ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
কম্বলের ভিতর প্রবেশ করে আস্তে আস্তে শুভ্র ওর লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রর শীতল হাতের ছোঁয়ায় ঘুমের মাঝেই লাবণ্য ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠে। লাবণ্যকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও কি মনে করে যেন ধরে নি। ঘুমের ঘোরে কম্বল’টা গাঁ থেকে ফেলে দিয়ে শুভ্রর বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পরে লাবণ্য। শুভ্রর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। শীতের প্রকোপ ভুলে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে শুভ্র। হাতে ভর দিয়ে শুয়ে মাথা ক্ষাণিকটা উঁচু করে মুগ্ধ নয়নে শুভ্র তাকিয়ে আছে ওর প্রেয়সীর মুখপানে। লাবণ্য তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শুভ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে ওর হাতের শীতল পৃষ্ট’টা লাবণ্যর গালে ছুঁয়ায়। শীতে কেঁপে উঠে লাবণ্য শুভ্রমুখী হয়ে শুইলো। পূর্বের ন্যায় এখনো শুভ্র হাতে ভর দিয়ে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত। মুগ্ধ শুভ্র কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর এগিয়ে যেতে থাকে লাবণ্যর দিকে। লাবণ্য তখনো ঘুমের ঘোরে। শুভ্র লাবণ্যর কাছ থেকে আরো কাছে চলে যায়। তারপর লাবণ্যর নাকে ঠান্ডা আঙ্গুল পরশ বুলিয়ে দেয়। লাবণ্য কেঁপে উঠে, ঘুমের মাঝেই শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে। মৃদু হেসে শুভ্র লাবণ্যকে ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে কল্পনার গভীরে হারিয়ে যায় শুভ্র। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসে ওর। লাবণ্য জেগে উঠে। চোখ মেলে শুভ্রর বুকে এভাবে মুখগুজে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় লাবণ্য। একি! ওনি এখানে এভাবে? শিশির?! শিশির কোথায়? আমি তো শিশিরের সাথে ঘুমিয়েছিলাম। তবে কি রাত্রে ওনি শিশিরকে সরিয়ে…..(….)….???
না, না, এ হতে পারে না।
শুভ্রর কিছু বুঝে উঠার লাবণ্য শুভ্রকে খাট থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। বেচারা শুভ্রর হাত গিয়ে পরল ঐখানে, যেখানে কিছুক্ষণ আগে ওর কাজিনরা দা,বটি,ছুড়ি রেখে গেছে গরুর মাংস প্রস্তুত করা শেষে। ধারালো কিছুর সাথে হাত লেগে শুভ্রর হাতের অনেকটা কেঁটে যায়। শুভ্রর হাতে কোনো খেয়াল নেই। বেচারা শুভ্র তখনো লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কি হলো সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, ” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ধাক্কা মেরেছি, ধাক্কা। আমি আপনাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছি। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন বিষয়টা? প্লিজ এখন আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান…..”
শুভ্র ওর কনুইয়ের দিকে তাকালো। ফুল হাতার শার্টের অনেকাংশে ইতিমধ্যে রক্ত ছড়িয়ে গেছে। শুভ্রর এতে বিন্দুমাত্র
কু-ক্ষেপ নেই। নিশ্চুপ শুভ্র নিজের কাটাস্থানের পরোয়া না করে লাবণ্যকে বুঝানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। লাবণ্যর চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ সুস্পষ্ট। শুভ্র ওর দিকে এগুতোই একরাশ বিরক্তির স্বরে বলে উঠে লাবণ্য, আপনাকে আমি যতটা ভালো ভেবেছিলাম না, আপনি ঠিক ততটা ভালো নয়। আপনি আসলে একটা লু…… (…..)….???
শুভ্র কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে, হ্যাঁ! বলো আমি কি? লাবণ্য কিছুটা ভড়কে যায়। ঢোক গিলে বলে উঠে, আ আ আপনি এভাবে এদিকে আসছেন কেন? শুভ্র আবারো বলে, আমি জানি কি বলছ? আমি লুচ…….(…)…??? শুভ্রর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় লাবণ্য, না, না! আমি আপনাকে সে কথা বলিনি। আমি তো আপনাকে……….
– হ্যাঁ, বলো! তুমি তো আমাকে কি???
লাবণ্যর আর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় নি। তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ে শিশির। লাবণ্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে বিছানায়। দরজায় একের এক নক পরতেছে দেখে দরজা খুলে শুভ্র। শিশিরকে দেখে ভ্রু কুচকে রুম থেকে চলে যায় শুভ্র।
রুমে প্রবেশ করেই ভাবির সাথে হাসি মসকারা’ই মেতে উঠে ননদ শিশির।
” এই ছিল তোমাদের মনে, নাহ?”
লাবণ্য মাথা উচু করে শিশিরের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকালো। শিশির পেত্নী মার্কা হাসি দিয়ে বলল, হয়ছে! আর বুঝতে হবে না। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। তাইতো বলি ব্যাটা এবার প্রথমে আমায় কেন ডাকল? ও আমায় জাগিয়ে দেওয়ার জন্য জাগেনি, ও ডেকেছে ওর কাজে………
কথাটা বলেই হো হো করে হেসে দেয় শিশির। রাগান্বিত চোখে ননদের দিকে তাকাই লাবণ্য। এটা দেখে ওর হাসি থেমে যায়। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, স্যরি! স্যরি,ভাবি! আর মজা করব না। এই মুখে পিন মারলাম। দু’জনেই চুপচাপ, স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই প্রথম ঈদ, যে ঈদে শিশির গোসল করে ২য় স্থান অধীকার করেছে। ব্যাপারটা লাবণ্যর সাথে শেয়ার করার জন্য ওর দিকে এগিয়ে গেল। ভাবি জানো…..(….)…..???
কথাটা বলেই স্তব্ধ হয়ে যায় শিশির। লাবণ্য শিশিরের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, বলো…..
শিশির কিছুক্ষণ লাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে দিল। এমন হাসি, যা থামতেই চাইছে না। লাবণ্য বিরক্তিকর স্বরে বলল, কি হলো? বলছ না কেন? অনেক কষ্টে হাসি থামায় শিশির। তারপর- ” ভাবি তোমার লিপ…(….)…?””
কথা পুরো বলতে পারেনি। তার আগেই হাসতে হাসতে রুম ছাড়ে শিশির। বেচারী লাবণ্য কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাল রাত্রে শিশির বায়না ধরেছিল লাবণ্যকে বউ সাজে দেখবে। তারই কথা মত সাজতে সাজতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই এগুলো না ধুয়েই ঘুমিয়ে পরেছিল ওরা। এখন তো সেসব সাজের মধ্যে লিপস্টিক’টা লেপ্টে আছে। আর এটা দেখেই না জানি শিশির উল্টাপাল্টা কি ভাবছে। ইস! কি লজ্জা….
আয়নার সামনে থেকে সরে যায় লাবণ্য। চটজলদি কাপড় এনে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে সে।
লাবণ্যর রুমে থেকে বের হয়ে সরাসরি কাজিন পলাশের কাছে চলে যায় শুভ্র। কেননা, এ এলাকার কম বেশী সবাই জানে পলাশের ঘরটা ছোট খাটো ফার্মেসীর মতই। কোনো ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হলে সবার আগে সবাই পলাশের কাছে ছুটে আসে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। আর হসপিটালে রোগীদের নিয়ে আসা যাওয়া করতে করতে অনেক কিছুই ওর রপ্ত হয়ে গেছে। শুভ্র অনেক খুঁজে কাজিন পলাশকে বের করল। ততক্ষণে শুভ্রর সাদা শার্টের হাতা পুরোটাই রক্তে ভিঁজে গেছে। শুভ্রকে এভাবে দেখে পলাশ হেসে বলে উঠল,
” ডাক্তার সাহেবেরই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষের কি হাল হবে?” শুভ্র ব্যাথায় কিছুটা কুকিয়ে উঠে বলল, পরামর্শ পরে দিস আগে আমায় কি করবি কর! ব্যাটা, তোর থেকে দেড়মাসের বড় আছি। সম্মান দিয়ে কথা বল। কথাটা বলেই পলাশ শুভ্রর গা থেকে শার্ট’টাই খুলে ফেলে। তারপর কাটাস্থান ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পলাশের সারা শরীর শিউরে উঠে। ” এমনভাবে কাজ করিস না?”
উফ, করে ব্যাথায় আর্তনাদ দিয়ে উঠে শুভ্র। পলাশ ভালো ভাবে ক্ষতস্থান ধৌত করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। শুভ্র উঠে চলে যাচ্ছিল, পলাশ ধরে ফেলে পিছন থেকে। পিছু ফিরে শুভ্রর জবাব, আর কি? চোখ বড় বড় করে পলাশ বলে উঠে, আর কি মানে? ইনজেকশন দিতে হবে। এখন আমার সাথে ফার্মেসীতে চল। পলাশ ওর ভাই শুভ্রকে নিয়ে যায় ফার্মেসীতে। সেখান থেকে ইনজেকশন দিয়ে তবেই ছাড়ে ওকে। ছাড়ার আগে বলে দেয়, শুন! আজকে কোথাও যাবি না আর। এখন গিয়ে বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিবি। শুভ্র মৃদু হেসে বলে, পাগল! সামান্য আঘাতে এত কেয়ার……
বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল শুভ্র, তার আগেই রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় ওকে ওর ছোট চাচী মরিয়ম। শুভ্র বার বার বলতেছে, কাকী মা! আমি বাসা থেকে দেখা দিয়ে আসি একবার। ওর কাকীমার একটাই জবাব, দেখা পরে করবি। আর ঈদের দিন ওরা কিছু বলবে না। আগে আমাদের বাসা থেকে খেয়ে তারপর যাবি। শুভ্রকে একরকম জোর করে ওর কাকীমা কাকার বাসায় নিয়ে যায়। পিঠা পায়েস এবং নানা রকম মিষ্টান্ন শুভ্রর সামনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। শুভ্র চোখ বড় বড় করে কাকীমাকে প্রশ্ন করে, আমাকে কি খাবারের ভিতর ডুবিয়ে মারবে তোমরা? শুভ্রর কাকীমা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, তুই একা খাবি নাকি? বউমাও আসছে। ওকে আনতে পাঠিয়েছি আমি। শুভ্র মনে মনে বলে, ওহ! সব আয়োজন তাহলে একমাত্র বউয়ের জন্য। বড় খাদক তাহলে মেমসাহেব!
ভাবতে ভাবতেই মেমসাহেব হাজির। শুভ্র সেদিকে না তাকানোর ভান করে খাওয়া শুরু করে। এদিকে লাবণ্য?!!!
শুভ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। ” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আনিনি। এই যে সামনে খাবার রাখা, এগুলো খেতে হবে। ডাক্তারসাহেব খাবার দেখেই পালিয়ে যাচ্ছিল, তোমার কথা বলে বসিয়ে রাখলাম।
লাবণ্য মাথা নিচু করে খাটের একপাশে পা দুলিয়ে বসলো। কাকীমা লাবণ্যর পাশে এসে দাঁড়ালো। এভাবে পা দুলিয়ে বসলে হবে না। পা উঠিয়ে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসো। পলাশ, পলাশের বউও আসছে। আরো আসছে সুমন আর বউ, হিমেল আর ওর বউ। ওদেরও দাওয়াত আজকে। ওরা সবাই এখানে টেবিলে খাবে, শুধু পলাশ আর ওর বউ তোদের সাথে বসবে। শুভ্র এতক্ষণে চোখ তুলে তাকায়। কাকীমা! নতুন বউয়ের সামনে আমরা খাবো? ব্যাপারটা কেমন কেমন না?
– ব্যাপার আবার কেমন কেমন হবে? পলাশ তোর বড়। হতে পারে বিয়েটা পরে করেছে, কিন্তু বয়সে পলাশ তোর চেয়ে বড়। শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ জানি। কিন্তু তবুও কেমন যেন লাগছে। কথা শেষ না হতেই পলাশ ওর বউকে নিয়ে হাজির। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পলাশ বলে উঠে,
” কি ব্যাপার? কি নিয়ে কথা চলছে এখানে?”
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না ভাইয়া।
ইতিমধ্যে হিমেল সুমনও ওদের বউ নিয়ে হাজির। কাকীমা লাবণ্যকে উপরে উঠে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসতে বলল। নিশ্চুপ লাবণ্য শুভ্রর পাশে গিয়ে বসল। একপাশে লাবণ্য শুভ্র, আরেক পাশে পলাশ-মৌরি। আর রুমে টেবিলে বসে খাচ্ছে সুমন-নাইমা, হিমেল-লামিয়া। সবাই বেশ চুপচাপ খেয়ে চলছে। শুধু লাবণ্যই ইতস্তত করতেছে। শুভ্র বারবার ওর হাঁটু দ্বারা লাবণ্যর হাঁটুতে মৃদু আঘাত করছে। আর লাবণ্য একটু একটু করে পিছনের দিকে সরতেছে। আড়চোখে পলাশের বউ পলাশকে সেটা দেখায়। দু’জনেই বেশ কৌতূহলের সাথে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র-লাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছ।
চলবে……