#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১
শশুরবাড়িতে আজ আমার বিচারের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষজন। দুই পক্ষের লোক উপস্থিত। সালিশ ডেকেছে আমার স্বামী আর তার মা-বাবা। আমার স্বামী আয়ান বসে আছে সোফার উপর। তার মুখে শয়তানি হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার কাছে হাসিটা পৈশাচিক হাসি লাগছে। অনেকক্ষণ কি সব কথাবার্তা হওয়ার পর আমাকে খানিক আগে ডাকা হয়েছে। আমি এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হচ্ছে যে, আমার জন্য এ সালিশ বসেছে আর সেটাও আমার স্বামী করেছে। লজ্জায় ঘৃণায় এখনি আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। মন বলছে, এখনি ফ্লোর দু’ভাগ হয়ে যাক আর আমি গর্তের মধ্যে ডুকে পড়ি।
আজ থেকে প্রায় তিনবছর আগে আয়ানের সাথে আমার বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে। ঠিকঠাক চলছিলো সব কিন্তু বাধা আর মনোমালিন্য তখনি তৈরি হলো, যখন আমি অন্য একজনের সাথে প্রেমে জড়িয়ে যাই। অপর মানুষটির সাথে প্রায় এক মাস কথা বলার পর আয়ান বুঝে যায় ব্যাপারটা আর আজ সেজন্য আমার এই অবস্থা। আমি স্বামী রেখে অন্য একজনের প্রেমে পড়েছি ঠিক। কিন্তু ভুলটা আমার হলেও আমার স্বামী এতে বেশি দোষী। তার কারণেই আমি আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি।
আমি রুহি। দেখতে বেশ সুন্দর, আকর্ষণীয়, মায়াবী আর আবেদনময়ী। বেশিরভাগ ছেলে প্রথম দেখায় আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য। ছোট থেকে আমি আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে আসছি। কিন্তু, ‘তুমি দেখতে বেশ মায়াবী, চোখ ফেরানো দায়’ এই কথাটা হাজারজনের থেকে শুনেও আমার মন ভরতো না, ভালো লাগতো না। মন চাইতো, বিশেষ একজনের থেকে এই কথাটা শুনতে। তারপর হুট করে বিয়ে হলো। আয়ান আসলো আমার লাইফে। আমাদের মধ্যে প্রেম হলো। ভালোবাসা হলো। কিন্তু বিয়ের তিন বছর হতে গেলো, প্রথম প্রথম এক দুইবার সে আমার প্রশংসা করলেও আর করেনি। চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও বলেনি, জানো রুহি? তোমার চোখজোড়া অদ্ভুত সুন্দর! অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ছাড়া সে কখনও রোমান্টিক আলাপ ও করেনি। চাঁদনী রাতে হাতে হাত ধরে চাঁদ দেখে গল্প করার কথা থাকলেও আমাদের এমন মুহুর্ত আসেনি। আমি আমার ইচ্ছের কথা বললেও সে নীরব থাকতো। কোনকিছুতে তার ইন্টারেস্ট নেই। যা লাগবে সে তা ঠিক টাইমে এনে দেবে, তার ভালোবাসা এইটুকুতে সীমাবদ্ধ। কেয়ারিং এর বিষয়ে সে জিরো। আমার মন চাইতো, কেউ আমায় ভীষণ যত্নে রাখুক। চোখে হারাক। মন খারাপের দিনগুলোতে আমার পাশে বসুক। আমার মন ভালো করার দায়িত্ব নিক। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।
আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আমার থেকেও বোধহয় বেশি বাসি। কিন্তু তবু হৃদয়ে অশান্তি লাগতো। সে থাকা স্বত্বেও ভেতর বাড়িতে অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করতো। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। খালি মনে হতো, আমি এখনও পরিপূর্ণ না। আমার মনের মতো কাউকে পাইনি।
লেখাপড়া ছাড়া নিজেকে অচল লাগে। তাই বিয়ের পরেও লেখাপড়া কন্টিনিউ চলছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। কলেজে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। কেউ কেউ যেচে এসে কথা বলে। বিবাহিত শুনার পর মন্তব্য করে, যে আপনাকে পেয়েছে সে খুবই ভাগ্যবান। তাদের থেকে এ কথা শুনলেই আমার মন ভেঙে যায়। মনে হয়, সবাই বলে আমারে যে পাইছে সে ভাগ্যবান কিন্তু আজ অব্দি একবারও সে বলল না, তোমাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান। অচেনা অভিমান আর মন খারাপি ভর করে তখন আমার উপর।
এক বৃষ্টিস্নাত দিনে লাইব্রেরী বসে আছি।হুদাই বইয়ের পাতা উলটপালট করছি। বান্ধবী চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, সামনে তাকিয়ে দেখ লাল টি-শার্ট পরা একটা ছেলে তোকে বারবার দেখছে। আমি আড় চোখে তাকালাম। সত্যিই তো, ছেলেটা একবার বইয়ের পাতায় চোখ বোলায় আর একবার আমার দিকে তাকায়। বেশ বুঝলাম, বইটই পড়ছে না। হুদাই আমাকে দেখার জন্য এই বাহানা করছে।
সেদিনের পর থেকে লাল টি-শার্ট ওয়ালা ছেলেটা কখনও সামনে থেকে আবার কখনও দূর থেকে আমাকে দেখতো। একদিন তো সোজা সামনে এসে গোলাপ নিয়ে বসে পড়লো হাটু গুজে। আমিসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে অতি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। সে সেসব দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। খালি দেখতে ইচ্ছে করে। না দেখলে মনের উঠান বিষাদে ভরপুর হয়। তুমি কি তোমাকে দেখার সারাজীবন সুযোগ দেবে আমায়? বিনিময়ে আমি ভালোবাসা দেবো। আগলে রাখব। যত্নে রাখব।”
কোন অস্বস্তি ছাড়া স্ট্রংলি ছেলেটা এক নাগাড়ে বলে ফেলল এত কথা। আমি কি বলব না বলব বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এতটুকুই বলতে পারলাম, “উঠুন আপনি।”
আমার বান্ধবী তাকে বলল, “আপনি ভুল করছেন। হয়তো জানেন না। রুহি বিবাহিত। ”
সে চোখজোড়া বন্ধ করে আবার খুলল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সহজ গলায় বলল, “ভালো লাগার সময় তার কোথাও লেখা ছিলো না যে, সে বিবাহিত। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন যখন তাকে নিয়ে বিভাের থাকতাম, তখনও আমার অনুভূতিরা একবারের জন্য ও জানান দেয়নি যে, মেয়েটা বিবাহিত। ভালো লাগা যখন ভালোবাসায় রুপান্তর হলো, তখনও এই শহরের একটি কাকপক্ষী ও বলেনি সে বিবাহিতা। সবশেষে এখন জানলাম সে বিবাহিতা। এখন তাকে ভুলে যাওয়া, এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ফুয়াদ। ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারে আছি। এখন তুমিই ডিসিশন নাও আমায় গ্রহন করবে কি না।”
আমি তো স্পেচল্যাস।এক পলক শুধু তাকালাম তার দিকে। তাকাতেই বুক ধুক করে উঠলো। অদ্ভুত সুন্দর ঘন পাপড়িওয়ালা বিশিষ্ট টানাটানা তার চোখ দুটো। মায়ায় কাড়া শ্যামলা বর্ণের চেহারা। বিস্তৃত কপালের উপরে কাটাকাটা করে চুল খাড়া করে রাখা। মনে হচ্ছে কেউ চুলগুলো সোজা করে ধরে রেখেছে উপরে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললাম। অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব।” এই বলে সে দ্রুত পায়ে চলে গেলো।
আমার মন খচখচ করতে লাগলো। মস্তিস্কে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো তার সুন্দর কথাগুলো।
ফিরিয়ে দেবার পরেও ফুয়াদ আমাকে দেখতো। আড়াল থেকে আবার সামনে থেকেও। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতো। তেমনি আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুমবৃষ্টির দিনে আমি ভিজে জবুতবু হয়ে কলেজ ডুকছিলাম। সে কোথা থেকে এসে হেঁচকা টান দিয়ে ছাতার ভেতর ডুকিয়ে রাগ ঝাড়লো, “কোথাও দাড়াতে পারতে! জ্বর আসবে তো!”
আমি কোন উত্তর না দিয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় উঠলাম।
দাড়াও আমি আসছি বলে দশ মিনিটের ভেতর একটা ওয়ান পিস, ওড়না আর টাইলস এনে দিয়ে বলল, “চেন্জ করে এসো তাড়াতাড়ি।”
আমি সত্যি তার এসব আচরণে অভিভূত হয়ে যাচ্ছি।
এইভাবে চলতে চলতে তার ভালোবাসা, কেয়ার দেখে আমিও তার প্রেমে পড়ে গেলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতাম। কলেজে এড়িয়ে চলতাম। তার কারণ কম বেশ অনেকে জানে আমি মেরিড।
একদিন সারাবেলা অফলাইন থাকায় সে সিমে মেসেজ করছিলো, “কোথায় তুমি? তুমি জানো না, তুমি ছাড়া সবকিছু আমার বিষাদ লাগে।”
সেই মেসেজটা আায়ান দেখে ফেলে। কথায় আছে না, কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। আমার বেলায় ও তাই হলো। আয়ান এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি কাঁপতে লাগলাম। চারপাশ অন্ধকার লাগতে শুরু করলো। আমি কিছু না ভেবে তার পায়ে পড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। মিনতি করে বললাম, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমার ভুল হয়েছে। আমায় ক্ষমা করে দাও। কখনও আর কারও সাথে কথা বলব না। মনে ভয় লাগতে শুরু হলো, যদি এই কারণে আয়ান আমাকে ছেড়ে দেয়, আমি মানতে পারব না। আমি আমার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসি। তার জন্য আমি হাজারও ফুয়াদকে ছেড়ে দিতে পারব। আয়ানকে সারারাত দিন মিনতি করলাম। কাউকে বলো না প্লিজ। আমি ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম আর তার কারণ এই এইগুলো। তুমি হয় এমন হও, আমাকে কেয়ার করো, আর না পারো করো না। ছোট্ট একটা জীবন, অত কিছ লাগব না আমার। তোমার সাথে থেকেই কাটিয়ে দেবো পুরো জীবন। আয়ানকে স্বাভাবিক দেখালো। বলল, মাফ করলাম। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তার প্রতি ভালবাসাটাও আরও বাড়ল।
ওদিকে ফুয়াদ ফোন কল মেসেজ দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। সময় করে তার সাথে কথা বললাম। বুজিয়ে বললাম, “তুমি জানো আমি বিবাহিতা আর তা জেনেই আমাকে ভালোবেসেছো। কিন্তু আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসিনি। বড়জোর প্রেমে পড়েছি বলতে পারো। তোমার কথার প্রেমে পড়েছি। তুমি খুব সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলো! হয়তো এজন্য! ”
“তাহলে আমার সব অনুভূতি কি তোমার কাছে শুধু কথার খেলা ছিল? আমি তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে হারিয়েছি, আর তুমি সেটা শুধু কথার মোহ বলে উড়িয়ে দিচ্ছো?”
“দেখো ফুয়াদ, তোমার জন্য আমার সংসার ভাঙ্গুক এটা কখনও চাইব না। আমায় আর খুজো না প্লিজ। ভুলে যেও। কখনও কথা বলার চেষ্টা করো না।”
“তোমার জন্য যদি আমার সঙ্গে কথা বলা কঠিন হয়, তাহলে চুপ থাকো। কিন্তু মনে রেখো, আমার মন থেকে তোমার জায়গাটা কখনো মুছবে না।”
“তোমার মন থেকে মুছে যাবে কি যাবে না, সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি স্পষ্ট বলতে চাই—তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা আমার নেই।”
ফুয়াদকে ফিরতি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিলাম। তাকে দেখলে হয়তো আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এজন্য কলেজ যাওয়া ও সাময়িক অফ করলাম।
আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ পর্দা কেন ফরজ করেছেন। যতই বিবাহিত আর অবিবাহিত হোক না কেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে। এসে যায়।
চলমান…..!