ভেনম পর্ব-০১

0
43

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ১)

১.
কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক টানা বৃষ্টি না। কিন্তু যখন হচ্ছে তখন পুরো একটা বেলা আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। তার পর পরই আবার রোদ। এবারের বর্ষার শুরুটা খুব অদ্ভুত। এই যে আজও মনে হচ্ছিল সারাদিন বুঝি আর সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিকেল হতেই বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার। মুরাদ আর আলসেমি করে বাসায় বসে থাকে না। বাসায় একদম শাকসবজি নেই। বেরোবার আগে একবার ফারিয়ার রুমে উঁকি দেয়। চোখের উপর হাতটা ভাঁজ করে শুয়ে আছে, ঘুমুচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

মুরাদ গলাখাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘বাজারে যাচ্ছি। শাকসবজি বাদে অন্য কিছু লাগলে মেসেজ দিও।’

ফারিয়া চোখের উপর থেকে হাত নামিয়ে ঘুম ঘুম চোখে একবার তাকায়, তারপর ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা।’

মুরাদ আর দেরি করে না। আবার না কখন বৃষ্টি নেমে পড়ে। লিভিং রুম পেরিয়ে দরজা খুলতে যেতেই পেছন থেকে কলেজপড়ুয়া মেয়ে পিংকি ডাক দেয়, ‘বাবা, আমার জন্য দুইশ পেজের দুটো খাতা নিয়ে এসো।’

মুরাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। মেয়েটা সবে কলেজে ঢুকেছে, সাইন্স নিয়ে। ওদের কলেজে পড়াশোনার ভীষণ চাপ। এরই মধ্যে চারজনের কাছে টিউশন নিতে হচ্ছে।

এখানকার বাজারটা একদম কাছেই, হাঁটা দূরত্বে। বিকেলে আগে আগে গেলে মাঝে মাঝে টাটকা শাকসবজি পাওয়া যায়। মুরাদ সেই লোভেই ছুটির দিনগুলোতে একবার হলেও বিকেলে বাজারে ঢুঁ মারে। ঢোকার মুখেই কচি সবুজ পুঁই শাক দেখতে পেয়ে ও থমকে দাঁড়ায়। তারপর পায়ে পায়ে কাছে যায়। পুঁই শাকের কচি পাতাগুলো কেমন সতেজ। দাম জিজ্ঞেস করতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আশি টাকা কেজি। অথচ গত সপ্তাহেই এটা চল্লিশ টাকা কেজি ছিল। সে কথা বলতে দোকানি তেড়িয়া গলায় বলে, ‘কেমুন বিষ্টি দেহেন না? এর মধ্যে যে শাক পাইছেন এই তো বেশি।’

মুরাদ গজগজ করতে করতে আধা কেজি পুঁইশাক নেয়। পাশেই কয়েকটা কচি জালি কুমড়া। এগুলো চাক চাক করে কেটে ভেজে খেতে খুব মজা। দরদাম করে একটা নিয়ে নেয়। দামটা অবশ্য অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশিই পড়ে যায়। বৃষ্টির দোহাই দিয়ে এরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিড়বিড় করতে করতে মুরাদ আরও কিছু কাঁচাবাজার করে। হাতে এখন চার পাঁচটা পলিথিনের ব্যাগ। বাজার থেকে বেরোবার মুখে কাঁচামরিচ কিনতে গিয়ে আরেকদফা মেজাজ খারাপ হয়। আড়াইশ টাকা কেজি! মুরাদ আড়াইশ গ্রাম কাঁচামরিচ নেয়। দাম মিটিয়ে খুচরো টাকাটা পকেটে ভরতেই ফোন আসে। সবগুলো ব্যাগ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে। বড়ো আপা শাম্মীর ফোন।

‘মুরাদ, তুই কই?’

মোবাইলটা কানে চেপে ধরে মুরাদ বলে, ‘এই তো আপা, বাজারে। কেন, ফোন দিয়েছ কেন?’

শাম্মী আপা এবার উত্তর দেবার গলায় বলে, ‘তোর দুলাভাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। একজন ভালো মেডিসিনের ডাক্তার দেখানো দরকার। তুই একটু খোঁজ নিয়ে সিরিয়াল দিলে যেতাম ওকে নিয়ে।’

মুরাদ কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। মোবাইলে আরেকটা কল ঢুকেছে। একবার স্ক্রিনে তাকাতেই বুক চলকে ওঠে, ফারিয়ার ফোন। ও তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘আচ্ছা আপা, আমি জেনে তোমাকে শীঘ্রি জানাব। এখন ছাড়ছি।’

ফোনটা রেখে ও দ্রুত ফারিয়ার নম্বরে ডায়াল করে। কয়েকটা রিং হতেই কেটে যায়। মুরাদ আবার রিং করে। এবারও কেটে যায়। যা ভেবেছিল তাই। ফারিয়া রাগ করে মোবাইল ধরছে না।

অগত্যা মেয়ের নম্বরে ফোন দেয়, ‘পিংকি, তোর মাকে ফোনটা দে তো।’

একটু পরেই ফারিয়ার তীক্ষ্ণ গলা পাওয়া যায়, ‘যার সঙ্গে কথা বলছিলে তার সঙ্গেই কথা বলো। যখনই ফোন করি, ফোন বিজি।’

গত কয়েকমাস ধরে ফারিয়ার এই সমস্যা হয়েছে। নাহ, আরও আগে থেকে। কিন্তু এখন বেড়েছে। সব কিছুতেই সন্দেহ। কোনো কারণে ফোন ব্যস্ত পেলে তো কথাই নেই। প্রথম প্রথম ও ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিত। কিন্তু দিন দিন এটা সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে।

মুরাদ স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে বলে, ‘সবসময় উল্টোপাল্টা কথা কেন বলো। বড়ো আপা ফোন দিয়েছিল। বিশ্বাস না হলে ওনাকে জিজ্ঞেস করো।’

কথাটা বলে ফোনটা কেটে পকেটে রাখে। খেয়াল করে আশেপাশের মানুষ হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুরাদের কপাল কুঁচকে যায়, ঠোঁট দুটো তীব্র অসন্তোষে বেঁকে যায়। হনহন করে বাসার পথ ধরে। ইচ্ছে হচ্ছে বাজারের ব্যাগগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে।

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ মনে পড়ে পিংকির খাতা কেনা হয়নি। এদিকে আকাশ আবার কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মুরাদ হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরিতে যায়। দ্রুত দুইশ পেজের দুটো খাতা কিনে একটা রিকশা নেয়। রিকশায় উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি নামে। মুরাদ টের পায় ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। খাতা দুটো যতটুকু পারে ভেতরের দিকে চেপে ধরে যাতে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে না যায়।

বাসায় পৌঁছাতেই মাগরিবের আজান পড়ে। পিংকি দরজা খুলে দিতেই মুরাদ আগে খাতা দুটো ওর হাতে দেয়। তারপর বাজারের ব্যাগগুলো কিচেনের সামনে নামিয়ে রাখে। ফারিয়া ইতোমধ্যে ঘুম থেকে উঠেছে। মুরাদের ইচ্ছে হয় না কথা বলতে।

হাতমুখ ধুয়ে টিভি সেটের সামনে বসে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে আড়চোখে খেয়াল করে ফারিয়া নাস্তা বানাচ্ছে। ফর্সা গোলগাল মুখটা গম্ভীর। একটা কাঠিন্য সারা মুখে। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। একটা সময় এত চুল ছিল যে সামলাতেই পারত না। বয়সের সাথে সাথে অনেকটাই মিইয়ে গেছে সব। এসব নিয়েই কি ওর মনটা এমন খিটমিটে হয়ে থাকে?

একটু পর পিংকি একটা হাফ বাটিতে নুডুলস নিয়ে এসে ওর সামনে রাখে। তারপর বলে, ‘বাবা, আম্মু বলেছে লবন নেই। লবন আনতে হবে।’

মুরাদ এবার বিরক্তি নিয়ে গলা চড়িয়ে বলে, ‘কেন, আমি যখন বাজারে ছিলাম তখন বলা গেল না?’

রান্নাঘর থেকে ফারিয়া ফোঁস করে বলে, ‘সে কথা বলতেই তো ফোন দিয়েছিলাম। দেখলাম ফোন বিজি। বাসার বাইরে গেলেই ফোন বিজি হয়ে পড়ে।’

মুরাদ সবে নুডুলস মুখে দিচ্ছিল। ও থেমে যায়, তারপর কেটে কেটে বলে, ‘তোমার এই অযথা সন্দেহ কবে যাবে? এমন কেনো করো?’

ফারিয়া উত্তর দেয় না। মুখ আরও গম্ভীর করে রান্নার জোগাড় করতে থাকে। পিংকি মাথা নিচু করে নিজের রুমে পড়তে চলে যায়। আম্মু ইদানীং কেমন যেন করে। সারাক্ষণ দু’জনের ঝগড়া লেগেই থাকে।

মুরাদের এখন সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। কোনো শান্তি নেই এই ঘরে। নুডুলসটা কোনোমতে খেয়ে আবার বের হয়, লবন আনতে। চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল, সেটা আর বলা হয় না।

সেদিন রাতে খাওয়া শেষে মুরাদ বেডরুমে শুয়ে শুয়ে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছিল। এমন সময় মেয়ের রুম থেকে কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেতেই ও উঠে আসে।

পিংকির তীক্ষ্ণ গলা পাওয়া যায়, ‘আমার মোবাইল নিচ্ছ কেন?’

ফারিয়া চোখে আগুন নিয়ে বলে, ‘কেন নিচ্ছি বোঝ না? রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করবে, আমি বুঝি না? রাতের বেলা মোবাইল আমার কাছে থাকবে।’

মুরাদ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বিরক্তির গলায় বলে, ‘ওর মোবাইলে আবার কী সমস্যা?’

ফারিয়া ঘুরে তাকায়, ‘খবরদার তুমি কোনো কথা বলবে না। নিজে তো নষ্টামি করে বেড়াও এখন মেয়েটাও বিপথে যাচ্ছে।’

পিংকি এবার ফুঁপিয়ে বলে, ‘আম্মু শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করে। আমি কলেজের গ্রুপে পড়াশোনা নিয়ে একটু কথা বলি, আর কিছু না।’

ফারিয়া ফোঁস করে ওঠে, ‘পড়াশোনা নিয়ে কথা বলো নাকি কী নিয়ে কথা বলো জানা আছে আমার। এখন থেকে রাতে মোবাইল আমার কাছে থাকবে।’

মুরাদের মন খারাপ হয়। ফারিয়া এখন মেয়ের সঙ্গেও যা তা ব্যবহার করছে। মেয়ের যে টিন এজ বয়স চলছে সেটা মাথায় নেই।

মুরাদ ভেতরে ঢোকে, তারপর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘মা, ইন্টারমিডিয়েট-এ কিন্তু পড়ার চাপ অনেক। আম্মু যেটা করেছে সেটা তোমার ভালোর জন্যই করেছে।’

পিংকির চোখমুখ লাল হয়ে আছে৷ একটা একরোখা ভাব চোখেমুখে। ইতোমধ্যে ফারিয়া ওর মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

মুরাদ বেডরুমে ঢুকে কপাল কুঁচকে বলে, ‘মেয়ে যে বড়ো হয়েছে এটা বোঝ? ওর হাত থেকে অমন করে মোবাইল কেড়ে নিলে কেন?’

ফারিয়া চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তুমি বেশি বোঝ? সেদিন আমি দেখেছি ও একটা ছেলের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলছে। কখন কী করে ফেলবে তার ঠিক আছে।’

মুরাদ থমকায়। তারপর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘সেটা বুঝলাম। কিন্তু এই বয়সটা ভালো না। অল্পতেই ভীষণ অভিমান হয়। তাতে করে সুইসাইড করে ফেলতে পারে।’

ফারিয়া কেমন অসুস্থ মানুষের মতো হাসে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তোমরা বাবা মেয়ে যা শুরু করেছ তাতে আমিই সুইসাইড করব।’

মুরাদ টের পায় ওর আবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিছু হলেই সুইসাইডের হুমকি দেয়। বিয়ের সেই প্রথম থেকেই এটা দেখে আসছে। এই একটা ব্যাপার ও ভীষণ ভয় পায়। সারাক্ষণ মনের ভেতর একটা টেনশন কুড়ে কুড়ে খায়। এখন দুটো টেনশন যোগ হয়েছে। পিংকিও যদি রাগ করে কিছু করে ফেলে?

মুরাদ নরম গলায় বলে, ‘আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। তুমি ওকে নিয়ে এত টেনশন কোরো না। এই বয়সে এক আধটা প্রেম হয়। আবার সময়ের সাথে সাথে সেটা কেটেও যায়। ওর মাথায় পড়াশোনার গুরুত্বটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ পেলে জীবন কেমন করে পাল্টে যাবে সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাহলে দেখবে ও আর কোন ভুলভাল করবে না।’

ফারিয়া কোনো উত্তর দেয় না। চুপ করে বসেই থাকে। মুরাদ আজ নিজেই বিছানা করে ডাকে, ‘আসো, ঘুমিয়ে পড়ো।’

ফারিয়া উঠে দাঁড়ায়, ‘আমি পরে ঘুমাব।’

সেদিন রাতে একটু পর পর মুরাদের ঘুম ভেঙে যায়। আর যতবারই ঘুম ভেঙ্গে যায় ততবারই একবার করে মেয়ের রুমে উঁকি দিয়ে আসে।

২.
‘কী রে, এখনও বের হোস নি?’
তাবাসসুমের রিনরিনে গলায় মুরাদ মাথা তুলে তাকায়। নিজের টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছিল। অফিস ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওর মতো এক দুজন এখনও রয়ে গেছে। তাবাসসুম ওর মতোই এই ওষুধ কোম্পানির একজন ম্যানেজার। পাশাপাশি রুমেই বসে।

মুরাদ মাথা নাড়ে, ‘এই তো যাব।’

তাবাসসুম ওর সামনে এসে বসে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোর কী হয়েছে? সেই সকাল থেকেই মুড অফ দেখছি? বউয়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে?’

ফারিয়ার ব্যাপারটা তাবাসসুমের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। মানে করতে হয়েছিল। অফিসের প্রয়োজনে প্রায়ই তাবাসসুমকে ফোন করতে হতো। আর ফারিয়া এটা কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারত না। শেষ পর্যন্ত ওকে অনুরোধ করতে হয়েছে যাতে বাসায় থাকলে ওকে ফোন না দেয়।

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হুম। আচ্ছা বল তো একজনকে সারাক্ষণ এমন করে খোঁচালে সে বাঁচে কী করে?’

তাবাসসুমের মায়া হয়। আট বছর ধরে ওরা একসাথে কাজ করছে। মুরাদকে কখনও উল্টোপাল্টা কিছু করতে দেখেনি।
ও ধারালো গলায় বলে, ‘তুই অমন ছেড়ে দিস কেন? কড়া গলায় কিছু বলতে পারিস না?’

মুরাদ হতাশ গলায় বলে, ‘কড়া করে কিছু বলতে গেলে খালি সুইসাইডের হুমকি দেয়। আর এই বিষয়টা আমি ভীষণ ভয় পাই। কী করি বল তো? কেন আমার সঙ্গে এমন করে?’

তাবাসসুম একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোর এই সমস্যাটা আমার কাছে আজব লাগে। আচ্ছা মুরাদ, সত্যি করে বল তো, তুই কোনো আকাম করে বউয়ের হাতে ধরা পড়িসনি তো?’

মুরাদ এবার হাসে, তারপর কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘কী যে বলিস। করলে তো তোর সঙ্গেই করতাম।’

তাবাসসুমের গালটা একটু লাল হয়। ও চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তাই, না? চল ওঠ। বাসায় যা। বউকে বেশি করে সময় দিবি। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মুরাদ মাথা নাড়ে, ‘হুম। আমার পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতি। আচ্ছা থাক সে কথা। ট্যুরের সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো?’

অফিসের কাজে সামনের সপ্তাহেই ওদের একসঙ্গে সিলেট যাবার কথা। তাবাসসুম উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি গাড়ি রিকুইজিশন দিয়েছি। তোকে বাসা থেকে তুলে নেব।’

মুরাদ জোরে মাথা নাড়ে, ‘আমি অফিস আসব ওইদিন। অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে আমিই তোকে তুলে নেব।’

তাবাসসুম উত্তর দিতে যেয়েও থেমে যায়। ওর বাসায় আসা মানে উলটো পথে আসা। আহারে বেচারা, বউয়ের ভয়ে এমন করতে হচ্ছে!

তাবাসসুম ওকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আচ্ছা, তুইই আসিস। আমার সমস্যা নেই।’

মুরাদ ব্যাগ গুছিয়ে বলে, ‘চল, নামি।’

গাড়িতে উঠে একটা কথা মনে হয়, ইদানীং ওর বাসায় ফিরতেই ইচ্ছে করে না। ফারিয়ার জন্য মনটা বিষিয়ে উঠেছে।

সেদিন রাতে খাওয়ার পর ট্যুরের কথাটা বলতেই ফারিয়া সন্দিগ্ধ গলায় বলে, ‘কাকে নিয়ে যাচ্ছ?’

মুরাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, ‘কাকে নিয়ে যাচ্ছি মানে?’

ফারিয়া মুখ গম্ভীর করে মশারী করে। তারপর বাতি নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে চুপচাপ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকে। তারপর কেমন একটা গলায় বলে, ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি সিলেটে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ অথবা ওখানে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ।’

মুরাদ টের পায় মাথায় রক্তচাপটা বেড়ে যাচ্ছে। কপালের দুইপাশ কেমন দপদপ করছে। রাগী গলায় বলে, ‘তুমি সবকিছু নিয়ে এমন বাজে কথা কেন বলো? সমস্যা কী তোমার? কোনোদিন আমার উল্টাপাল্টা কিছু দেখেছ?’

ফারিয়া ঠান্ডা গলায় বলে, ‘দেখিনি। কিন্তু আমি টের পাই তোমার মধ্যে কোনো না কোনো ঝামেলা আছে। শোনো মুরাদ, একবার যদি প্রমাণ পাই আমি সেইদিনই এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। না হয় সুইসাইড করব। আর মরার আগে তোমার নাম লিখে যাব।’

মুরাদ টের পায় ওর কেমন যেন শীত শীত লাগছে। রাগটা গিলে ফেলে। গম্ভীর গলায় বলে, ‘ফারিয়া, কথায় কথায় এই কথা কেন বলো? মেয়ে বড়ো হয়েছে। ওর সামনেও ইদানীং এসব বলো। একদিন দেখবে তোমার মেয়ে তোমাকে এই হুমকি দেবে।’

কথাটায় কাজ হয়। ফারিয়া আর কোনো উত্তর দেয় না। ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে। মুরাদ একবার তাকিয়ে কোলবালিশ টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ পর ফারিয়া হঠাৎ উঠে বসতেই মুরাদ চোখ কুঁচকে তাকায়। তারপর বিরক্ত গলায় বলে, ‘কী হলো, উঠে পড়লে কেন? ঘুমাবে না?’

ফারিয়া হিসহিসিয়ে বলে, ‘তোমার তো খালি ঘুম। বউকে আদর করতে ইচ্ছে করে না? আমি না বললে তো ইদানিং আমাকে ছুঁয়েও দেখো না। কার সাথে তোমার সম্পর্ক তাই বলো। অসভ্য লোক একটা।’

মুহুর্তেই মুরাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আদর ব্যাপারটার সঙ্গে মন জড়িয়ে থাকে। তুমি সারাক্ষণ এমন ঝগড়া করবে আর আমি তোমাকে রাত হলে আদরের জন্য টেনে নেব?’

ফারিয়া তীব্র শ্লেষের গলায় বলে, ‘আমাকে টেনে নিতে হবে না। যার পাল্লায় পড়েছ তারে টেনে নিও। আমি এই সংসারেই থাকব না।’

কথাটা বলেই ফারিয়া দুই হাতে মশারীটা হ্যাঁচকা টানে উঠিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে। তারপর এলোমেলো পায়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসে থাকে।

মুরাদ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত পোনে একটা। কাল সকালে অফিস আছে। কিন্তু ঘুমাবে কী করে? ফারিয়ার রাগ না কমা পর্যন্ত ওকেও জেগে থাকতে হবে। দুই দিন পর পর এই অশান্তি আর ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব অশান্তি শেষ করে দিতে।

মুরাদ উঠে বসে। গলা বাড়িয়ে ডাইনিং-এর দিকে তাকায়। ফারিয়ার পা দেখা যাচ্ছে।পায়ের আঙুলগুলো কেমন সাদা টাইলস খামচে ধরে আছে।

রাত বাড়ে। মুরাদ ঢুলুঢুলু চোখে ফারিয়ার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে। আর ফারিয়া কেমন শুন্য চোখে ডাইনিংয়ের সিলিংয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৬/০৭/২৪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে