#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
তোমার জন্য একটা গিফট আছে দেখবে?
টুসি খুশি হয়ে বললো,
— ওয়াও কি গিফট দেখি?
সোহান বাম হাতে টুসি’কে আঁকড়ে ধরে ডান হাত দিয়ে পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা সাদা রঙের বক্স বের করলো। তারপর টুসি’র হাতে দিয়ে বললো,
— নাও খুলে দেখে বলো পছন্দ হয়েছে কিনা?
ধীরে ধীরে বক্সটি খুললো টুসি। খুলে বেশ চমকে গেল! কেননা এটা একটা স্মার্ট ফোন।টুসি সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করল,কার এটা?
— তোমার! পছন্দ হয়েছে কিনা বলো?
টুসি থতমত খেয়ে বললো,
— আমার জন্য?
সোহান তার বেবি হেয়ার গুলো কানের পিছনে নিতে নিতে বললো,
— খুশি হওনি?
টুসি ফোনটা দেখতে দেখতে বললো,
— তা নয়। তবে আমার ফোনের প্রয়োজন ছিল না। আপনার ফোন থেকেই তো আমি আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলতে পারি।তা ছাড়া অন্যান্য কাজ ও করতে পারি। তাহলে কি দরকার ছিল এতো গুলো টাকা শুধু শুধু নষ্ট করার?
— বাহ্ আমার পিচ্চি বউটা তো বড় হয়ে যাচ্ছে। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে “মা শা আল্লাহ”।
— সে যাই বলেন আপনি এটা ফিরত দিয়ে দিবেন।
সোহান টুসি’র দুই গাল, নিজের দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ফিরত দিয়ে দিলে, আমি আমার বউটার সাথে কি করে কথা বলবো শুনি?
টুসি তার অরুনলোচন আঁখি মেলে, নিজের শাহাদাত আঙ্গুল তুলে ইশারা করে বললো,
— এই যে এভাবে ফেইস টু ফেইস কথা বলবেন।
সোহান ঠোঁট কামড়ে বললো,
— আমাকে যে বিদেশে যেতে হবে কয়েক বছরের জন্য! তাহলে ফেইস টু ফেইস কিভাবে কথা বলবো?
অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো টুসি,এই মুহূর্তে তার রিয়েকশান ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। কিভাবে কি বলবে? ঠিক কি বললে সোহান কে আটকে রাখা যাবে মাথায় আসছে না। সবকিছু কেমন একটা গুলিয়ে যাচ্ছে তার।
তখন দরজায় কড়াঘাত পরে, রোকেয়া বেগম সোহান কে ডাকছে।তাই টুসি’কে বসিয়ে রেখে সোহান দরজা খুলে তার আম্মার কাছে গেল।
টুসি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় দপ করে শুয়ে পড়ল। কোলবালিশ দিয়ে মুখশ্রী ঢেকে রাখলো তাই তার অনুভূতি বোঝা দায় এই মুহূর্তে।
.
.
ছোট ভাইয়ের বিয়েতে থাকবি না তুই?এই সপ্তাহে না হয় বিয়ের তারিখ ঠিক করি। তবুও তুই বিয়েতে উপস্থিত থাক, শেষ হলে তবেই বিদেশে চলে যাস।
সোহান মলিন মুখশ্রী করে বললো,
— তা হয় না আম্মা তোমাকে তো আমি আরো সপ্তাহ খানেক আগে বলেছিলাম যে আমাকে বিদেশে যাওয়া লাগবে হয়তো।আর এখন তো আগামীকাল ফ্লাইট! পিছুপা হওয়ার কোন চান্স নাই। বিয়েতে কাজ কর্ম দেখা শোনার জন্য আমি লোকজন ঠিক করে দিয়ে যাবো। তুমি এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।আর মেয়ে কি ভাইয়ের পছন্দ হয়েছে?
রোকেয়া বেগম হাসি হাসি মুখে বললেন,
— আরমান বলেছে তোমাদের পছন্দ্ই আমার পছন্দ।এ নিয়ে চিন্তা নাই, আমার ছেলে মেয়েদের আমার উপর ভরসা আছে।
— “আলহামদুলিল্লাহ”।
রাতের মেডিসিন নিয়েছো আম্মা?
— হ ঔষধ খাইতে খাইতে আর ভাল্লাগে না রে বাপ।এর থেকে মরন ভালো মনে হয়। মরনের আগ পর্যন্ত খাইতে হইবো এই ঔষধ।আর খাইতে ইচ্ছা করে না।
সোহান তার আম্মার গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,
— এমন কথা মুখেও আনবে না আম্মা। আব্বা মারা যাওয়ার পর তুমি একমাত্র সম্বল আমাদের। তোমার মুখের পানে তাকিয়ে আমরা আব্বার কষ্ট গুলো ভুলে থাকি। এমন কথা আর বলতে যেন না শুনি তোমায়। আমি সময় পেলেই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো তখন যেন না শুনি যে তুমি খাবারের অনিয়ম করেছো।এই বলে দিলাম।
মেহুল টলমল চোখে তাকিয়ে আছে, সোহান কাছে ডাকতেই হাউমাউ করে কেঁদে দিল। বললো,
— ভাইয়া তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমরা? তুমি যেও না কোথাও।
সোহান মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— বোকা মেয়ে আমি কি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি নাকি? আল্লাহ চায়েতো কাজটি শেষ করে আবার তোদের মাঝে ফিরে আসবো। ঠিক মতো পড়াশোনা করবি তুই এবং টুসি দু’জনেই। আমি যেন দু’জনেরই ভালো রেজাল্ট শুনতে পাই। আর মায়ের কথা মতো চলবি, মায়ের খেয়াল রাকবি কেমন?
মেহুল কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সোহান গাল টেনে দিয়ে বলে, আমার কিউট বোন’টা মা শা আল্লাহ।
দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে। সোহান বললো,
— আরমান মনে হয় চলে এসেছে। আমি দরজা খুলছি বস তুই।
অতঃপর দরজা খুলে দেখে সত্যিই আরমান এসেছে।বড় ভাইকে সালাম দেয় আরমান। দুই ভাই কুশল বিনিময় করে রুমে ডুকে। তারপর রোকেয়া বেগম কে সালাম দেয় আরমান। চকলেট আইসক্রিম এর প্যাকেট’টা মেহুল কে দিয়ে দুষ্টুমি করে বলে,
— এই পিচ্চি নে ধর তোর তকলেট! এবার ফেচফেচানি কান্না থামা।
মেহুল রেগে গিয়ে বললো,
— তোর চুল টেনে ছিঁড়ে দিব কিন্তু! আমি চকলেট এর জন্য কাঁদছি নাকি?নিজে তো বিয়ে করবি বলে দেইদেই করে নাচছিস। ভাইয়া যে চলে যাবে জানিস তুই?
আরমান খুব অবাক হয়ে বললো, ভাইয়া কোথায় চলে যাবে?
মেহুল সবটা বললো। সবটা শুনে আরমান খুব মনঃক্ষুন্ন হয়।তার এমন একটা বিশেষ দিনে বড় ভাই থাকবে না। এটা মানা আসলেই কষ্টের।তাই মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেল। সোহান কতো ডাকলো তাও শুনলো না।
.
.
নিজের রুমে এসে ভিতর থেকে দরজা লক করে দিল সোহান। তারপর সামনে লক্ষ্য করে দেখে টুসি এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে। তাই সোহান পাশে বসে টুসি’র চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
— এই টুসি ম্যাডাম ঠিক ভাবে শুয়ে তারপর ঘুমাও। এভাবে উল্টা পাল্টা শুলে ঘুম আসে?
টুসি’র কোন সাড়া শব্দ নেই, সোহান তার পিঠে হাত রাখতে অনুভব করলো টুসি কেমন কাঁপছে। এমন কেন করছে দেখার জন্য নিজের দিকে ঘুরাতে গেলে টুসি শক্ত হয়ে কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু সোহান ও কম যায় না, জোর করে নিজের কোলে টুসি’র মাথাটা নিয়ে আসে। তারপর লক্ষ্য করে দেখে টুসি ম্যাডাম কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলেছে। বেশি সময় কাঁদার ফলে চোখ মুখ লাল রঙা ধারন করেছে। ফর্সা গোলগাল মুখশ্রী অধিকারীর মানুষ গুলো হয়ত এমনি,কান্নার চিহ্ন গুলো মুখশ্রী তে ফুটে উঠে।
সোহান তার দুই গাল আঁকড়ে ধরে বললো,
— এভাবে কাঁদে কেউ?চোখ মুখের কি অবস্থা করেছো দেখেছো তুমি?
টুসি হেঁচকি দিতে দিতে বললো,
— আমি আপনাকে ছাড়া এখানে একদম থাকতে পারবো না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন আপনার সাথে।আর তা না হয় আপনি কোথায় যাবেন না।
টুসি’র কার্যকলাপ দেখে সোহানের নিজেরই বুক ফেটে কান্না আসছে। সত্যি এতো গুলো দিন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে সে? সে যে বড্ড বেশি ভালোবাসে তার স্ত্রী কে।
রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় আসে সোহান।টুসি’কে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে তার উপর হালকা ভর দিয়ে থাকে সে।টুসি’র চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে
দিতে বললো,প্লিজ আমাকে এভাবে দূর্বল করে দিও না। আল্লাহ তা’আলা যা কিছু করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। হয়তো এখানে আমাদের কল্যাণ নিহিত আছে, তাই যাচ্ছি।
টুসি ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। সোহানের দুই গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বলে,
— ভুলোনা আমায়!
সোহান তার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,ভুলোনা আমায়!
টুসি এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে।যেন ছাড়লেই সোহান বিদেশে চলে যাবে।
.
রাতটা তাদের স্মরনীয় হয়ে থাকবে। কেননা এই রাত তাদের “ভালোবাসাময় রাত”!একে অপরের খুব গভীর ভাবে উপলব্ধি করার রাত। যেখানে বিন্দুমাত্র ফাঁকা নেই,একে অপরের পরিপূরক হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে তাদের পবিত্র বন্ধন।
ঘড়িতে দুইটা বাজতে এলার্ম বেজে উঠল। সোহান ঘুম ঘুম চোখে এলার্ম বন্ধ করে দেয়। তারপর টুসি’র দিকে লক্ষ্য করে দেখে মেয়েটা গুটিসুটি মেরে সোহানের সাথে মিশে আছে। সোহান তার কপালের বেবি হেয়ার গুলো সরিয়ে দিয়ে নিজের অধরপল্লব দুটি ছুঁয়ে দেয়।এতে কোন ভাবান্তর নেই টুসি’র সে তার মতো করে শান্তি’তে ঘুমিয়ে আছে।এই শান্তিপূর্ণ ঘুম হয়তো চাইলেও পাবে না বছরের পর বছর।
সোহানের ইচ্ছে হলো আজকে দুজন মিলে একসাথে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার। ঘুমন্ত টুসি’র ঘুম না ভাঙ্গার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। আবার কবে না কবে এই সুযোগ আসে কে জানে? আজকে দুজনে মিলে আল্লাহ তা’আলার দরবারে হাত তুলবে। চুপিচুপি নিজেদের ইচ্ছা গুলো সৃষ্টিকর্তার কাছে ব্যক্ত করবে।
কতই না সুন্দর আল্লাহ তা’আলার মহিমা “সুবহান আল্লাহ”।
অতঃপর সোহান টুসি’র সাড়া মুখশ্রী জোরে আঁকিবুঁকি করে বলছে,
— টুসি ম্যাডাম উঠুন আমরা একসাথে নামায আদায় করবো।
কে শুনে কার কথা?টুসি সোহানের হাত জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। তাই সোহান তার অন্য হাত দিয়ে আবার দুষ্টুমি শুরু করে। একসময় বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায় টুসি। সোহান তখন আদুরে গলায় বলে,
— চলো না একসাথে তাহাজ্জুদ নামায পড়ি?
এতো আদুরে আবদার ফেলতে পারে না টুসি।তাই বলে,
— চোখ বন্ধ করুন আপনি, আমি শাওয়ারে যাবো।
সোহান দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,
— আমি তো সব দেখে নিয়েছি, এখন চোখ বন্ধ করে কি হবে?
এতে করে টুসি চোখ রাঙিয়ে তাকায় সোহানের পানে। সোহান মাথা চুলকে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। তারপর টুসি ব্ল্যাঙ্কেট জরিয়ে বাথরুমে ঢুকে।
.
.
অতঃপর দু’জনে নামাযের জন্য সুন্দর করে সাজগোজ করে তৈরি হয়ে নেয়।রাত তখন দুইটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।
টুসি’র চুল গলিয়ে পানি পরছে,তা দেখে তাওয়ালে দিয়ে খুব যত্ন সহকারে পানি গুলো মুছে দেয় সোহান। তারপর দুজনে নামাযে দাঁড়ায়।
নামায শেষে সোহানের কাঁদে মাথা রেখে তসবিহ পড়ে। পাশে থাকা জানালার থাইগ্লাস টা খুলে দেওয়া হয়েছে।ঐ দূর আকাশে চাঁদ মামা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
.
.
আজকে সোহান ঘরেই ফজর নামাজ পড়ে নিল।যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে সময়টা অতিবাহিত করার জন্য।সযত্নে আগলে রেখে দিল নিজের বাহুবন্ধনে,আবদ্ধ করে নিল টুসি’কে…..
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।