মধুবালা পর্ব-১+২

0
2464

#মধুবালা [০১]
#ফারজানা_আক্তার

পিরিয়ডের র’ক্তে মাখামাখি ছোঁয়ার সাদা পায়জামা। তলপেটে হালকা ব্যাথা এবং পায়জামা কিছুটা ভেজা অনুভব করতেই বিয়ে বাড়ির এক কোণে গিয়ে একটু সাইডে সবার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া যাতে কেউ এই অপ্রস্তুত অবস্থায় ওকে না দেখে। পুরো বিয়ে বাড়ি জমজমাট। কি করবে বুঝতে পারছেনা ছোঁয়া। অন্যদিকে সব বন্ধু বান্ধব ছোঁয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। আজ ছোঁয়ার বেস্টফ্রেন্ড সাহারার বিয়ে। ছোঁয়া সব বন্ধুদের সাথেই ছিলো হঠাৎ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি অনুভব করে সবার আঁড়ালে লুকালো কারণ ছোঁয়া সাদা পায়জামা পরিধান করেছে এবং সে জানে সাদা পায়জামায় খুব স্পষ্ট ভাবে সব ফুটে উঠবে। ছোঁয়া একবার ভাবলো ওর বান্ধবীদের কল করে ডাকবে কিন্তু আজ সবাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে যাতে তাদের আনন্দে কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে আর এই কারণেই ছোঁয়া চেয়েও কল দিতে পারছেনা। আর ওর বন্ধুরাও একই চিন্তা থেকে ওকে কল করেনি। প্রায়ই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ছোঁয়া বেশ বিরক্ত হয়ে নিজের কপাল নিজেই থা’প্রা’চ্ছে। বিয়ে বাড়ির হৈ হুল্লোড় শুনে ছোঁয়া বুঝতে পারলো বরযাত্রি চলে এসেছে। রা’গে দুঃখে ছোঁয়া প্রায়ই কেঁদে ফেলে। ছোঁয়া আর না পেরে কল দেয় ওর সব বন্ধু বান্ধবীদের কিন্তু কল রিসিভ করেনি কেউ কারণ সবার ফোন সাইলেন্ট আর হাতে ফোন কেউ রাখেনি ছেলে ফ্রেন্ডদের ফোনও মেয়ে ফ্রেন্ড’দের ব্যাগে।

বিয়ে পরানোও শেষ। ছোঁয়া সব লক্ষ করছে আড়াল থেকে। বিয়ে বাড়িতে প্রচুর শব্দ থাকাই ওর গলার স্বর কারো কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। এবার ছোঁয়া সত্যি সত্যিই কেঁদে দিলো। এতো কষ্ট করে বাসা থেকে বালা দুটো চু’রি করে এনেছে অথচ যে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এতো পরিশ্রম সেই বিয়েই কিনা সে এটেন্ড করতে পারলোনা। ছোঁয়ার পেটের ব্যাথাও তিব্র হচ্ছে।

“ছোঁয়া তুই এখানে?”

হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ছোঁয়া ভীষণ রকম ভয় পেয়ে যায়। এটা যে ওর জেটাতো ভাই শুভ্রর কন্ঠ। শুভ্র যদি ওর হাতে এই বালা দেখে তবে এখনই ছিঁনিয়ে নিয়ে নিবে। তাই ছোঁয়া হাত থেকে বালা গুলো খুলে ব্যাগে ভরে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে শুভ্রর দিকে তাকায়। শুভ্র কঠিন কন্ঠে বলে “বালা গুলো আগেই দেখেছি আমি, এতো ঢং করে লুকাতে হবেনা আর। আমার ভবিষ্যৎ বউয়ের বালা চু’রি করে পরতে তোর লজ্জা লাগেনা?” ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে শুভ্র এখানে কি করছে। আর মনে মনে বলে “হুহঁ তোমার ভবিষ্যত বউ তো আমিই হবো।” ছোঁয়ার ভাবনায় ছেদ পরে শুভ্রর চেঁচানিতে। শুভ্র চেঁচিয়ে বলে “এখানে কি করছিস তুই?”

“আমার বান্ধবী সাহারার বিয়ে আজ। তাই সব বন্ধুদের সাথে এসেছি।”

“তাহলে একা একা এই কোণায় এসে মুক্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

“এমনি।”
আমতা আমতা করে বলে ছোঁয়া। ছোঁয়ার মুখ দেখে শুভ্রর মনে হচ্ছে ছোঁয়া কিছু একটা লুকাচ্ছে তাই শুভ্র চোখ রাঙ্গিয়ে বলে “দেখ ছোঁয়া এখানে বন্ধুর বিয়ের বরযাত্রি হয়ে এসেছি, আমি কোনো ঝামেলা করতে চাইনা তাই চুপচাপ বল কি হয়েছে। কি করছিস একা একা সবার আঁড়ালে?”
ছোঁয়া এবার চুপসে যায় একদম। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। শুভ্রকে দেখলেই ছোঁয়ার হার্টবিট দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ছোঁয়া আর কোনো পথ খোলা না পেয়ে শুভ্র কে বলে “ভাইয়া তোমার জ্যাকেট টা আমায় ধার দিবা আজকের জন্য? প্রমিজ করছি সুন্দর করে ধুইয়ে শুকিয়ে আয়রন করে ফেরত দিয়ে দিবো আবার।”

শুভ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বুঝার চেষ্টা করতেছে কি হয়েছে ছোঁয়ার। তারপর আর কিছু না ভেবেই শুভ্র নিজের জ্যাকেট টা খুলে ছোঁয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে কিন্তু ছোঁয়ার অস্বস্তি হবে ভেবে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
শুভ্র চলে গেলে ছোঁয়া জ্যাকেট টা কোমরে বেঁধে নেয় শক্ত করে তারপর খুব ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির কাছে যেতেই দেখে সব বন্ধুবান্ধব গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ছোঁয়াকে দেখতেই সবাই চেঁ’তে গিয়ে অনেক কথা শুনাই ওকে। ছোঁয়া কিছু না বলে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে সবার দেওয়া বকা গিলতেছে। তারপর এক বান্ধবী নিহা কে ইশারা করে বলে সমস্যার কথা, নিহা সব বুঝে বন্ধুদের বলে “সাহারার বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে সবাই ওর কাছে যাও।”
সবাই চলে গেলেও মেয়ে বান্ধবীরা থেকে যায়। বান্ধবী রা সবাই আবারও বকে ওকে ওর সমস্যার কথা ওদের কাউকে না বলার জন্য। আর জ্যাকেটটা কোথায় পেয়েছে তাও জানতে চাই ওরা। ছোঁয়া একটু লজ্জা পেয়ে সবাইকে বলে সবটা। তারপর সবাই এই বিষয়টা নিয়ে অনেক হাসি তামাসাও করে। সবাই-ই জানে ছোঁয়া শুভ্রর বউ হতে চাই খুব করে আর কোন লোভে এতো বউ হওয়ার ইচ্ছে সেটাও জানে।
ছোঁয়া সবাইকে বিদায় দিয়ে একা বাসার দিকে রওনা দেয়। সাথে ড্রাইভার এনেছিলো বলে ছোঁয়াকে আর ড্রাইভ করতে হয়নি কষ্ট করে।
*******
মির্জা বাড়ির আলিশান ড্রয়িংরুমে আজ সভা বসেছে। সবাই উপস্থিত আছে শুধু ছোঁয়া আর শুভ্র ছাড়া। বিকাল ৫টা। ছোঁয়ার জন্যই আজ সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে। ছোঁয়ার বাবারা চার ভাই। শুভ্রর বাবা সবার বড়, ছোঁয়ার বাবা মেজু আর বাকি দু’জন তাদের ছোট। ছোঁয়ারা অনেক কাজিন হলেও চার ভাইয়ের মাঝে শুধু একটাই ছেলে সন্তান শুভ্র আর দুই ভাইয়ের সব মেয়ে। ছোঁয়ার ছোট চাচার ঘরে কোনো সন্তান নেই। অনেক চেষ্টা করেও একটা সন্তান জন্ম দিতে পারেননি এই দম্পতি। ছোঁয়ার ছোট চাচি তাই ছোঁয়াকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন। ছোঁয়াও ছোট চাচির সাথে বেশ ভাব জমায়। ছোঁয়ার দাদা গত হয়েছে অনেক বছর আগে, প্রায়ই ওর ছোট চাচার বিয়ের আগে কিন্তু ওর দাদি আনজুমা খাতুন এখনো জীবিত আছেন। আনজুমা খাতুন খুব ক্ষো’ভ নিয়ে বসে অপেক্ষা করছেন ছোঁয়ার জন্য।

পা টিপে টিপে ঘরের সদর দরজায় পা রাখতেই সবাইকে ড্রয়িংরুমের সোফায় জড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো ছোঁয়া। এই অবস্থায় সবার সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকবে কিভাবে ভাবছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তখনই ছোঁয়ার বড় আব্বু মোঃ বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে দেখে রাগী কন্ঠে বলে উঠে “এইতো আসছে আমাদের মহারানী, আমার একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখা রাজকুমারী।”

বেলাল মির্জার কথায় সবাই সদর দরজায় দৃষ্টি দিতেই ছোঁয়াকে দেখতে পাই। ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন মুখ শুকনো করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন সোফার পাশে। ছোঁয়ার পেঁছন পেঁছন শুভ্রও আসে। কারণ শুভ্র জানে আজকে আবারো বাড়িতে মহাকান্ড ঘটবে। শুভ্রর বাবা মোটেও পছন্দ করেনা ছোঁয়াকে যার কারণ ঘরের সব ছোট সদস্যদের অজানা কিন্তু বড় রা সবাই-ই জানে। ছোঁয়ার ভীষণ মন খারাপ হয় যখন বাড়ির অন্য ছোট সদস্যদের বেলাল মির্জা খুব আদর করেন তখন।
ছেলেকে দেখে বেলাল মির্জা আবারো বললেন “বাহ্ হবু বর বধুর দেখি একসাথেই প্রবেশ ঘটলো। তা একসাথে কোথায় যাওয়া হয়েছে মির্জা বাড়ির খানদানি বালা দুটো চু’রি করে?”
শুভ্র বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে ছোঁয়াকে বললো “রুমে যা তুই, ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর সবার সব প্রশ্নের উত্তর তুই নিজেই দিবি। এবার সত্যি সত্যি তোর একটা শাস্তি হওয়া খুব জরুরি। বারংবার তুই একই ভুল করিস। সামনে পরিক্ষা সেই খেয়াল তোর মোটেও নেই।”
ছোঁয়ার ভীষণ মন খারাপ হলো। বড় ভাইয়ের মতোই শাসন করে শুভ্র সবসময়ই ওকে। বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট লুকিয়ে ছোঁয়া নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। এতোদিনে ছোঁয়া বেশ বুঝতে পেরেছে এই ঘরের হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি সবাই ওকে অপছন্দ করে। কিন্তু দিনশেষে ওর মায়ের একটু অতিরিক্ত আদরে সব মন খারাপ পালিয়ে যায় ছোঁয়ার। ছোঁয়া ফ্রেশ হতে যেতেই শুভ্রর মা নাজমা বেগম ওকে জিজ্ঞেস “শুভ্র তোর জ্যাকেট ছোঁয়ার কোমরে কেনো?”
শুভ্র এবার বেশ বিরক্ত হলো মায়ের প্রতি। একটা মেয়ে হয়েও কিভাবে সবার সামনে ওর মা এমন প্রশ্ন করতে পারলো? যদিও শুভ্র জানে ওর মা ছোঁয়াকে মোটামুটি পছন্দ করে। বাড়ির মেয়েকে তো ফেলে দেওয়া যায়না সেই হিসেবে নাজমা বেগম ছোঁয়াকে সেই সমান ভালোবাসেন সবার মতোই। শুভ্র মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দাদির পাশে গিয়ে সোফায় বসে পরে ধ’প করে। আনজুমা খাতুন নাক-মুখ কুঁচকে শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন “ছোঁয়ার সাথে কোথায় গিয়েছিলি? বিয়ে টিয়ে করার পরিকল্পনা করতেছিস নাকি দাদু ভাই?”
শুভ্রর রাগে মাথা ফে’টে যাচ্ছে। সবাই সব না জেনেই এভাবে অহেতুক প্রশ্ন করে শুভ্রর রাগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই ছোঁয়ার উপর খুব ক্ষেঁ’পে আছে ওর হবু বউয়ের জন্য রাখা খানদানি বালা চু’রি করার দায়ে শুভ্র।
এই বাড়িতে একমাত্র আনজুমা খাতুন আর বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে সহ্য করতে পারেনা মোটেও কিন্তু বাকিরা সবাই ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে।

ছোঁয়া ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সামনে এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে যেনো এই মুহুর্তে সে ১০/১২ টা খু’নে’র আ’সা’মি
এবার ছোঁয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ে মা’র’লো ওর বাবা মান্নান মির্জা।
“বারবার কেনো এভাবে আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করিস তুই ছোঁয়া? তুই কি বুঝিসনা এসব তোর জন্য নয়। এই খান্দানী বালা তে শুধু বাড়ির বউদের অধিকার থাকে। শুভ্র তোর জেটাতো ভাই। আর তোর বড় আব্বু কোনোদিন তোকে শুভ্রর বউয়ের স্থানে মেনে নিবেনা জানিস তুই তবুও সব জেনে এমন পাগলামি কেনো করিস তুই মা। আমি তো প্রমিস করেছি ঠিক এর মতোই আরেক জোড়া বালা তোকে আমি বানিয়ে দিবো, একটু সময় কি দেওয়া যায়না এই অযোগ্য বাপটাকে?”

ছোঁয়ার চক্ষু মাঝে জ্বলজ্বল করছে জল। ছোঁয়া যেনো মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ভেবেও ছোঁয়া কিছু উচ্চারণ করতে পারছেনা মুখ দিয়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#মধুবালা [০২]
#ফারজানা_আক্তার

মাথা নিচু করে ছোঁয়া হাস্যজ্জোল চেহারা করে বলে উঠে “শুভ্র ভাইয়াই তো আমায় বললো ওর সাথে ওর বন্ধুর বিয়েতে যেতে আর বালাগুলোও নিতে বলেছিলো। তাই তো আমি নিলাম।”
কথাটা বলেই ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে আনজুমা খাতুনের হাতে বালা জোড়া দিয়ে একটু থেমে সবার হতবাক হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে “আমি যদি এভাবে বলি কেউই বিশ্বাস করবেনা আমি জানি কারণ এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সবাই খুব মন মেজাজ খারাপ করে বসে আছে দেখে একটু দুষ্টুমি করলাম ক্ষমা করুন বড় আব্বু। আমি আসলে আমার বেস্টফ্রেন্ড সাহারার বিয়েতে গিয়েছিলাম। আম্মু আব্বুকে বলেই গিয়ছিলাম কিন্তু বালা জোড়ার কথা আব্বু আম্মু জানতোনা। সবাই জানে বালা গুলোর প্রতি ভীষণ আকর্ষণ আমার তাই এই সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাইনা। সবাই মিলে যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো আমি তবুও সুযোগ পেলে লকার খুলে বালা দুটো নিতে একটুও ভয় করবোনা। এই বালা গুলোর প্রতি ভীষণ দুর্বল আমি তা হয়তো এতোদিনে সবাই-ই বুঝে গেছে। শুভ্র ভাইয়া আবারো বলছি বিয়ে করে অর্ধাঙ্গিনী রুপে স্বীকার করে নাওনা আমায় প্লিজ।”

প্রায়ই অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ হয়ে ছোঁয়ার কথাগুলো হজম করছে। সবাই খুবই অবাক আজ। ছোঁয়া যে এতো পাগলামি করতে পারে সামান্য দুটো বালার জন্য তা কারোই জানা ছিলোনা। ছোঁয়ার মায়ের অবস্থা খুবই অস্থির। বুকটা দুরুদুরু করছে সেলিনা পারভীনের। কিন্তু ছোঁয়া কথাগুলো শেষ করে হাসিমুখ নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। মান্নান মির্জাও কিছুটা ঘামছে মেয়ের এমন পাগলামোতে।
হুট করে উপস্থিত সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো শুধু মুখ গম্ভীর করে রেখেছে আনজুমা খাতুন আর তার বড় ছেলে বেলাল মির্জা। শুভ্রও মুখ বেশ গম্ভীর করে রেখেছে। সবার মুখের হাসি মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো শুভ্রর কন্ঠস্বর কর্ণকুহর হতেই “তোর মতো মধুবালাকে বিয়ে করার কোনো শখ নেই আমার ছোঁয়া। বিশ্বাস কর বোন তোর এসব পাগলামি দেখতে দেখতে ভীষণ ক্লান্ত আমি আর বিরক্তও খুব। পড়ালেখায় মন দে আর হ্যাঁ দ্বিতীয় বার আর ভুলেও আমার হবু বউয়ের বালা জোড়ার দিকে নজর দিবিনা কখনো। মাথায় রাখিস কথাগুলো।”

এসব বলতে বলতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো শুভ্র। ছোঁয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু সবার মুখে বিষন্নতা ছেয়ে গেলেও ছোঁয়া স্বাভাবিক আছে কারণ ছোঁয়ার যে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে তাই আর গায়ে মাখেনা কারো কটু কথা। বেলাল মির্জা তেঁ’তে কিছু বলতে যাবেন তখনই ছোঁয়া এক ছুটে ওর রুমে চলে যায়। এতে বেলাল মির্জা বেশ অপমানবোধ করেন। আনজুমা খাতুন বালা পেয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন ধীর পায়ে। বাড়ির ছোটদের সবার রুম দু’তলায় হলেও ছোঁয়ার রুম নিচে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে যদিও ছোঁয়ার মনে হাজারো প্রশ্ন তবুও সে কখনো মনখারাপ করেনি।

“এতো অপমান করে সবাই তোকে তবুও তুই এমন করিস কেনো? কেনো বারবার সবাইকে এভাবে সুযোগ দিস কথা শোনানোর?”

ছোঁয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন ঘাটছিলো। সেলিনা পারভীনের কথায় ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বলে “মা জানো তুমি আমার না সবার বকা শুনতে বেশ মজা লাগে।”
সেলিনা পারভীন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে “তুই আমাকে ছুঁয়ে ওয়াদা কর আর কখনো ওই বালা জোড়া ছুঁয়েও দেখবিনা তোর দাদির অনুমতি ছাড়া। ”
সেলিনা পারভীনের কান্না জড়িত কন্ঠ দূর্বল করে দিচ্ছে ছোঁয়াকে। ছোঁয়া সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগছে। প্রায়ই অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ছোঁয়া মাকে কথা দিয়ে দিলো কিন্তু সে বালা দু’টির লোভ কিছুতেই সামলাতে পারেনা। ছোট্ট থেকেই চুঁড়ি পাগলী ছোঁয়া। ছোঁয়ার হাজার ডিজাইনের চুঁড়ি থাকলেও বালা দু’টির ডিজাইন আকৃষ্ট করে ছোঁয়াকে বড্ড বেশি। হঠাৎ করেই মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ছোঁয়া আর মনে মনে শপত করে একদিন দাদি নিজেই ওকে এই বালা জোড়া পরিয়ে দিবে। সেদিন ছোঁয়া মন খুলে হাঁসবে।
*******
দুইদিন পর ছোঁয়া শুভ্রর রুমে এসে উঁকি দেয় কিন্তু দেখেনা কাউকে। ছোঁয়া কাউকে দেখতে না পেয়ে হাত থেকে শুভ্রর জ্যাকেট টা বিছানায় রেখে চলে যেতে নিলেই শুভ্রর কন্ঠস্বর ওকে থামিয়ে দেয়।

“একবার কাউকে কিছু দিলে সেটা ফেরত নেওয়া শুভ্র মির্জার ডিকশনারিতে নেই। নিয়ে যা জ্যাকেট টা তুই।”

“তাহলে বালা জোড়া কেনো নিয়ে নাও বারংবার ছিনিয়ে?”

“কারণ ওই বালা জোড়া তোকে দেওয়া হয়না বরং তুই চু’রি করে পালিয়ে যাস। চু’র’নি একটা।”

“তুমি আমায় চু’র’নি বলতে পারলে শুভ্র ভাইয়া?”

“আর এক সেকেন্ড যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস তবে এর চেয়েও বেশি কিছু বলে ফেলবো। যা এখান থেকে।”

ছোঁয়া আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো জ্যাকেট টা নিয়ে। শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ছোঁয়াকে দেখে কেমন জানি কিছু একটা অনুভব করলো। যেনো নেশা করা ঘ্রাণ। শুভ্র কিছুতেই দূর্বল হতে চাইনা ছোঁয়ার প্রতি তাই ওকে দেখলেই রাগ দেখানোর চেষ্টা করে।

ছোঁয়া কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কপালে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা ব্রণের ভীড় জমেছে। নাকের উপর ব্লাকহ্যাডস। কিন্তু চেহারা টা তো মাশাআল্লাহ তবে কেনো শুভ্র ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেনা? গায়ের রং টাও তো উজ্জ্বল শ্যামলা। শ্যামবতীও বলা যায়। ইস্ কত্ত কিউট আমি আর ওই শুভ্রর বাচ্চা কিনা আমাকেই ইগ্নোর করে।

“নিজের প্রশংসা নিজেকে করতে নেই মধুবালা, নজর লেগে যাবে।”

শুভ্রর ছোট বোন লিলির কথায় মুখ বাঁকিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে ছোঁয়া বলে “চুপি চুপি কারো কথা শোনা কিন্তু ভালোনা। চল কলেজে যাবো। কয়েকদিন পর থেকে ফাইনাল পরিক্ষা। এখন কলেজ মিস করা মোটেও চলবেনা।

লিলি আর ছোঁয়া একই ক্লাসে পড়ে। এবার অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা দিবে দুজন। লিলি পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো হলেও ছোঁয়ার তেমন একটা টান নেই পড়াশোনার প্রতি তবুও লাক ভালো বলে প্রতিবার ভালো নাম্বারে পাশ করে যায় ছোঁয়া।
শুভ্র অফিসে যাওয়ার পথেই দুজনকে কলেজ ড্রপ করে দিয়ে যায়। শুভ্র মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। পরিবার অনেক বুঝিয়েও ওকে ফেমিলি বিজনেসে জয়েন করার জন্য রাজি করতে পারেনি। শুভ্র একমাত্র ছেলে বলে পরিবারের কেউ ওর সাথে তেমন একটা বারাবাড়ি করতে চাইনা তাই ও নিজের মতো চলতে পারে।
ছোঁয়া সবসময়ই শুভ্রর পাশের সিটে বসে। লিলি মিটি মিটি হাসে ছোঁয়ার শুভ্রর দিকে আনমনা হয়ে তাকানোটা কিন্তু ছোঁয়া কখনোই স্বীকার করেনা ও যে শুভ্রকে ভালোবাসে সেটা। ছোঁয়া নিজেও জানেনা বালার প্রেমে নয় শুধু মালিকের প্রেমেও সাঁতার কাটতেছে সে।
*******
রাতে খাবার টেবিলে সবাই নিজের মতো খাওয়ায় ব্যস্ত কিন্তু মন খারাপ ছোঁয়ার। মাকে যে কথা দিয়েছে বালা জোড়ায় কখনো হাত লাগাবেনা সেটা চিন্তা করতে করতেই ছোঁয়া ক্লান্ত। ছোয়ার ছোট চাচি জায়েদা বেগম ওকে বলেন “কি হয়েছে ছোঁয়া। খাচ্ছিস না কেনো?”

ছোট চাচির প্রশ্নের জবাবে ছোঁয়া কি বলবে খুঁজে না পেয়ে বলে “চাচিম্মু একটু খাইয়ে দিবে আমায়?”
ছোঁয়ার এমন আদুরে আবদার কিছুতেই ফেলতে পারবেননা জায়েদা বেগম। এই ছোট্ট ছোট্ট আবদার গুলোর জন্যই তো জায়েদা বেগম ছোঁয়াকে একটু বেশি ভালোবাসেন। ছোঁয়া উনার কাছে থাকলে উনার মনেই হয়না যে উনি নিসন্তান।
এসব আদিখ্যেতা দেখে আনজুমা খাতুন নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেন। সবার নজর এড়ালেও ছোঁয়ার নজর এড়ালোনা। ছোঁয়া একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে সব ভুলে যায়। মুখে রাখে বিশ্ব যোদ্ধ জয়ের হাসি।
*******
সকাল সকাল শুভ্র ঘুম থেকে জেগে আঁতকে উঠে হঠাৎ। ঘুম ভা’ঙ’তে’ই শুভ্র আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে খুব ভালো করে রোজ। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আয়নার সামনে যেতেই শুভ্র হালকা চিৎকার দিয়ে দুই কদম পিঁছিয়ে যায়। শুভ্রর পুরো মুখ জুড়ে লাল লিপস্টিক লাগানো। কেমন এঁকেবেঁকে করে এঁকেছে কেউ বুঝাই যাচ্ছে। এমন মুহুর্তে শুভ্র কাউকে ডাক দিবে তাও পারছেনা কারণ ওর কথা শোনার আগেই সবাই অট্টহাসিতে লেগে যাবে। বেলাল মির্জা গম্ভীর হলেও পরিবারের বাকি সদস্য খুব চঞ্চল তা শুভ্রর জানা আছে বেশ ভালো করে।
মাথায় হাত দিয়ে শুভ্র বসে আছে খাটে। হঠাৎ মাথায় আসলো ছোঁয়ার খেয়াল। এই কাজ যে ছোঁয়া ছাড়া আর কারো করার সাহস হবেনা তা শুভ্র জানে। কিন্তু ছোঁয়া ওর রুমে প্রবেশ করলো কিভাবে? দরজা তো ভেতর থেকে লক করা।

“অপেক্ষা কর মধুবালা। আজ সকাল আমার জন্য যেমন অদ্ভুত তোর আগামী সকাল তার চেয়েও বেশি ভ’য়ং’ক’র হবে। ”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে