ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ইতোমধ্যে’ই ইনজেকশনটা দেওয়া শেষ। এই মুহূর্তে শুভ্র লাবণ্যর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য এখনো দু’চোখ বন্ধ করে মুখটা বাচ্চাদের মত করে আছে। নিশ্চুপ শুভ্র একবার লাবণ্যর মুখের দিকে তো আরেকবার ওর কাঁধের দিকে তাকাচ্ছে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চোখ খুলে লাবণ্য। চোখাচোখি হয় দু’জনের। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুটা সময় একজনের আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ যায় শুভ্রর কাঁধের দিকে। লাবণ্য তাড়াতাড়ি হাতটা নিয়ে আসে কাঁধ থেকে। শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে লাবণ্য। শুভ্রও কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ লাবণ্যর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মিনিট পাঁচেক পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে শুভ্র। প্রশ্ন করে লাবণ্যকে, কেন এমনটি করেছ? লাবণ্য বুঝেও না বুঝার ভান করে অনেকটা দুরে সরে যায়। লাবণ্যর সাথে সাথে শুভ্রও দাঁড়িয়ে পরে। লাবণ্যর দু’বাহু ধরে মুখটা শুভ্র ওর নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। তারপর আবারো প্রশ্ন করে, কি হলো? বলছ না যে? কেন কেঁটেছ হাত? চুপ করে থেকো না, উত্তর দাও। লাবণ্য বিষণ্ন মনে শুভ্রর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নেয়। শুভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠে, চোখ সরিয়ে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না লাবণ্য। লাবণ্য শুভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দুরে সরে গিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে, আমি হাত কাটিনি, অসাবধানতায় কেটে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে, তবে চোখ কেন ফিরিয়ে নিয়েছ তুমি? কেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতেছ না? তুমি কি ভেবেছ? আমি কিচ্ছু বুঝি না? কিচ্ছু না?!!! আরে এতটা বোকা আমি নয়, যতটা তুমি ভেবেছ। আমায় তুমি ভালোবাসো এটা তোমার মুখ নয়, তোমার চোখ জানান দিচ্ছে। অনুভূতিগুলো যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন, তোমার এই চোখের ভাষা কিন্তু আমি ঠিক পড়ে নিয়েছি। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো সেটা তোমার চোখ দেখেই বুঝে গেছি। লাবণ্য অসহায় চোখে একবার শুভ্রর দিকে তাকালো, তারপর ওর দু’বাহু থেকে শুভ্রর হাত দুইটা সরিয়ে নিয়ে ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে দাঁড়ায়।
হা, হা, হা…..
দুরে দাঁড়িয়ে’ই শুভ্র হেসে উঠে। তারপর লাবণ্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, শুনো! তুমি শুধু আমার থেকে এতটুকু দুরেই যেতে পারবা, এর চেয়ে বেশী নয়। কি মনে করেছ তুমি? দুরে গেলেই আমি তোমাকে দুরে যেতে দিব? ভালোবাসি তোমাকে। বড্ড বেশী ভালোবাসি। কি করে আমি সে ভালোবাসার মানুষটাকে দুরে সরে যেতে দেই, বলো? আর লাবণ্য! আমি তো তোমাকে স্যরি বলেছি, আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছি, ভুল স্বীকার করেছি। তবুও কেন তুমি আমার থেকে এভাবে দুরে দুরে থাকতেছ? লাবণ্য চোখ মুখ শক্ত করে বলে, কারন আপনি ভালোবাসলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসতে পারব না? শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে বলে, কেন ভালোবাসতে পারবে না? লাবণ্য আবারো ওর বাহুদ্বয় থেকে শুভ্রর হাতটা সরিয়ে নেয়। তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে, কারন- আমার সব অনুভূতিগুলো অনেক আগেই ভোতা হয়ে গেছে। আমি আর এখন ভালোবাসতে পারব না আপনাকে। শুভ্র দু’হাত দিয়ে লাবণ্যর একটা হাত আকড়ে ধরে বলে, প্লিজ লাবণ্য! এমন করো না। বললাম তো আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও লাবণ্য। প্লিজ, আমায় একটা বার তোমায় ভালোবাসার সুযোগ করে দাও। লাবণ্য হ্যাচকা টানে ওর হাতটা সরিয়ে নেয় শুভ্রর থেকে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, হুহ! ভালোবাসা? সেতো কবে’ই গলে পঁচে গেছে। আমার অনুভূতিগুলো মরা বকুলের মতো শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দিকে একধাপ এগিয়ে বিনয়ী স্বরে বলে উঠে, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও না প্লিজ? লাবণ্য কিছুটা পিছুহটে পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠে বলে- ঝরা ফুল, যার পাপড়িগুলো শুকিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, যার সুভাস প্রায় নেই বললেই চলে; আপনি পারবেন সে ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে? শুভ্র কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে, আমায় একটা সুযোগ দাও লাবণ্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাতের কালো অন্ধকার কেটে গিয়ে আমাদের জীবনেও একদিন সোনালী আলোর রেখা উঁকি দিবে। এর জন্য দরকার তোমার একটু বিশ্বাস। লাবণ্য প্লিজ তুমি আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। লাবণ্য ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে বলে, পারব না। যে ভুল একবার করছি, সে ভুল দ্বিত্বীয় বার করে আমি আমার জীবনটাকে এভাবে নিজ হাতে শেষ করে দিতে পারব না। আমি আর বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাই না। কোথায় আমি, আর কোথায় আপনি? লাবণ্য যেন শুভ্রর বলা কথাগুলো দিয়েই শুভ্রকে খোঁচা দিল। শুভ্র তবুও লাবণ্যকে বুঝালো। লাবণ্য বুঝতে চাইলো না। লাবণ্যর এক কথা, আগের মতো আবারো আপনি আমায় ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিবেন। আর আমি? ঝরা ফুলের পাপড়ির মতো কিংবা পার্কে ছড়িয়ে থাকা বাদামের খোসার মতো পড়ে থাকব। লাবণ্যর কথায় শুভ্র অবাক হয়ে গেল এই ভেবে, ওহ! আমার প্রতি এই তাহলে তোমার বিশ্বাস?
একটু থেমে লাবণ্য আবার বলল, আমার প্রতি আপনার যত ভুল ছিল সব যদি দুর হয়ে গিয়ে থাকে, আমাকে যদি আপনার সত্যিই ভালো লাগে তাহলে আমাকে বন্ধু হিসেবে পেতে পারেন। তাতে না পাওয়ার বেদনা থাকবে না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না।
লাবণ্যর এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলার কাছে শুভ্র হেরে গেল। শুভ্রর অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। তার পরও শুভ্র হাল ছাড়লো না।
ডাক্তারদের আবার ঈদ। কোনোরকম ঈদের দিনটা গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন’ই ঢাকার উদ্দেশ্যে একা একা রওয়ানা দেয় শুভ্র। আসার সময় লাবণ্যকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে ওর সাথে ওর বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু লাবণ্য ওর সিদ্ধান্তে অটল। ও শুভ্রর বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। আর সেটা শুভ্রর সাথে নয়, শুভ্রর বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় আলাদা বাসায়। শুভ্র লাবণ্যর কথায় মেনে নিল। প্রতি শুক্রবার লাবণ্যর সাথে দেখা করার জন্য শুভ্র ওর বাবা মায়ের বাসায় চলে আসত। তাছাড়া ওদের ইউনিয়নের কোনো ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গেলেও শুভ্র দেখা করত লাবণ্যর সাথে।
লাবণ্যর নিজস্ব যে ফোন ছিল সেটা ভেঙে ফেলেছে। মায়ের ফোন দিয়ে লুকিয়ে লাবণ্য শুভ্রর সাথে কথা বলত। তবে সেই কথাটা প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে হতো।
কথা বলার ফাঁকে শুভ্র বুঝতে পারল, লাবণ্যর মনে ওর প্রতি যে অভিমানের পাহাড় ছিল, সেটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। লাবণ্য ওকে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
শুভ্র ওকে একটা ফোন কিনে দিতে চাইল। কিন্তু লাবণ্য পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে নিতে চাইল না।
কেটে যায় আরো একটা বছর। এরই মাঝে লাবণ্যর অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। শুভ্র একদিন ঠিক করলো লাবণ্যকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। বিশেষ কারনে লাবণ্যর শশুর শাশুড়ি সেদিন বরিশাল গিয়েছিল লাবণ্যকে সাথে নিয়ে। পাগল শুভ্রও সেখানে ছুটে যায় প্রিয়তমার সাথে দেখা করার জন্য। লুকিয়ে দেখা করল প্রাণের প্রিয়ার সাথে। তারপর রিকশায় চেপে দু’জন রওয়ানা দিল একটা স্টিমার ঘাটের দিকে।
রিকশায় বসে লাবণ্যর একটা হাত ধরলো শুভ্র। লাবণ্য ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না।
কখন যেন হাত দুটির উপর লাবণ্যর আরেকটি হাত এসে ভর করল। শুভ্র লক্ষ্য করল, লাবণ্যর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আরো খেয়াল করল, ওর হাতের মধ্যে রাখা লাবণ্যর হাত দুটো মৃদু কাঁপছে।
চলবে……