ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
আমি কি এখন রুমে যাব? ভাবির সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আমি কি রুমে গিয়েই ভাবির হাত থেকে শাঁড়িটা কেড়ে নিব? আমি কি সত্যি সত্যি শাঁড়িটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসব? না, না! এ আমি পারব না। এ আমার দ্বারা সম্ভব না। আপন মনেই কথাগুলো বলে দরজার সামনে থেকে সরে যায় শিশির। তারপর চোখের জল মুছে দরজা থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে ডাক দিল শিশির-
” ভাবি! কোথায় তুমি? আম্মু ডাকছে তোমায়। খেতে আসো।”
আগেভাগেই কারো আগমনী বার্তার সংকেত পেয়ে সাবধান হয়ে যায় লাবণ্য। ফ্লোর থেকে উঠে চটজলদি শাঁড়িটা লুকিয়ে ননদের কথার স্বাভাবিক জবাব দেয়-
” আসছি শিশির! তুমি যাও…..”
আমি তো যাব’ই। তার আগে আমার যে একটা কাজ আছে ভাবি। ঐ কাজটা করে তবেই যে আমি নিচে নামব। মনে মনে কথাটা বলে শিশির ওর রুমের আলমারি থেকে একটা পুরনো কাপড় বের করে নেয়। মোড়কে আবৃত কাপড়টা নিয়ে শিশির যখন সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিল তখন সবাই শিশিরের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচে নেমে কাউকে কিছু না বলে সরাসরি দরজার সামনে চলে যায় শিশির। দরজার কাছে গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় শিশির। কতগুলো চোখ তখনো ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার কৌতূহল মেটানোর জন্য শিশির জবাব দেয়-
” মোড়কে আবৃত জিনিসটা আর কিছু নয় শুভ্র ভাইয়ার কেনা ঐ শাঁড়িটা ছাড়া। তুমি বলছিলা না এটা কালকে ডাস্টবিনে ফেলে দিবে? তাই আমি এখন আমি এটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতেছি।”
শুভ্রর মা গম্ভীর গলায় বলেন, হ্যাঁ, যা! ফেলে দিয়ে আয়। শিশির যাচ্ছি বলে বাইরে চলে যায়। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পরে শুভ্র। জল ছলছল চোখ আর মনে ব্যথা নিয়ে কিছু পেটে না দিয়েই সে স্থান পরিত্যাগ করে শুভ্র। শাশুড়ির বারংবার ডাকে ক্ষাণিক বাদেই খেতে আসে লাবণ্য। টেবিলে বসে মলিন মুখে লাবণ্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চাতকের ন্যায় ঐ দুটি আঁখি যেন কাউকে খুঁজছে! কিন্তু মুখ খুলতে পারছে না।অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকানোর পর লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে লাবণ্য-
” শুভ্র ভাইয়া কে যে দেখছি না! ওনি কি খাবে না?!”
ভাইয়া!!!
খাবার মুখে তুলে হাসতে হাসতে কাশি উঠে যায় শিশিরের। লাবণ্যর শাশুড়ি একধমকে শিশিরের হাসি থামিয়ে হাতে একটা পানির গ্লাস ধরিয়ে দেয়। তারপর লাবণ্যর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে জবাব দেন-
” খাবার টেবিলে বসছিস, খেয়ে চলে যা। এসব শুভ্র টুভ্রর খাবার নিয়ে চিন্তা তোকে করতে হবে না। যার ইচ্ছে হবে নিজে নিয়েই খেতে পারবে। আর ইচ্ছে না হলে না খাবে। এই নে! তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরে খেতে। জলে টলমল চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকে লাবণ্য। তারপর যখন বুঝতে পারে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে, তখন কাউকে কিছু না বলে ড্রয়িংরুম থেকে দৌঁড়ে চলে যায় লাবণ্য। লাবণ্যর চলে যাওয়ার পর শিশির উত্তেজিত গলায় বলে উঠে-
” হলো তো এবার?
মা! আর কত? আর কত কষ্ট দিবা ভাইয়াকে? তোমার নিজ পেটের ছেলে। একটুও কষ্ট হয় না ওর জন্য? একটা বছর ধরে ওকে এভাবে দিনের পর দিন ব্যথার তীরে জর্জরিত করে আসতেছ। আর কত জর্জরিত করবা ওকে? এবার তো ক্ষতটা শুকাতে দাও…”
মেয়ের কথা শুনে রেগে গেলেও কিছুই বললেন না রোকসানা বেগম। তবে মুখ খুলেন বাবা। রাগান্বিত স্বরে ধমক দিয়ে বলেন-
” চুপ! একদম চুপ! ছোট হয়ে বড়দের ব্যাপারে কথা বলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
“বাবা তুমিও?”
অবাক বিস্ময়ে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে খাবার প্লেটে পানি ঢেলে হনহনিয়ে রুমে চলে যায় শিশির।
রাত্রি সাড়ে বারো’টার মত বাজে। সবাই আরো একটাদিন সেহরী খাওয়ার অপেক্ষায় নিদ্রাজগতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই শুভ্র লাবণ্যর চোখে। একজন মেয়েদের মত হাউমাউ করে ফ্লোরে বসে কান্না করতেছে, আরেকজন বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতেছে। একজন কাঁদতেছে ওর কৃতকর্মের জন্য, ওর করা ভুলের জন্য।
আরেকজন কাঁদতেছে অনর্থক।
হ্যাঁ, অনর্থক’ই বটে।
না হলে এভাবে কাঁদবে কেন?
কি মানে আছে এই কান্নার? আর কেন’ই বা কাঁদবে? কিসের জন্য কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে?
সব প্রশ্নের একটাই উত্তর, আর সেটা হলো ভালোবাসা। আপনার আমার কাছে যেটা অনর্থক, ওর কাছে সেটা ভালোবাসার কান্না।
আমরা মানুষগুলোই এরকম। প্রচন্ড রকম দুঃখবিলাসী। না হলে যার থেকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পায় কেন তার কাছে এভাবে ফিরে ফিরে যায়?
সেদিন সেহরীর সময় শুভ্র কিংবা লাবণ্য কেউ ঘুম থেকে উঠেনি।
শুভ্রর মা এবং শিশির দুজনের রুমের দরজায় অনেকক্ষণ নক করেছে, কিন্তু কেউ দরজা খুলেনি। ফজরের নামাজের আজান ধ্বণি ভেসে আসতে লাগল দুরের সব মসজিদ থেকে। কিন্তু ওরা? তখনো ঘুমুচ্ছে।
সকাল ৯টা। শুভ্র বাসা থেকে এই সময়ই বের হয়ে যায়, কিন্তু আজ? সে ঘুমুচ্ছে। সকাল ১০টা। লাবণ্য কলেজে প্রাইভেট পড়তে যায়। অথচ আজ? ও ঘুমুচ্ছে। বেলা ১২টা। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে। দুপুর ১টা বেজে ৩৫মিনিট। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে।
শিশির:- মা….
আর কত ওয়েট করবা? এবার তো দরজা দুইটা ভাঙো।
মা:- আর একটু ওয়েট কর। তোর বাবা আসতেছে।
কাজের মেয়ে:- ঐ তো আংকেল এসে গেছে।
,
দুইটা সুঠামদেহী যুবক নিয়ে শুভ্রর বাবার আগমন হলো ২য় তলায় রুমের সামনে।
,
,
শিশির:- বাবা! দেখো না ওরা দরজা খুলতেছে না।
শুভ্রর মা:- এসেছ তুমি? এবার তাড়াতাড়ি দরজা ভাঙো।
শুভ্রর বাবা:- সরো তোমরা। আমি ডেকে দেখি।
শুভ্রর বাবা শুভ্র এবং লাবণ্য দু’জনের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর জোর গলায় বলতে শুরু করল-
” শুভ্র দরজা খুল। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। ”
” লাবণ্য মা! দরজা খুলো। অনেক বেলা হয়েছে। এবার তো উঠো।”
” কি হলো শুভ্র? দরজা কেন খুলতেছিস না?”
” লাবণ্য! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? দুপুর আড়াইটা বাজে। নামাজ পড়বা কখন? দরজা খুলো তাড়াতাড়ি।”
” শুভ্র! এবার কিন্তু আমার রাগ উঠে যাবে। দরজা খুল বলছি।”
” লাবণ্য মা! দরজাটা খুলো।”
নাহ!
কোনো কাজ হলো না। এবার মনে হচ্ছে দরজাটা ভাঙতেই হচ্ছে। কামাল, কাশেম!
তোমরা দরজা ভাঙার জন্য প্রস্তুত হউ। প্রচন্ড রাগে ফুসছে শুভ্রর বাবা। এভাবে লোক হাসানোর কোনো মানেই হয় না। আজ দরজাটা ভাঙোক, তারপর দুটোকেই বাড়ি থেকে বের করে দিব। এ বাড়িতে থেকে কোনো নাটক চলবে না। ???
আগে তো দরজা ভাঙোক……???
চলবে……..