#মধুমাস
#পর্ব_০২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শ্যামা মাথা ঘুরিয়ে উপজেলার আশেপাশে তাকায়।চোখে কাউকে দেখার আজন্ম তৃষ্ণা কিন্তু তৃষ্ণা তো মিটছে না আশেপাশে যে মধুমাসের রাজা নেই।হঠাৎ করেই শ্যামার মন ভিষণ খারাপ হয়,হু হু করে বুকটা মুচড়ে উঠে,সবসময় যেখানে ফিরোজের বাইকটা স্টেন করা থাকে আজকে জায়গাটা ফাঁকা;তার নিজেকেও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,অকারনেই চোখ উপচে পানি আসতে চাইছে তখনি সে দেখে তার ভাই আসছে।
শ্যামাকে দেখে রিপন বাইকের গতি কমায়।উপজেলার সামনে একা বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিপনের ভ্রু কুঁচকে যায়।পুরুষের আনাগোনা যেখানে বেশী সেখানে তার বোনের কি কাজ বুঝতে পারে না। গলার স্বর না চাইতেও গম্ভীর হয়ে যায়।
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
রিপনকে দেখে শ্যামা ভ,য় পায়,ভাইকে কি বলবে যুৎসই উত্তর মুখে জোগাড় করতে পারলো না।আমতা আমতা করে বললো,
“ফারিয়া ভেতরে গেছে তাই দাড়িয়েছি।”
রিপন উপজেলার ভেতরের দিকে তাকায়।
“ভেতরে গিয়ে দাঁড়া,রাস্তায় বলদের মতো দাঁড়াতে হবে না,মানুষ খারাপ বলবে।”
শ্যামা আস্তে করে উপজেলার গেইট ডিঙ্গিয়ে ভেতরে যায়।রিপন তখনো গেইট দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে কি করবে বুঝতে পারে না।ফারিয়া যেই রুমে ফিরোজের কাছে যায় সে ফট করে সেই রুমে ঢুকে যায়।বোনকে ফারিয়ার কাছে যেতে দেখে রিপন আর দাঁড়ায় না
বাইক চালিয়ে বাজারের উদেশ্যে চলে যায়।
শ্যামা ভাইয়ের যাওয়ার দিকে লক্ষ করে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে রুমের চারপাশে নজর ভুলাতেই গা জুড়ে বয়ে যায় শীতল বাতাস।একজোড়া শক্ত কঠিন চোখের দৃষ্টি তার উপরেই নিবন্ধ।চেয়ারে হেলান দিয়ে একহাত গালে ভর করে ফিরোজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।শ্যামা এই লোকটাকে ভালোবাসলেও কেনো জানি ভিষণ ভ,য় পায়,উনাকে দেখলে একদিকে যেমন ভালোবাসার ময়ূর নাচে তেমনি ভয়ের ফোয়ারা হু হু করে বয়ে যায়।ফিরোজের এই কঠিন দৃষ্টি দেখে শ্যামা ভ,য় পায়,হালকা হেসে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়।বোকার মতো মাথা দু’দিকে নেড়ে বললো,
“ফিরোজ ভাই….”
ফিরোজ এতোক্ষণ শ্যামার কর্মকাণ্ড দেখেছে।হুট করেই রুমে প্রবেশ করে মেয়েটা কেমন করে তাকে দেখছে।সে সটান দাঁড়িয়ে যায়।শ্যামার কথা শ্যামার মুখে থাকতেই বললো,
“এখানে কি?”
শ্যামা কি উত্তর দেবে?সে কি বলবে ফিরোজকে দেখতে তার বুকে ঝড় বইছিলো তাই এসেছে।নাকি রিপন ভাইয়ের কথা বলবে?শেষমেষ শ্যামা বললো,
“ওই ফারিয়া;ফারিয়াকে খুঁজতে এসেছি।”
ফিরোজ তীক্ষ্ণ চোখে শ্যামাকে পরখ করে বললো,
“ফারিয়া নানাবাড়িতে গেছে।”
শ্যামা জানে সে কথা কিন্তু কোনো অজুহাত দিয়ে তো বাঁচতে হবে।
“অহ;জানতাম না ভাইয়া।”
ফিরোজ মুখের ভাব কঠিন করে বললো,
“ভাইয়াও বলো আবার চোরাচোখেও তাকাও।মতলব কি তোমার?”
ফিরোজের কথায় শ্যামা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।সে তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললো,
“কোনো মতলব নেই।”
ফিরোজ গলার স্বর গম্ভীর করে বললো,
“আমার বয়স কতো জানো?”
শ্যামা জানে কিন্তু কিছু না বলে ফিরোজের দিকে তাকালে
ফিরোজ বললো,
“ত্রিশ।”
যদিও সংখ্যাটা বেশী কিন্তু শ্যামার মাঝে কোনো চমকানোর রেশ দেখা গেলো না।যেনো সে জানতই।আসলেই ফিরোজের বয়স নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। ভালোবাসে এটাই বড়ো কথা,এরমধ্যে বয়স নিয়ে টানাটানি করার কি দরকার?সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।ফিরোজের রাগ হয়।এইটুকু বাচ্চা মেয়ে তার সাথে ভাব নিতে আসে!আশ্চর্যের কথা তো।সে ধমকে উঠে,
“এই!এমন ভাব নিচ্ছো কেনো?”
ফিরোজের ধমকে শ্যামা কেঁপে উঠে।মিনমিন করে বললো,
“আমি যাই,ক্লাস আছে।”
ফিরোজ ক্যাটকেটে গলায় বললো,
“আমার সামনে এসব নাটক ফাটক করতে আসবেনা।আর ভুল করেও আমার দিকে তাকাবেনা।”
শ্যামা ফিরোজের কথায় সম্মতি দিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
“বেশী পেকে গেলে স্বপন কাকাকে বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবো।”
শ্যামা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
ফিরোজ কুটিল গলায় বললো,
“আচ্ছা মানে?তোমার বয়স কতো যে বিয়ে করে নিতেও আপত্তি নেই।”
শ্যামা লাজুক গলায় বললো,
“এখন সতেরো।আর পাঁচ মাস পড়ে আঠারো হবে।”
ফিরোজ রাগে ধমকে বললো,
“বেয়াদব মেয়ে।যাও বেরিয়ে যাও।”
শ্যামা ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“একটা কথা বলি?”
ফিরোজ শ্যামার দিকে তাকায়।শ্যামা বললো,
“আপনি এমন করে কথা বলেন কেনো আমার সাথে?”
“তোমার চোখের দৃষ্টি ভালো না।অসভ্য মেয়ে।”
ফিরোজের এমন কথায় শ্যামা হতভম্ব হয়ে যায়।সে অসভ্য!শ্যামাকে আবারো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিরোজ বললো,
“আজকে তোমার আব্বার কাছে বিচার দেবোই।”
শ্যামা আর কোনো কথা বলেনা।মাথা নিচু করে বেরিয়ে।
যায়।
ফিরোজ শ্যামার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা কি পাগল?ফারিয়া তার সামনেই শ্যামাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে নানাবাড়ি যাচ্ছে অথচ মেয়েটা কি সুন্দর মিথ্যা সাজিয়ে ফেললো।সে বুঝে যে তার জন্য শ্যামা প্রতিদিন অপেক্ষা করে,চুপিচুপি লুকিয়ে একটু দেখে চলে যায়।ফিরোজ শ্যামার চোখের দিকে তাকালে দেখে,নদীর মতো টলটলে দুটি চোখে কি আকুলতা;অথচ এই আকুলতার দিকে তাকিয়েও কেনো জানি ফিরোজের মন নদীর জলে ভিজে না।নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণের কোনো নারীকেই ভালো লাগে না।সব নারীই কালপ্রিট।তার অবিধানে নারী মানেই ছলনাময়ী।
শ্যামার বাবা স্বপন ইসলাম মুরাদনগর ডিয়ার স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক।ভিষণ রাগী আর নিয়মমাফিক যার চলাফেরা।বাঁচতে হলে ভাত খেতে হবে এটা যেমন উনি বিশ্বাস করেন তেমনি বি,এনপি হচ্ছে জনগনের জন্য আদর্শ নেতা এটা শতগুন বেশী বিশ্বাস করেন।যদিও বর্তমানে আ,ওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আছে কিন্তু উনার সমর্থন নড়েনি।ভিষন ভাবে উনি বিএনপির ভক্ত।বিএনপি নিয়ে কেউ বাজে কথা বললেই উনি রেগে যায় শুধু রেগে যায় না তর্কাতর্কি শুরু হয়।পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাত খেতে বসেছেন।কথায় কথায় হঠাৎ উনি বললো,
“মুহাম্মদ আলী ভাই কতো ভালো মানুষ কিন্তু উনার বড়ো ছেলেটা আস্ত বেয়াদব।”
রিপন বললো,
“কে আব্বা?ফিরোজের কথা বলো?”
“হ্যাঁ।রাস্তাঘাটে মুরব্বি চায়না কিছুনা;পাইছে একটা বাইক;ওটায় বসে সিগারেট ফুকতে থাকে।সিগারেট খা ভালো কথা কিন্তু মুরব্বি দেখলে ফেলে দে না হলে লুকিয়ে ফেল।কিন্তু না বেয়াদব ছেলে লুকাবে তো দূরের সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।একটা সালাম অবধি দেয় না।”
ফিরোজের নামে এতো বদনাম শুনে শ্যামা থমকে যায়।প্রিয় মানুষের যতোই দোষ থাকুক না কেনো এসব দোষের কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগবে না।শ্যামারও ভালো লাগছে না।বাবার কথায় রিপন সমর্থন করে বললো,
“ছেলেটা আগে কতো ভালো ছিলো এসব রা,জনীতিতে ঢুকেই উচ্ছন্নে গেলো।”
ছেলের কথায় স্বপন ইসলামের কপালে ভাজ পড়ে।কর্কশ গলায় বললো,
“রাজনীতির দোষ দিচ্ছো কেনো?কতোটুকু জানো রাজনীতি সম্পর্কে?আমার দল কতো ভালো সে ব্যাপারে তোমার ধারনা আছে?ওই ছেলে খারাপ হয়েছে খারাপ দলে চলে।এসব উলটা পালটা দল করলে এমন বেয়াদব হবার কথাই।”
উনার কথায় সবাই চুপ হয়ে যায়।রিপনের স্ত্রী স্বামীর হাতে চাপ দিয়ে চুপ থাকতে বলে,শশুড়মশাই রেগে গেলে সমস্যা।রিপন আর কথা বাড়ায় না,এসব রাজনীতি নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু ফিরোজের চলাফেরা আসলেই উগ্র।শ্যামার মা ফাতেমা বেগম বললো,
“পরের কথা নিয়ে ঘরে এতো কথার কোনো মানে হয় না।যার ইচ্ছা যে সেভাবেই চলুক,আমরা তো আর মেয়ে বিয়ে দিচ্ছিনা।”
স্বপন ইসলাম মেয়ের দিকে তাকান তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“এমন পাত্রে মেয়ে দিতে হলে মেয়েকে ঘরের খুটি বানিয়ে রাখবো,তবুও বেয়াদবকে জামাই বানাবো না।”
শ্যামার বুকে তার আব্বার কথাটা খট করে লাগে।মন খারাপের কালো মেঘে ছেয়ে যায় মনের দেয়াল।বুকের মন টিপটিপ করে জানান দেয় কোনোদিকেই তার রাস্তা নেই।প্রেমিকপুরুষ তো বুঝেই না তার উপর এই কঠিন ফ্যামিলি।মিলন হবে কিভাবে?
রবিবার সকাল সাতটায় ফারিয়া আর শ্যামা আইসিটি প্রাইভেট পড়ে।কলেজের শিক্ষকের কাছে পড়ে বিধায় দুই বান্ধুবি কলেজ পাড়ায় যাচ্ছে।বাগদাদ হোটেলের সামনে গিয়ে ফারিয়া থামে।শ্যামাকে বলে,
“কাল রাতেও কিছু খাইনি এখনো না খেয়েই এসেছি।চল নাস্তা করে যাই।”
শ্যামা মাত্রই রুটি আর আলুভাজি খেয়ে এসেছে তার একদমই খিদে নেই কিন্তু হোটেলের দিকে তাকিয়ে পেটের খিটা মিটানোর স্বাধ না হলেও হৃদয়ের খাবার ঠিকি পেয়ে যায়।কাউন্টারে ফিরোজ হেলান দিয়ে বসে আছে।চোখের দৃষ্টি মোবাইলে নিবদ্ধ।শ্যামা মন ভরে দেখে।ইশ ছেলেটাকে এত্তো ভালো লাগে কেনো?ফারিয়া কাছে গিয়ে বললো,
“বাব্বাহ আজকে চাঁদ কি দিনেও উঠলো নাকি?”
বোনের কণ্ঠ শুনে ফিরোজ সামনে তাকায়।মিষ্টি করে হেসে বললো,
“আপনি!আপনার আগমনে আমার হোটেল ধন্য আপুমনি।কি খাবেন বলুন।”
ফারিয়া ফিকফিক করে হেসে দেয় শ্যামার হাতে কনুই দ্বারা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“দেখ আমার ভাই কতো মিষ্টি করে কথা বলে,তুই খালি খালি সবসময় পাথর বলিস।”
ফিরোজ এতোক্ষণে খেয়াল করে শুধু তার বোন একা না পাশে শ্যামাও দাঁড়িয়ে আছে।শুধু দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে তাকে গোগ্রাসে গিলছে।মেয়েটা এতো কথার পরেও এতো নিলজ্জ কিভাবে হয়?সে গলার স্বর গম্ভীর করে বললো,
“যা গিয়ে বোস।”
ফারিয়া হেলেদুলে একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসে।শ্যামার দিকে তাকিয়ে ফিরোজ চোখ পাকিয়ে বললো,
“রড দিয়ে চোখগুলো তুলে ফেলবো।”
শ্যামা আস্তে করে বললো,
“তুলে আপনার মনে লাগাইয়েন প্লিজ।”
শ্যামার কথায় ফিরোজ হতভম্ব হয়ে যায়।মেয়েটা নির্ঘাত আস্ত একটা পাগল আর তাকেও পাগল বানানোর পায়তারা করছে।হোটেলে আছে বিধায় কথা বাড়ালো না।সে বিরবির করে বললো,
“অসভ্য।”
ফিরোজের নরম কণ্ঠ শুনেই কিনা শ্যামার আজকে একটু কম ভ,য় লাগছে।সাহস করে মাথা নেড়ে সায় দেয়।
“অসভ্য হলে যদি বুড়োর মন গলে তাহলে অসভ্যই সই।”
চলবে….