#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৯
আমাকে আর ফুফাকে আলাদা সে’লে রাখা হয়েছে। দু’টো সেল মুখোমুখি। তাকালে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। ফুফা গম্ভীর মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে-মুখে উদভ্রান্ত ভাব। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। বয়স্ক কনস্টেবলটা সে’লের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মোবাইলে কিসব ভিডিও দেখেছে। প্র’তিবাদী কোন কিছু নিশ্চয়ই। কাজী নজরুলের কবিতা শোনা যাচ্ছে। এক গ্লাস পানি পান করলাম। শরীরটা ভালো লাগছে না। গতকাল দুপুরের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি। রাতে দারোগা সাহেব ফল মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন সেসব মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনি। মেঝেতে বসে পড়লাম। একটু ঘুমের প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করলে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগে। ভয়ভয় হয়।
চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি দারোগা সাহেব মতিনকে খুব রাগারাগি করছেন। মতিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ দারোগা সাহেব বললেন, “একজন পুলিশ সদস্য হয়ে কিভাবে এমন সাহস দেখালে? এজন্য তোমার কি শা’স্তি হতে পারে জানা আছে?”
মতিন জড়ানো গলায় বলল, “না স্যার। আমাকে মাফ করে দিন। আমার ছোট ভাইটা হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার বলেছে ওর দু’টো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুণি চিকিৎসা করতে না পারলে ওকে বাঁচানো যাবে না।”
দারোগা সাহেব খানিকটা শান্ত হলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” এরপর যেন কখনও এমন কিছু না দেখি। মনে থাকে যেন।”
মতিন মাটিতে বসে পড়তে পড়তে বলল, “মনে থাকবে স্যার। মনে থাকবে।”
দারোগা সাহেব থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বয়স্ক কনস্টেবলকে কিছু বলে গেলেন। তিনি শুধু মাথা নাড়ালেন। দারোগা সাহেব যাওয়ার পর থেকে থানার পরিবেশ বেশ ঠান্ডা। ফুফা কোন কথা বলছে না। অন্যরাও চুপচাপ। মতিন একটা চেয়ারে বসে আছে। ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বয়স্ক কনস্টেবল হাতের ইশারায় মতিনকে কাছে ডাকলো। নিচু গলায় বলল, “কত পেয়েছিস?”
মতিন বলল, “কি পাবো?”
“তুই আমাকে যতটা বোকা মনে করিস, আমি কিন্তু অতো বোকা না। এই ছেলেটাকে মা’রার জন্য কত টাকা পেয়েছিস? আমাকে চা পানি খেতে তো কিছু দিতে পারতি, কাজটা সহজ হয়ে যেত।”
“আমি কারো কাছ থেকে টাকা পাইনি। বাজে কথা বলবেন না।”
“শোন ছেলে, এতদিন ধরে পুলিশে চাকরি করি। দারোগা সাহেবের সাথে আছি। উনি মাথা নাড়লে আমি সব বুঝে যাই।”
“ভালো কাজ করেন। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।”
মতিন থানা থেকে বেরিয়ে গেল। বয়স্ক কনস্টেবল দেদার হেসে বলল, “কি মোশারফ ভাই? এমন বাচ্চা ছেলেকে দিয়েন কি এসব কাজ হয়? আমাকে তো বলে দেখতে পারতেন। নিরাশ করতাম না আপনাকে।”
হঠাৎই খুব বিশ্রী লাগতে শুরু করল। এই পৃথিবীর কোথাও কি একটু সুন্দর জায়গা নেই? সেখানে মানুষের মনে লোভ থাকবে না, হিংসা থাকবে না। সম্পত্তি পাওয়ার আক্রোশ থাকবে না। ফুফা কড়া চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যেন উনার এই পরিস্থিতির জন্য আমি দায়ী। সুন্দর করে হাসলাম। ফুফা চমকে উঠলেন। সেই চমক দেখতে খুব একটা খারাপ লাগলো না। বরং ভালো লাগলো। খুব ভালো লাগলো।
রাত নয়টার দিকে দারোগা সাহেব এলেন। আমাকে আলাদাভাবে উনার সাথে কথা বলতে নিয়ে যাওয়া হলো। দারোগা সাহেব বললেন, “কেমন আছো ফয়সাল? সব ঠিকঠাক?”
মাথা নাড়ালাম। অস্পষ্ট গলায় বললাম, “জ্বি।”
“তোমাকে একটা কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। খালিচোখে সবাইকে মানুষ মনে হলেও সবাই মানুষ হয় না। থানার মধ্যে কারো দেওয়া কোন খাবার খাবে না। কোন ধরনের গল্পগুজব করবে না।”
“জ্বি মনে থাকবে।”
“আজ রাতে তোমাকে অন্য জে’লে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে আমার এক বন্ধুকে বলে দেবো।”
“কেন পাঠানো হচ্ছে?”
“নিরাপত্তার জন্য। বলা ঠিক না তবুও বলছি। তোমার ফুফা মতিনকে দিয়ে তোমাকে মা”র’তে চেয়েছিল। ষাট হাজার টাকাও দিয়েছে শুনলাম।”
“ওহ!”
“মতিনের ছোট ভাই হাসপাতালে ভর্তি। ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। অসহায় মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে ন’রপি’শা’চরা ব্যবসা করে যায়।”
“এসব আপনি কিভাবে জানলেন? আর ফুফা এত টাকা দিবে কেন?”
“মতিন নিজেই আমাকে বলেছে। লাখ লাখ টাকার সম্পত্তির কাছে ষাট হাজার কোন ব্যাপারই না।”
” মতিন কি বলেছে?”
“মোশারফ সাহেব ওকে টাকা দিয়েছে। তারপর ওই খাবার-দাবার ইত্যাদি। সবকিছু কি আর কাকতালীয় হয়!”
“কি বলছেন বুঝতে পারছি না।”
“মতিন ছেলেটার টাকার প্রয়োজন ছিল। আগেরদিন মোশারফ সাহবকে কথায় কথায় সবকিছু বলে দিয়েছি। তখন উনি ভাবলেন যে মতিনকে দিয়ে তোমাকে মে”রে ফেললে কোন সমস্যা হবে না। সেই অনুযায়ী উনি মতিনকে টাকা দিলেন। মতিন প্রথমে অভাবের তাড়নায় টাকাগুলো নিয়েছিল ঠিকই পরে আমাকে সবকিছু বলে দিয়েছে। তখন আমিই ওকে বলেছিলাম তোমার জন্য খাবার নিয়ে যেতে।”
“আপনি তো চাইলে সোজাভাবেই সবকিছুর সমাধান করতে পারতেন। এভাবে ঘোরানোর কি ছিল?”
” অসৎ লোকের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করাটাও অপরাধ। তোমার ফুফা দোষ করছে তিনি তার দোষের শাস্তি পাবেন। আমরা তো তার সম্পত্তি দখল করতে পারি না।”
“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপরাধ করলে কি সেটা অপরাধ নয়?”
“অবশ্যই অপরাধ। সেজন্যই মতিনকে রাগারাগি করেছিলাম।”
“খাবারে কি বি’ষ ছিল?”
“না, খাবারে বি’ষ ছিল না।”
“তাহলে বিড়াল মা’রা গেল কিভাবে?”
“মতিন দেখেছিল বিড়ালটা খাবার খাচ্ছে। পরে ওটাকে মে’রে ফেলেছে। সেজন্যই ওকে বকাঝকা করছিলাম।”
কি বলবো বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মানুষের প্রাণই কি প্রাণ? অন্য প্রাণীর কি জীবন নেই? দারোগা সাহেব বললেন, “যাও তৈরি হয়ে এসো। তোমাকে অন্য জে’লে দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে।”
“ঠিক আছে।”
থানাটা আমার বাড়িঘর নয়। এখানে তৈরি হওয়ার কিছু নেই। তবুও শেষবারের মতো সেলটা দেখতে এলাম। জায়গাটা কেমন পরিচিত হয়ে গেছে। আপন আপন মনে হয়। তালেব ফুফার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমায় দেখে অল্প হাসলো। সেলের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “কেমন আছিস? তোর চোখ-মুখ শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
“এমনিতেই।”
“আমার ওপর কি রাগ করে আছিস?”
“না, তোর ওপর রাগ করে থাকব কেন?”
“সত্যিই রেগে নেই তো?”
“না।”
“আমি জানি রে তুই নানিআপুকে খু’ন করিসনি। আব্বাও করেনি। আমরা কেউ কিছু করিনি।”
“তালেব তুই যা। ফুফা রাগ করবেন।”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুফা খ্যাক করে উঠলেন। কর্কশ গলায় বললেন, “তুই গেলি ওখান থেকে? বেজন্মারা আপন পর চেনে না। সবই আমার কপাল।”
তালেব মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে গেল। দারোগা সাহেব এসে আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গাড়ির কাছে তালেব দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু বলবে?”
তালেব ইতস্তত করে বলল, “ফয়সালের সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।”
দারোগা সাহেব বললেন, “আচ্ছা বলো।”
“ভাই, তিশা আপু তোকে এই চকলেটগুলো দিতে বলেছিল। নিবি?”
দারোগা সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। তালেব বলল, “আপু না কেমন কেমন হয়ে গেছে। ঠিকমতো কথা বলে না। খায় না। সারাক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।”
“দাদির জন্য কষ্ট পেয়েছে হয়তো।”
“আমরা তো নানিআপুর মুখটাও আর দেখতে পারলাম না। উনাকে কি আর ফেরত দেওয়া হবে না?”
দারোগা সাহেব বললেন, “নিশ্চয়ই। তদন্ত চলছে। কাজ শেষ হলে লা” শ দেওয়া হবে।”
তালেব কেমন যেন কেঁপে উঠল। আমিও উঠলাম। লা’শ কথাটা মানতে পারিনি হয়তো। তালেব চলে গেল। ওর দু-চোখ ভিজে উঠেছে। শার্টের হাতায় চোখ মুছে গাড়িতে উঠে বসলাম। কিছুই ভালো লাগছে না।
সকালে ঘুম ভাঙলো একটা কাকের ডাকে। দাঁড়কাক বোধহয়। কেমন কা কা করে ডাকছে। নতুন জেলের পরিবেশ আলাদা কিছু লাগছে না। মনটা কেমন বি’ষিয়ে আছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। নানান চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা। বেলা নয়টার দিকে দারোগা সাহেব আমাকে নিতে এলেন। খুব জরুরি কোন কাজ আছে।
বহুদিন বাদে নিজের বাড়ির মুখ দেখতে পারলাম। সময়ের হিসাবে খুব বেশি না হলেও এতটুকু সময়কে আমার কাছে কয়েক যুগ মনে হয়েছে। বসার ঘরে সকলে গোল হয়ে বসে আছে। ফুফু আমায় দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলল। ফুফাকেও এখানে আনা হয়েছে। বলতে গেলে সবাই এখানে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “আপনাদের এখানে নিয়ে আসার একটা বিশেষ কারণ আছে। আমাদের মাঝে একজন বিশেষ মানুষ আসতে চলেছে। তার সাথে পরিচয় করার জন্যই এই আয়োজন।”
ফুফু বলল, “যা বলার সোজাভাবে বলুন। আপনার হেয়ালি দেখতে ভালো লাগে না।”
“সোজাভাবেই বলব। পরনারীর সাথে হেয়ালি করতে আমারও ভালো লাগে না। যাইহোক কাজের কথা বলি। মোশারফ সাহেব কি সবকিছু স্বীকার করতে চান?”
ফুফা কিছু বললেন না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। দারোগা সাহেব বললেন, ” মানতেই হবে আপনার মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কাজ করে। এই দ্রুততর মস্তিষ্ককে কি ভালো কাজে লাগাতে পারতেন না?”
ছোট দাদি কঠিন মুখে বললেন, “মস্কারা না করে সোজাভাবে বলুন। আমাদের আরও অনেক কাজ আছে।”
“জ্বি, সোজাভাবেই বলছি।”
দারোগা সাহেব মোবাইল বের করে কাউকে কল দিলেন। সহজ হয়ে বললেন, “মতিন, উনাকে নিয়ে আসো। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বাড়িতেই আসো।”
মিনিট পাঁচেক পর মতিন একজন মানুষকে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকটা হতবাক হয়ে গেছি বলা চলে।
চলবে