#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১২
দারোগা সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার মুখ থমথমে। তিশা আপুও কোন কথা বলছে না। এক কোণে গুটিসুটি মে’রে দাঁড়িয়ে আছে। ফুফু চিন্তিত মুখে ফুফার দিকে তাকাচ্ছে। মতিন বলল, “সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আপনাদের আর কি কথা থাকতে পারে? এভাবে আমাদের সময় নষ্ট করবেন না।”
ফুফা বললেন, “সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার পরও এসব আলাপ আলোচনার দরকার কি? আপনারা এসব এলাউ করছেন কেন?”
দারোগা সাহেব মাথা নাড়ালেন। ভরাট গলায় বললেন, “তিশা কিছু বলতে চায়। সেজন্যই ওকে থানায় আনা হয়েছে। আপনার স্ত্রী আর ফয়সালও এসেছে। এতে আমার কোন হাত নেই। তিশা, তুমি কি বলতে চাও? বলো।”
ফুফার মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফুফুও দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিশা আপু বলল, ” আমার আব্বুকে নানি আপুকে মা’রেনি। উনাকে আমি মে’রেছি।”
দারোগা সাহেব বললেন, “এ কথা বলছ কেন?”
তিশা আপু ঢোক শুকনো ঢোক গিলে বলল, “নানি আপু ফয়সালকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করতেন। সেদিন ফয়সাল আব্বার সাথে মাছ ধরতে গেছিল। এটা নানি আপুর পছন্দ হয়নি। উনি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,” তোর বাবা কোথায় মাছ ধরতে যায় জানিস? না জানলে তোর বাপের থেকে জেনে একটু জানাস তো।”
আমি জানতাম না ওরা কোথায় মাছ ধরতে যায়। সেজন্য আব্বুর থেকে জেনে নানি আপুকে বলেছিলাম। নানি আপু আমাকে নিয়ে ওই জায়গাটা দেখতে গেছিলেন। তারপর,”
দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,” তারপর কি? চুপ করে থাকার কিছু নেই। যা বলতে চাও। সোজাভাবে বলো।”
“ওই জায়গায় যাওয়ার পর নানি আপুর সাথে একটা ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়। তর্কের এক পর্যায়ে আমি উনাকে ধাক্কা মা’রি। নানি আপু কাঁদায় পড়ে যায়। অনেক ডাকাডাকির পরেও ওঠেনি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওঠাতে পারিনি। ওই জায়গায় তেমন লোকজন থাকে না। সাহায্যের জন্যও কাউকে খুঁজে পাইনি। আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাড়াতাড়ি করে নানির নম্বর থেকে আব্বুকে কল দিই। সবকিছু খুলে বলি। আব্বু আমাকে তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে যেতে বলে। কিন্তু আমি রাজি হচ্ছিলাম না। আব্বু বলল- তার কোন বন্ধু এসে নানি আপুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমি যেন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারকে সব বলে রাখি।”
ফুফু ফুফার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি কিছু বলতে চাইছে। ফুফা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। দারোগা সাহেব বললেন, “থামলে কেন? বলো।”
তিশা আপু বলল, “আব্বুর কথামতো আমি হাসপাতালের দিকে যাই। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে পারিনি। তার আগেই ফুফু আর দাদি আমাকে ধরে নিয়ে আসে। আমাকে বলে যে নানি আপু সুস্থ আছে। দুশ্চিন্তা না করতে। আমি নানি আপুকে দেখতে চাইছিলাম কিন্তু আমাকে যেতে দেয়নি। ধরে বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর জানতে পারলাম নানি আপুর খু’নের অপরাধে ফয়সালকে গ্রে’ফ’তার করা হয়েছে। আমি সবকিছু সত্যি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু দাদি বলতে দেয়নি। ফুফু আর দাদি মিলে আমাকে অনেক মা’র’ধ’র করে। ঘরে আটকে রাখে। মা এসবের কিছু জানত না। ওরা মা’কে বলেছিল আমি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়েছি। তাই এমন করছে।”
দারোগা সাহেব মতিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তাড়াতাড়ি যাও। ওরা যেন পালাতে না পরে। আমার মন বলছে ওরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।”
মতিন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ফুফু বলল, “তুই এসব কথা আগে বলিসনি কেন?”
তিশা আপু বলল, “আমি বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। কালকেও না। উল্টো ফয়সালকে চড় মা’র’লে, ওর কোন কথা না শুনে আমাকে নিয়ে ঘরে চলে আসলে। দাদি তোমাকে যা বুঝিয়েছে তুমি তাই বুঝে গেছ। কখনও নিজের মেয়ের কাছে প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করোনি। ফয়সাল আমার ছোট ভাই, শিমুল তালেবের মতোই ভাই মনে করি। ওর সাথে আমার অনৈতিক সম্পর্কের কথা কিভাবে বিশ্বাস করতে পারলে?”
ফুফু সত্যিকার অর্থে নিভে গেছে। কথা বলছে না। আঁচলে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “চুপ করে আছেন কেন? বলুন। আপনার শাশুড়ি আপনাকে কি বলেছিল?”
ফুফু ইতস্তত করে বলল, “মায়ের মৃ’ত্যু, ফয়সালের ধরা পড়া এসবের মধ্যে তিশার ব্যাপারে কিছু ভাবার সময় পাইনি। শাশুড়ি ননদ বলেছিল- তিশা এক ছেলের সাথে পালিয়ে যাচ্ছিল ওরা ধরে নিয়ে এসেছে। আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না বিধায় এসব নিয়ে চিন্তা করতে চাইনি। ওরা সবকিছু দেখেছে। গতকাল ফয়সাল বাড়ি যাওয়ার পর তুলি আমার কাছে এলো। একটা চিঠি দিয়ে বলল -ফয়সাল এই চিঠি তিশাকে লিখেছে৷ চিঠিতে ফয়সাল আর তিশার নাম ছিল। তুলি বলল, ‘ওদের মধ্যে নিয়মিত অনৈতিক যোগাযোগ আছে। তিশার জন্য হলেও ফয়সালকে সরাতে হবে।’ আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু যখন দেখলাম তিশা লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো ফয়সালের ঘরে যাচ্ছে। তখন সবকিছু বিশ্বাস হয়ে গেল। দরজায় কান পেতে শুনলাম- তিশা ফয়সালকে লাইট নিভিয়ে দিতে বলছে। সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল। ফয়সালকে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে তিশাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। তখন তিশা বলল- সে একবার দারোগা সাহেবের সাথে কথা বলতে চায়। ওর আব্বু নাকি খু’ন করেনি। সেজন্যই আজ ওদের নিয়ে থানায় আসলাম।”
ফুফা মাথা নিচু করে সবকিছু শুনছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি এই মুহূর্তে মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে শান্তি পেতেন। দারোগা সাহেব বললেন, “শেষ প্রশ্ন। তিশা তোমার নানি আপুর সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?”
“ফয়সালের লেখা চিঠি নিয়ে। ওটা আমরা মজা করে লিখেছিলাম। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার জন্য। চিঠিটা নিয়ে বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি। সেদিন নানি আপু আমাকে ওই চিঠি নিয়ে কথা শোনাচ্ছিলেন। চরিত্র নিয়ে অনেক বাজে কথা বললেন। আরও কিছু বলেছিলেন যা মুখে আনতে পারছি না। সেগুলো খুবই কুৎসিত ধরনের কথা।”
আপু কাঁদছে। আমার চোখেও পানি চলে এসেছে। মানুষের মনে এতো প্যাঁচ কিভাবে থাকতে পারে? সংসারে অশান্তি লাগিয়ে তারা কি সুখ পায়? আমি না হয় ওদের কিছু না কিন্তু তিশা আপু তো ওদের আপন। তাকে নিয়ে এমন নোংরা খেলা খেলতে একবারও বাঁধলো না? ফুফুই বা কিভাবে এসব বিশ্বাস করে নিতে পারলো? কালকে চ’ড়ের কারণটা আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব বললেন, ” ফয়সালের দাদির মৃ’ত্যু হয়েছে হার্ট-অ্যাটার্কে। এটা যে কারো গভীর ষড়যন্ত্র তা বুঝতে পেরেছি যেদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসলো। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে উনার মৃ’ত্যুর কারণ হার্ট-অ্যাটার্ক। সেদিন থেকে মোশারফ সাহেবের ওপর সন্দেহ তৈরি হয়। এসব পরিকল্পনা উনার তৈরি তার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এতে কার কার হাত আছে তা বোঝা সহজ কাজ ছিল না। মোশারফ সাহেব কিছু স্বীকার করতেন না। এই যেমন উনি তিশার নামটা এড়িয়ে গেছেন। সেদিন তিশা কল দেওয়ার পর উনি অতিদ্রুত পরিকল্পনা সাজালেন। উনার বন্ধু কাম কুকর্মের সাথীকে দিয়ে খু’ন করানোর প্লান করলেন। ফয়সালকে সাথে নিয়ে গিয়ে ওকে ফাঁসিয়ে দিলেন। উনি ভেবেছিলেন ভিডিও দেখিয়ে প্রমাণ করে দিবেন ফয়সাল খু’ন করেছে। আমিও প্রথম দিকে ফয়সালকেই সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ভাবনা বদলাতে শুরু করলো। সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যেদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলো।”
আমি বললাম, “আপনি যখন সবকিছু বুঝে গেছিলেন তাহলে এতদিন নাটক করলেন কেন? সহজেই কে’সটা সমাধান করে দিতেন।”
দারোগা সাহেব তরল হাসি হাসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “একটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই। এমন করলাম।”
ঘন্টা খানেক পর মতিন ফিরে এলো। তার সাথে দু’জন কনস্টেবল তুলি আন্টি আর ছোট দাদিকে ধরে নিয়ে এসেছে। মতিন বলল, “সব গহনাপত্র নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। সময় মতো গিয়ে ধরে ফেলেছি। একটু দেরি হলেই হাতের বাইরে চলে যেত।”
“খুব ভালো। জেলে ঢুকিয়ে দাও। মা আর ভাই-বোন জে’লে পঁচে ম’রুক।
ফুফু মেঝেতে ঢলে পড়লো। একদম পড়ে যায়নি। তিশা আপু তাকে ধরে ফেলেছে। মতিন বলল, ” ফ্যামিলি ড্রামার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।”
হাসপাতালের বিছানায় বসে আছি। ফুফুর জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছেন, ” অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এমনটা হয়েছে।” তিশা আপু ক্রমাগত কাঁদছে। তালেব এসেছে। সে-ও মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক পর ফুফুর জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ভেজা গলায় বলল, “আমার জীবনের পাপের শাস্তি আমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেলাম। বাবা ফয়সাল, আমাকে মাফ করে দিস বাপ। আমাকে মাফ করে দিস। আল্লাহ আমায় দুনিয়ায় ঘোরাচ্ছে কেন? আমায় কেন তুলে নিচ্ছে না?”
ফুফু কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। ভুল বুঝতে পারার পর যে অনুশোচনা হয় তার কাছে দুনিয়ার সব শাস্তি হার মেনে যায়।
মর্গ থেকে দাদির লা’শ নিয়ে এসেছে। লা’শ থেকে কেমন গন্ধ আসছে। কপ্পুর, আতরের গন্ধ ওই গন্ধকে চাপা দিতে পারছে না। আসর বাদ জানাজা হবে। দাদির আত্মীয় স্বজনরা দলবেঁধে আসতে শুরু করেছে। অথচ এতদিন এদের বেশিরভাগ মানুষের দেখা পাওয়া যায়নি। কেউ সামান্য একটা কল দিয়েও খোঁজ নেয়নি। আজ তারা হাতে-হাতে কাজ করছে। বাঁশ কাটছে, ক’ব’র খুঁড়ছে। ম’রা লা’শকে দুনিয়ার ওপর ঘোরানোর নিয়ম নেই। যত দ্রুত সম্ভব তাদের মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিতে হয়। এই কাজে কেউ কৃপণতা করে না। দারোগা সাহেব আর মতিন সাথে এসেছে। বোধহয় জানাজা পড়বেন।
লোকজনের মধ্যে থেকে খানিকটা দূরে চলে গেলাম। কোলাহল ভালো লাগছে না। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!
চলবে