ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। শুভ্র আর বাসায় ফিরছে না। টেনশনে অস্থির লাবণ্য ফোন হাতে নাম্বার তুলেও কল দেওয়ার সাহস পায়নি। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। শুভ্রর তখনো ফেরার নাম নেই। অস্থির লাবণ্য বারান্দা থেকে রুম, রুম থেকে গেইটের সামনে, গেইটের সামনে থেকে বারান্দায় এভাবেই ঘুরঘুর করছে আর অধির আগ্রহে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু শুভ্রর ফেরার কোনো নাম নেই। নিরুপায় লাবণ্য সাহস করে এবার শুভ্রর নাম্বারে কল দিয়েই ফেলল। এদিকে বারবার কল দেওয়ার পরও শুভ্র কল রিসিভ করছে না। টেনশনে উদ্ভিগ্ন লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। একটা সময় ওপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠে ভেসে উঠে, “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু পর আবার চেষ্টা করুন।” ফোন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। বার বার ওপাশ থেকে একই কন্ঠ ভেসে আসছে। বাধ্য হয়ে লাবণ্য হসপিটালে কল দেয়। জানা যায়, শুভ্র সারাদিনে একবারও হসপিটালে যায় নি। হসপিটালে যায়নি, এদিকে ফোনও বন্ধ। শুভ্রর কিছু হয়নি তো? অজানা আশঙ্কায় লাবণ্যর ভিতরটা শিউরে উঠে। নিরুপায় লাবণ্য শুভ্রর খুঁজে বের হয়ে পরে বাসা থেকে। বাসার সামনের টঙ দোকান, চেনা জানা অলিগলি, ক্যাফে, রেস্তোরা কোথাও, কোথাও বাদ পরেনি খুঁজতে। কিন্তু শুভ্রর সন্ধান আর মিলাতে পারেনি লাবণ্য। রাত্রি তখন দশটা। সারাদিনের অভুক্ত লাবণ্য অসুস্থ্য শরীরে যখন হেলেদুলে রাস্তা হাঁটছিল তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরূপী জানোয়ারগুলো ওর দিকে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল। কাকতালীয় ভাবে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল লাবণ্যর কলেজ ফ্রেন্ড সুমন। ছেলেদের বাজে মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে এসে বুঝতে পারে এ আর কেউ নয় তারই প্রাণের বান্ধবী লাবণ্য ছাড়া। সুমন দৌঁড়ে যায় লাবণ্যর কাছে। জিজ্ঞেস করে, কিরে কি অবস্থা দোস্ত? এত রাত্রে তুই এখানে যে? লাবণ্য কথা ঘুরিয়ে জবাব দেয়, রাতের শহর দেখতে এসেছিলাম। তুই? তুই এখানে কি করছিস? স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, বান্ধবীদের সাথে রাত্রিবেলা শপিং করার শখ জাগছে। একটা বউ বলে কথা। ফেলতে পারিনি আবদার। নিয়ে এলাম শপিংয়ে। মেয়েদের শপিং। বুঝতেই তো পারছিস সময়ের ব্যাপার… তাই বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসির রেখা টেনে লাবণ্যর জবাব, ওহ, আচ্ছা! বুঝতে পারছি। আজ তাহলে আমি আসিরে। অন্য আরেকদিন কথা হবে। ভালো থাকিস। লাবণ্য রাস্তা পার হচ্ছিল, পিছন থেকে লাবণ্যর হাত ধরে হ্যাচকা টানে সুমন লাবণ্যকে ওর কাছে নিয়ে যায়। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে সুমনের দিকে তাকিয়ে আছে। সুমন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে, আরেকটু হলে তো উপারে চলে যাইতি। চল, তোকে রাস্তা পাড় করিয়ে দিচ্ছি।
রাত্রি সাড়ে ১০টা।
শুভ্র বাসায় পায়চারি করছে আর বার বার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। অস্থির শুভ্র ফোন করে বন্ধু আতিক’কে। “আতিক! তোর ভাবি তো এখনো ফিরেনি। তুই কি বাসা থেকে বের হইবি একটু?” সিরিয়াস কন্ঠে আতিকের জবাব, আর দেখতে হবে না দোস্ত। যা দেখার দেখে নিয়েছি। শুভ্র! আজ সত্যি বুঝতে পারছি তুই আসলেই সত্যি কথা বলতি। আর আমি ব্যাটা ভাবছি তুই’ই ভুল। শুভ্র অস্থির ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে আতিককে, কি? কি বলছিস তুই? কার কথা বলছিস? আতিক সাথে সাথে একটা এমএমএস পাঠায় শুভ্রর ফোনে। এমএমএসটা ওপেন করে শুভ্রর চোখ কপালে। একটা অচেনা ছেলের সাথে ওর বউ হাত ধরাধরি অবস্থায় হাঁটতেছে। ভুলের পাহাড় ছোট্ট থেকে মুহূর্তেই বিকট আকার ধারণ করে। সত্যি’টা অনুধাবন না করেই লাবণ্যর প্রতি একরাশ ঘৃণা পুষে ফেলে শুভ্র। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শুভ্র যখন সোফায় বসেছিল তখন ভীরু পায়ে রুমে লাবণ্যর আগমন। শুভ্রকে বাসায় দেখে লাবণ্যর মুখে হাসি ফুটে উঠে। শুকনো হাসি মুখে এনে বলে, “এসেছেন?”
সোফায় হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি না এলেই তো হ্যাপি থাকতি, তাই না?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে লাবণ্য, এসব কি বলছেন আপনি? সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ্র। চটজলদি লাবণ্যর চুলের গোছা ধরে ফেলে। মুঠোভর্তি চুলের গোছা ধরে বলে উঠে শুভ্র, ” বুঝতে পারছিস না? সত্যি কি তুই বুঝতে পারছিস না?” আচমকা শুভ্রর এধরনের আচরণে অবাক লাবণ্য বলে উঠে, ” আমি কি কোনো অন্যায় করেছি শুভ্র?” চুলের মুঠি আরো শক্ত করে ধরে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর চোখে চোখ রেখে বলে, খবরদার! তোর ঐ পাপ মুখে আর কখনো আমার নাম নিবি না। লাবণ্য অবাক বিস্ময়ে আবারো প্রশ্ন করে, ” আমার অন্যায়টা কি সেটাতো বলুন আপনি!” রাগে আগুন শুভ্র লাবণ্যর চোখের সামনে আতিকের দেওয়া সেই এমএমএসটা মেলে ধরল। একপলক তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসির রেখা টেনে বলে উঠে লাবণ্য, এটা? উচ্চস্বরে শুভ্রর জবাব, অবাক হয়েছিস যে কিভাবে এটা আমি পেলাম? আরে সত্য কখনো চাপা থাকে না, সত্যকে হাজার চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যায় না। তুই ধরা পড়ে গেছিস। সময় হয়ে গেছে তোর মুখ ও মুখোশ উন্মোচনের।
দেখুন আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। এই ছেলে আমার…..(…..)….???
চুপ, একদম চুপ! কোনো কথা বলবি না। অনেক সয়েছি, আর না……….
লাবণ্য সেদিন অনেক চেষ্টা করছে সত্যিটা বলার, কিন্তু শুভ্র তা শুনতে নারাজ। অসহায় লাবণ্য সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে শেষরাত্রে যখন ঘুমানোর জন্য চোখ বুজল তখন হ্যাচকা টানে শুভ্র ওকে বিছানা থেকে তুলে বসায়। অনেক ঘুমিয়েছিস, আর না! এবার চল আমার সাথে। শুভ্র লাবণ্যকে একরকম টানতে টানতে গেইটের সামনে ওর গাড়ির কাছে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে লাবণ্য, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? রাগে আগুন শুভ্রর জবাব, তোর বাপ-মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আজ থেকে ওদের কাছে থাকবি। কিন্তু আমার বাবা- মা তো…….. (…..)….??? কোনো কিন্তু নেই। তুই ওদের কাছে থাকবি, এটাই ফাইনাল। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর গ্রামের বাড়ির রাস্তায় চলে আসে। আসবার কালে অসহায় লাবণ্য জল ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়েছিল। পিছু ফিরে শুভ্র যখন তাকিয়ে ছিল তখনো অবধি লাবণ্যর বিশ্বাস ছিল শুভ্র মনে হয় মজা করছে। এখন দৌঁড়ে এসে আমার কাছে এসে বলবে স্যরি, আমি আসলে মজা করছি তোমার সাথে। নাহ! শুভ্র এসব কিছুই বলেনি। বলেছিল শুধু- মনে আছে তো আমি কি বলছি? কাঁদো কাঁদো গলায় লাবণ্যর জবাব, হুম! আজ থেকে আমি আমার বাবা মায়ের সাথে থাকব। জোর গলায় শুভ্রর জবাব,
Good…মনে থাকে যেন…..
দেখতে দেখতে শুভ্রর গাড়ি দুরে, বহুদুরে মিলিয়ে যায়। ক্লান্ত লাবণ্য একটু একটু ওর বাবা মায়ের কবরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে……..
চলবে………………