ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”
লাবণ্যর সঙ্গে শুভ্রর কখনো সেভাবে চোখাচোখি হয়নি। শুভ্র যখনই লাবণ্যর চোখের দিকে তাকাতো, তখনই ও চোখ ফিরিয়ে নিত।
আবার শুভ্র যখন এদিক-ওদিক তাকাতো, তখন লাবণ্য শুভ্রর দুই চোখে বিচরণ করত। শুভ্র আড়চোখে দেখত। লাবণ্য কখনো কখনো ধরা পড়ে যেত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালো ওরা। নদীর পাড়ে কোলাহল মুক্ত একটা জায়গায় গিয়ে বসল।
নদীর তীরে চুপচাপ বসে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। কারো মুখেই যেন কোনো কথা নেই, যদিও অনেক কথায় জমা আছে দু’জনের মনে।
পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে বেশক্ষাণিক’টা দূরত্ব বজায় রাখা। শুভ্র চুপচাপ নদীর ঢেউগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আর লাবণ্য? লাবণ্য পলকহীন দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও শুভ্রর দৃষ্টি নদীর দিকে তথাপি সে লাবণ্যর কৃর্তিকলাপ আড়চোখে লক্ষ্য করছে।
মনে মনে লাবণ্য শুভ্রকে একশ একটা গালি দিল। শয়তান একটা, খাটাশ একটা! ভদ্রতা দেখাতে আসছে। একটু কাছাকাছি বসলে কি এমন ক্ষতি হতো?
লাবণ্যর খুব ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু তাতো আর সম্ভব নয়! আচ্ছা, কাঁধে মাথা নাইবা রাখলাম হাতটা তো ধরতে পারি। মনের এই ছোট্ট চাওয়ার প্রাধান্য তো দেওয়াই যায়।
লাবণ্য দুর থেকেই শুভ্রর হাতের দিকে ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিল। কাঁপা, কাঁপা দুটি হাত শুভ্রর হাতের খুব কাছে নিয়ে গেলেও রাখতে পারল না। লাবণ্য ওর হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুর অজানার দিকে।
আড়চোখে এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিল শুভ্র। এইমুহূর্তে লাবণ্যর মনটা যে খুব বেশী ভালো নয় সেটাও বুঝতে পেরে গেছে সে। তাইতো দুর থেকেই শুভ্র ওর একটা হাত লাবণ্যর হাতের উপর রাখে। মৃদু কেঁপে উঠে লাবণ্য হাতের দিকে তাকাই। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
মনে মনে হাসছে শুভ্র। মুখে কিছু না বলেই দুর থেকে লাবণ্যর অনেকটা কাছে, পাশাপাশি গাঁ ঘেষে বসে যায়। লাবণ্যর পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠে শুভ্র যখন শক্ত থেকে আরো শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরে।
বেশকিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর নিরবতা ভাঙ্গে শুভ্র। লাবণ্য, সুন্দর না জায়গাটা? লাবণ্য মৃদুস্বরে জবাব দেয়, হুম। লাবণ্য চলো আমরা ওপাশে গিয়ে বসি। শুভ্র লাবণ্যকে নিয়ে নদীর অপর পাশে চলে যায়।
সত্যিই জায়গাটা অনেক সুন্দর। নদীর ধারে ফুটন্ত কাশফুল সেই সৌন্দর্যকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। জায়গাটা এতই সুন্দর যে লাবণ্য বিমোহিত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে লাবণ্য প্রজাপতির পিছনে দৌঁড়াচ্ছে আর তাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শুভ্র সেই মুহূর্তকে তার কাছে থাকা গোপন ক্যামেরা’ই বন্দি করে ফেলে।
সারাটা দিন এভাবেই কেটে যায়। কখনো নৌকায় চড়ে, কখনো বা নদীর আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে। এক ফাঁকে দুপুরের খাবারটাও খেয়ে নেয় ওরা পার্শ্ববর্তী হোটেল থেকে। বিকেল হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে চায় লাবণ্য। শুভ্র রিকশায় করে লাবণ্যকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। যাবার সময়ও দু’জন বেশ চুপচাপ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ লাবণ্যর ইচ্ছে হচ্ছিল শুভ্র ওর হাতটা ধরুক, কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হয় না। সেদিন লাবণ্যকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র একহাতে লাবণ্যর দুটো হাত আলতু করে চেপে ধরে আরেকহাত দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। লাবণ্যর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠে। ব্যাপারটা শুভ্রর নজর এড়ায় না।
লাবণ্যকে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে শুভ্র রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। নিশ্চুপ লাবণ্য বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভেঁজা চোখে শুভ্রর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
লাবণ্য বরিশাল থেকে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ঢাকায় ফিরে আসছে একসপ্তাহ হলো,
এর ভিতরে একটা বারের জন্য শুভ্র ওকে কল দেয়নি। আজকাল খুব বেশী এড়িয়ে চলছেন ওনি আমাকে। আগের মত কলও দেই না। বোধ হয় সময়ের সাথে সাথে আমার প্রতি টানটাও কমে গেছে। ধূর! কি ভাবছি এসব? ওনি তো ব্যস্তও থাকতে পারেন। আর তাছাড়া কিসের টানের কথা বলছি আমি? কোন সম্পর্কের টানে ওনি আমার কাছে আসবেন? আমাদের মধ্যে আদৌ কি কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? লাবণ্য নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করে এই ভেবে যে, ধূর!কি ভাবছি এসব?
সেদিন সারা রাত্রি বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে লাবণ্য। হাজার চেষ্টা করেও কেন ঘুমাতে পারছিল না। বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে শুধু একটি নাম ভেসে উঠে, সে শুভ্র। তবুও লাবণ্য নিজে নিজেকে এই বলে বাঁধা দেয় যে, না, না! এ হতে পারে না। আমি ওর বন্ধু। স্রেফ বন্ধু হয়েই থাকতে চাই।
সকাল সকাল লাবণ্য কলেজের দিকে রওয়ানা হয়। উদ্দেশ্য একটাই আর সেটা হলো মাস্টার্সে ভর্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কলেজে জমা দিয়ে আসা। কলেজ থেকে আসবার কালে লাবণ্য ওর শ্বশুরের পরিচিত একটা দোকানে যায়। কয়দিন আগে একটা ফোন দেখে গিয়েছিল লাবণ্য, আজ আসছে সেই ফোনটা নিতে। অনেক কষ্টে, শ্বশুর শাশুড়ির দেওয়া টাকা থেকে কিছু কিছু জমিয়ে আজ এসেছে ফোনটা কিনতে। যদিও ওর শ্বশুর বলে দিয়েছে, ওর পছন্দমত সেট নিতে। টাকা ওনিই দিবে। কিন্তু লাবণ্য ওর জমানো টাকার মধ্যেই একটা ফোন কিনল। সাথে একটা সিমকার্ড। রিচার্জ করে নিয়েছে ১০০টাকা। ফোন হাতে পেয়ে লাবণ্যর খুশি আর দেখে কে? খুশিতে আত্মহারা লাবণ্য মনে মনে ভাবছে, যাক! এখন আমার যখন ইচ্ছে তখন’ই শুভ্রকে কল দিতে পারব। ওর সাথে কথা বলতে পারব। দোকান থেকে বেরিয়ে পরম খুশি মনে শুভ্র লাবণ্যকে কল দেয়। ব্যস্ত শুভ্র ব্যস্ততার মাঝেও কল রিসিভ করে। কানে নিয়ে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে লাবণ্য লম্বা করে সালাম দেই। সালামের জবাব জানিয়ে কুশল বিনিময় করে শুভ্র। সবকিছুর জবাবই আজ লাবণ্য হেসে হেসে দিয়েছে।
কি ব্যাপার? আজ ম্যাডামকে এত খুশি খুশি লাগছে? শুভ্রর এই কথায় লাবণ্য কোনো জবাব দেয় না। শুধু বোকার মত একটা হাসি দিল। এদিকে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যস্ত শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে, আচ্ছা! আমি পরে কথা বলছি, এখন ব্যস্ত আছি। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় শুভ্র। হাসিমুখটা নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। গুমড়া মুখে বাসায় ফিরে যায় লাবণ্য।
ওহ, নিজেকে কি মনে করে? বোম্বের নায়ক? হুহ, আমি ওকে কল’ই দিব না। রাগে দুঃখে ফোনটা বন্ধ করে রাখে লাবণ্য। এদিকে শুভ্র? সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় এসে রান্না করে খেয়ে’ই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়। একে তো ক্লান্ত শরীর, তারউপর সেই ক্লান্ত শরীরে এসে রান্না করে খাওয়া। নিদ্রাদেবী চোখে তাড়াতাড়িই ভর করে। আর শুভ্র তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
লাবণ্য ফোন বন্ধ করেছে দুপুরের দিকে। এখন রাত্রি ৯টা বাজে। আচ্ছা, ওনি তো এখনো মায়ের ফোনে কল দিচ্ছে না। তবে কি ওনি আমার নাম্বারেই শুধু ট্রাই করছে। আচ্ছা, আমার নাম্বারে কল দিয়ে ওতো ফোন বন্ধ পেয়েছে। তারপর কি ও কল দিয়েছিল? কল দিলে তো তখনো নাম্বার বন্ধ পেয়েছে। বন্ধ পেয়ে কি ওনি চিন্তিত হয়ে পরেছিল? আমায় মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছিল? ইস! আমি তো মনে হচ্ছে আজকে ব্যাটাকে জব্দ করে দিয়েছে। এখন তো মনে হয় ওনার অবস্থা নাজেহাল। নিশ্চয় কান্না করে করে শেষ? খুশিতে লাফিয়ে উঠে বিছানায় উঠে বসে লাবণ্য। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা এনে চালু করে সেটা। পরম কৌতূহলের সাথে স্ক্রিনে মেসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। ৫মিনিট হয়ে গেল, এখনো একটাও মেসেজ আসছে না। আচ্ছা, তবে কি ওনি একটা মেসেজও দেয়নি? না, না! এ হতে পারে না। ওনি নিশ্চয় এসএমএস দিয়েছে। হয়তো নেট প্রবলেমের কারনে এসএমএস আসছে না। লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফোন হাতে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো ফোনটা উপরের দিকে তুলছে নেটের জন্য। মনে মনে হাজারটা বকাও দিয়ে দিয়েছে অলরেডি গ্রামীণফোনের নেটকে।
গালি দিতে দিতে বারান্দায় চলে যায় লাবণ্য। সেখানে গিয়েও ফোনটা মাথার উপর নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে। তখনই রিংটনের আওয়াজ হয়। খুশিতে লাফিয়ে উঠে ফোন রিসিভ করে উৎকন্ঠার সাথে বলে, হ্যাঁলো….
ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠ। “মা” এত রাত্রে বারান্দায় কি করো? লাবণ্যর হাসোজ্জল মুখটা মলিন হয়ে যায় শ্বশুরের কন্ঠ শুনে। ওর কিছু বলার আগেই শ্বশুর বলে উঠো, এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ ফোনে তোমার সম্পূর্ণ নেট আছে! যাও এবার নিশ্চিন্তে রুমে যাও। কল/মেসেজ দিলে রুমেও আসবে। জি, বাবা…. বলেই কলটা কেটে দেয় লাবণ্য।
আমি এখানে মাথার উপর ফোন ঘুরাচ্ছি, এটা নিশ্চয় বাবা দেখে গেছে। ইস! কি লজ্জা! সব’ই ঐ ব্যাটা হারামির জন্য। মনে মনে একশ একটা গালি দিল লাবণ্য শুভ্রকে। তারপর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গে লাবণ্য। ঘুম চোখে ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখে কোনো কল আসছে কি না ফোনে। একটাও কল এসএমএস আসেনি দেখে মুখটা কালো হয়ে যায় ওর। ফোনটা বিছানায়া রেখে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নেয় লাবণ্য। নামাজটা কোনো মতে শেষ করেই দৌঁড়ে আসে ফোনের কাছে। নাহ, একটাও কল আসল না। ওনি বোধ হয় আমায় ভুলেই গেছে। ওনি বোধ হয় আমাকে আর কল দিবে না। এসব ভেবে ভেবেও লাবণ্য বার বার ফোনের দিকে চাতকের ন্যায় শুভ্রর ফোন আসার প্রতিক্ষায়। সারাদিন গেল। শুভ্র একটা বারও কল দিল না। রাত্রিতে সাত, পাঁচ ভেবে লাবণ্য নিজেই কল দিয়ে ফেলে। ২,৩বার কল বেজে যাওয়ার পর রিসিভ করে শুভ্র।
– হ্যাঁলো…..
এপাশে লাবণ্য নিশ্চুপ……
– হ্যাঁলো, কে বলছেন?
লাবণ্য তখনো নিশ্চুপ………..
– হ্যাঁলো, কথা বলুন……….
এভাবে মানুষ, মানুষকে পর করে দেয়, সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
– ওহ, লাবণ্য তুমি? এটা তোমার নতুন ফোন নাকি?
শুভ্রর প্রশ্নে লাবণ্য অভিমানী স্বরে বলে, থাক! চিনতে হবে না আর। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিয়ে লাবণ্য নিজেই বোকা হয়ে গেছে, ভাবছিল শুভ্র কল ব্যাক করে ওর রাগ ভাঙাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টো ওকে শুভ্রর ফোনের প্রতিক্ষায় সারা রাত ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। সকালের দিকে লাবণ্য শুভ্রকে কল দেয়। ঘুম চোখে শুভ্র কল রিসিভ করে। হ্যাঁ, বলো লাবণ্য। লাবণ্য কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে ইয়ে মানে বলছিলাম কি আপনি কি আজকে ফ্রি আছেন? শুভ্র বিছানায় উঠে বসে, কোনোরকম হাসি আটকিয়ে বলে হুম, কেন? লাবণ্য নিচু গলায় বলে, আমরা কি আজকে দেখা করতে পারি? হাসি আটকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে শুভ্রর জবাব, দেখা করাটা খুব কি বেশী দরকার? মানে আজকে তো অফ ডে, আমার একটু ঘুমাতে হবে আর কি। কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দেয় শুভ্র। লাবণ্য কি বলবে বুঝতে পারতেছে না। আসলে এ প্রশ্নের উত্তর কি হওয়া উচিৎ ওর নিজেরও জানা নেই। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, ওহ! আচ্ছা। সমস্যা নাই। আপনি ঘুমান। ঘুম না আসলে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। তবুও ঘুমান। আসতে হবে না আপনার। কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে কলটা কেটে ফোনটা বন্ধ করে ফেলে লাবণ্য।
চলবে…….