ভুলোনা আমায় পর্ব-১৫

0
973

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

বাবা’র বাড়ি থেকে এস এস সি পরীক্ষার পার্ট শেষ করে সবে মাত্র আজকে ঢাকায় ফিরলো টুসি। তখনি দুইটা খুশির খবর জানতে পারলো এক তার ছোট জা প্রেগনেন্ট।দ্বিতীয়টা হলো মেহুলের বিয়ে ঠিক হয়েছে! ছেলে মন্ত্রণালয়ে চাকরি করে, সরকারি কোয়ার্টারে থাকে পরিবার নিয়ে। খুব ভালো সমন্ধ দেখে রোকেয়া বেগম রাজি হয়ে গিয়েছেন। সোহান কে সব কিছু বলে রাজি করিয়েছেন। তারপর ও সোহান আরমান কে বলেছেন ছেলের সম্পর্কে ভালো করে খুঁজ খবর নেওয়ার জন্য। আরমান খুঁজ নিয়ে ভালো রিপোর্ট ই পেয়েছে।তাই গতকাল পাকা কথা বার্তা হয়েছে। আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। কেননা বিবাহের জন্য জুমার দিন হচ্ছে উত্তম দিন। ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোন দিন, যে কোন সময় বিবাহের জন্য বৈধ। তবে শাওয়ার মাস আর জুমার দিনে বিবাহ করা সুন্নত।[১]

বুখারী সাথে করে টুসি’কে নিয়ে এসেছে।আর তাই রোকেয়া বেগম এতো সময় পাত্রের সম্পর্কে সব কিছু জানালেন বুখারী কে। বুখারী খুশি হয়ে বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ।দো’আ করি আমাদের বোন সুখী হোক।

রোকেয়া বেগম বললেন,
— হ বাপ একটা মেয়ে আমার ওর শান্তি দেখে গেলে মরলে হাড় গুলো পচবো! সোহানের জন্য দুঃখ হয়, ছেলেটা ভাই বোন কারো বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারলো না। কতো আশা ছিল বোনের বিয়ে নিজ হাতে দিব।তা আর হলো কই।তয় তোমরা কিন্তু অবশ্যই থাকবে তোমাদের বোনের বিয়েতে। আমি ভাইজান রে আজকেই কল করে বলবো। তবুও তোমারে বলি দরকার হলে ঘরে তালা দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে আসবে।

বুখারী বললো বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবে। তারপর রোকেয়া বেগম এবং মেহুল বলে কয়ে আজকের দিনটা রেখে দিল বুখারী কে।

এর পরের দিন সকালে নাস্তা করে বাড়ির জন্য র‌ওনা হয় বুখারী।
.
ভাবী ননদিনী অনেক দিন পর একসাথে হয়েছে তাদের মনে কতো সুখ দুঃখের কথা জমেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। দু’জনে দোলনায় দোল খেতে খেতে মনের কথা গুলো শেয়ার করছে একজন আরেকজনের কাছে।কার পরীক্ষা কেমন হলো? কেন্দ্রের মধ্যে কেমন গার্ড দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে টুসি দুঃখ প্রকাশ করে বলে,
— তোমার ভাইকে ছাড়া, তোমার সাথে সারাদিন কথাবার্তা বলে দিন কাটিয়েছি। এখন তুমি চলে গেলে কি হবে আমার? আমি একা একা কিভাবে সময় কাটাবো?

মেহুল তার আদরের ভাবী কে জরিয়ে ধরে বললো,
— আমিও তোমাকে ছাড়া ঐ নতুন পরিবেশে লোকজনের সাথে কিভাবে কাটাবো ভাবী? মাকে বলো না আমাকে এখন বিয়ে না দিতে!

টুসি মেহুল কে ছাড়িয়ে তার হাত দুটো ধরে বললো,
— এমন কথা মুখেও আনে না বোন। আমাদের মেয়েদের জন্ম‌ই হয়েছে পরের ঘরে বাস করার জন্য। তোমরাও কিন্তু আমার কাছে অপরিচিত ছিলে কারণ ফুফি বছরে একাতবার আমাদের বাড়িতে গেলেও তোমরা কখনো যাওনি। ইভেন তোমার ভাইকে তো আমি আগে কখনোই দেখিনি। তবে সব কিছুর মাঝে একটা ভালো আছে, “লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক” সেটা হলো স্বামীর ভালবাসা। তুমি যখন তোমার স্বামীর ভালবাসা গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে তখন বাদবাকি সব কিছু তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে।
— আচ্ছা তোমার স্বামী বুঝি তোমাকে অনেক ভালোবাসে?

টুসি লজ্জা পেয়ে বললো,
— দুষ্টু মেয়ে কোথাকার..

এর মাঝে রোকেয়া বেগম এসে বললেন,
— কত্ত কাজ কাম বাকি আর তোরা বসে বসে গল্প করিস।
টুসি সাথে সাথে উঠে এসে বললো,
— আমি এক্ষুনি যাচ্ছি আম্মা।

সাথে মেহুল যেতে চাইলে রোকেয়া বেগম বললেন,
— তোকে এই কয়েকদিন কোন কাজ করতে হবে না।যা গিয়ে মুখের যত্ন (রুপচর্চা) নে।
.
রোকেয়া বেগম নিজ হাতে টুসি’কে ধরে ধরে কাজ শিখাতে লাগলেন।টুসি ও শিখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।যদিও অনেক ভুল হয়ে যায় এতে করে রোকেয়া বেগম রোজিনা বেগম কে নিয়ে কথা শুনাতে ছাড়েন না। রোজিনা বেগম কেন কাজ শিখালেন না এগুলো নিয়ে বলতে থাকেন।
মাঝে মাঝে টুসি’র ইচ্ছে করে জবাব দিতে কিন্তু সোহানের কথা ভেবে নিজেকে সংযত করে রাখে।
.
.
বিয়ের আগের দিন টুসি’র মা আর দাদু ছাড়া বাকি সবাই এলো। এছাড়াও রোকেয়া বেগমের অনেক আত্মীয় স্বজন এবং মিরার বাপের বাড়ির লোকজন সহ।টুসি সবার আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। সোহান কল করলেও কথা বলতে পারছে না। সোহান বুঝতে পারছে না টুসি কি এমন কাজ করছে, পিচ্চি কাজ পারেই কতটুকু?তাই খানিক রাগ করে মায়ের সাথে কথা বলে রেখে দিয়েছে।

সোহান তো আর জানে না তার পিচ্চি ব‌উ এখন কাজ কর্ম অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছে।
টুসি’র কাজের চাপ দেখতে পেয়ে তার দুই ভাবী সাহায্য করতে যায়। কিন্তু টুসি দেয় না, জোর করে নিয়ে রুমে বসিয়ে রাখে।

অতঃপর,
এর পরের দিন বিয়ে সম্পুর্ন হলে আত্মীয় স্বজন চলে যেতে শুরু করে। আবার দূরের যারা আছে তারা থেকে যায়। তারপরের দিন সোহানের কথায় আরমান টুসি’র দুই ভাবীর জন্য খুব সুন্দর কাতান শাড়ি নিয়ে এসে তাদের উপহার দেয়।তারা নতুন ব‌উ এই প্রথম সোহানদের বাড়ি এসেছে বলে কথা।
এতে টুসি খুব খুশি হয়, সোহানের প্রতি।

এদিকে মিরা ফিসফিস করে আরমান কে খুঁচিয়ে বলে, তোমার তো সাধ্য নেই আমার পরিবার কে কিছু উপহার দেওয়ার।এই শাড়ি গুলো কমের মধ্যে এনে তো বাকি টাকা দিয়ে আনতে পারতে?
আরমান তখন বললো,
— এসব বলে না মিরা, আল্লাহ গুনাহ দিবেন। এটা একধরনের চোরি করা হতো।

মিরা ভেংচি কেটে চলে যায় তার রুমে।
.
.
এক সপ্তাহ পর,
টুসি’র ভিশন জ্বর আসে। তাকে সেবা করার জন্য শুধু কাজের মহিলা আমেনা বুয়া আসে। মাঝে মাঝে একটু মাথায় পানি ঢেলে দিয়ে যায়।এ ছাড়া আর কেউ আসে না। এতে করে খুব কষ্ট পায় টুসি। কিছুই খেতে পারে না একটু খেলে‌ই ভুমি হয়ে যায়।”ফাহিম চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি গল্প চোরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে” সোহান ও আজকে কল করেনি এ জন্য টুসি’র মনটা আরো বিষিয়ে আছে।
ভালো লাগছে না বলে,ড্রয়িং রুমে উঠে এসে বসে। তখন দেখে রোকেয়া বেগম সোহানের সাথে কথা বলছে। এতে টুসি খুব কষ্ট পেলো তাকে কেন কল করলো না সোহান?তার অসুস্থতার মাঝে সোহানের সাথে কথা বললে মনটা প্রশান্তি পেত। বিষন্ন মন নিয়ে সারাদিন শুয়ে বসে পার করলো টুসি।এর মাঝে মাঝে খুব কষ্টে নামায আদায় করে নিয়েছে। কেননা মুমিন মুসলমানের জন্য ঈমানের পর প্রথম ও প্রধান ইবাদত হচ্ছে নামাজ। নামাজের রোকনগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে না পারলেও নামাজের ফরজিয়ত তথা আবশ্যকতা থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই। হাদিসে এসেছে-হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমার অশ্ব রোগ ছিল। এ অবস্থায় আমি কিভাবে নামাজ আদায় করবো তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় কর, যদি না পার; তবে বসে (নামাজ আদায়) কর, তাও যদি না পার, তাহলে এক পার্শ্বের উপর (নামাজ) আদায় কর।[২]
.
.
এরপরের দিন সোহান কল করলে টুসি বলে,
— আম্মা কে গতকাল কল করলে অথচ আমাকে আপনি কল করলেন না কেন?

গতকাল কাজের খুব চাপ ছিল বলে মায়ের সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলে রেখে দেয় সোহান। সেটা টুসি’কে বলার আগেই টুসি কথার শুরুতেই মাকে নিয়ে হিংসাত্মক কথা বলায় খুব রেগে যায় সোহান!রেগে কল কেটে অফলাইনে চলে যায়।

টুসি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে,সে এ কোন সোহানের সাথে পরিচিত হলো?এই মুহূর্তে বড্ড অচেনা লাগছে মানুষটাকে। একদিকে জ্বর এখনো অবধি পুরোপুরি কমেনি তার উপর সোহানের এমন ব্যাবহার মাথা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো।
ডাইনিং এ পানি খেতে আসলে হাতের কাঁপুনিতে পানির কন্টিনার হাত থেকে পরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রোকেয়া বেগম আর মিরা দৌড়ে এসে এহেন অবস্থা দেখে রাগে তেতে উঠে রোকেয়া বেগম বলে,
— বাপের বাড়ি থেকে কি জিনিষ পত্র নিয়ে এসেছিস এভাবে যে ভেঙে চুরমার করলি?বাপ তো একটা সুতো পর্যন্ত দেয়নি!

টুসি তার প্রিয় আব্বুর নামে এভাবে বলায় সহ্য করতে পারলো না। চেয়ার চেপে ধরে বললো,
— আম্মা আপনি কি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন? আপনি ও তো আনেন নাই। ভুলবশত ভেঙে গেছে তাই বলে আব্বু কে টেনে আনছেন কেন এখানে?

ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট ছিল রোকেয়া বেগম এর জন্য। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে গিয়ে ধিরাম করে দরজা বন্ধ করে ছেলের কাছে ফোন লাগালো!একটার জায়গায় দুইটা বাড়িয়ে বললো!
ছেলে তার মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ কল দিল টুসি’কে।কল দিয়েই বলতে শুরু করলো,
— আমার মাকে কটুক্তি করে কথা বলার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে? বলেছিলাম আমার মায়ের মুখে মুখে তর্ক করবে না তাও করেছো। তোমার জন্য আমার আম্মা কষ্ট পেয়েছে। এক্ষুনি গিয়ে আম্মার কাছে মাফ চাইবে তুমি!আর যদি মাফ চাইতে না পারো তবে তোমার থাকার দরকার নেই!

টুসি কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় সোহান।টুসি কাঁদতে কাঁদতে ফ্লুরে বসে পরে। এমনিতেই অসুস্থ তার উপর এতো প্রেশার সহ্য করতে পারে না।
দিন দিন আরো অসুস্থ হয়ে পরে, সেটা সোহান জানতেও পারলো না। সেদিনের পর থেকে সোহান না কল করেছে আর না ধরেছে।টুসি’র খারাপ অবস্থা দেখে রোকেয়া বেগম স্বপন তালুকদার কে খবর দেয়, তিনি ভালো ডাক্তার দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্স করে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যান কারণ টুসি’র টায়ফয়েড হয়ে গিয়েছে।এই সময় অনেক সেবার প্রয়োজন।
কয়েকদিন যেতে সবাই বিষয়টি খেয়াল করলো এতো কিছুর মধ্যে সোহান একবার ও কল করলো না!টুসির দাদি এবং রোজিনা বেগম টুসি’কে জিজ্ঞাসা করে কারণ কি এর?টুসি নিরবে নিভৃতে কাঁদে..
_______
রেফারেন্স:-
[১] ফাতাওয়ে শামী ৩/৮।
[২](বুখারি)।
________

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে