ভুল থেকে ফুল পর্ব-০২

0
59

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২

সব ঠিকঠাক চলতে লাগল। আয়ান যে আমার অজান্তেই তার পরিবারকে এ বিষয় জানিয়েছে, সেটা আমি জানতাম না। তার মা-বাবা সবার পরামর্শেই সে সালিশ বসিয়েছে। নিজের স্ত্রীকে সবার সামনে এভাবে সালিশ ডেকে অপমান করার বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারছি না। না চাইতেও তার প্রতি খারাপ লাগা আসছে। আমার জন্য আমার মা-বাবার বা সম্মান কোথায়! সে আমার পরিবারের দিকটা ভেবে দেখলে পারতো। এত মিনতি করার পরেও সে কেন এমন কাজ করল! কেন অন্যদের কথা শুনতে গেলো! তার নিজের বিবেক নেই!

উপস্থিত সবার সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “তুমি কি সংসার করতে চাও?”

কোন কথা না বলে আমি হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম।

“যদি করতে চাও তাহলে আজ থেকে ওই ছেলের সাথে কখনও কোনও কথা বলবা না।”

বাধ্য মেয়ের মতো আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে আসলাম নিজের রুমে। জোরে কান্না পাচ্ছে আমার কাঁদতে লাগলাম। মা এসে বললেন, এমনভাবে তোর জন্য আমাদের ছোট হতে হবে কখনও ভাবিনি।

মাকে পুরো বিষয় বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে হলো না আমার। থাকার জন্য ও বললাম না। ফুপিয়ে কাঁদছি। আয়ান হেসে ঘরে ডুকলো। জড়িয়ে ধরলো আমায়।এই প্রথমবার তার জড়িয়ে ধরায় গা গিরগির করতে লাগল। সে বলল, সব ঠিক হয়ে গেছে, আর কোনও ঝামেলা নেই। আমিও তোমায় ক্ষমা করে দিলাম।

একবার বলতে ইচ্ছে হলো, আমি তোমার বউ হই।আমার ভুলগুলো একান্ত তুমি শুধরাবে। তুমি কেন দু’পরিবারে সেটা জানাবে। এতে আমি আর আমার পরিবার অপমানিত হয়েছি। তোমার প্রতিও ঘৃ*ণা আসছে। কিন্তু কিছুই বললাম না। সে বুঝার হলে আগেই বুঝতো।

কয়েকদিন এই বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেল। হাসি আনন্দে দিন কাটছে আয়ানের সাথে। ওদিকে ফুয়াদ বিভিন্ন নাম্বার থেকে, বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে, হোয়াটসঅ্যাপ এ নক করে, আমি সাথে সাথে ব্ল*ক দেই। আমি চাই না আবার আমার সংসারে অশান্তি লাগুক।

আমি প্রে*গ*ন্যা*ন্ট হই। মা হতে চলেছি, এই অনুভূতি বলে বুঝানের মতো না। আয়ান আর আমি ভীষণ খুশি। ডেলিভারি হওয়ার দুমাস আগে বাপের বাড়ি চলে যাই। আয়ান প্রথমে রেগুলার খোজ খবর নিলেও আস্তে আস্তে তার মাত্রা কমে আসলো। এমনিতে শরীর ভীষণ খারাপ তার উপর তার এই পরিবর্তন আমাকে গভীর ভাবাচ্ছে। আমি কোনমতে শান্তি পাচ্ছি না। দুই দিনে, তিনদিনে একবার সে আমায় কল করে তাও তিন চার মিনিট কথা বলে শেষ। অভিমান করে আমিও আর কল দেইনা। এই মানসিক অশান্তি ভোগ করতে করতে চলে আসলো আমার ডেলিভারি ডেট। সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চাইলেই আমার দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারতো কিন্তু নেয় নি। শুধু এক দুইবার খোজ নিয়েছে, ব্যাস। আমার ছেলে বাবু হয়েছে। গভীর রাতে বাবুকে বুকে জড়িয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদলাম। সে কেনো আসলো না এইজন্য।

একটা সংসার তো আর সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমি দ্রুত তার কাছে ফিরলাম। মানুষটার হয়েছে টা কি তা দেখার জন্য। নজরুলের মতো লম্বা চুল আর উদাস উদাস ভাব দেখে আমার সন্দেহ হলো বেশ। কিন্তু প্রকাশ করিনি কিছু। আমার সাথে ভালোই ব্যবহার করছে। বাবুকে যত্ন করছে। মেয়ে তো আমি, তাই সে শত আঘাত দেওয়ার পরেও একবার ভালো করে কথা বললে সব ভূলে যাই।

সপ্তাহ যেতে না যেতে একদিন তার ফোনের ওয়ালে একটা মেসেজ আসলো হোয়াটসঅ্যাপ এর। স্বাভাবিক মেসেজ না, প্রেমের কথা। আমার দম বন্ধ লাগছিলো এটা দেখে। কিন্তু আয়ানকে বুঝতে দেইনি। তার ফোনের পাসওয়ার্ড চেন্জ ছিলো তাই কৌশলে আগে সেটা জানলাম। সারাদিন অশান্তিতে থেকেছি, রাতে অনেক আগে শুয়ে পড়লেও ঘুমাইনি। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। সে যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন রাত তিনটা। তার ফোনটা হাতে নিয়ে চুপিচুপি বারান্দায় গেলাম। ফোন কল, মেসেজ, মেসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু সবকিছুতে একই মেয়ে। ভালোবাসার, প্রেমের, রোমান্টিক আর অ*শ্লী*ল*তার মেসেজে ভরপুর সব বক্স।এসব দেখে বসে পড়লাম আমি। অদ্ভুত কাঁপুনি হচ্ছে পুরো দেহে। কান্নারা দলা বেধে গলায় এসে জড়ো হলো। মুখে কাপড় গুজে চিৎকার করলাম। কবে থেকে এসব শুরু তা খুজতে লাগলাম। সব দেখে বুঝলাম, আমি বাড়ি যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই সে রিলেশনে জড়িয়েছে। নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট মনে হলো আমার। আমি এতো আকর্ষণীয় হয়েও তাকে আমাতে আসক্ত করতে পারলাম না।

আয়ান টের পেয়ে উঠে আসলো। কেড়ে নিলো ফোন। কেঁদে কেঁদে বললাম, “এটা কি করলে? আমাদের বাচ্চা আছে এখন! এখন কি এসবের সময়?”
সে ঝটপট উত্তর দিলো, “তুমি প্রেম করতে পারছো, আমি পারব না কেন?”
আমি শকড খেলাম তার কথায়। বললাম, “আমি জাস্ট ক’দিন কথা বলেছি। এত ভালোবাসার আর নোংরামি মেসেজ করিনি। আমি জড়ানোর আগেই ফিরে এসেছি। অনুতপ্ত হয়েছি। মাফ চেয়েছি। আর তুমি! মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা তোমার বউয়ের থেকেও বেশি ঘনিষ্ঠ। ”

আয়ান কোন উত্তর দেয় নি। সে অনুতপ্ত ও নয়। আমার মন বলছিলো, এই বোধহয় বলবে, আর এমন হবে না রুহি। মাফ করে দাও। কিন্তু সে বলেনি এমনটা। ব্যাপারটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটালাম। কাউকে বলার ও সাহস নেই। বললে নিজেরই লজ্জা লাগবে। যদি কেউ করুণা করে বলে উঠে, বউ এত সুন্দর হওয়া স্বত্বেও বর আরেক মেয়ের সাথে কথা কয়, ইশ বেচারী!
এই যে এই কথাগুলো আমি মেনে নিতে পারব না। নিজেরে বড্ড ছোট লাগবে।

পরের দিন রাত ১২টায় সে টেক্সট করছে ওই মেয়ের সাথে। আমি গিয়ে পাশে বসি। না চাইতেও চোখের পানি পড়ছে। সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ ও নাই। রাগে, জেদে, কষ্টে রুমে এসে ব্লে*ড নিয়ে নিজের হাত কাটতে গেলাম। কেটে কেটে একদম রক্তের নদী বসিয়ে ফেলব, এমনটা মনোভাব। হুট করে তখন মাথায় আসলো একটা কথা, আমি পাশে বসে কান্না করা স্বত্বেও যে ফিরে তাকায়নি একবার। আমার পুরো শরীর কেটে ফেললেও তার কিছু যাবে আসবে না। আমি উঠে দাড়ালাম। নতুন করে শক্তি পেলাম। ওযু করে তাহাজ্জুদ পড়লাম। কেঁদে কেঁদে দোয়া করলাম। দীর্ঘ সময় মোনাজাত করার পর ভেতরে শান্তি অনুভব করলাম।

তারপর থেকে আমাকে কেমন যেন অন্যচোখে দেখে সে। অল্পস্বল্প ভুল হলে শাশুড়িকে, এমনকি আশেপাশের সবাইকেও বলে। তারা আবার আয়ানকে ফিরতি বলে, বউকে এতছাড় দিতে হয় না। শাষন করতে হয়। আমি এসব শুনি আর আড়ালে গিয়ে চোখের পানি ফেলি। আয়ানকে অনেক বুঝাই। কিন্তু সে ঠিক হয় না। আমি হিসেব খুজি, কি করে একটা মানুষ এভাবে রাতারাতি পরিবর্তন হয় হুট করে। আমার হিসেব মেলে না।

আমার প্রতি তার অবহেলা চরম পর্যায়ে পৌছাচ্ছে। অযথা খুত খুজে। বকে। অপমান করে। বহুদিন অপেক্ষা করেছি, সে ভালো হওয়ার। একটা বাচ্চা আছে এজন্য সব ছাড় দিয়েও থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। অপারগ হয়ে ভাবলাম, আমার বাচ্চার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তখন মা-বাবাকে পুরো বিষয়টা জানালাম। বললাম, আমি আর পারছি না। পাগল হয়ে যাব এভাবে থাকলে। আমি আসছি বাড়ি।

সপ্তাহের ভেতর চলে গেলাম বাপের বাড়ি। কিছুদিন যেতেই আয়ান যায়, মিনতি করে নিয়ে আসে। বলে আর করবে না এসব। এভাবে কয়েকবার চলল, আমি যাই আর সে ‘করব না’ বলে নিয়ে আসে। কিছুদিন ভালো যায় তারপর আবার শুরু হয় অশান্তি। খারাপ ব্যবহার করে। আমার সত্যিই খুব ঘৃ*ণা চলে আসল আয়ানের প্রতি। ঠিক করলাম, তার কথায় আর ভুলব না। হাজার মিনতি করলেও ফিরব না। সে আমাকে জ্বালাবে, আবার ছাড়বে ও না। অন্য জায়গায় ফ*ষ্টি*ন*ষ্টি করে বেড়াবে। এবার তাকে চিরতরে মুক্তি দেবো।

চলমান…..!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে