ভেনম পর্ব-০৪

0
120

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৪)

১.
মোবাইল বাজার শব্দে রাহাতের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কুঁচকে একবার দেখে, ওর সহকারী হাফিজের ফোন। কয়টা বাজে? ফোনটা ধরতে ধরতে একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়, ছয়টা বিয়াল্লিশ। কাল অনেক রাতে থানা থেকে ফিরেছে। ভেবেছিল আজ একটু দেরি করে যাবে। নাহ, এই সাত সকালেই আবার কী হলো?

রাহাত ফোন ধরে বিরক্ত গলায় বলে, ‘হাফিজ, কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?’

ওপাশ থেকে হাফিজ সালাম দিয়ে বলে, ‘স্যার, ইকবাল রোডে একজন মহিলা সুইসাইড করেছে। আমি ফরেনসিক টিমকে খবর পাঠিয়েছি। ওরা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবে। ওরা আসলে তারপর ক্রাইমসিনে রওনা দেব।’

রাহাত উঠে বসে। ইতোমধ্যে ঘুম চলে গেছে। এই থানায় এসেছে বছরখানেক। সুইসাইড কেস যে এর আগে আসেনি তা না। কিন্তু কেন যেন সুইসাইড ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারে না রাহাত। ও চিন্তিত গলায় বলে, ‘বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে, ফরেনসিকের লোক সময়মতো এলেই হয়। আচ্ছা, আমি রেডি হয়ে আসছি।’

ফোনটা রেখে নামতে গিয়েই করবী ওর হাত টেনে ধরে, ‘এই, কই যাচ্ছ? তুমি না কাল বললে দেরি করে অফিস যাবা আজ?’

রাহাত ওর দিকে ঝুঁকে মন খারাপ গলায় বলে, ‘একটা স্যাড নিউজ পেলাম। একজন মহিলা নাকি আত্মহত্যা করেছে। যেতে হবে।’

করবীর চোখ বড়ো হয়ে যায়, ‘কী বলছ! ইশ, এগুলো শুনলে আমার খুব খারাপ লাগে। দেখা যাবে পরিবারের মানুষগুলো হয়তো কথা শোনাত। সইতে না পেরে মরে গেল।’

রাহাত ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি এগুলো নিয়ে ভেব না। ঘুমাও, আমি আজ থানায় গিয়েই নাস্তা করব।’

করবী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে, ‘আরে না। তুমি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হতে হতে আমি নাস্তা বানিয়ে ফেলব।’

রাহাত হাসে। করবী কখনোই ওকে বাসা থেকে না খেয়ে বেরোতে দেবে না। দেখা যায় সারাদিনের মধ্যে সকালের খাবারটাই ঠিকমতো বাসায় খাওয়া হয়।

আধাঘন্টার মধ্যে রাহাত বেরিয়ে পড়ে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ অন্ধকার। কেমন মন খারাপ করা আবহাওয়া। রাহাত গাড়িতে উঠে মনে মনে গুছিয়ে নেয় কী কী করতে হবে।

ঘন্টাখানেক পর পুলিশের পুরো টিমটা যখন ইকবাল রোডের সেই বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় ততক্ষণে ঘড়িতে আটটা চল্লিশ বেজে গেছে। মানুষজন সব অফিসের দিকে ছুটছে। ফরেনসিক টিমের অফিসার নাজমুল এসেছে। ওর কাজ খুব নিখুঁত।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান ইদ্রিস সালাম দেয়, তারপর ভীত গলায় বলে, ‘স্যার, লিফটের পাঁচে। ভয়ংকর ঘটনা। ফ্যানের লগে ফাঁস দিছে।’

রাহাত কড়া চোখে তাকাতেই লোকটা মিইয়ে যায়। পুরো টিমটা নিয়ে লিফটে উঠে পাঁচতলায় নামে। প্রতি ফ্লোরে একটাই ইউনিট। দরজা খোলাই ছিল। ভেতর থেকে করুণ সুরে কেউ একজন বিলাপ করছে। আর কৌতুহলী মানুষজন বাসায় ঢোকার মুখে জটলা পাকিয়ে আছে।

রাহাত প্রথমেই এদের সবাইকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়, ‘হাফিজ, শুধু কাছের মানুষ ছাড়া সবাইকে বের করে দাও।’

পুলিশ দেখে এবার সবাই সরে দাঁড়ায়। রাহাত ভেতরে ঢুকতেই একজন মাঝবয়েসী লোক এসে সালাম দেয়, ‘আমি মুরাদ হাসান। আপনাদের আমিই ফোন দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী ফারিয়া কাল ভোর রাতের দিকে ডাইনিং রুমে সুইসাইড করেছে।’

রাহাত লোকটার দিকে তাকায়। মাথার চুল অবিন্যস্ত, চোখেমুখে রাত জাগার ক্লান্তি। একটা নীল ট্রাউজার সাথে সাদ টি-শার্ট পরা। লম্বায় কত হবে? পাঁচ ফুট সাত-আট। হ্যাংলা পাতলা গড়ন।

রাহাত মাথা নেড়ে ডাইনিংয়ের দিকে এগোয়। এসব বাসায় যেমন থাকে, একপাশে বসবার ঘর আরেকপাশে খোলা জায়গায় ডাইনিং টেবিল। রাহাত সিলিংয়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গলায় শাড়ি প্যাঁচানো, সিলিং ফ্যান থেকে নিথর দেহটা ঝুলছে। চোখ নামিয়ে নেয় রাহাত। হঠাৎ করেই করবীর কথা মনে হয়। মেয়েরা যখন এমন করে মরে যায় তখন তার পেছনে অনেকদিনের মানসিক কষ্ট থাকে।

রাহাত ফরেনসিক টিমের অফিসার নাজমুলকে উদ্দেশ করে বলে, ‘তোমাদের কাজ শুরু করে দাও। যদিও তোমাকে বলার কিছু নাই, তারপরও ভাল করে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিও।’

রাহাত এবার মুরাদের দিকে ফিরে, ‘আপনিই প্রথম দেখেছেন?’

মুরাদ মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘রাত তিনটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ডাইনিংয়ে আসতেই দেখি এই দৃশ্য।’

রাহাত গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘বাসায় আর কে কে ছিল রাতে?’

মুরাদ মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি আর আমার মেয়ে পিংকি। ও কলেজে পড়ে। রাত এগারোটার দিকে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ওই রুমটায় ঘুমিয়ে ছিলাম।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কাল ঘুমাননি?’

মুরাদ মাথা নিচু করে বলে, ‘কয়েকদিন যাবত মনোমালিন্য চলছিল। তাই আলাদা ঘুমোতে হচ্ছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তার মানে হাজব্যান্ডের উপর রাগ করেই এই আত্মহত্যা। কিন্তু মেয়েটা নিজের বেডরুমে আত্মহত্যা না করে ডাইনিং-য়ে এসে আত্মহত্যা করল কেন?

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘উনি কাল রাতে কোন রুমে ঘুমিয়েছিলেন?’

মুরাদ হাত তুলে দেখায়, ‘ওই রুমটায়।’

রাহাত গম্ভীরমুখে ফারিয়ার বেডরুমে ঢোকে। একপাশে একটা ডাবল খাট। আরেকপাশে বড়ো একটা ওয়ারড্রব। রাহাত সিলিংয়ের দিকে তাকায়, ফ্যানটা খাটের মাঝামাঝি উপরে সিলিং-য়ে। ফারিয়া যদি সুইসাইডই করতে চায় তাহলে নিজের বেডরুমেই করার কথা। নাহ, এটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে।

রাহাত এবার ডাইনিং টেবিলের কাছে যায়। কাচের টেবিল। এটাতে উঠেই শাড়ি বেঁধেছে। একটা ছোট প্লাস্টিকের টুল নিচে পড়ে আছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই টেবিলের উপর টুল নিয়ে তারপর শাড়িটা বেঁধেছিল। তারপর শেষ মুহুর্তে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টুলটা ফেলে দিয়েছে। আর সেই শব্দেই মুরাদের ঘুম ভেঙেছিল। এটা একটা সহজ ব্যাখ্যা। কিন্তু ব্যাপারটা যদি মার্ডার হয়? কথাটা ভাবতেই এবার ভালো করে ও পুরো ডাইনিং রুম, শোবার ঘর ভালো করে দেখে। অস্বাভাবিক কোনো কিছু চোখে পড়ে না।

ভেতরের দিকে বেডরুমে আত্মীয়স্বজন সবাই জড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছে। এমন সময় একজন বয়স্ক মহিলা আহাজারি করতে করতে বাসার ভেতর ঢোকে। মুরাদ এগিয়ে গিয়ে কান্না কান্না গলায় বলে, ‘আম্মা, ফারিয়া নেই।’

মুরাদ ওনাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে যায়।

কাউকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানা যায় ভদ্রমহিলার নাম মনোয়ারা, মুরাদের মা, যিনি বড়ো ছেলের বাসায় থাকেন।

দুপুরের দিকে লাশ নামিয়ে যখন ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয় তখন মেয়ের বাবা আরিফুল হক আকুল গলায় বলে, ‘অফিসার, আমার মেয়ের ময়নাতদন্তের দরকার নেই। লাশটা দিয়ে দিন। আমরা চাই না কাটাকুটি হোক।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকায়। তারপর বলে, ‘আপনার মেয়েকে খুন করা হয়েও তো থাকতে পারে? আর সেটা জানার জন্যে হলেও আপনার উচিত ময়নাতদন্ত চাওয়া।’

আরিফুল হক বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘আসলে ও অনেকদিন ধরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল। তার চিকিৎসাও চলছিল। পনের বিশ দিন আগে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তাই বলছি এখানে কোনো খুনের ঘটনা ঘটেনি। আর মুরাদ ফারিয়া আপন খালাতো ভাইবোন ছিল।’

রাহাত থমকায়। ফারিয়া নামের মেয়েটার মানসিক সমস্যা ছিল?

এই সময় ভেতর থেকে একজন মোটাসোটা বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে আসে। চিৎকার করতে করতে বলে, ‘ওই মুরাদ আমার মেয়েরে মেরে ফেলেছে। ও আত্মহত্যা করার কথা না। অফিসার ওই মুরাদকে ধরে নিয়ে যান।’

আরিফুল এবার ধমক দেয়, ‘তুমি চুপ করো। এক ঝামেলার মধ্যে আরেক ঝামেলা পাকিও না।’

শামসুন্নাহার হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো বলে, ‘ওই খুনি। ও আমার মেয়েকে খুন করে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে এখন আত্মহত্যা বলছে। আপনি ওকে ধরে নিয়ে যান।’

পেছনে মুরাদের মা মনোয়ারা বোনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করে। ‘তুই এসব কী উল্টোপাল্টা কথা বলছিস!’

শামসুন্নাহার এক ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলেন, ‘আমি ঠিকই বলছি আপা। ওই মুরাদকে গ্রেফতার করুক পুলিশ।’

রাহাত এবার শান্ত গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আপনার নাতনি পিংকিকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে হয়।’

শামসুন্নাহার থমকে যায়, কপাল কুঁচকে বলে, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? পিংকি ওর মাকে মেরে ফেলেছে? আপনার মুখে কিছু বাঁধে না?’

রাহাত এবার মাথা নেড়ে বলে, ‘পিংকি সাহায্য না করলে কাউকে অত উঁচুতে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া সম্ভব না। কাউকে মেরে অত উঁচুতে ফ্যানে ঝোলাতে হলে নিচ থেকে কেউ একজনকে লাশটা ধরে রাখতে হবে। আর এই বাসায় কাল আপনার নাতনি আর মেয়ে জামাই ছিল। পিংকি যদি সাহায্য না করে তাহলে এটা পরিস্কার আত্মহত্যা।’

শামসুন্নাহার এবার থেমে যান। তারপর হাতজোড় করে বলেন, ‘আমার মেয়েকে বেশি কাঁটাছেড়া করবেন না। ওর লাশটা আমাদের তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবেন।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তারপর হাফিজকে উদ্দেশ করে বলে, ‘পুরো বাসা ভালো করে সার্চ করে দেখো তো কোথাও কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায় কিনা।’

বের হয়ে যাবার সময় ফরেনসিক অফিসার নাজমুলকে ডেকে বলে, ‘ডাইনিং টেবিলের উপর পায়ের ছাপগুলো ভালো করে নিয়েছ তো? কাচের টেবিলে পায়ের ছাপগুলো স্পষ্ট।’

নাজমুল হেসে বলে, ‘এটা তো রুটিন কাজ স্যার। দেখে মনে হচ্ছে একজনেরই পায়ের ছাপ। মাল্টিপল মানুষের পায়ের ছাপ না।’

রাহাত মাথা নাড়ে। পায়ের ছাপটা ফারিয়া নামের মেয়েটারই হবে। আর এটা যে পরিস্কার আত্মহত্যা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

রাহাত মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে। ফারিয়ার মেয়ে পিংকির সঙ্গে কথা হলো না। শোকের ধাক্কাটা কমুক, তারপর একদিন কথা বলা যাবে।

২.
ফারিয়ার লাশ হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে। ওদের পক্ষ থেকে কেউ কেস করতে রাজি হয়নি। যদিও মেয়েটার মা বার বার মুরাদের দোষ দিচ্ছিল। ফরেনসিক থেকে প্রাথমিক রিপোর্ট পাওয়া গেছে তাতে সুনিশ্চিত যে এটা আত্মহত্যা। শাড়ির গিঁটটায় একটা লুপ ছিল। ৮০% সুইসাইড কেসে এমন থাকে। আর কাচের টেবিলের উপর থেকে একজন মানুষেরই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। আর সেটা হলো ফারিয়ার। অন্য কেউ মেরে লাশটা ঝোলালে সেক্ষেত্রে তার পায়ের ছাপও পাওয়া যেত। মেয়েটা সুইসাইড করেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন করল সেটা জানা দরকার। মেয়েটা যে একজন মানসিক চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা করছিল সেটা বাসা থেকে পাওয়া প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ থেকেই বোঝা গেছে। কিন্তু মেয়েটার মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল নাকি তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে সেটা জানা দরকার। আর সেটা জানতেই আজ মুরাদকে থানায় ডেকেছে।

একজন কনস্টেবল দু’কাপ চা দিয়ে যায়। রাহাত সামনে বসা মুরাদকে উদ্দেশ করে বলে, ‘নিন, চা খেতে খেতে কথা বলি।’

মুরাদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। রাহাত ভালো করে ওর মুখটা খেয়াল করে। চেহারায় বিষণ্ণতা। মাথা নিচু করে চা খাচ্ছে।

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘মুরাদ সাহেব, আপনার শ্বশুর সেদিন বলছিল যে ফারিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। একবার নাকি আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছিল। ওনার এই মানসিক অসুখ কবে থেকে?’

মুরাদ মাথা তুলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘বছরখানেক ধরে ওর একটা সমস্যা তৈরি হয়। সব কিছুতে খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে। আমার ফোন বিজি পেলেই উল্টোপাল্টা কথা বলত। তারপর শুরু হলো আমার কলিগকে নিয়ে সন্দেহ। কিন্তু কোনোটাই সত্যি ছিল না। আমি প্রথম দিকে খুব চেষ্টা করতাম বোঝাতে। কিন্তু এতে উলটো ফল হতো। একটা সময় আমি ওকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। উনি অনেক কথা বলেন, কিছু ওষুধও দেন। আপনাকে তো আমি ইতোমধ্যে ওর প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিও। ভেবেছিলাম ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু হলো না।’

হঠাৎ করেই কথা শেষ করে চুপ হয়ে যায়। রাহাতের কাঁধের উপর দিয়ে ও সামনের দেয়ালের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে।

রাহাত একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, যেদিন উনি আত্মহত্যা করে সেদিন রাতে আপনি ক’টা সময় ঘুমোতে যান?’

মুরাদ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা। আমি মেয়ের রুমে একবার উঁকি দিয়ে কথা বলে আমার রুমে চলে আসি। ফারিয়া তখন নিজের রুমেই শুয়ে ছিল।’

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনাদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল যার জন্য এমন আলাদা রুমে ঘুমাতেন?’

মুরাদের হাত মুঠো হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো চেপে ধরে শক্ত করে। নিচু গলায় বলে, ‘ক’দিন আগে ও আমার একটা সাদা শার্টে লালচে একটা দাগ খুঁজে পায়। আর তাতেই যা হবার হয়। ওর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এটা নিয়ে বার বার আমাকে কথা শুনিয়েছিল। মাঝে ব্যাপারটা মিটেও গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আবার ঝগড়া শুরু করে। রাগ করে বলেছিল আমাকে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমোতে। আগেও এমন হয়েছে। তিন চার দিন পর ওর রাগ কমে যেত। এবারও ভেবেছিলাম তাই হবে। কিন্তু ও চলে গেল, সারাজীবনের জন্য।’

রাহাত এক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটার অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। আর তার জেরেই এই আত্মহত্যা। নাহ, মুরাদের কললিস্ট থেকে শুরু করে সব খতিয়ে দেখতে হবে। তার আগে ওদের মেয়ে পিংকির সঙ্গে কথা বলে মিলিয়ে দেখতে হবে আসলেই এটা নিয়ে অশান্তি ছিল নাকি অন্য কিছু।

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনার মেয়ে কি এখন এই বাসাতেই?’

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘নাহ, ওর নানুর বাসায়। এই বাসাটা ছেড়ে দেব। এখানে আমি বা পিংকি কেউই থাকতে পারব না।’

রাহাত মাথা নাড়ে, ‘ঠিক আছে, বাসা পালটালে আমাদের জানাবেন। আর আপনার শাশুড়ির বাসার ঠিকানা দিন। আপনার মেয়ের সঙ্গে আমি একটু কথা বলব।’

মুরাদ একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যায়।

কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় রাহাত পিংকির নানু বাড়িতে আসে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে গতকালই কথা বলে আসার কথা জানিয়েছিল।

পিংকির নানা আরিফুল হক ওকে নিয়ে বসবার ঘরে বসায়। একটু পরেই শামসুন্নাহার আসেন। এসেই আক্ষেপের গলায় বলেন, ‘এখন আর কথা বলে কী করবেন? আমিই বুঝতে পারি নাই আমার মেয়ে ভেতরে ভেতরে এতটা একলা হয়ে গিয়েছিল।’

রাহাত সহানুভূতির গলায় বলে, ‘আসলে মনের ব্যাপারগুলো বাইরে থেকে তেমন করে বোঝা যায় না। তাই এমন হয়। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমি কেসের স্বার্থে পিংকির সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই।’

শামসুন্নাহার মাথা নেড়ে বলেন, ‘আমি ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু ওর মনের ক্ষতটা এখনও কাঁচা। মনের উপর চাপ পড়ে এমন কোনো কথা জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।’

ওরা দুজন চলে যায়। রাহাত অপেক্ষা করতে থাকে। একটু পর পায়ের আওয়াজ পেতেই তাকায়। পিংকি দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা বিষণ্ণ। মেয়েটা লম্বায় পাঁচ ফুটের উপর, হালকা পাতলা গড়ন, মুখে কৈশোরের নরম ছাপ।

রাহাত নরম গলায় বলে, ‘এখানে এসে বোসো পিংকি।’

পিংকি বাধ্য মেয়ের মতো সামনের সোফায় এসে বসে। রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পিংকি, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারি। কোনো সান্ত্বনাই যথেষ্ট না। কিন্তু এটা একটা পুলিশ কেস। তদন্ত করে দেখতে হয় মানুষটা কেন এমন করল।আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে?’

পিংকি মুখ তুলে তাকায়, তারপর ছোট্ট করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তোমার আম্মু আর বাবার কি প্রায়ই ঝগড়া হতো?’

পিংকি নিচু গলায় বলে, ‘হ্যাঁ।’

একটু চুপ থেকে আবার বলে, ‘আসলে আম্মু আর বাবার সম্পর্ক এমন ছিল না। ইদানীং আম্মু প্রায়ই বাবাকে সন্দেহ করত আর তাই নিয়ে ঝগড়া হতো। এমনকি আমাকেও রাতে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না। আমাকেও খুব সন্দেহ করত। বাবা তো আম্মুকে ডাক্তারও দেখাল। কেন যে আম্মু এমন করত বুঝতেই পারি না।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে। তার মানে মুরাদের কথা সত্য। ফারিয়ার মানসিক সমস্যা ছিল। একটু ভেবে ও বলে, ‘আচ্ছা, তোমার বাবা কি কখনও তোমার আম্মুর গায়ে হাত তুলেছিল?’

পিংকি জোরে মাথা নাড়ে, ‘নাহ। বাবা, আম্মুকে কখনও উঁচু গলায়ও কিছু বলত না।’

রাহাত নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘শেষ প্রশ্ন। সেদিন রাতে তুমি ক’টায় ঘুমিয়েছিলে?’

পিংকি একটু মনে করে বলে, ‘বারোটা নাগাদ। এর আগে বাবা এসে একবার খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল।’

রাহাত মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা। তুমি যাও।’

পিংকি চলে যায়। আরিফুল আর শামসুন্নাহার ভেতরে ঢোকে। আরিফুল অনুরোধের গলায় বলে, ‘এই কেসটা আপাতত শেষ করে দিন। সাংবাদিকরা নানা গল্প লিখছে পেপারে। মাঝখান দিয়ে সেটা পিংকির জন্য খুব অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। ও তো বন্ধুদের সাথে মিশতেই পারবে না।’

রাহাত আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ভাববেন না। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু মানুষ ভুলে যাবে। আমি উঠছি আজ।’

সেদিন রাহাত থানায় ফেরার পথে ভাবে, ফারিয়া ওদের দু’জনকেই সন্দেহ করত। আচ্ছা যাকে সন্দেহ করা হয় তার নিশ্চয়ই রাগ হতো ফারিয়ার উপর? মেয়েকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না। সেক্ষেত্রে মেয়েরও একটা রাগ ছিল। আর এই বয়সের মেয়েরা একটু জেদি হয়, মুখে মুখে তর্ক করে। এটাও হয়তো ফারিয়াকে কষ্ট দিত। ফারিয়া একে তো মুরাদের উপর সন্দেহ করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল তার উপর মেয়ের ব্যাপারেও হয়তো হতাশ ছিল।

মেয়ের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মুরাদের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। আসলেই ওর অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল কি-না। ফারিয়া কি ওকে শুধু শুধু সন্দেহ করত?

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৮/০৭/২৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে