ভেনম পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
166

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৬) – শেষ পর্ব

১.
শামসুন্নাহার গম্ভীরমুখে বসেছিল। সেদিনের সেই পুলিশ অফিসার একটু আগে এসেছে। চা নাস্তা দেওয়া হয়েছে। পিংকির নানা একটু বাসার বাইরে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এই পুলিশ অফিসার যেসব বিব্রতকর প্রশ্ন করছে তাতে করে বাসায় কেউ না থাকাটাই ভালো। পিংকি অবশ্য ভেতরের রুমে আছে।

শামসুন্নাহার গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ফারিয়া একটা সময় জড়িয়ে পড়েছিল। এই নিয়ে ওদের দুজনের মাঝে সেই সময় অনেক অশান্তি হয়েছিল। মানুষ তো ভুল করে। আবার নিজেকে শুধরিয়েও নেয়। আমার মেয়ে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল। আমার কাছে ও বার বার অনুতাপ করত কেন অমন করে আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আর গত একটা বছর ফারিয়ার দিক থেকে কোনো ঝামেলাই হয়নি। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু ও হঠাৎ এমন কেন সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ল আমি জানি না। মুরাদ তো কিছু স্বীকার করেনি। কিছু জানলে পিংকি জানতে পারে। বাসায় কিছু না কিছু ঘটেছিল যার জন্য এমন হলো।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা, একটু পিংকিকে ডাকবেন? যাবার আগে একটু কথা বলে যাই। কেসটা নিয়ে আর বিশেষ কিছুই ভাবার নেই।’

শামসুন্নাহার মাথা নাড়ে। তারপর ভেতরে যায়। খানিকবাদে পিংকিকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। পিংকি সালাম দিতেই রাহাত সালাম নিয়ে তাকায়। আজ মেয়েটাকে অনেকটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মানুষ বুঝি ধীরে ধীরে সব শোকই কাটিয়ে ওঠে।

রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার কলেজ কেমন চলছে? সব ঠিকঠাক?’

পিংকি ছোট্ট করে মাথা নাড়ে।

রাহাত এবার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘একটা ছোট্ট ব্যাপার জানার ছিল। আমি ফারিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি যেটা বললেন ফারিয়ার মানসিক অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না যে উনি সুইসাইড করে ফেলতে পারেন। আচ্ছা, ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর একটা মাস নতুন করে কি কিছু হয়েছিল? জানলে আপনাদের দুজনের মধ্যে কেউ জানবেন, বিশেষ করে পিংকি।’

শামসুন্নাহার একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘বলার মতো একটা ঘটনাই ঘটেছিল। আর সেটা হলো ওর ছাদে উঠে পড়ে যাবার ঘটনাটা। আট তলার জারিফ ছেলেটা ওকে দেখেছিল পড়ে যেতে। ও বলছিল ফারিয়া নাকি ছাদের পাঁচিল থেকে বিপদজনকভাবে ঝুলছিল। যে কেউ দেখলে ভাববে সুইসাইড করছিল। কিন্তু ফারিয়ার সাথে পরে আমার কথা হয়েছে। ফারিয়া আমাকে বলেছিল ও নাকি ভাবতেই পারে না যে সেদিন ও ওই কাজ করছিল। আমি ভালো করেই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল কিনা। কিন্তু ও নিজেই কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিল এমন একটা কাজের জন্য। কেমন যেন আনমনে হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। অনেক কিছুই ভুলে যেত।’

পাশ থেকে এবার পিংকি বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, আম্মু সব ভুলে যেত। বাবা ডাক্তার দেখিয়ে আনার পর প্রেসক্রিপশনটাও হারিয়ে ফেলেছিল। বাবা ভীষণ রাগ করেছিল সেদিন। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রেসক্রিপশনটা পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় আম্মু ওটা ফেলে দিয়েছিল। ভাগ্যিস বাবার কাছে প্রেসক্রিপশনের সফটকপি ছিল। সেটা আম্মুকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রেখেছিল। আম্মু আবার আমাকেও পাঠিয়ে রেখেছিল যাতে আর না হারায়।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিন্তু তোমার আব্বু তো আমকে অরিজিনাল প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিল। ফারিয়ার যে মানসিক চিকিৎসা চলছিল সেটা প্রমাণ করতে। হারিয়ে গেলে সেটা আবার কোথা থেকে আসলো? ওটা কি পরে আবার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল?’

পিংকি একটু অবাক হয় তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘না তো, সেরকম কিছু আম্মু আমাকে বলেনি। বরং আম্মু আমাকে নিয়ে ওষুধের দোকানে গিয়ে মোবাইল থেকে প্রেসক্রিপশনের ছবি দেখিয়ে ওষুধ কিনে এনেছিল।’

রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘পিংকি তোমার কাছে প্রেসক্রিপশনটা এখনো আছে হোয়াটসঅ্যাপে?’

পিংকি মোবাইলটা বের করে হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। কিছুক্ষণ স্ক্রল করে, তারপর অবাক গলায় বলে, ‘আরে, আম্মুর পাঠানো মেসেজ থ্রেডটা নেই!!’

রাহাতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এটা নিশ্চয়ই মুরাদের কাজ। তারপর বলে, ‘তুমি তোমার মোবাইলে ডাউনলোড ফোল্ডারে একবার খুঁজে দেখো। ছবিটা ডাউনলোড করা থাকলে ওখানে থাকার কথা। অথবা রিসাইকেল বিনে।’

পিংকি ভ্রু কুঁচকে এবার মোবাইলে ডাউনলোড ফোল্ডার খুলে। একটু খুঁজতেই পেয়ে যায়। মুখে হাসি ফোটে। ছবিটা বের করে বাড়িয়ে ধরে, ‘হ্যাঁ পেয়েছি প্রেসক্রিপশনটা।’

রাহাত আগ্রহের চোখে প্রেসক্রিপশনটা দেখে, তারপর ওর মোবাইল নম্বরটা দিয়ে বলে, ‘আমাকে একটু পাঠাও তো প্রেসক্রিপশনটা।’

পিংকি প্রেসক্রিপশন পাঠাতেই ও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে। কোনো ঝামেলা নাই তো?

সেদিন আর ও বসে না। থানায় যেতে হবে এখুনি। অরিজিনাল প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে এটা মিলিয়ে দেখতে হবে।

ঘন্টাখানেক পর থানায় পৌঁছে ও হাঁক দেয়, ‘হাফিজ, সেদিন মুরাদ যে প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিল ওটা ফারিয়ার সুইসাইডের ফাইল থেকে নিয়ে আসো তো।’

হাফিজ একটু পর প্রেসক্রিপশনটা এনে টেবিলে রাখে, তারপর হেসে বলে, ‘স্যার, আপনি এই সুইসাইডের কেসটা নিয়ে শুধু শুধু বেশি চিন্তা করছেন।’

রাহাত মৃদু হেসে বলে, ‘আজকের পর আর ভাবব না এটা নিয়ে।’

রাহাত এবার মোবাইল খুলে পিংকির পাঠানো প্রেসক্রিপশনের ছবিটা খোলে। তারপর টেবিলে রাখা আসল প্রেসক্রিপশন এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। একই প্রেসক্রিপশন। ওষুধগুলোও একই। নাহ! এক না। একটা ওষুধ ভিন্ন। এটা কী করে হলো??

রাহাত এবার ভালো করে পুরো প্রেসক্রিপশন মেলায়। দুটো প্রেসক্রিপশন একই তারিখের। রোগীর নাম, বয়স সবকিছু হুবহু মিল আছে। শুধু দুই নম্বরে যে ওষুধটা লিখা আছে সেখানে গড়মিল। রাহাত জুম করে দেখতেই ওর চোখ বড়ো হয়ে যায়। পিংকিকে ফারিয়া যে প্রেসক্রিপশনটা ফরওয়ার্ড করে রেখেছিল সেটাতে দুই নম্বর ওষুধটা পাল্টে দেওয়া হয়েছে। কেন??

রাহাত নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তারপর ডাক্তার সুশান্তের নম্বরে ফোন দেয়।

ওপাশে ডাক্তার সাহেব ফোন ধরতেই রাহাত সালাম দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনাকে ফারিয়ার একটা প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাই। একটু দেখে আমাকে কনফার্ম করতে পারবেন এটা কি আপনি দিয়েছিলেন?’

সুশান্ত সম্মতি দিতেই রাহাত ছবিটা পাঠায়। তারপর দমবন্ধ করা দশটা মিনিট কাটে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই প্রেসক্রিপশনে কোনো গন্ডগোল আছে।

শেষ পর্যন্ত ফোনটা আসে। ওপাশ থেকে সুশান্তের উত্তেজিত গলা পাওয়া যায়, ‘এটা তো আমার প্রেসক্রিপশনকে ওভার রাইট করে লেখা হয়েছে। দুই নম্বর ওষুধটা তো আমি লিখিনি। আর এখানে যে ওষুধটা ওভার রাইট করে লিখা হয়েছে সেটা খুবই বিপদজনক এবং ডাবল ডোজে লেখা হয়েছে। রাহাত সাহেব আপনি একটু আমার চেম্বারে আসতে পারবেন। এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে আমার কাছে। ফারিয়া সুইসাইড করেনি ওকে করতে বাধ্য করা হয়েছে।’

রাহাত সোজা হয়ে বসে। টের পায় বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। ও জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমি এখুনি আসছি স্যার।’

ফোন রেখে রাহাত উত্তেজিত গলায় বলে, ‘হাফিজ এখনই গাড়ি বের করো। ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের চেম্বারে যেতে হবে।’

হাফিজ প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যায়। স্যারের এই রূপ ওর চেনা। নিশ্চয়ই কেসে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটেছে। মরা কেসটা কি তবে গতি পেলো?

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের চেম্বারে পৌঁছে যায়। এতক্ষণে সব রোগী চলে গিয়েছে। সুশান্ত সাহেব তার চেম্বারে একাই বসে ছিলেন। রাহাতকে দেখে উঠে দাঁড়ায়, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে ডাক্তার সুশান্তের সঙ্গে রাহাতের কথা হয়। একটা সময় রাহাতের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যেতে থাকে আর ডাক্তার সুশান্তকে দেখে মনে হয় প্রচন্ড হতাশায় ভুগছেন।

২.
বাসাটা একদম ফাঁকা। ইদানীং কেমন ভয় ভয় লাগে এই বাসাতে। মনে হয় ফ্যানের দিকে তাকালেই ফারিয়ার ঝুলন্ত শরীরটা দেখবে। মুরাদ লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। রেডি হতে হবে। সেই পুলিশ অফিসারটা আবার থানায় যেতে বলেছে। কে জানে কেন।

মুরাদ প্রথমে সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে, তারপর আন্ডারওয়্যার পরে প্যান্ট হাতে নেয় পরার জন্য। কী মনে হতে চেয়ারে বসে পড়ে। মাথা নিচু করে বসেই থাকে। একটা শান্তি হয়েছে এখন, ফারিয়ার কথার খোঁচাগুলো আর এখন নেই। এই একটা বছর প্রতিদিন একটা যন্ত্রণায় কাটত।

এমন সময় বাসার কলিংবেল বাজে। মুরাদ উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দু’জন কনস্টেবল আর একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। ওদের চোখে অবাক দৃষ্টি।

আজ সকালেই রাহাত স্যার নির্দেশ দিয়েছেন এই মুরাদ হাসানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে। কিন্তু লোকটা এমন শুধু শার্ট আর আন্ডারওয়্যার পরে বসে আছে কেন? এরও কি মানসিক সমস্যা?

হাফিজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘প্যান্ট পরে নিন। আপনাকে থানায় যেতে হবে।’

মুরাদের হুঁশ ফেরে। আরে তাই তো, ও এমন এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন। ঘুরে দ্রুত পায়ে ভেতরে যায়। তারপর প্যান্ট পরে রেডি হয়ে বাইরে আসে।

হাফিজ ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠে থানার উদ্দেশে রওনা দেয়। আচ্ছা, আজ এরা ওর বাসা পর্যন্ত কেন এল? ও তো নিজেই যাচ্ছিল। কোনো ঝামেলা হলো আবার?

৩.
ছোট একটা কাঠের টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ার। একপাশে রাহাত অন্যপাশে মুরাদ বসে আছে। শেষ দু’বার রাহাতের রুমে বসেছিল ওরা। আজ যে রুমটায় বসেছে এটাতে আলো কম। এই দিনের বেলাতেও একটা বাতি জ্বলছে। রুমটায় ছোট্ট একটা জানালা আছে তা দিয়ে অল্প একটু আলো আসে।

মুরাদের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কোথাও কোনো বড়ো ধরনের ঝামেলা হয়েছে। না হলে আজ হঠাৎ করে এই রুমটায় কেন নিয়ে এলো?

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘মুরাদ সাহেব, আপনি তো একজন ওষুধ বিজ্ঞানী। কোন ওষুধ কিসে কাজ করে আপনি জানেন, তাই না?’

মুরাদ একটু থমকায়। এই পুলিশ অফিসার আসলে কী জানতে চায়? ও মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তা তো জানতেই হয়। এটাই তো আমার কাজ।’

রাহাত হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। আচ্ছা, আপনি তো এটাও জানেন কোন ওষুধের ডোজ কত এবং সেগুলো খেলে কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়?’

মুরাদ মনে মনে সতর্ক হয়। গম্ভীরমুখে বলে, ‘হ্যাঁ, সেটাও জানতে হয়। কেন বলুন তো?’

রাহাত এবার কতগুলো ওষুধ সামনে রাখে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এই ওষুধগুলো আপনার স্ত্রী খেতো। এগুলোর ডোজ কী, আর তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হয় আপনার তো জানা। তাহলে এই ওষুধটা ওনাকে কেন খেতে দিলেন?’

মুরাদ ওষুধটার দিকে তাকায়, তারপর অসহিষ্ণু গলায় বলে, ‘আমি খেতে দেবার কে? ডাক্তার সাহেব যেভাবে প্রেসক্রিপশন করেছেন সেভাবেই ও খেয়েছে। আর এসব ওষুধের কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো জেনে বুঝেই তো ডাক্তার দিয়েছেন।’

রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘ডাক্তার সাহেব জেনে বুঝেই দিয়েছিলেন। আপনি তার মধ্যে একটা ওষুধ চেঞ্জ করে দিয়েছেন। আর যেটা দিয়েছেন সেটা ফারিয়ার জন্য ক্ষতিকর ছিল। এটার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো এই ওষুধ মানুষের সুইসাইড করার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। আর সেটা দিয়েছেন ডাবল ডোজে।’

মুরাদ অবাক হবার ভান করে, ‘আমি! আমি কেন করব। ওষুধ তো ফারিয়াই কিনেছে।’

রাহাত কঠিন গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, ওষুধ ফারিয়াই কিনেছিল। আর সেটা আপনার ষড়যন্ত্রের অংশ। আপনি ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর দিন আসল প্রেসক্রিপশনটা সরিয়ে ফেলেন। তারপর সেই প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে দুই নম্বর যে ওষুধটা ছিল সেই নামটা মুছে আপনি এই ক্ষতিকর ওষুধের নামটা লিখে দেন। আর ফারিয়াকে এই ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপে আপনি পাঠিয়েছিলেন। বেচারী ভেবেছিল ও আসলেই প্রেসক্রিপশনটা হারিয়ে ফেলেছে। এটা যেন আবার হারিয়ে না যায় সেজন্য এটা মেয়েকে দিয়ে রেখেছিল। ভাগ্যিস পিংকির সাথে আমার কথা হয়েছিল। না হলে তো জানতেই পারতাম না যে প্রেসক্রিপশন হারিয়ে গিয়েছিল। আর আপনি সেই সুযোগে একটা ক্ষতিকর ওষুধ যোগ করে নতুন প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন। ওষুধ ফারিয়াই কিনেছে, তার মৃত্যুর পরোয়ানা সে নিজেই লিখেছে। একটা মানুষকে আপনি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আপনি জানতেন এই ওষুধটা ডাবল ডোজে খেলে ওর মাঝে সুইসাইডের প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। সুইসাইডের ব্যাপারটা ওর মাঝে অল্প কিছু হলেও ছিল। এই ওষুধ সেটা আরো বেশি করে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কেন এমন করলেন, বলুন?’

শেষ কথাটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলে রাহাত।

মুরাদ মাথা নিচু করে থাকে। দীর্ঘসময় পর মাথা তুলে, তারপর বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আমি ওষুধ চেঞ্জ করে দিয়েছলাম। আমি জানতাম এতে ওর সুইসাইডের প্রবণতা বাড়বে। যখন ও আমাকে কথায় কথায় সন্দেহ করা শুরু করল তখন খুব রাগ হতো। যে মানুষ নিজে সন্দেহের কাজ করেছে এখন সে-ই উলটো আমাকে কারণে অকারণে সন্দেহ করা শুরু করল। বুঝতে পারতাম ও আসলে একটা হীনমন্যতায় ভুগত। আমাকে ওর মতো দোষী প্রমাণ করতে চাইত৷ আর সেটা না পেয়ে বার বার অমন করত। একটা সময় ব্যাপারটা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেল। তখন আমি একদিন ঠান্ডা মাথায় প্ল্যানটা করি। ওর সন্দেহ আরও বাড়াতে কিছু কাজ করি। সেবার আমি অফিসে কাজের সিলেটে গিয়েছিলাম সাথে তাবাসসুম। বাসায় বলে গিয়েছিলাম আমি একাই যাচ্ছি। পরে সিলেট থেকে ফিরে আসার পর আমার আর তাবাসসুমের কিছু ছবি ওর ইনবক্সে আমি একটা ফেক আইডি থেকে পাঠাই। এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হলো। ওর সন্দেহটা আরও উস্কে দিতে আমি একদিন ইচ্ছে করে আমার একটা সাদা শার্টে লাল দাগ দিয়ে রেখেছিলাম। সেটা দেখে ওর মাথা আরো বেশি করে খারাপ হয়ে গেল। একটা সময় ওর আম্মুকে নিয়ে বোঝালাম যে ওকে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার।

প্রথমটায় রাজি হয়নি, পরে রাজি হলো। তারপর ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর ওর একটা কাজ আমার প্ল্যানকে সফল করতে সাহায্য করেছিল। ওকে একদিন ওষুধ খাবার কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল ফেলে দিয়েছে। তখনই আমি সুযোগটা নেই। আমি আসল প্রেসক্রিপশনটা লুকিয়ে ফেললাম। দোষ দিলাম ও হারিয়ে ফেলেছে। তারপর আমার প্ল্যানমতন ওষুধ পালটে দিলাম। আর সেদিন থেকে অপেক্ষা করতাম কবে ঘটনাটা ঘটবে।

একদিন বিকেল বেলা বাসায় ফিরে জানতে পারলাম ফারিয়া নাকি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল। সেদিন আমি মনে মনে খুব উত্তেজিত ছিলাম। আমার প্ল্যান ঠিকঠাক কাজ করছে।

আমি জানতাম ফারিয়া কিছুদিনের মধ্যেই সুইসাইড করবে। তাই যখন আবার সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করল তখন আলাদা রুমে ঘুমানো শুরু করলাম। তাতে করে ওর মনের ওপর চাপটা বাড়ল। আর শেষ পর্যন্ত ঠিকই ও ভেঙে পড়ল।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে। মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ একটা মানুষকে ও এখন দেখছে। সবার আগে তো মুরাদের চিকিৎসা হবার দরকার ছিল। কী ভয়ংকর একটা সাইকোপ্যাথ!

ও সামনে ঝুঁকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না আপনি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিতেন। এমন মেরে ফেলার প্ল্যান করলেন কী করে?’

মুরাদ শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর আনমনে বলে, ‘আমি ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ও বার বার আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। ক্ষমাও করেছিলাম। কিন্তু এরপর কখনও মন থেকে কাছে টেনে নিতে পারেনি। অথচ ওর আগের জায়গাটা চাচ্ছিল। আর আমি সেটা দিতে পারছিলাম না বলেই ও সন্দেহ করা শুরু করল। একটা সময় মনে হলো ওর একটা শাস্তি হওয়া দরকার। অফিসার আপনি কি মনে করেন, এটা হওয়া উচিত ছিল না?’

রাহাত এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘আপনি ভীষণ ভুল করেছেন। উনি শুধু আপনার স্ত্রী না আপনার সন্তানেরও মা। আপনি সারা জীবন আপনার সন্তানের কাছে একজন ঘৃণিত পিতা হিসেবে পরিচিত হবেন। ফারিয়াকে যদি ভালোইবাসতেন, ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাহলে কাছে টেনে নিতে পারেননি কেন? আপনার উচিত ছিল একজন মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। আপনি একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ। আপনাকে আমি ফারিয়া হত্যা মামলায় গ্রেফতার করছি।’

মুরাদ মাথা নাড়ে, কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসে। তারপর বলে, ‘আমাকে যে এমন করে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষে পরিণত করল তার বিচার হবে না অফিসার?’

মুরাদকে দু’জন কনস্টেবল হাতকড়া পরিয়ে বাইরে নিয়ে যায়। আর রাহাত মন খারাপ করে ভাবতে থাকে, ঠিকঠাক ভালোবাসা না পেলে মানুষ কী ভীষণভাবে বদলে যেতে পারে৷ সন্দেহ, বিশ্বাসভঙ্গ – একজন সাধারণ মানুষকে ভয়ংকর মানুষে পরিণত করতে পারে৷

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১০/০৭/২০২৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে