার আম্মাকে দেখে নেয়।গরমে সারা শরীর ঘেমে একাকার।সে লেখলো,
“তো বাড়িতেই নিয়ে যেতেন।”
ফিরোজ গম্ভীর গলায় বললো,
“তুমি আমার বউ।যোগ্য সম্মান দিয়ে বাড়ি আনবো,এমনি আনলে সবাই ছোট ভাববে।”
শ্যামা ছোট করে লেখে,
“হুম।”
ফিরোজ হঠাৎ নিভু নিভু আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেয়।আদুরে গলায় বললো,
“পাখি কি আমাকে মিস করছে?”
ফিরোজের এমন আদরমাখা কন্ঠ শুনে শ্যামার এতোক্ষণ চেপে রাখা কান্না বুক ফেঁটে বেরিয়ে আসে।কাঁপা কাঁপা হাতে লেখে,
“ভিষণ।”
ফিরোজ চুপ করে থাকে তার কেনো যানি মনে হচ্ছে শ্যামা কাঁদছে।নিশ্চুপ থেকে যেনো দু’জন দুজনের মনের অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে।ছুঁয়ে দিচ্ছে একে অপরকে।ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“বউ!”
শ্যামার মন ভালো লাগায় ভরে উঠে।
“হুম।”
ফিরোজ নিজেকে আটকে রাখতে পারে না।
“আমি একটু আসি?দেখা করতে পারবেনা?”
এমন আদর করে আবদার করে কেনো ছেলেটা! বুঝে না তার বউয়ের কষ্ট হয়।শ্যামারও ইচ্ছে করে দেখা করতে কিন্তু তার আম্মা পাশে দেখা করার উপায় নেই।
“আম্মা পাশে তো।”
“বাহিরে আসতে পারবেনা?”
শ্যামার খুব অসহায় লাগে।
“না।”
“টয়লেটে যাও না তখন কিভাবে যাও?”
“তখন তো যাই আর আসি।”
“তাহলে এভাবেই আসো।আমি তোমাদের ঘরের সামনে এসে ফোন দেবো।”
শ্যামা না করতে পারলো না।ফিরোজ যেমন ছটফট করছে সে ও তো একি য,ন্ত্রণায় ছটফট করছে।শ্যামা সায় দেয়,স্বামীর প্রথম আবদার ফেলতে পারে না।কিছুক্ষণ পরে ফোন আসলে ধুকপুক বুকে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।আশেপাশে তাকিয়ে সোজা গোসলখানায় ঢুকে পরে।
ফিরোজ আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো শ্যামাকে দেখে হাসে।
হাত বাড়িয়ে গাল টেনে দেয়।ফিসফিস করে বললো,
“থাকার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তুমি চুম্বকের মতো টেনে আনলে।আজকে বাসর না বাসরে বউ ছাড়া থাকলে ভুতে ধরে।”
ফিরোজের কথায় শ্যামা হাসে।
“ধরুক।”
“তোমাকে আদর করবে কে তাহলে?”
“আপনি।”
ফিরোজ শ্যামার দীঘির মতো টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি কিন্তু খুব খারাপ শ্যামাপাখি।”
শ্যামা ফিরোজের গা ঘেষে দাঁড়ায়।
“তো।”
ফিরোজ নিমিষেশ তাকিয়ে থাকে।
“কিছু না।”
“আমরা একে অপরের স্বামী স্ত্রী আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“এভাবেই আমরা একে একে সব করে নেবো।তুমি শুধু আমার উপরে ভরসা রেখো।”
“আচ্ছা।”
ফিরোজ বললো,
“মধুরানী কি জানে তার রাজা তাকে কতো ভালোবাসে?”
শ্যামা মাথা দুলায়।শ্যামা ফিরোজের হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজকে জড়িয়ে ধরে।আদুরে,তুলতুলে বিড়ালের মতো ফিরোজের বুকে মিশে যেতে চায়।ফিরোজের ইচ্ছে করে বিড়ালটাকে বুকে পুড়ে নিতে,তাহলে যখন তখন আদর করা যাবে,শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখা যাবে।সে বললো,
“আজকে তো একটু বেশী আদর পাওনা ,আফটারঅল তুমি আমার বউ।”
ফিরোজের মুখে বউ ডাকটা শুনে শ্যামার সারা দেহে অজানা কাঁপন বয়। সে কথা বলে না।
ফিরোজ শ্যামার মুখটা উপরে তুলে অধরের ভাজে অধর মিলিয়ে দেয়।ভালোবাসার মধুর সুধা অধরের ভাজে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে।
কিছুক্ষণ পরে ফিরোজ নিজেই নিজেকে বললো,
“কন্ট্রোল ফিরোজ কন্ট্রোল!”
ফিরোজের কাজে শ্যামা হেসে বললো,
“পাগল।”
ফিরোজ শ্যামার কোমড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে বললো,
“তোমারই তো বর।”
চলবে…..