ভেনম পর্ব-০৩

0
123

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৩)

১.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফারিয়া টের পায় মাথার একটা পাশ ভীষণ ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সামলায়। অনেক কাজ, কেমন যেন সব হিবিজিবি লাগে আজকাল।

ফারিয়া প্রথমেই ময়লা জামা কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াশিং মেশিনের কাছে আসে। অনেক কাপড় জমে গেছে। একটা একটা করে কাপড় উল্টেপাল্টে দেখে ওয়াশিং মেশিনের ভেতর দেয়। বিশেষ করে মুরাদের প্যান্ট শার্টে প্রায়ই টাকা না হয় কাগজ থাকেই। ফারিয়া ওর প্রতিটি পকেট ভালো করে দেখে তবেই দেয়। সাদা একটা শার্টের পকেট হাতড়ে দেখতে যেতেই ও থেমে যায়। শার্টটা চোখের সামনে মেলে ধরে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। শার্টের বুকপকেটের কাছে হালকা একটা লালচে দাগ। কিসের দাগ এটা?

ফারিয়া টের পায় ওর নিশ্বাস দ্রুত পড়ছে। ভাবনাটা ভাবতে চায় না। কিন্তু একটা সময় ভাবনাটা ওর পুরো মাথা গ্রাস করে নেয়। এটা নিশ্চয়ই লিপস্টিকের দাগ। কথাটা মনে হতেই মাথায় আগুন ধরে যায়। দ্রুত টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছবি তোলে। তারপর মেসেঞ্জার খুলে পাঠাতে গিয়ে থেমে যায়। ডাক্তার সাহেবের কথা মনে পড়ে। মনের ইমোশনাল স্টেট এখন শক্তিশালী। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনের রিজনাবেল স্টেটটা সক্রিয় করার চেষ্টা করে। ফারিয়া এবার ভাবনাটা উলটো করে ভাবার চেষ্টা করে। হয়তো ওর নিজের লিপস্টিক লেগে গিয়েছিল কখনও। কিন্তু ও তো অনেকদিন লিপস্টিক দেয়৷ না। তাহলে? এটা হয়তো লিপস্টিকের দাগ না। অন্য কোনো কিছুর দাগ।

ফারিয়া লম্বা করে নিশ্বাস নেয়। মাথাটা কয়েকবার নেড়ে ভাবনাটা তাড়াবার চেষ্টা করে। মনকে বোঝায় এটা ও ভুল ভাবছে। মুরাদ বাসায় ফিরলেই সব সত্যি জানা যাবে। কিন্তু ও কি সত্যিটা বলবে?

ফারিয়া সাদা শার্টটা এক পাশে সরিয়ে রেখে অন্য জামা কাপড়গুলো ওয়াশিং মেশিনে দেয়। স্টার্ট বাটন চেপে দাঁড়িয়েই থাকে। নাহ, ও কেন যেন এই মানসিক সমস্যা থেকে বেরোতেই পারছে না। আর এই উল্টোপাল্টা জিনিসগুলো ওর চোখেই পড়ে।

ঘরে এখন কেউ নেই। পিংকি কলেজে, মুরাদ অফিসে। পুরো ঘরটা যেন ওকে গিলে খেতে চাচ্ছে। ফারিয়া টের পায় ওর কেমন অস্থির লাগছে। ঘরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে।

কী মনে হতে ও বাসার দরজা লক করে বাইরে আসে। তারপর লিফট চেপে একদম টপ ফ্লোরে চলে আসে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে। দুপুর বেলা পুরো ছাদটা খালি। না খালি না একদম। একটা কম বয়েসী ছেলে সিগারেট খাচ্ছিল। ওকে দেখে সিগারেট লুকায়। ফারিয়া না দেখার ভান করে সামনে এগিয়ে যায়।

ছাদ জুড়ে নানা ধরনের গাছ। চারপাশটা কেমন সবুজ। অনেকগুলো টবে ফুল ফুটেছে। কোনোটা গোলাপি, কোনটা সাদা, কোনোটা লাল। আচ্ছা, মুরাদের শার্টে ওই লাল দাগটা আসলে কিসের? ওই জায়গাটায় লিপস্টিক ছাড়া অন্য কিছুর দাগ তো লাগার কথা না। ওই তাবাসসুম মেয়েটার সঙ্গে ওর নিশ্চয়ই কোনো গোপন সম্পর্ক চলছে। ফারিয়া টের পায় ওর আবার ইমোশনাল স্টেট শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ডাক্তার সাহেব যেমন করে বললেন ব্যাপারটা এত সহজ না আসলে। এই যে ও এখন কিছুতেই ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। মুরাদকে একটা সময় ও পাগলের মতো ভালোবাসত। দিনে বিশ পঁচিশ বার ফোন দিয়ে খবর নিত। সারারাত বুকে ঘুমিয়ে থাকত। আর মুরাদ এখন সারারাত একটা কোলবালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। দিন দিন এমন হয়ে গেল কেন সব?

ছাদের কাছটায় বুক সমান উঁচু পাঁচিল। ফারিয়া পায়ে পায়ে পাঁচিলের কাছে যায়। তারপর পাঁচিলের উপর বিপদজনকভাবে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক উঁচু বিল্ডিং এটা, আট তলা। ফারিয়া কেমন মোহগ্রস্তের মতো নিচের পিচ ঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে শরীরটা আরও খানিকটা উঠে আসে পাঁচিলের উপর।

কোথাও থেকে একটা বাতাস আসছে। তাতে করে কপালের কাছে চুলগুলো উড়ছে। ফারিয়া চোখ বন্ধ করে। কেমন যেন একটা শান্তি অনুভব করছ। শরীরটা এখন অর্ধেকের বেশি পাঁচিলের বাইরে বিপদজনকভাবে দুলছে। দূর থেকে একটা শব্দ কানে আসছে। ফারিয়ার ইচ্ছে হয় না ঘুরে দেখতে। ওর অবশ্য এখন পেছনে ফিরে তাকানোর উপায়ও নেই। বরং নিচে পড়ে যাওয়াই সহজ।

ফারিয়া শরীরে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করে। সেইসাথে একটা তীক্ষ্ণ গলার স্বর পাওয়া যায়, ‘আপনি কী করছেন আন্টি! পড়ে যাবেন তো এখুনি।’

ছেলেটা সর্বশক্তি দিয়ে ওকে টেনে তুলে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আন্টি, আপনি তো আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিলেন।’

ফারিয়া শূন্য চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কথাগুলো বোধগম্য হয় না। এই ছেলে ওকে ধরে রেখেছে কেন? ও পড়ে যাচ্ছিল মানে?

ফারিয়া এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘অ্যাই ছেলে, তুমি আমার হাত ধরেছ কেন?’

ছেলেটা অবাক গলায় বলে, ‘আপনাকে টেনে না ধরলে এতক্ষণে নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে যেতেন। মানুষের উপকার করে উলটো কথা শুনতে হলো।’

ফারিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ছাদের পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা হয়তো ঠিকই বলছে। অযথা ওকে বকাঝকা করল।

ফারিয়া নরম গলায় বলে, ‘আমি আসলে বেখেয়ালে একটু বুঝি বেশিই ঝুঁকে গিয়েছিলাম। তুমি টেনে না ধরলে সত্যিই পড়ে যেতাম।’

ছেলেটার চোখেমুখে এবার স্বস্তি ফোটে। তারপর চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘হ্যাঁ আন্টি! আমি তো দূর থেকে দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আপনি পিংকির আম্মু না? পাঁচতলার ফ্ল্যাটে থাকেন, তাই না? চলুন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।’

ফারিয়া এবার হেসে মাথা নাড়ে, ‘লাগবে না, আমি একাই নামতে পারব।’

ফারিয়া ছাদ থেকে নেমে আসে। ছেলেটা অদ্ভুত চোখে ওর নেমে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিকেলে মুরাদ বাসায় ফিরতে ফিরতে কেমন করে যেন পুরো বিল্ডিংয়ের সবাই ঘটনাটা জেনে যায়।

সবার প্রথমে দারোয়ান ইদ্রিস হড়বড় করে বলে, ‘স্যার, আপনি এতক্ষণে বাসায় আসছেন। ভাবি নাকি আইজ ছাদ থেকে পইড়া যাইতে নিছিল। ভাগ্যিস ছাদে তখন আটতলার জারিফ ছিল। নাইলে তো একটা অঘটন ঘইটা যাইত।’

বুকটা ধক করে ওঠে। কপাল কুঁচকে বলে, ‘কী সব আবোলতাবোল কথা বলছ। ফারিয়া ছাদ থেকে পড়ে যাবে কেন, ও কি ছোট মানুষ?’

ইদ্রিস এবার জোর দিয়ে বলে, ‘স্যার, সত্যই কইতাছি। ভাবি আইজ দুপুরে ছাদ থেকে নিচে পইড়া যাইতে নিছিল।’

মুরাদ আর দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে লিফটে ওঠে। বাসায় পৌঁছে ব্যস্ত হাতে বেল বাজায়। পিংকি দরজা খুলে দেয়। ওর পরনে কলেজের ড্রেস পরা। বোধহয় মাত্রই এল।

মুরাদ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তোর আম্মু কই?’

পিংকি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘বাবা, আম্মু নাকি আজ ছাদ থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিল। আমি মাত্রই বাসায় এসে শুনলাম। তোমাকে এখুনি ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’

মুরাদ মেয়ের হাত ধরে বলে, ‘এসব কী বলছিস! কই তোর আম্মু?’

মুরাদ ওকে নিয়ে বেডরুমে এসে দেখে ফারিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে কিনা বোঝা যায় না। কাছে গিয়ে বসে নিচু গলায় ডাকে, ‘ফারিয়া ঘুমুচ্ছ?’

ফারিয়া চোখ না খুলেই বলে, ‘না।’

মুরাদ এবার কাছে এসে বসে, তারপর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আচ্ছা, নিচের দারোয়ান কীসব উল্টোপাল্টা কথা বলল। তুমি নাকি আজ দুপুরে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছিলে?’

ফারিয়া চোখ খুলে তাকায়। চোখে কেমন একটা পাগলাটে দৃষ্টি। কেটে কেটে বলে, ‘পড়ে গেলেই তো ভালো হতো, তাই না? তোমার শার্টে যার ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগ লাগানো তাকে বিয়ে করে আনতে পারতে।’

মুরাদ দ্রুত ঘুরে মেয়ের দিকে তাকায়। পিংকি মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আবার অশান্তি শুরু হলো।

মুরাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার শার্টে আবার কার লিপস্টিকের দাগ পেলে? অদ্ভুত তো।’

ফারিয়া ঝট করে উঠে বসে। তারপর দ্রুত বিছানা থেকে নেমে সকালের সেই সাদা শার্টটা নিয়ে এসে ওর চোখের সামনে মেলে ধরে। তারপর তীব্র গলায় বলে, ‘এই দাগ কোথা থেকে এলো?’

মুরাদ চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু ও কোনো দাগ খুঁজে পায় না। বিরক্ত গলায় বলে, ‘কোথায় দাগ পেলে তুমি?’

ফারিয়া এবার বুকপকেটের কাছটা দেখিয়ে বলে, ‘এই যে, দেখতে পাও না?’

মুরাদ চোখ ছোট ছোট করে দেখে হালকা একটা লালচে দাগ। ও অবাক গলায় বলে, ‘এই দাগ! বাপরে, আতশ কাচ দিয়ে দেখতে হয়। আমি জানি না এই দাগ কোথা থেকে এলো। আমি তো শার্ট খুলে রেখে ওয়াশিং মেশিনের উপরে রেখে দিয়েছিলাম। হয়তো অন্য কোনো জামা থেকে রঙটা লেগেছে। বা অন্য কিছু। তুমি প্লিজ এসব ভাবনা ভেব না।’

ফারিয়া তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে ওঠে, ‘তুমি অন্য মেয়ের লিপস্টিপ এর দাগ শার্টে লাগিয়ে আনবে আর আমি ভাবব না?’

মুরাদ পিংকির রুমের দিকে তাকায়। কথাটা নিশ্চয়ই ওর কানে গেছে। ফারিয়া আবার আগেরমতো সন্দেহপ্রবণ আচরণ করছে।

মুরাদের হঠাৎ করেই মনে হয় ফারিয়া কি তবে আজ সুইসাইড করতেই ছাদে উঠেছিল? কথাটা মনে হতেই পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। ও হঠাৎ করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ফারিয়া, তুমি কি আজ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যেতে চেয়েছিলে? ফারিয়া, সত্যি করে বলো।’

ফারিয়ার টের পায় ওর খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর। বুক ভেঙে কেমন কান্না আসছে। ও মুরাদের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে যেতে বলে, ‘আমি জানি না, আমার কী হয়েছিল।’

মুরাদ পরম মায়ায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

পিংকি ওর রুম থেকে বেরিয়ে একবার উঁকি দেয়। কতদিন পর এমন দৃশ্য দেখল!

২.
আড়ংয়ে এলে ফারিয়ার মন ভালো হয়ে যায় সবসময়। এদের সবকিছু কেমন পরিপাটি করে সাজানো গোছানো থাকে। তাতে করে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ কিছুতেই মন ভালো হচ্ছে না। কেমন যেন বিক্ষিপ্ত লাগছে।

ফারিয়া ঘুরতে ঘুরতে শাড়ির সেকশনে আসে। কত রঙবেরঙের শাড়ি। নীল রঙ, সবুজ রঙ, আকাশি, মেরুন, লাল। আচ্ছা, মুরাদের শার্টে লাল রঙয়ের দাগটা কি লিপস্টিকের ছিল?

এই সময় শোরুমের একটা অল্প বয়েসী মেয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, কী খুঁজছিলেন? সুতী শাড়ি নাকি সিল্ক?’

ফারিয়া ঘুরে তাকায়। মেয়েটা ধবধবে ফর্সা, নাকটা বোচা, চোখে কালো কাজল, আর ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটা ঘোর ধরে যায়।

ফারিয়া ওর দিকে তাকিয়ে কেমন একটা গলায় বলে, ‘আচ্ছা, গলায় ফাঁস দিতে সুতী শাড়ি ভালো হবে নাকি সিল্কের শাড়ি?’

মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়। তোতলানো গলায় বলে, ‘জি ম্যাডাম, কী বললেন! বুঝিনি।’

ফারিয়া মাথা নাড়ে, ‘নাহ, কিছু না। চিকন সুতার সুতী শাড়ি খুঁজছিলাম।’

মেয়েটা এবার হাত তুলে একদম শেষের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘ওদিকটায় পাবেন ম্যাডাম।’

ফারিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সুতী শাড়ির সেকশনের দিকে চলে যায়। তারপর বেছে বেছে হালকা গোলাপি রঙের চিকন পাড়ের একটা শাড়ি কেনে। তারপর পিংকির জন্য একটা টপস নেয়।

বিল দিয়ে বাইরে আসতেই দেখে এই ভর দুপুরে আকাশ রাতের মতো অন্ধকার। এখনই বৃষ্টি নামবে। ফারিয়ার মধ্যে অবশ্য তাড়াহুড়া দেখা যায় না৷ ও ধীরেসুস্থে একটা রিক্সা নেয়। এখান থেকে পনের বিশ মিনিট লাগবে বাসায় যেতে৷

অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামে। রিক্সাওয়ালা দ্রুত রিক্সা থামিয়ে বলে, ‘আপা, একটু নামেন, পলিথিন দেই।’

ফারিয়া হাত তুলে থামায়, তারপর বলে, ‘লাগবে না। আপনি রিক্সা চালান। হুড খোলাই থাক।’

রিক্সাওয়ালা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর রিক্সায় উঠে প্যাডেলে চাপ দেয়। খুব একটা অবাক হয় না। অনেকেই এমন বৃষ্টিতে ভিজে।

বাসার কাছে আসতেই ফারিয়া ভিজে একসা হয়ে যায়। কাগজের শপিং ব্যাগগুলোও ভিজে কেমন চুপসে গেছে।

বাসায় ফিরে ফারিয়া ভেজা জামা কাপড় পাল্টে নেয়। শপিং ব্যাগ থেকে শাড়ি আর পিংকির টপ্স বের করে দেখে। খুব একটা ভিজে নাই। বারান্দায় গিয়ে মেলে দিয়ে ভেতরে আসে।

পিংকি আসে একটু পরেই। ফারিয়া ওর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, ‘তুই এমন ভিজে এলি কেন? গাড়ি যায়নি?’

পিংকি ঠোঁট উল্টে বলে, ‘গিয়েছিল। কিন্তু আমার আজ ভিজতে ইচ্ছে করছিল আম্মু।’

ফারিয়া ধমক দিতে গিয়েও থেমে যায়। মেয়েটা ওর মতোই হয়েছে। ফ্রিজ থেকে কালকের রাতের তেহারি বের করে গরম করে খেতে দেয় ওকে। তারপর বারান্দা থেকে টপসটা এনে ওকে দেখায়, ‘পরে দেখিস তো, লাগে কিনা?’

পিংকি একবার চেয়ে দেখে, তারপর বলে, ‘পরে পরব। আমি এখন ঘুমোব।’

ফারিয়া আহত চোখে তাকিয়ে থাকে। মোবাইলের ইস্যুতে মেয়েটা প্রায়ই ওর সাথে এখন দূরত্ব বজায় রাখে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিয়া প্লেট, গ্লাস ধুয়ে নিজের রুমে আসে। তারপর পাতলা একটা কাঁথা গায়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

মুরাদ আসে সন্ধ্যাবেলা। এসে চুপচাপ নাস্তা খায়, তারপর চা। অন্যান্য দিনের মতো রাত দশটা পর্যন্ত টিভি দেখে। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ফারিয়ার আশেপাশে কয়েকবার ঘুরে। কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু ও কোন উত্তর দেয় না। তারপর গেস্ট বেডে চলে আসে ঘুমাতে। গত কয়েকদিন ধরেই আলাদা ঘুমুচ্ছে। মানে বাধ্য হচ্ছে আলাদা ঘুমোতে। ফারিয়া সেদিন হুট করে আবার সেই শার্টের কথা তুলল। আর সেই নিয়ে কুৎসিত একটা ঝগড়া হলো। তারপর থেকেই রাতে শোবার এই ব্যবস্থা।

সেদিনের ছাদের সেই ঘটনার পর মাত্র এক মাস পেরিয়েছে। ডাক্তারের কাছে আবার যাওয়া দরকার। কিন্তু ফারিয়া কেন যেন যেতে চাচ্ছে না।

মুরাদ ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি খায়। ফারিয়ার রুম অন্ধকার। ডাইনিংয়ের আলো গিয়ে পড়েছে, তাতে ওকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। মুরাদ এবার মেয়ের রুমে উঁকি দিয়ে বলে, ‘ঘুমুবি না? সাড়ে এগারোটা বাজে তো।’

পিংকি একটু হাসে। মেয়েটা কেমন মন খুলে হাসে না। নিচু গলায় বলে, ‘এই তো বাবা, বারোটা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়ব।’

মুরাদ নিজের রুমে চলে আসে। সেই বিয়ের পর থেকেই এমন। কিছু হলেই ফারিয়া কথা বন্ধ করে দেবে, আলাদা ঘুমোবে। একটা মানসিক অশান্তি সবসময়। মাথায় একটা চাপ অনুভব করে মুরাদ। এমন জীবন আর ভালো লাগছে না।

মুরাদ নিজের রুমের লাইট অফ করে ঘুমোতে যায়। আজ আবহাওয়া ঠান্ডা। মুরাদ একটা পাতলা কাঁথা টেনে নেয়।

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না। হঠাৎ করেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কুঁচকে ও বোঝার চেষ্টা করে ঘুমটা ভাঙল কেন? কোথাও কোনো শব্দ হলো? মুরাদ এবার ঘুরে মাথাটা একটু উঁচু করে ডাইনিং রুমের দিকে তাকায়। কী ব্যাপার, ডাইনিং এর লাইট অফ কেন?

মুরাদ বিছানা থেকে নামে। দরজার কাছে এসে রুমের সুইচ হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ করেই থেমে যায়। বাইরে থেকে হালকা একটা আলো এসে পড়েছে ডাইনিং-য়ে। তাতে করে আলো অন্ধকারে আবছা একটা কিছু শূন্যে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। মুরাদ টের পায় ওর সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে। কোনোমতে লাইট জ্বালায়। আর তাতে করে দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়। ফারিয়ার শরীরটা ডাইনিংয়ের ফ্যান থেলে ঝুলছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ঘাড়টা একপাশে হেলে আছে।

মুরাদ চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৮/০৭/২৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে