#মধুমাস
#পর্ব_০৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রোজিনা বেগম টেবিলে বসে আছে।গলায় জোড় লাগিয়ে হাকডাক করে বললো,
“এই বাড়িতে কি বান্দি করে এনেছে নাকি?সব কাজও করবো আবার খাবার নিয়া বসেও থাকবো?পেয়েছে কি আমাকে? ”
তামিম ভার্সিটিতে যাবে।রেডি হয়ে নাস্তা সেড়ে নেয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আস্তে কথা বলোনা আম্মা।ভাইয়া ঘুমাচ্ছে।”
তামিমের কথা শুনে রোজিনা বেগমের মেজাজ আরো তেতে যায়।
“ঘুমাবেনা কি করবে?মাগনা খানা পেলে নাভীতে তেল দিয়ে ঘুমাতে সমস্যা কি?”
মায়ের কথা তামিমের পছন্দ হয় না।মুখে বিরক্তির ছোঁয়া ফুটিয়ে বললো,
“ভাইয়া যা করে সেটাও একটা কাজ।তাছাড়া হোটেলেও তো বসে।”
“হোটেলে বসার দরকার কি?আর তোকেও বলি এসব মাস্টার্স টাস্টার্স করে কি হবে?তোর আব্বা বেঁচে থাকতে হোটেলটাকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আয়,সারাজীবন আর বাঁচার চিন্তা করতে হবে না।”
তামিম অবাক হয়ে বললো,
“হোটেল একা আমার নামে আনবো কেনো? ভাইয়াও এর ভাগিদার।উল্টোপাল্টা কথা বলো না তো।”
রোজিনা বেগম মন খারাপ করে বললো,
“তোরা আমার নিজের সন্তান এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,নিজের ভালোমন্দ আর বুঝলি না।আরে সৎ ভাই কখনো আপন হয় না সুযোগ বুঝে কোপ মা,রবেই;তাই সময় থাকতেই তো সব নিজের করে নিবি।”
“সৎ ভাই সৎ ভাই করবে না।তোমার সৎ হতে পারে কিন্তু আমার রক্তের ভাই।ভাইয়া আমাকে কতো ভালোবাসে তুমি জানো?”
তামিম উঠে যায়।রোজিনা মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো করে বললো,
“এগুলা ভালোবাসা না এগুলা হলো নাটক।সম্পত্তির বোয়াল মাছের কোড় ফিরোজ্জাই নিবো।দেখিস।”
তামিম আর কথা বাড়ায় না।মায়ের এই ব্যাপারটাই তার খারাপ লাগে,সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে ভাইয়ার প্রতি মায়ের এই অবহেলা।সে যখন বুঝতো তখন দেখতো তার মা ফিরোজকে কারনে অকারনেই মা,রে।এরপর ফিরোজ পাল্টে গেলো,নিজেকে গুটিয়ে নিলো নিজের দুনিয়ায় কিন্তু রোজিনা বেগম পাল্টায়নি।উনি সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে।ফিরোজ যতোক্ষণ বাসায় থাকে উনার কথা বলার মাত্রা বেড়ে যায়,সারাক্ষণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলে।
ফিরোজ বিছানায় শুয়ে চুপচাপ সিলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছে।রোজিনা বেগমের চিৎকার চেচামেচির কারণে ঘুম ভেঙে গেছে,আর এটা প্রতিদিনই হয়।রোজিনা বেগমের প্রত্যেকটা কথা কর্ণগোচর হয়েছে।ছোটবেলায় এসব কথা শুনলে মন খারাপ হতো,চুপচাপ কান্না করতো তারপর শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে তার খুব অভিমান হয় যদি তার মায়ের এতো কাহিনী করার ছিলো তাহলে জন্মের সময় সে মা,রা গেলেই পারতো।মা ছাড়া একটা বাচ্চার জীবন যে কতোটা দুর্বিষহ সেটা নিজে উপলব্ধি করা ছাড়া কেউ কখনো বুঝবেনা।রোজিনা বেগম তাকে কম কষ্ট দেয়নি।আগের পুরোনো কথা মনে হলে ফিরোজ ঠিক থাকতে পারবেনা।তার রূপ,ব্যবহার সবই পাল্টে যাবে।সে তো কবেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো কিন্তু একজনের জন্যই যে যেতে পারছেনা আর সেই ব্যক্তিটা হলো;মোহাম্মদ আলী।উনি যে ফিরোজকে কি পরিমান ভালোবাসেন তা ফিরোজ কেনো পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ জানে।ফিরোজের মা চলে যাবার পরে তার আব্বা বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু সংসার সামলে ব্যবসা সামলে পুরুষ মানুষ কুলিয়ে উঠে না।যতোই হোক নারীর মতো করে সংসার সামলানো কি সোজা কথা?তাছাড়া ফিরোজ ছোট তার যত্ন নিতে হয় সবাই পরামর্শ দেয় বিয়ে করার জন্য।অনেক ভেবেচিন্তে উনি রোজিনাকে বিয়ে করে।বিয়ের প্রথম প্রথম কয়দিন ফিরোজকে আদর যত্ন করলেও আস্তে আস্তে পালটে যায়।সৎ ছেলে আপন হয় না ভেবে ফিরোজকে কষ্ট দিতে থাকে।তখন মোহাম্মদ আলী ফিরোজকে আগলে নেয়,পরম মমতায় বুকে নিয়ে রেখেছেন।ফিরোজ তার আব্বাকে ভিষণ ভালোবাসে।ফিরোজ চোখ বন্ধ করে থাকে।তখন ফারিয়া আসে।মিহি গলায় ডাকে,
“ভাইয়া…”
ফিরোজ চোখ খুলে তাকায়।টেনশনের কারনেই কিনা চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।আলগোছে বিছানায় উঠে বসে বোনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে গেলেও থেমে যায়।দরজায় বিড়ালছানার মতো আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মুখে নদীর মতো ঢেউ।তার বোনের উপর খুব রাগ হলো,আরেক জনকে নিয়ে এই সাতসকালে কেউ ভাইয়ের ঘরে আসে?মেয়েটা বড়োই হয়েছে আক্কেল হয়নি।ফিরোজের গলার স্বর গম্ভীর হয়ে যায়।
“কি চাই?”
ফারিয়া শ্যামার হাত ধরে টেনে ভেতরে আনে।ফিসফিস করে বললো,
“আমার ভাই মানে তোর ভাই এতো ভ,য় পেতে হয়?”
শ্যামা থমকে যায়।লজ্জালজ্জা চোখে ফিরোজকে দেখে।কালো ট্রাউজার পড়ে খালি গায়ে বসে আছে।দুধে আলতা গায়ে কালো পশম গুলো নিবিড় ভাবে লেপ্টে আছে।ইশ কি সুন্দর মানুষটা!ফিরোজকে আগে কখনো সে খালি গায়ে দেখেনি।নিপুনভাবে পশম জড়িয়ে আছে।শ্যামার হাত নিশপিশ করে উঠে,একটু ছুঁয়ে দেখতে লোভ হয়।নিজের এমন বেশামাল ইচ্ছায় সে নিজেই লজ্জা পায়,আজকাল ফিরোজকে দেখলে মনের ভেতর যে উত্তাল ঝড় বয় তা যদি ফিরোজ জানতো তাহলে কি হতো?নির্ঘাত আব্বার কাছেই বিচার দিতো।শ্যামা ফারিয়ার কথায় মনে মনে হাসে আর বলে,
“ওরে ফারু রে তোর ভাই যে আমার কোন লেভেলের ভাই লাগে তা যদি জানতি তাহলে আর টেনে ঘরে ঢুকাতি না।”
ভাইয়ের কথায় ফারিয়া মিষ্টি করে হেসে বললো,
“এক হাজার টাকা দিতে পারবে?”
ফিরোজ তীক্ষ্ণ চোখে শ্যামাকে দেখছে।শ্যামার চোখের দৃষ্টি তার বুকে।সে হকচকিয়ে যায়।এতো নিলজ্জ মেয়ে হয়?শ্যামার চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে খাটের পাশের চেয়ার থেকে তোয়ালে টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয়।এই মেয়ের মাথায় নির্ঘাৎ সমস্যা আছে।
“টাকা? কেনো?”
ফারিয়া মাথা দুলিয়ে বাচ্চাদের মতো বললো,
“সব ফ্রেন্ডরা মিলে একটু খাওয়ার আয়োজন করবো।”
“আমি টাকা দিলে কি লাভ আমাকে খাওয়াবি?”
ফারিয়া অতি উৎসাহের সহিত বললো,
“অবশ্যই তুমাকে অগ্রীম দাওয়াত।কালকে দুপুরেই।”
ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়।লম্বা চওড়া পেটানো শরীরে সাদা তোয়ালেটা জড়ানো তাকে দেখতে খুবই আদুরে লাগছে।শ্যামার ইচ্ছে করছে তোয়ালেটার ভিতরে ঢুকে যেতে।লোকটা যে কবে তার হবে?এতো মধুর সমাহার নিয়ে বসলে মধুর দিকে না তাকিয়ে পারা যায়?মধুরাজের মধুরানী হতে বুকে তোলপাড় হয়।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।হাত দিয়ে শক্ত করে ব্যাগ খামচে ধরে।
ফিরোজ ওয়্যারড্রোব থেকে মানিব্যাগ বের করে ফারিয়াকে টাকা দিয়ে বললো,
“যা।”
ফারিয়া হাসিমুখে শ্যামার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বলেছিলাম না ভাইয়া দেবেই তুই খালি খালি ভ,য় পাচ্ছিলি।”
ফারিয়ার কথায় ফিরোজ শ্যামার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়।কফি কালার বোরকা গায়ে টিপটিপ করে তাকেই দেখছে।তার বোনটা আস্ত গাধা।শ্যামা ভ,য় পায় নাকি কি পায় সেটা এখনো বুঝে না।গলার স্বর কর্কশ করে বললো,
“আমার রুমে যাকে তাকে নিয়ে ঢুকবি না।মনে থাকে যেনো।”
ফিরোজের কথাটা শ্যামার বুকে কাটার মতো বিধে।সরাসরি না বললেও সুক্ষ্ম অপমানে গা নেতিয়ে যায়।না চাইতেও চোখের কোলে চিকচিক করা পানির দেখা মিলে।চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ফেলে নিজেকে সামলায়।ফারিয়া কিছু বলার আগে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ফারিয়া শ্যামার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“শ্যামা কথাটায় মাইন্ড করেছে।”
ফিরোজের এসবে পাত্তা নেই।কোনো আকর্ষন কিংবা টান সে কোনো মেয়ের প্রতিই অনুভব করে না।সে গম্ভীর গলায় বললো,
“মাইন্ড করলে আমার কি?যা বলেছি মনে রাখিস।”
শ্যামা কাঁদছে।অন্যকারো কথাও এতো আঘাত লাগেনা যতোটা না প্রিয় মানুষের কথায় লাগে।প্রিয় মানুষের করা সামান্য কথাও বুকে যে কি পরিমাণ আঘাত করে তা বলা মুশকিল।ফিরোজের এমন কথায় শ্যামার খারাপ লেগেছে।লোকটা বোধহয় বুঝে শ্যামার দুর্বলতা তাইতো এমন করে।ফারিয়া আসার আগে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।ফারিয়া আসলে দুজন পাশাপাশি হাটে।ফারিয়া কিছুক্ষণ পরে বললো,
“ভাইয়ের কথায় কিছু মনে করিস না।”
শ্যামা হেসে বললো,
“তোর ভাইয়ের কথায় মনে করার কি আছে।গাধা।”
ফারিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
“গাধা!কে?আমি নাকি আমার ভাই?”
“তোর ভাই।”
“আমার ভাই কি করলো?”
“কেমন করে কথা বলে,এই তোর ভাইয়ের ভাব বেশী তাই না?”
শ্যামার কথায় ফারিয়া খিলখিল করে হাসে।
“আমার ভাই দেখতে ঠিক রাজকুমারের মতো তো আমার ভাইয়ের ভাব হবে না ভাব কার হবে শুনি?হিরো আলমের?”
ফারিয়ার কথা শুনে শ্যামা কিছু বলেনা।সে নিজেও এটা মানে যে ফিরোজ খুবই সুন্দর।তার চোখে কোনো কমতি ধরা পড়ে না।শুধু একটাই সমস্যা খুব গম্ভীর আর পাথরকঠিন মন।
এর পরের দিন দুপুরে ফারিয়া উপজেলায় আসে হাতে খাবারের প্যাকেট।ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে বললো,
“তোমার জন্য এনেছি ঝটপট খেয়ে নাও।”
ফিরোজ হাসিমুখে খাবার হাতে নেয়।বোনের দিকে পানির বোতল দেখিয়ে বললো,
“পাশের রুমে ফিল্টার আছে পানি নিয়ে আয়।”
ফারিয়া পানি আনতে গেলে ফিরোজ খেয়াল করলো দরজায় শ্যামা দাঁড়িয়ে।আজকে সামনে আসছে না।ফিরোজ গলার শব্দ উঁচু করে ডাকলো,
“শ্যামা…”
ফিরোজের কালকের অপমান এখনো শ্যামার মনে দাগ কেটে আছে।তাইতো সে ভেতরে যায়নি।এই লোককে ভুলতে পারলে মসজিদে পাঁচশো টাকা দেবে বলে নিয়ত করেছে কিন্তু পাগল মন এই নিয়তের বিপক্ষে সে চায় ফিরোজের সঙ্গ।হঠাৎ ফিরোজের কন্ঠ শুনে শ্যামা চমকে যায়।উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে তাকায়।ফিরোজ এদিকেই তাকিয়ে আছে।
“জ্বি ভাইয়া।”
“এদিকে আসো তো।”
শ্যামা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় আজকে না চাইতেও মুখের ভাব গম্ভীর।ফিরোজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ফিরোজ বললো,
“খাবারে তাবিজ টাবিজের পানি মিশিয়ে দিয়েছো নাকি?”
শ্যামা অবাক হয়ে ফিরোজের দিকে তাকায়।
“এসব করবো কেনো?”
“তুমিই ভালো জানো?”
“আপনাকে তাবিজ করে বশে আনতে হবে নাকি?”
“মতলব কি বুঝা যায়?”
“শ্যামা এতোটাও ফেলনা না যে তাবিজ করে…. ”
ফিরোজ কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
“কি?বাকি কথাটা শেষ করো।”
“আপনি বেশী বুঝেন।”
“তুমি চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ মেয়ে।”
শ্যামা অপলক ফিরোজকে দেখে বললো,
“আমি খারাপ? ”
ফিরোজ নিচু গলায় বললো,
“ভালো মেয়েরা ছেলেদের খালি বুকের দিকে তাকায় না।”
“ছেলেরা মেয়েদের সামনে এমন বুক দেখিয়ে রাখলে তাকাবেই।”
“এমন মানে?”
শ্যামা লাজুক হেসে বললো,
“সুন্দর,আদুরে,মধুর মতো।”
ফিরোজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।এটা মেয়ে নাকি অন্যকিছু?এর সব লজ্জা কি গুমতি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে?
চলবে………