মধুবালা পর্ব-৫+৬

0
1398

#মধুবালা [০৫]
#ফারজানা_আক্তার

ছোঁয়াকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে শুভ্র। ছোঁয়া ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে ফেলে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শুভ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে “তোর মতো মধুমালার সাথে যদি হাজার ছেলেও ঘষাঘষি করে তবুও এই শুভ্র জে’লা’স ফিল করবেনা বুঝেছিস।”

কিছুটা সাহস জুগিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে ছোঁয়া বলে “হাতে ব্যাথা লাগছে খুব। প্লিজ ছেড়ে দাও ভাইয়া।”

শুভ্রর রাগ যেনো সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। ছোঁয়ার চোখ বেয়ে অনবরত জল ঝরতেছে। ছোঁয়া বসে আছে খাটের কোণে জড়োসড়ো হয়ে আর শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে একহাত কোমরে এবং আরেক হাত দেওয়ালের সাথে চেপে রেখে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে শুভ্র। শুভ্র চাইনি এতোটা রাগ দেখাতে ছোঁয়ার সাথে কিন্তু কিভাবে কি হয়ে গেলো সে বুঝতে পারেনি। আঁড়চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকাতেই বুকে যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো শুভ্রর। ছোঁয়া হাত ধরে বসে বসে বোবা কান্না কাঁদছে। শুভ্র ঠা’স করে দরজা খুলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। শুভ্র যেতেই ছোঁয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওর ফ্রেন্ড রকিকে কল দিয়ে বলে “দোস্ত একটা সাহায্য করবি?”

“কি করতে হবে বল শুধু। জানটাও হাজির করে দিবো চাইলে তুই।”

“জান দিতে হবেনা। আমি আমার ফেসবুক রিলেশন দিতে চাই। ”

“তো দে। সমস্যা কি?”

“আমি তোর সাথে ট্যাগ করে রিলেশন স্ট্যাটাস দিতে চাই। প্লিজ না করিসনা।”

রকি মুহুর্তেই হ্যাঁ বলে দিলো কিছু না ভেবে কারণ রকি মনে মনে ছোঁয়াকে ভীষণ পছন্দ করে শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট হবে ভেবে কখনো প্রকাশ করেনি সেটা। কিন্তু পর মুহুর্তেই রকির হাস্যজ্জোল মুখে নেমে এলো আমাবস্যা যখন ছোঁয়া বললো এটা ফেক স্ট্যাটাস। তবুও রকি ছোঁয়ার কাছে কিছু প্রকাশ করেনি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কল কেটে দেয়।
*******
ছোঁয়ার ছোট চাচি জায়েদা বেগম একা একা নিজের রুমে বসে আছেন আর ভাবছেন ছোঁয়ার কথা। ছোঁয়াকে দেখলেই কেমন জানি আপন আপন লাগে উনার। বাড়ির অন্যকোনো ছোট সদস্যদের জন্য এমন অনুভূতি হয়নি কখনো যা ছোঁয়ার জন্য হয়।
ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন জায়েদা বেগমের রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে “কড়া করে চা করে এনেছি। বিকালে এই বাড়ি একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায় কারণ সবাই ঘুমায় কিন্তু তুমি কখনোও ঘুমাওনা আর আমারও আজ ঘুম উড়ে গেলো কোথাও জানি তাই একটু বিরক্ত করতে আসলাম তোমায়।”

“আরে আপা বিরক্ত করবেন কেনো? আপনি এসে তো ভালোই করেছেন। বিকালের এই সময়টা ভীষণ বি’ষা’ক্ত ভাবে কাটে আমার সবসময়ই একা একা। জানেন আপা আমি এতক্ষণ ছোঁয়ার কথায় ভাবছিলাম।”

“আচ্ছা! কি ভাবছিলে? ”

“ভাবছিলাম আমার একটা ছেলে থাকলে ছোঁয়া মাকে বউ করে আমার কাছেই রেখে দিতাম। জানেন আপা আপনার ছোট দেবর তো আমাকে বলছিলো ছোঁয়াকে কাগজে কলমে আমরা নিয়ে নিলে ভালো হতো। মেয়েটার প্রতি আপনার ছোট দেবরেরও ভীষণ দূর্বলতা আছে আপা। উনি সবসময়ই ছোঁয়ার কথায় মগ্ন থাকেন। রাতেও ঘুমাতে ঘুমাতে ছোঁয়ার নাম জপে মাঝে মাঝে।”

কথাটা শুনতেই আঁধার ছেঁয়ে গেলেন সেলিনা পারভীনের মুখে। বুকের মাঝে যেনো অজানা ভয় এসে হুট করেই বাসা বেঁধেছে। মুখটা মলিন হয়ে এসেছে। অদ্ভুত রকম কষ্ট উঁকি দিয়েছে বুক পাঁজরে।
সেলিনা পারভীনের এমন অবস্থা দেখে জায়েদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন “ভাবী আপনার কি শরীর খারাপ করছে?”

“নাহ বোন। বিকালে ঘুমাই তো রোজ আজ হঠাৎ ঘুম না হওয়ায় এমন লাগতেছে। চিন্তা করিওনা রাতে ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চা খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। ”

সেলিনা পারভীন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলেন কথাগুলো। কিন্তু জায়েদা বেগমের কেমন জানি একটুখানি সন্দেহ হলো সেলিনা পারভীনের আচরণে। তবুও দুজনের মনের অস্পষ্ট কথা দু’জনেই আঁড়াল করে হাসাহাসি করে সময়টা পার করে দেন।
*******
খাবার টেবিলে লিলির দৃষ্টি যায় ছোঁয়ার হাতে। হাতটা কেমন জানি নিলচে হয়ে আছে। লিলি জিজ্ঞেস করতেই ছোঁয়া কাচুমাচু করা শুরু করে। শুভ্র বসে আছে গম্ভীর হয়ে। লিলির কথা শুনে সবাই-ই জিজ্ঞেস করে একে একে। জায়েদা বেগম আর সেলিনা পারভীন তো প্রায়ই কান্নাই করে ফেলে। এসব দেখে বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন মুখ বাঁকায়। ছোঁয়া কোনোরকম কথা কাটিয়ে দ্রুত খেয়ে রুমে চলে যায়।

ছোঁয়া খাটে আধশোয়া হয়ে শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে ডাটা অন করেই ফেসবুকে গিয়ে রিলেশন স্ট্যাটাস দেয়। তারপর কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করে বাঁকা হেঁসে ফোন রেখে ঘুমিয়ে যায়।
********
ছোঁয়ার ছোট চাচা জীবন মির্জা আর জায়েদা বেগম বসে বসে ছোঁয়াকে নিয়ে কথা বলছেন।
জীবন মির্জা একটু গলা খাখারি দিয়ে বলেন “ছোঁয়াকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় আমার। মেয়েটা সবার সাথে থেকেও যেনো ভীষণ একা। চঞ্চল হলেও মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো সে কারো সাথে শেয়ার করেনা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁ’ড়ে মেয়েটাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। এক টুকরো প্রকৃত সুখ মেঘ থেকে ছি’নি’য়ে এনে দি মেয়েটার হাতে। কিন্তু আমার হাত যে শী’ক’ল দিয়ে বাঁধা। মেয়েটা যে আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে।”

“হুম ঠিক বলেছো তুমি। ছোঁয়া যদি আমার নিজের মেয়ে হতো তবে সত্যি সত্যিই ওকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম দূর অজানাই। এমন পরিবারের ছায়াও ছোঁয়ার উপর পরতে দিতামনা যে পরিবারে এক সদস্যকে একেক চোখে দেখে।”

এভাবে কথা বলতে বলতেই দু’জনে কেঁদে দেয় কিন্তু দু’জনের মনের অবস্থা দুই রকম। এই পরিবারের অনেক কঠিন সত্যি যে জায়েদা বেগমের অজানা এখনো।
*******
মাঝরাতে হঠাৎ ছোঁয়া ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। এক জগ পানি ছোঁয়ার মুখ থেকে সারা শরীরে বৃষ্টির মতো বয়ে গেছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা ছোঁয়া। হালকা হালকা শীত পরছে ইদানীং। এমন গায়ে কাঁ’টা দেওয়ার মতো শীতে এক জগ ঠান্ডা পানিতে ছোঁয়া ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখ উল্টিয়ে সামনে তাকাতেই পুরুষালি অবয়ব কাউকে দেখতে পেয়ে তাকে চিনতে মোটেও ভুল করেনি ছোঁয়া। ছোঁয়া রাগে দুঃখে ফুঁসতে ফুঁসতে দ্রুত উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখ দিয়ে যেনো আ’গু’ন ঝ’ড়’ছে। ছোঁয়া শুভ্রর চোখ দেখেই যেনো ভয়ে কেঁপে উঠে আবার রাগও হচ্ছে শুভ্রর এমন অ’স’ভ্য’তা’র জন্য। ছোঁয়ার গায়ের নীল টি-শার্ট টা ভিজে লেপ্টে রয়েছে শরীরের সাথে। ছোঁয়ার খুব শীত শীত লাগছে তাই সে কাবার্ড খুলে একটা খয়েরি রঙের টি-শার্ট আর কালো রঙের প্লাজু বের করে ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই শুভ্র ছোঁয়ার হাত টান দিয়ে কাপড়গুলো মেঝেতে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে “সাহস হলো কি করে তোর অন্য ছেলের সাথে রিলেশনে যাস? বড্ড বেড়ে গেছিস তুই তাইনা? এই কারণেই ওইদিন ছেলেটা এভাবে তোর হাত ধরেছিলো বুঝতে পারছি সব এবার। আচ্ছা ছেলেটা কি শুধু হাত ধরেছে নাকি রুম ডেটেও গিয়েছিস তোরা? আমি তো একটু ছুঁলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠিস। কোথায় কোথায় টাচ করেছে ছেলেটা বলতো শুনি? নাকি বিয়ের আগেই বাসর সেরে ফেলেছিস?”

শুভ্রর কথা শেষ হতে না হতেই ছোঁয়া গায়ের সব শক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয় ওকে। গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় শুভ্র। অ’গ্নি দৃষ্টিতে ছোঁয়াকে যেনো সে গিলে খাবে। ছোঁয়া নিজেও ভীষণ অবাক। ক্ষো’ভে’র চো’টে ছোঁয়া নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি আর।

“আপনি খারাপ সেটা জানতাম কিন্তু এতোটা জ’ঘ’ন্য তা জানতাম নাহ। হ্যাঁ আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য পাগল ছিলাম একসময় কিন্তু এখন আপনার প্রতি কিংবা আপনাদের ঘরের বউয়ের খান্দানী বালার প্রতি কোনো লোভ নেই আমার। কিভাবে পারলেন আপনি আমার চরিত্রে এতো বড় দাগ লাগাতে? ছিঃ”

“ওহ্ এখন তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম। ছেলেটাকে খুব আপন করে নিয়েছিস নাহ? কয়দিন হয়েছে এই সম্পর্কের?”

“আপনাকে বলা প্রয়োজন মনে করিনা। কে আপনি হ্যাঁ? ভুলে যাবেননা আপনি আমার জেটাতো ভাই নিজের ভাই নও?”

“ওহ্। ঠিক বলেছিস। এক মাসের মধ্যেই আমি বিয়ে করে দেখিয়ে দিবো তোকে, তুই পারলে আমিও পারি।”

কথাটা বলেই হনহন করে বেলকনি দিয়েই বেড়িয়ে গেলো শুভ্র। ছোঁয়া ধপাস করে বসে পরলো নিচে। শুভ্র যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতো খারাপ কথা বলবে ওর চরিত্র নিয়ে তা ছোঁয়ার কল্পনার বাহিরে ছিলো। কিভাবে পারলো শুভ্র এমন বাজে ইঙ্গিতে কথা বলতে? ঘৃ’ণা’য় গা ঘিন ঘিন করছে ছোঁয়ার। শুভ্র চাইলে দরজা দিয়েও যেতে পারতো কিন্তু রা’গে ক্ষো’ভে সে যেখান দিয়ে আসছে সেখান দিয়েই চলে যায়। ছোঁয়া ভাবতে পারছেনা শুভ্র বেলকনির দরজা বারবার কিভাবে খুলে ফেলে।

সব চিন্তা বাদ দিয়ে ছোঁয়া কাপড় চেঞ্জ করে আসে। কিন্তু বিছানা ভিজে যাওয়ায় সে আর বিছানায় না শুইয়ে নিচে বিছানা করে সেখানে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে পরে।

শুভ্র রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় শাওয়ারের নিচে। হঠাৎ কেনো জানি শুভ্রর বুকটা ভীষণ খালি খালি লাগছে। অদ্ভুত রকমের কষ্ট হচ্ছে। শুভ্র বুঝতে পারছেনা হঠাৎ হঠাৎ কি হয়ে যায় ওর। কেনো সে এমন অদ্ভুত আচরণ করে ফেলে ছোঁয়ার সাথে। তবে কি শুভ্র সত্যিই কিছু অনুভব করে ছোঁয়ার জন্য?

এসব ভাবতে ভাবতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে শুভ্র।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#মধুবালা [০৬]
#ফারজানা_আক্তার

শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে ছোঁয়ার প্রাণজুড়ে। নিজের রুমে চুপটি মে’রে মন খারাপ করে বসে আছে ছোঁয়া। শুভ্রর এমন অবস্থার জন্য মনে মনে নিজেকেই দায়ি করছে সে। পুরো রুম জোড়ে পায়চারি করছে। দুই হাতকে একটার সাথে আরেকটা মলামলি করছে শুধু। কিছুই ভালো লাগছেনা এই মুহুর্তে ছোঁয়ার। বুকের ভেতর কেমন অজানা ছটপট করছে শুধু। ছোঁয়ার ইচ্ছে করছে এক ছুটে শুভ্রর রুমে ছুটে যেতে কিন্তু আবার ইগো বাঁধা দেয়। শুভ্র যে রাতে ওর চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলছে তা মনে পরে যাচ্ছে ওর। শুভ্র ছোঁয়া দু’জনেরই জেদ সমান সমান। কেউই কারো থেকে কম নয়।

পিটপিট করে চোখ খুলে শুভ্র। পুরো পরিবার শুভ্রর রুমে উপস্থিত শুধু ছোঁয়া ছাড়া কিন্তু শুভ্রর চোখ যে শুধু ছোঁয়াকেই খুঁজে চলেছে। শুভ্রর অশান্ত মনটা যেনো কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। শুভ্রর জ্ঞান ফিরতেই ওর মা নাজমা বেগম ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মহিলাটার মনটা বড্ড নরম। অল্পতেই উনি ভে’ঙে পরেন। মায়ের এমন আহ্লাদী কান্না দেখে শুভ্র একটু বিরক্ত হয়। কেনো জানি নিজের মায়ের সাথেই শুভ্রর একটা দূরত্ব আছে ছোটবেলা থেকে। জেদ শব্দটা বড্ড ভয়ানক। আর সেই জেদের বসেই শুভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব দ্রুতই সে বিয়ে করবে। আর এই জেদের কারণেই হয়তো আপন মায়ের সাথে তার এতোটা দূরত্ব।

প্রেশার লো হয়ে এবং ঠান্ডা পানিতে প্রায়ই কয়েক ঘন্টা ভিজার কারণেই জ্ঞান হারায় শুভ্র। ডাক্তার বলেছে কিছু একটা নিয়ে ভীষণ চিন্তা করছে শুভ্র অনেকদিন ধরে তাই এমন অবস্থা। সবাই খেয়াল করে শুভ্রর মুখটা মলিন হয়ে আছে, ঠোঁট গুলোও শুকনো, কপালে গোটা গোটা ব্রণ, চোখের নিচে হালকা কালি। ফর্সা চেহারায় এই হালকা কালি যেনো সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

শুভ্রর মা বারংবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে কি নিয়ে সে এতো চিন্তা করছে কিন্তু মায়ের কথাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না শুভ্র। তারপর সবাই সেটা খেয়াল করে একে একে সবাই জিজ্ঞেস করতে থাকে তবুও শুভ্র চুপ থাকে। যখন বেলাল মির্জা একটু উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন তখন শুভ্র গলা খাখারি দিয়ে বলে “বিয়ে করতে চাই আমি।”

সবাই যেনো অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। হা হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। পিনপতন নীরবতা বয়ে গিয়েছে পুরো রুম জুড়ে।
দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কথাটি শুনে ফেলেছে ছোঁয়া। এক দৌড়ে ছাঁদে চলে যায় সে। পাঁজর ভা’ঙা কষ্টে বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো। ছোঁয়া বুঝে উঠতে পারছেনা শুভ্র বিয়ে করলে ওর কেনো এতো কষ্ট লাগছে। ও তো কখনোই শুভ্রকে ভালোবাসেনি। ওর আকর্ষণ তো ছিলো শুধুমাত্র খান্দানী বালা জোড়া। তবুও কেনো কষ্ট হচ্ছে? হয়তো বালা জোড়া অন্য কারো আয়ত্তে চলে যাবে বলে। কিভাবে সহ্য করবে ওর প্রিয় জিনিস অন্যকারো হাত সাজাবে সেটা। এসব ভাবতে ভাবতেই কান্নার ব্যাগ যেনো বেড়ে যায় ছোঁয়ার।
হঠাৎ কারো হাত ছোঁয়ার কাঁধ স্পর্শ করতেই চমকে উঠে ছোঁয়া। পাশ ফিরে দেখে লিলি দাঁড়িয়ে আছে মুখটা মলিন করে। ছোঁয়া চোখের জল মুছে নিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে লিলিকে বলে “চল কলেজের দেরি হয়ে যাবে। আর ১০দিন পর থেকে পরিক্ষা। ”

কথাটা বলেই ছোঁয়া পা বাড়ায় রুমে যেতে কিন্তু লিলির কথা কর্ণকুহর হতেই যেনো আপনা আপনি ছোঁয়ার পা থেমে যায়।
লিলি খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে “কি হলো বল খুব ভালোবাসিস আমার ভাইয়াটাকে তাইনা?”

ছোঁয়া একটা রহস্যময় হাসি দেয়। তারপর পেঁছন থেকে লিলিকে জড়িয়ে ধরে বলে “এতোটাই দূর্বল নয় যে এই ছোঁয়া কোনো ছেলের জন্য নিজের চোখের জল নষ্ট করবে। আমি কেঁদেছি আম্মু আমাকে একটা কসম দিয়েছে সেটার জন্য। ”

“কসম? কিসের কসম দিয়েছে মেজু চাচিম্মু তোকে?”

“ওই যে তোদের বংশের খান্দানী বালা আমি ছুঁলে যে অপবিত্র হয়ে যায় তাই বালা জোড়া আমি যেনো না ছুঁই আর সেটাই কসম করিয়েছে আম্মু আমায়।”

“এভাবে বলছিস কেনো ছোঁয়া? তুইও তো এই বংশেরই মেয়ে।”
একটু নরম কন্ঠে মন খারাপ করে বলে লিলি।

ছোঁয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে “এই ঘরের কে মনে করে সেটা বল তো? দাদি আর বড় আব্বু তো কখনোই আমাকে সেই অনুভূতি দেয়নি যে আমিও এই বংশের অংশ। জানিস মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় আমার।”
***************
আজ থেকে ছোঁয়ার পরিক্ষা শুরু। বাকি সব চিন্তা বাদ দিয়ে ছোঁয়া পড়ালেখা নিয়ে প্রচুর ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। শুভ্র ছোঁয়ার সামনে বসে থাকলে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছোঁয়া চোখ তোলে শুভ্রর দিকে তাকায়না আর এতেই যেনো শুভ্রর বুকটা ছা’র’খা’র হয়ে যায়। একদিন বিকালে ছোঁয়া ছাঁদে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো তখনই ছাঁদে প্রবেশ করে শুভ্র। শুভ্র প্রায়ই অনেকক্ষণ ছোঁয়ার কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছোঁয়া সামান্য ভ্রুক্ষেপও করেনি। ছোঁয়া এমন ভাব ধরেছিলো যেনো সে শুভ্রর উপস্থিতি মোটেও টের পায়নি। সেদিন সারা রাত শুভ্রর আর ঘুম হয়নি।
আর মাত্র পাঁচ টা আছে ছোঁয়ার পরিক্ষা।

শুভ্রর মামাতো বোনের সাথেই শুভ্রর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই শুভ্রর মামাতো বোন টিয়া শুভ্রকে পছন্দ করতো। টিয়ারও পরিক্ষা চলছে তাই আপাতত শুধু কথাবার্তা বলেই রেখে দিয়েছে। শুভ্রর দাদার বাড়ি চট্টগ্রাম হলেও শুভ্রর নানার বাড়ি ঢাকা তাই পরিক্ষা শেষে টিয়া রা পুরো পরিবার চট্টগ্রামে চলে আসবে এবং টিয়া আর শুভ্রর বিয়ে পর্যন্ত থাকবেন সবাই।

আজ ছোঁয়া খুব তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছে পরিক্ষার হলে যাওয়ার জন্য। কলেজ গিয়ে ছোঁয়ার কিছু কাজ আছে বলে। তাই সে লিলিকে বলেছে আজ শুভ্রর সাথেই যেতে ওকে। লিলিও আর কিছু বললোনা।
শুভ্র লিলিকে ড্রপ করে দিয়ে গাড়ি সার্ট দিবে তখনই লক্ষ করে কিছুটা দূরে ছোঁয়া রকির সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে আবার কিছুক্ষণ পর পর হাসতে হাসতে ছোঁয়া রকির বুকে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। এসব দেখেই শুভ্রর ভেতরটা যেনো দু’ম’রে মু’চ’ড়ে যাচ্ছে।
শুভ্র আর সময় নষ্ট না করেই চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র চলে গেলেই ছোঁয়া সেদিকে আঁড়চোখে চেয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয়।

লিলি কলেজের সদর দরজায় প্রবেশ করতেই একটা পুরুষালি শরীরের সাথে ধা’ক্কা খেয়ে ধপাশ করে নিচে পরে গেলো কিন্তু ছেলেটা সোজা খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সানগ্লাসটা একটু ঠিক করে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দেয় লিলির দিকে। লিলি তখনও হা হয়ে অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে।
হঠাৎ কোথায় থেকে ছোঁয়া দৌড়ে এসে লিলিকে নিচে থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে ছেলেটাকে ব’ক’তে শুরু করে দিলো।

“এই যে মিস্টার আপনি কী অন্ধ? চোখে দেখেননা? চোখ তো চারটা লাগিয়ে রেখেছেন তবুও কি চোখের সামনে এতো বড় মানুষটাকে লক্ষ করতে পারেননি?

এখন এভাবে হা হয়ে আছেন কেনো? দেখতে তো একদম ছ্যাঁচড়া লাগতেছে তাও এতো এটিটিউড কিসের হ্যাঁ?

দেখ বেটা ব্যাটখায় চাই রইছে। এই যে আপনি কি বোবা?
কেমনডা লাগে কোনো রেসস্পন্স-ই করেনা। এই লিলি চলতো। সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ করে দিলো।”

এটা বলেই চলে গেলো ছোঁয়া আর লিলি। লিলিকে ছোঁয়া যেনো একপ্রকার টেনে টেনেই নিয়ে গেলো। লিলি তবুও বারংবার পেঁছন ফিরে দেখে গিয়েছে সেই সুদর্শন পুরুষকে যতক্ষণ দৃষ্টির সীমানায় ছিলো। ছোঁয়ার কপালে যেনো বিরক্তির রেখা।

ছোঁয়া লিলি চলে গেছে। আর দেখা যাচ্ছে না তাদেরকে। আলিফ আহমেদ নামের ছেলেটা যেনো বিরক্ত হলো ওদের চলে যাওয়াতে। আলিফ এতোক্ষণ যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। ছোঁয়ার কথা গুলো ওর কর্ণকুহর হলেও চোখজোড়া আঁটকে গিয়েছিলো সেই রমনির মাঝে যাকে দেখে হৃৎস্পন্দন টা ধুকপুক করে উঠেছিলো কয়েক মুহুর্ত আগে। ঘোর কাটতেই নিজের বোকামির জন্য কিছুটা লজ্জা পাই আলিফ। মুচকি হেঁসে মাথার চুলে হাতে বুলাতে থাকে আলিফ আর মুখে হালকা শব্দে উচ্চারণ করে “অদ্ভুত সুন্দর মেয়ে তুমি। ব্রণ মুখেও বড্ড বেশি মায়াবী লাগছে তোমায়। যদি তুমি আমার হও তবে অন্য কোনো রমনী এই আলিফের দৃষ্টির সীমানাতেও প্রবেশ করবেনা কথা দিলাম। অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেলে মায়াবীনি।”

পরিক্ষা শুরু হতে কয়েক মিনিট আছে। লিলি আর ছোঁয়ার সিট একই কক্ষে পরলেও তাদের সিট একটু দূরে দূরে পরেছে। আলিফ ক্লাসে প্রবেশ করতেই ছোঁয়ার চোখ যেনো বড় বড় হয়ে যায়। মুখে বিরক্তি নিয়ে ছোঁয়া এগিয়ে যায় আলিফের দিকে তারপর যা নয় তা বলতে শুরু করে ওকে সাথে রাগে ফুঁসছেও।
ক্লাসের সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লিলি দৌড়ে যায় ছোঁয়ার দিকে। পুরো ক্লাস যেনো থমকে গেছে।
***********
শুভ্রর কোনো হুঁশ নেই। এলোমেলো ভাবে খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে সে। বারংবার শুভ্রর চোখে ভেসে উঠছে ছোঁয়া আর রকির সেই সুখময় মুহুর্তটা। জলে দু-চোখ ভরে গেলো শুভ্রর। শুভ্র গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো আরো। শুভ্র জানেনা ওর গন্তব্য। এক মনে চলছে গাড়ি।
শুভ্র হয়তো এখনো বুঝতে পারছেনা ছোঁয়া ওর বুকের সবটা জোড়ে মিশে গিয়েছে।
সামনে একটা বড় ট্রাক ধেয়ে আসছে কিন্তু এসব কিছুই শুভ্রর ধ্যানে নাই। শুভ্রর চোখে শুধু ছোঁয়া আর রকির দৃশ্য আনাগোনা করছে। এই দৃশ্যে শুভ্রর কেনো এতোটা খারাপ লাগছে তা এখনো শুভ্র পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। অপরদিকে ট্রাকচালকও ম’দ খেয়ে একেবারে হুঁশহীন। ভাগ্যটাও অদ্ভুত। কার জীবন ঘড়ির টিকটিক শব্দ কবে থেমে যাবে তা কেউই টের পায়না আগে থেকে। ভালোবাসা সত্যিই নিষ্ঠুর। সঠিক সময়ে ভালোবাসার মায়নুষকে খাঁচায় বন্দি না করলে উড়ে যেতে সময় লাগেনা।
চারিদিকে লোকজনের ভীড় জমে গিয়েছে। এম্বুলেন্সও ডাকা হয়ে গেছে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে