#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩(শেষ)
ঘড়ির কাটায় রাত বাজে এগারো টা। আগামীকাল চলে যাব তাই গুছিয়ে নিচ্ছি সব। আয়ান ঘরে ফিরলো। তার সাথে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলাম। অবাক লাগলেও ভাবলাম হয়তো তার কোন আত্মীয় হবে। শাশুড়ির রুমে ডুকলো মেয়েটাকে নিয়ে। আয়ানকে বলতে শুনলাম, মা এই সে!
আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে শাশুড়ির রুমের দরজায় দাড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে ও?
মা ছেলে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। মেয়েটা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল। আমার সন্দেহ বাড়ছে। জোর গলায় বললাম, “কে ও, বলছো না কেন?”
আয়ান কাঠ কন্ঠে বলল, “ওকে বিয়ে করেছি আমি।”
কথাটা শুনামাত্র আমার চারপাশ ঘুরতে লাগলো। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ছেলেকে নামিয়ে রেখে দরজা শক্ত করে ধরলাম। শত চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারলাম না। বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললাম। প্রচন্ড রাগে এগিয়ে গেলাম আয়ানের কাছে। তার শার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিলাম, “তোমার সাহস কি করে হয়, একটা বউ থাকা স্বত্বেও আরেকটা বিয়ে করার? উত্তর দাও?”
আয়ান কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিলো। বাচ্চা কান্না করছে, গিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটাকে কষিয়ে কয়েকটা থা*প্প*ড় দিলাম পরপর। বাজেভাবে বললাম, তুই কেমন মেয়ে? জানতিস না ওর বউ আছে, বাচ্চা আছে। তারপরেও পালিয়ে এসেছিস? দুনিয়ায় কি আর ছেলে ছিলো না বিয়ের জন্য? ফের আবার মারতে গেলে আয়ান এসে সজোরে আমাকে থা*প্প*ড় দিলো এলোপাতাড়ি।
শাশুড়ী বললেন, এসব হচ্ছে কি? ছেলেরা বিয়ে করতেই পারে সমস্যা কি তাতে? তোমাকে তো আর ফেলে দেবে বলেনি।
আমি কি করব কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না। দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছি শুধু। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকে জড়ো হয়ে গেছে। কেউ কেউ লুকিয়ে আমাকে বলছে, পুলিশে যাও। এই করো ওই করো। কিন্তু আমি ওসব কিছুই ভাবছি না। আমি চাচ্ছি এই মুহুর্তে এই নরক থেকে পালিয়ে যেতে।
সবাই ওদিকে ব্যস্ত। আমি ছেলে কোলে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সাথে কোন ফোন ও নিয়ে আসিনি। আগে আমার বাড়ি যেতে হবে। নয়তো দম আটকে আমি মরেই যাব। এত কিছু সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
তাড়াতাড়ি ভ্যান এ উঠলাম। ভ্যান থেকে নামিয়ে দিলো বাস স্টেশনে। রাত বাড়ছে। মানুষজনের সংখ্যা কম স্টেশনে।খানিক ভয় ভয় ও লাগছে। হঠাৎ কেউ আমার নামে ডাকলো ‘এই রুহি’ বলে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ফুয়াদ।
সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে তুমি এখানে কেন? আর এ কি অবস্থা তোমার? হয়েছে টা কি?”
কিছু বলার মতো অবস্থা না আমার। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে।
“এ কি তুমি কাঁদছো কেন? প্লিজ বলো রুহি, হয়েছে কি? এদিকে এসো বসো এক জায়গায়।”
আমি নড়লাম না। সে হাত ধরতেই চিৎকার করে উঠলাম। “হাত ছাড়ো বলছি।”
“আরে চিৎকার করছো কেন? মানুষ ভাববে কি! ছেলেটা কাঁদছে। আমার কাছে দাও।”
“না। আমার ছেলেকে নিবে না। কাঁদুক। ”
“আরে পাগল তোমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি না।” এই বলে সে ছেলেকে কোলে নিলো। দোকান থেকে পানি এনে দিয়ে বলল, “পানি খাও। মুখ ধুয়ে নাও। ভালো লাগবে। আর আমাকে বলো কোথায় যাবে?”
বিস্তারিত তাকে বলে বললাম, আমি এখন আমার বাড়ি যাব।
সব শুনে ফুয়াদ বলল, “তোমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। ওখানে থেকে তোমার পরিবারকে খবর দেওয়া উচিত ছিলো।”
“তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে আসিনি।। ছেলেকে দাও। আমাকে যেতে হবে।”
“চলো আমি নিয়ে দিচ্ছি।”
আগুন চোখে তাকালাম তার দিকে, “আমি একা যেতে পারব।”
“এত রাতে একা যাওয়া সেফ না। আমি তোমার বাড়ি যাব না। শুধু সাথে যাব। তুমি পৌঁছালেই চলে আসব। অযথা তর্ক করো না। বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। ”
কিছু না বলে বাসে উঠলাম।
বাড়ি গিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। খানিক সময় পার হলে সব বললাম। মা-বাবা ভাইসহ সবার একই কথা, শেষ দেখে ছাড়বে আয়ানের। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আয়ানকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।
বাবা, ভাই তাই করলেন। টাকা পয়সা সব ঢেলেও আয়ান রেহাই পায়নি। জেল খাটছে কয়দিন। পরে আমারই দয়া হলো, যত হোক সে আমার ছেলের বাবা। বাবাকে মিনতি করে তাকে ছাড়ালাম।
তারপরে শুরু হলো আমার উপর জবরদস্তি। আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নামলেন মা-বাবা। কিন্তু আমি কোনমতে রাজি না। তার কারণ আমার ছেলে। তাকে কখনও একা ছাড়ব না আমি। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় অনেক কথা ও শুনতে হয়েছে পরিবারের সবার। চুপচাপ শুনতাম। কিছু বলতাম না। কান্না পেলে কাঁদতাম। ভাবলাম আর বিয়েই করব না। ছেলেকে নিয়ে এই ছোট্ট জীবন কাটিয়ে দিতে পারব অনায়াসে।
সুখে দুঃখে কেটে গেছে দুই থেকে তিন বছর। এর মধ্যে আমি প্রাইমারিতে জব ও পেয়ে গেলাম। মানসিক অবস্থা ও আগের থেকে ভালো। হুট করে এক সন্ধ্যায় ফুয়াদের আগমন। তাকে দেখে বেশ চমকালাম। এতবছরে তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিলো না। সে কেন, কোনও ছেলের সাথে আর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। নিজের ইচ্ছে ছিলো না।
ফুয়াদের সাথে দেখি আরও মানুষ। জানতে পারি তার মা ভাই উনারা। আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে আমার পরিবারে। বুঝতে পারলাম না। এত বছর পর সে আবার কেন ফিরলো। তাও বিয়ের জন্য। আমি তাকে আড়ালে ডাকি। নাকোচ করি প্রস্তাব।
জানাই বিয়ে করব না আমি। আর তোমাকে তো কখনই না।
সে বলে, “কেন।”
আমি বলি, “নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না। তাই করব না।”
সে বুঝায়, “সবাইকে এক পাল্লায় মেপো না। আজ তিন চারটে বছর থেকে তোমার পিছনে পড়ে আছি, তুমি কথা না বলা স্বত্বেও। এই যুগে ক’জন এমন করে একবার ভাবো? তারপরেও আমাকে বিশ্বাস করছো না। একবার বিশ্বাস করে দেখতে পারো আমায়। কখনও ভাঙবে না।
জানো রুহি? যেদিন তোমায় প্রথম লাইব্রেরি তে দেখি, এক আকাশ পরিমাণ মুগ্ধতা নিয়ে তোমাকে দেখেছিলাম। এখনও দেখি। জীবনের শেষ অব্দি ও দেখতে চাই। প্লিজ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না আমায়।”
“আমার ছেলেকে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না। বাবাহারা সে, মা হারাও করতে চাই না। দরকার হয় আমার সুখ বিসর্জন দেবো।”
সে হাসলো খানিক। বলল, “তুমি সত্যিই পা*গ*ল৷ আমাকে বুঝতে পারো নি। ছেলেটা তোমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তোমাকে আপন করতে চাই মানে, তোমার আপন সবকিছু আমার ও আপন। আমি যেমন ভালো স্বামী হব তেমনি একজন ভালো বাবা হয়েও দেখাবো। তোমার আমার দুজনের সাথে ছেলে থাকবে।”
“এতদিন কোথায় ছিলে? কোন মেয়ে আসেনি জীবনে?”
“সত্যি বলতে মেয়ে এসেছে। কিন্তু মন বসাতে পারিনি কোথাও। ওভাবে সম্পর্ক ও গড়ে উঠেনি কারও সাথে। মনের ঠিকানা একমাত্র তোমার মাঝে।
আর এতদিন আমি বাহিরে ছিলাম। তোমাকে তো নক করলেই ব্ল*ক করতে তাই আর করিনি। সব খবরাখবর নিতাম তোমার বান্ধবীর থেকে। বলো না বিয়ে করবে আমায়?”
“জানি না। আমার মন সায় দিচ্ছে না।” বলে আমি চলে আসলাম।
আমি দু টানার মধ্যে থাকলেও পরিবারের সবাই রাজি হওয়াতে আমিও হলাম। মা তো বলেই দিয়েছেন, এ বিয়েতে রাজি না হলে আমার আর মুখ দেখবি না। দুদিন পর আমরা মরে গেলে কে তোকে দেখবে। ভাগ্যের লিখন হয়তো তাই ছিলো। আমাদের বিয়ে হলো। এত এত ভালোবাসা, কেয়ারিং দেখে আমি মাঝেমধ্যে অবাক হই। একটা মানুষ এত ভালো হয় কি করে। মন বলে, এইতো মনের মতো কাউকে পেয়েছি।
দেখতে দেখতে বিয়ের সাত বছর হয়ে গেলো। সপরিবারে আমরা লন্ডনে থাকি। ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমেনি ফুয়াদের। ছেলের সাথে বন্ডিং ভালো ফুয়াদের। ফুয়াদকে বাবা বলেই ডাকে সে। তাদের যখন একসাথে আড্ডা দিতে দেখি তখন আমার একটা কথাই মনে হয়, মাঝেমাঝে রক্তের সম্পর্ক থেকেও আত্মার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। ফুয়াদ তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে।
আয়ান তার মা বোন কদিন পরপর কল দেন ছেলের সাথে কথা বলার জন্য। ফুয়াদ নিজে থেকে কথা বলিয়ে দেয়। শুনেছি সেই মেয়েটা আয়ানের সাথে নেই। ডিভোর্স হয়েছে। আর বিয়ে করেনি কাউকে।
মাঝেমধ্যে বুক খানিক হু হু করে উঠে আয়ানের জন্য। প্রথম ভালোবাসা সে। পরমুহূর্তে যখন আবার মনে পড়ে আমার সাথে করা তার অ*ত্যা*চা*র। তখনি ঘৃ*ণা জেগে উঠে।
[সমাপ্ত ]