ভেনম পর্ব-০২

0
121

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ২)

১.
ফারিয়ার আজ বেলা করে ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে একবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। একটা হাই তুলে উঠে বসে। সকালে একবার উঠেছিল। পিংকি কলেজ যায় সাতটায়। ওকে নাস্তা খাইয়ে বিদায় দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। মুরাদ সকালে বাসায় নাস্তা করে না। অফিসে গিয়েই নাস্তা করে।

ফারিয়া এবার আড়মোড়া ভেঙে অলস পায়ে বেসিনের কাছে এসে চোখেমুখে পানি দিতেই ঘুমটা কাটে। বেসিনের আয়নাটা নতুন লাগিয়েছে মুরাদ। আগেরটায় চেহারা ঘোলা দেখা যেত। এটাতে একদম পরিস্কার দেখা যায়। ফারিয়া আয়নার দিকে ঝুঁকে নিজের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুই চোখের নিচে কালি পড়েছে। দেখতে অনেকটা অর্ধবৃত্তাকার চাঁদের মতো। এর ঠিক নিচেই মেছতার দাগ। আগে এটা ছিল না। গত কয়েক মাস ধরে লক্ষ করছে ও। ফারিয়া ফ্রিজ থেকে এক টুকরো এলোভেরা বের করে মেছতার জায়গাটা একটু ঘষে। কে যেন বলেছিল এটা করলে নাকি মেছতার দাগ চলে যায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিয়া আবার মুখ ধোয়। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। আগের মতো মুখটা মসৃণ না। আচ্ছা, মুরাদ কি এজন্যই ওর কাছে আসে না? অন্য কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে? প্রায়ই ফোন বিজি পাওয়া যায়। বারান্দায় লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে। ইদানিং নতুন নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে, সাথে ম্যাচিং করে জুতো বেল্ট, ঘড়ি। এগুলো আগে ছিল না। মানুষ এগুলো করে কাউকে মুগ্ধ করার জন্যই। যদিও সরাসরি কোনো প্রমাণ পায়নি, কিন্তু কোথাও একটা ঝামেলা আছে ওর।

মন খারাপ হয়ে যায় ফারিয়ার। কত ধুমধাম করে বিয়ে হলো। সম্পর্কে ওরা দু’জন খালাতো ভাইবোন। আব্বা রাজি ছিল না প্রথমে। কিন্তু তারপরও দুই বোনের প্রবল আগ্রহেই ওদের বিয়েটা হয়। সুখীই তো ছিল। কিন্তু এই বয়সে এসে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন?

ডাইনিং-এ এসে এক কাপ চা আর একটা পরোটা নিয়ে বসে। ডিম ভেজে খেতে ইচ্ছে করছে না। ফারিয়া পরোটা রোল করে নেয়, তারপর একটা মাথা চায়ে ডুবিয়ে রাখে। মুখে দিতেই তুলতুলে নরম, মিষ্টি একটা স্বাদ। ভালো লাগছে খেতে। পরোটাটা আবার ডোবায়। যখন তুলতে যাবে ঠিক তখন মোবাইলের মেসেঞ্জারে ‘টুন’ করে একটা শব্দ হয়। ফারিয়া পরোটা মুখে পুরে মোবাইল খোলে। অপরিচিত একটা একাউন্ট থেকে মেসেজ এসেছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। ফেসবুকে কিছু মানুষ এতটাই বিকৃত রুচির যে সারাক্ষণ মেয়েদের ইনবক্সে আজেবাজে মেসেজ পাঠাতে থাকে।

ফারিয়া মোবাইল রেখে পরোটা আর চা শেষ করে। তারপর চায়ের মগটা ধুয়ে টেবিলে রাখতেই আবার মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ হয়। কপাল কুঁচকে দেখে সেই একই আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। আইডির নামটাও কেমন যেন – ভেনম।

খুলবে না ভেবেও স্প্যাম ফোল্ডারে গিয়ে মেসেজটা খুলে। চোখ স্থির হয়ে যায়, টের পায় দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে। মাথার ভেতর কেমন যেন লাগছে। ইনবক্সে মুরাদের সঙ্গে একটা মেয়ের দুটো ছবি – একটা চা বাগানে, আরেকটা কোনো একটা হোটেলের লবিতে। ক’দিন আগেই মুরাদ সিলেট গিয়েছিল অফিসের কাজে। যাবার আগে খুব ঝগড়া হয়েছিল। মুরাদ বলেছিল ও নাকি মিথ্যা সন্দেহ করে ওকে। অথচ আজ হাতে ঠিক প্রমাণ এলো। তার মানে এতদিন ধরে ও যে সন্দেহটা করে আসছিল সেটা সত্য। মুরাদ অফিসের ট্যুরের নাম করে অন্য কাউকে নিয়ে সিলেট থেকে ঘুরে এসেছে। মাথায় আগুন ধরে যায়। ইচ্ছে করছে পুরো ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে৷

ও দ্রুত ছবি দুটো ডাউনলোড করে নেয় আগে। তারপর মুরাদের মেসেঞ্জারে ছবি দুটো পাঠিয়ে লিখে, ‘মিথ্যাবাদী, ভন্ড।’

মুরাদ মনোযোগ দিয়ে একটা সেলস রিপোর্ট দেখছিল। এমন সময় মোবাইলে মেসেজ আসতেই চেয়ে দেখে ফারিয়ার মেসেজ। ভ্রু কুঁচকে ও মেসেজ খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। টের পায় বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে৷ মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত তাবাসসুমের রুমে ঢোকে। উত্তেজিত গলায় বলে, ‘তাবাসসুম, এই ছবিগুলো আমার বউকে কে পাঠাল! আমার তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

তাবাসসুম অবাক চোখে ছবিগুলো দেখে, তারপর বিস্মিত গলায় বলে, ‘তোর বউ এটা পাঠিয়েছে তোকে? কী করে? আমি তো আমার ফেসবুকে সিলেট ট্যুরের এই ছবিসহ আরও অন্যান্য ছবি পোস্ট করেছিলাম। আর সেটা শুধু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড যারা তারাই দেখতে পাবে৷ তোর বউ তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড না। এই ছবি ওর কাছে গেল কী করে?’

মুরাদ হাহাকার করে বলে, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। এমনিতেই ফারিয়া সারাক্ষণ কথা শোনায়। আর এখন তো এই ছবি দেখার পর ও পাগল হয়ে যাবে। তোর ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কেউ এটা করেছে।’

তাবাসসুম থতমত খেয়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘এই অফিসের প্রায় সবাই আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। এছাড়া বাইরের মানুষও আছে। মুরাদ, এটা ওই তালেবের কাজ না তো?’

কয়েক মাস ধরেই তালেব ভীষণ পিছে পড়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তাবাসসুমকে ভালোবাসে সেটা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাবাসসুম ওকে একবিন্দুও পাত্তা দেয়নি। তাই নিয়ে সেদিন কথা শুনিয়েছিল, ‘মুরাদের সঙ্গে তো খুব ভাব। সারাক্ষণ একসাথে লেগে থাকো।’

সেদিন তাবাসসুম ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়েছিল। এরপর আর জ্বালায়নি। ভেবেছিল ও থেমে গেছে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে থামেনি। ঈর্ষাপরায়ণ হয়েই এই ছবিগুলো মুরাদের বউকে পাঠিয়েছে।

মুরাদ হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আমি বাসায় যাচ্ছি। বসকে সামলাস। না হলে ফারিয়া কখন যে কী করে ফেলে।’

তাবাসসুম এবার বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘শোন, তুই ওকে গিয়ে সত্যিটা বলবি। আমাদের তো অফিসের ট্যুর ছিল। আর চা বাগানটা তো হোটেলের পাশেই, তাই ছবি তোলা হয়েছিল। তুই তো এর আগেও অনেকবার আমার সঙ্গে ট্যুরে গিয়েছিস। এরপর থেকে বউকে সত্যিটা বলে যাবি। এই দেখ, এখন শুধু শুধু একটা সন্দেহ সৃষ্টি হলো।’

মুরাদ বের হতে হতে বলে, ‘আমি তো বলতেই চাই। কিন্তু ওর ভয়েই বলি না। আচ্ছা আমি যাই। আর শোন, বাসায় গিয়ে আমি ফারিয়াকে একবার ফোনে ধরিয়ে দেব। তুই একটু বুঝিয়ে বলিস।’

তাবাসসুম সহানুভূতির চোখে তাকায়। একটা অযাচিত অপরাধবোধ ওকে ঘিরে ধরে৷ মুরাদ যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হলো।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ও বাসায় পৌঁছে যায়। দুরুদুরু বুকে বেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। মুরাদ দরজা বন্ধ করে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ফারিয়াকে ঝাপটে ধরে, আকুল গলায় বলে, ‘তুমি যা ভাবছ তা সত্যি না।’

ফারিয়া এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীব্র গলায় বলে, ‘এতদিন তাই জানতাম, কিন্তু আজ তো হাতে হাতে প্রমাণ পেলাম। আমি আজকেই এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। আম্মুকে ফোন করে বলেছি আসতে। তুমি আর তোমার মেয়ে থাকো। তারপর আরাম করে এসব কাজ কোরো।’

মুরাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘খালাকে আসতে বলেছ! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে? আরে ওই মেয়েটা তো আমার কলিগ, তাবাসসুম। এর আগেও ওকে অফিসের অনুষ্ঠানে দেখেছ। সিলেট ট্যুরে ও সঙ্গে ছিল। আমদের মাঝে মাঝে একসাথে যেতে হয়, আর সেটা পুরোটাই অফিসের কাজে। বিশ্বাস না হলে ওকে ফোন দাও।’

ফারিয়া থমকায়। মেয়েটাকে তখন খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মুরাদ বলাতে এখন মনে পড়ল। এই মেয়েটার সাথে এক দুবার কথা হয়েছে। কিন্তু ও যাবার দিন তাহলে মিথ্যে বলল কেন? এই তাবাসসুম মেয়েটার সাথে ওর কোন চক্কর চলছে না তো?

ফারিয়া কেটে কেটে বলে, ‘এখন ফোন দিয়ে কী হবে? সব তো শিখিয়ে পড়িয়ে এসেছ। আমি আর থাকব না এই সংসারে।’

মুরাদ এবার গম্ভীর গলায় বলে, ‘কিছু হলেই তুমি এই কথা বলো। কেন বলো? আর আমাকে এত অবিশ্বাস কেন করো? তোমার আসলে মানসিক অসুখ হয়েছে। ডাক্তার দেখানো দরকার।’

ফারিয়া চিৎকার করে বলে, ‘তোমার হয়েছে। তুমি গিয়ে ডাক্তার দেখাও।’

কথাটা বলে ও গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢোকে। হাড়িপাতিলের সশব্দ আওয়াজ পাওয়া যায় যা ওর রাগের সমানুপাতে বাড়তে থাকে৷
মুরাদ মন খারাপ করে লিভিংয়ে বসে থাকে। একটা কথা মনে হতেই ও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। খালা মানে ফারিয়ার আম্মা কাছেই থাকেন। কিছু হলেই ফারিয়া মাকে ডাকবে। খালা অবশ্য মুরাদের পক্ষেই সবসময় বলেন। তারপরও একটা অদৃশ্য চাপ অনুভব করে মুরাদ।

সেদিন বিকেলে ফারিয়ার মা শামসুন্নাহার ঠিক আসেন। হাতে বিকেলের নাস্তা – পরোটা আর চিকেন চাপ। পিংকি ওর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। শামসুন্নাহার নাতনিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুই তো আমার চেয়েও লম্বা হয়ে গেছিস। আর সুন্দর হচ্ছিস দিন দিন।’

পিংকি লাজুক গলায় বলে, ‘তোমার মতো ফর্সা কেউই না নানু।’

শামসুন্নাহার হাসেন। তারপর বলেন, ‘নে, পরোটা আর চিকেন চাপ এনেছি।’

ফারিয়া গম্ভীরমুখে বলে, ‘পিংকি, তুমি তোমার রুমে যাও। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

পিংকি একবার মায়ের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়, তারপর ধুপধাপ করে নিজের রুমে চলে যায়। আজ বাসায় এসেই বাবাকে অসময়ে বাসায় দেখে অবাক হয়েছিল। পরে বুঝেছে আম্মু আবার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আর সেজন্যই নানুর এমন হঠাৎ করে বাসায় আসা।

বেডরুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে ফারিয়া বসে। তারপর উত্তপ্ত গলায় বলে, ‘তোমার বোনের ছেলে একটা আস্ত বদমাশ। সারাক্ষণ অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। বুড়ো হয়ে গেছে তাও নোংরামো কমে না। ঢাকার বাইরে মেয়ে নিয়ে ঘুরতে যায়।’

শামসুন্নাহার কপাল কোঁচকান। ফারিয়ার মুখে ইদানিং কোনো লাগাম নেই। যা আসে তাই বলতে থাকে। ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘চুপ কর তুই। অ্যাই মুরাদ, কী হয়েছে বল তো?’

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বলে। শামসুন্নাহার মাথা নাড়েন, তারপর ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে, ‘তুই শুধু শুধু এমন কেন করিস? ও তো এর আগেও ট্যুরে যেত। তখন তো এমন করতি না। আর মুরাদ, তুই যা করবি ওকে বলে কয়েই করবি।’

মুরাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি তো সব বলতেই চাই। কিন্তু ও এমন করে চিৎকার করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে যে আমি ভয়েই আর কিছু বলি না। কিন্তু খালা, ও দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ওকে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি বলেছি উলটো রাগ করে।’

ফারিয়া রাগী গলায় বলে, ‘তুমি দেখাও। আমি যাব না। নিজেকে ঠিক করো, তাহলেই আমি ভালো হয়ে যাব।’

শামসুন্নাহার এবার বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘ফারিয়া, তুই রাগ করিস না। তুই একবার ওর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যা। মানুষের যেমন শরীরের অসুখ হয় তেমন মনেরও অসুখ হয়।’

ফারিয়া মাথা নিচু করে বিড়বিড় করতে থাকে। কেন যেন এই জীবন আর ভালো লাগে না। মেয়াটাও ইদানিং মুখে মুখে কথা বলে। কেউ ওর কথা শোনে না।

২.
মনোচিকিৎসক ডাক্তার সুশান্ত মনোযোগ দিয়ে ফারিয়ার সব কথা শুনছেন। মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন আবার মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে।

ফারিয়ার কথা শেষ হতেই সুশান্ত নরম গলায় বলেন, ‘বয়সের এই পর্যায়ে এসে এমন হতে পারে। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কমে যায়। লাইফ পার্টনার তার ক্যারিয়ারে আগের চেয়ে এই বয়সে অনেক উঁচুতে উঠে যায় তাতে করে মনে হয় সে বুঝি নাগালের বাইরে চলে গেল। আর আপনার কথায় যেটা মনে হলো আপনি নিজের চেহারা নিয়েও গ্লানিতে ভোগেন এখন। সব মিলিয়ে আপনার মনে একটা হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়েছে যেখান থেকে এই সন্দেহগুলোর সৃষ্টি। আমি সন্দেহগুলো অহেতুক বলব না। আবার সত্যিও বলব না। আপনার লাইফ পার্টনার মি. মুরাদ যদি সত্যিই জড়িয়ে থাকে তাতেও আপনাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হতে হবে। আপনি যা চোখে দেখবেন শুধু সেটাই বিশ্বাস করবেন। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাবেন। এজন্য নিজের মনকে তৈরি করতে হবে।’

ফারিয়া তাকিয়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘সেটা কী করে?’

সুশান্ত বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘মানুষের মনের তিনটা স্টেট – রিজনাবেল স্টেট, ইমোশনাল স্টেট আর ওয়াইজ স্টেট। বাংলায় বললে, যৌক্তিক মন, অনুভূতিপ্রবণ মন আর জ্ঞানী মন। যখন আমরা আমাদের যৌক্তিক মন দিয়ে কোন কিছু চিন্তা করি তখন আমরা ব্যাপারটা যুক্তি দিয়ে ভাবি, আবেগকে পাশে সরিয়ে রেখে। এটার রঙ নীল। আবার যখন আমরা আবেগ দিয়ে ভাবি তখন আমরা আমাদের মনের ভেতরের কথা শুনি, যুক্তির কথা কম শুনি। এটার রঙ ধরুন লাল। আর এই দুটোকে এক করে যা হয় তা হলো আমাদের জ্ঞানী মন যেটা যুক্তি দিয়ে আমাদের আবেগের মনকে একটা জায়গায় নিয়ে আসে। আমাদের মনের দুটো অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন আপনি যে কাজগুলো করেন তার বেশিরভাগই আবেগ দিয়ে দিয়ে করেন। আপনার ইমোশনাল মাইন্ড খুব শক্তিশালী। এটা হতে দেওয়া যাবে না।’

ফারিয়া এখন কৌতুহল বোধ করছে। ও আগ্রহের গলায় বলে, ‘সেটা কী করে পারব?’

সুশান্ত নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আপনি যখনই এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন আপনি তখনই সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। সময় নিন, যতক্ষণ না যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন ততক্ষণ চুপ থাকুন। দেখবেন সময় দিলে যে ব্যাপারটা নিয়ে আপনি অনেক রেগে যাচ্ছেন সে ব্যাপারটাতে রাগ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। এই যে আপনি বললেন যে আপনি আপনার হাসব্যান্ডের সঙ্গে একটা মেয়ের ছবি পেয়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফরোয়ার্ড করেছেন। তার মানে আপনি আপনার ইমোশনাল মনের কাছে হেরে গেছেন। আপনার উচিত ছিল অপেক্ষা করে সবটা জানা, যুক্তি দিয়ে বিচার করা। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। চট করে আয়ত্ত্বে আসবে না। আপনি আজ থেকেই শুরু করুন অভ্যাসটা। আমি সেই সাথে কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি নিয়মিত খাবেন। এক মাস পরে আবার আসবেন।’

ডাক্তার সাহেব মুরাদের সাথেও বিস্তারিত কথা বলে। যাবার সময় উপদেশ দেবার গলায় বলে, ‘আপনি যেহেতু আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার। আপনি যাই করবেন সেটা খোলামেলাভাবে আপনার স্ত্রীর সাথে শেয়ার করবেন। ওনার সন্দেহ হয় এমন কাজ কম করবেন। আপাতত এটুকুই।’

সেদিন ফেরার পথে ফারিয়া কোনো কথাই বলে না। চুপ করে ভাবতে থাকে। ডাক্তার সাহেব যেমন এত সহজে কথাগুলো বলতে পারেন আসলে কি এত সহজ? মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তো ওনার সাহায্যই লাগে না। বড়ো বড়ো কথা। ডাক্তার নিজে যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ত তাহলে বুঝত।

বাসায় ফিরে মুরাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘এই যে প্রেসক্রিপশন আর এক মাসের ওষুধ। মনে করে খেও।’

ফারিয়া কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে। ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুরাদ অপেক্ষা করে বসে থাকে ও কখন বেরোবে।

ক’টা দিন বেশ ভালো যায়। ফারিয়া এর মাঝে নতুন করে কোনো ঝামেলা করেনি। সেদিন সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে মুরাদ স্বস্তির গলায় বলে, ‘ডাক্তারটা বেশ ভালোই, তাই না?’

ফারিয়া টিভিতে একটা সিরিয়াল দেখছিল। ও মুখ না তুলে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো।’

মুরাদ গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘ওষুধগুলো খাচ্ছ তো?’

ফারিয়া এবার ঘুরে তাকায়, ঠান্ডা গলায় বলে, ‘না খাচ্ছি না। ফেলে দিছি। আমার ওষুধ লাগবে না।’

মুরাদ চেষ্টা করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না, চাপা গলায় বলে, ‘এক মাসের পুরো ওষুধ ফেলে দিয়েছ? তুমি কী? ওষুধ না খেলে শুধু শুধু ডাক্তার কেন দেখালে?’

ফারিয়া মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। মুরাদ এবার ওর কাছে এসে বসে। একটা হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ফারিয়া, আমরা সবাই চাই তুমি ভালো হয়ে যাও আগেরমতো। ডাক্তার যেভাবে বলে সেভাবেই চলো ক’টা মাস।’

ফারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা। আমি কিনে নেবনি ওষুধ।’

মুরাদ স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ে। যাক ফারিয়া শেষ পর্যন্ত ওর কথা শুনছে। দেখে মনে হয় ও বুঝি সত্যিই অনুতপ্ত। মুরাদ সে রাতে ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। ফারিয়া নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে। ফারিয়াও ভাবছিল ওর মনের অসুখটা এবার সেরে যাবে। ও ঠিক ডাক্তারের কথামতো চলবে এখন থেকে। সন্তান, স্বামী – সবার কাছ থেকে ও দূরে সরে যাচ্ছে। কাল থেকে ওষুধগুলো খাবে, আর অবহেলা করবে না। তাতে করে ও ঠিক ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ফারিয়া জানত না ও আর কোনোদিন ভালো হতে পারবে না।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৬/০৭/২৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে