ভুলোনা আমায় পর্ব-০৯

0
869

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৯
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

রোজিনা বেগম নাস্তা নিয়ে এসে দেখে সোহান এখনো আসেনি। টেবিলে নাস্তার ট্রে রেখে দিয়ে টুসি’র দিকে পলক ফেলতেই টুসি’র মলিন মুখশ্রী নজরে পরে রোজিনা বেগম এর।তাই কাছে এসে বললেন,
— কিরে এভাবে বসে আছিস কেন?ভাবী’দের পছন্দ হয়েছে?

টুসি’র থেকে কোন উত্তর না পেয়ে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রোজিনা বেগম আবার বললেন,
— ওহ হ্যাঁ জামাই তখন ঐভাবে একা একা চলে আসলো কেন?কিছু কি হয়েছে?

এবার ও চুপ করে বসে আছে টুসি।তা দেখে যা বোঝার বুঝে গেল রোজিনা তাই রুক্ষ গলায় বললেন,
— আবার নিশ্চ‌ই কোন ঘটনা ঘটিয়েছিস? তুই কি আমাদের মরন চাস?

চমকে মায়ের পানে তাকায় টুসি! রোজিনা বেগম আরো কঠোরতা অবলম্বন করে বললেন,
— সোহানের মতো ভদ্র ছেলে বলে তোকে এখনো সহ্য করে যাচ্ছে অন্য কোন ছেলে হলে দূর দূর করে তারিয়ে দিত। আসলে কি বল তো এমন একজনের স্ত্রী হ‌ওয়ার যোগ্যতা তোর নেই। এখন কি মনে হচ্ছে জানিস?আমরা ছেলেটার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি!

টুসি’র চোখ দুটো ছলছল করছে, ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখেছে। রোজিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, হনহন করে বেড়িয়ে চলে যান।টুসি’র চোখের অবাধ্য নোনা পানির ফোঁটা চোখের কোটর থেকে গড়িয়ে পরে।
এশার নামাযের সময় হয়ে আসছে তবুও সোহান বাড়ি ফিরে এলো না।

এদিকে সোহান দীঘির পাড়ে পাকা সিঁড়িতে বসে আছে। মনের আকাশে মেঘ জমেছে তার!টুসি’র সব কিছু সহ্য করে নিলেও বে-পর্দা চলাফেরা মেনে নিতে পারছে না সে। দুপুরের সেই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠলেই রেগে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নেয়। একটা পরপুরুষ হয়ে কেন তার স্ত্রীর হাত ধরবে? কেন? ইচ্ছে করছিল থাপ্পর দিয়ে টুসি’র গাল দুটো লাল করে দিতে, কিন্তু সোহান তার রাগ কে শংবরন করে নেয় কেননা,
স্ত্রী কে কখনো মারধর না করা সুন্নাত। রাসূল (সাঃ) কখনো কারো উপর প্রতিশোধ নিতেন না, এবং স্ত্রীদের ও মার ধর করতেন না।[১]

যাই হোক এবার যেভাবেই হোক টুসি’কে বুঝতে হবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা এতো ঠুনকো কাচের মতো নয়। এটা একটা পবিত্র বন্ধন,যেটা আল্লাহ পাক নিজ হাতে নির্ধারণ করেছেন।
.
এশার নামাযের আযান হচ্ছে, সোহান আযানের সাথে সাথে জবাব দিচ্ছে। তারপর আযান শেষ হলে আযানের দো’আ পড়ে, দূর আকাশের ঐ চাঁদের দিকে তাকিয়ে দুই হাত তুলে বলতে শুরু করে কেননা এই সময়টা দো’আ কবুলের মুহূর্ত,

— ইয়া আল্লাহ আমাকে তুমি আরো ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করো,বোঝবান হ‌ওয়ার পর থেকে তোমার হাবিবের আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
সাবা আমাকে অনেক পছন্দ করতো আমি বুঝতে পারছি তাই একজন নারীকে সম্মান করে,আম্মা’র কাছে সাবা’র ব্যাপারে প্রস্তাব রাখি। কিন্তু আম্মা রাজী ছিলেন না,আর তাই মায়ের অবাধ্য হয়ে সাবা’কে বিয়ে করিনি।
জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ধ্বংসহোক সেই ব্যক্তি! যে তার মা-বাবা উভয়কে অথবা উভয়ের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অথচ সে জান্নাত লাভ করতে পারল না। হোক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘আমিন’। অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করুন।’ (মিশকাত) কত মারাত্মক কথা। এ হাদিস থেকে অনুমান করা যায় যে, মা-বাবার সঙ্গে অবাধ্য আচরণ করলে কেন কবিরা গোনাহ হবে।
মা-বাবার অবাধ্য হওয়া আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী। কেননা আল্লাহ তাআলা মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ পালন করা প্রত্যেক সন্তানের জন্য ফরজ। এ জন্য যারা মা-বাবার অবাধ্য হবে; এটি তাদের জন্য কবিরা গোনাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। (আরও) নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।[২]

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত মা-বাবার অবাধ্য না হওয়া আল্লাহর নির্দেশ। আর এর ব্যতিক্রম করার অর্থই হলো- আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা। আর তা কবিরা গোনাহ।

এমনকি বাবা-মা অমুসলিম হলেও…

তবে কোন অবৈধ নির্দেশের ক্ষেত্রে পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া জায়েজ।আর বিবাহ মূলত বিবাহ কারীর পছন্দে হ‌ওয়া উচিৎ।বরং এটা তার হক।তবে প্রত্যেক বাবা মায়ের সন্তানের কাছে একটা আশা থাকে তাই সে দিকটাও লক্ষ্যণীয়।তাই আম্মার ইচ্ছা কে সম্মান করে তার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করেছি।

এবংকি কোনদিন কোন হারাম সম্পর্কে নিজেকে জড়াইনি। একটা হালাল সম্পর্ক চেয়েছি সর্বদা। আর তাই আম্মার অবাধ্য হয়ে সাবা’কে বিয়ে করিনি।আম্মার পছন্দ মতোই বিয়ে করেছি।
তাই আমরা স্ত্রী কে সঠিক জ্ঞান দান করো আল্লাহ। আমি দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতেই পারি না। আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়, সচরাচর এমন সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেঙ্গে যায়। কিন্তু আমি চাই না সেরকম কিছু হোক। আমি তোমার সাহায্য চাই আল্লাহ, তুমি একমাত্র আমাকে সাহায্য করতে পারো ইয়া আল্লাহ।
.
মোনাজাত শেষে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ে বাসায় ফিরে। খুব খিদে অনুভব করছে সে, সেই সকালে নাস্তা করেছিল তার পর আর খাওয়া হয়নি।ভাবছে রোজিনা বেগম কে খাবারের কথা বলবে কিনা?পরে আবার মনে হলো বাড়িতে অনেক মেহমান রয়েছে। উনি নিশ্চ‌ই কাজে ব্যস্ত আছেন,, এরকম বিভিন্ন কথা চিন্তা করে আর গেল না বড় ঘরে। চোখের উপর লম্বা করে ডান হাত রেখে খাটে শুয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর কারো পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলো টুসি এসেছে।তাই পুনরায় আগের ভঙ্গিতে শুয়ে রইলো।

টুসি কাছে এসে বসলো সোহানের। তারপর ধীরে ধীরে সোহানের বাম হাতটা নিজের দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
— আমাকে মাফ করে দিন? আমি আর কখনো আপনার অবাধ্য হবো না। আপনি যেমনটি বলবেন, তেমনটি হবে। এবারের মতো মাফ চাই..

তখন রোজিনা ঘরের দরজায় কড়াঘাত করে।টুসি হাত ছেড়ে দিলে সোহান উঠে বসে।
রোজিনা বেগম বলে,
— সোহান বাবা খেতে আসো, তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
— জ্বি মামি আসছি।
— আচ্ছা আসো তাড়াতাড়ি।

সোহান খাট থেকে নেমে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
— খাবার খেতে আসো।

তারপর একা একা ঐ ঘরে চলে গেল।টুসি চুপচাপ কতোক্ষণ বসে থেকে তারপর ডাইনিং রুমে যায়।টুসি’র দাদি দেখে বলে, সোহানের পাশে বসতে বলে।টুসি বাধ্য মেয়ের মত বসে পরে। খেতে খেতে সোহানের দিকে আড়চোখে তাকায়। সোহান ধীরে ধীরে খুব সুন্দর করে খাচ্ছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক খিদে পেয়েছে বেচারার।
টুসি এভাবে তাকাতে তাকাতে আনমনে মরিচ খেয়ে নেয়।এতে করে জ্বালে অবস্থা নাজেহাল তার।রোজিনা বেগম পানি এগিয়ে দেয়।স্বপন তালুকদার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— দেখে শুনে মরিচ বেছে খাবি তো। এখন একটু কমেছে?

টুসি মাথা নাড়িয়ে বোঝায় কমেছে। এদিকে সোহান ফিরেও তাকায় না টুসি’র দিকে।এতে করে টুসি খুব কষ্ট পায়।অন্য সময় হলে খুব যত্ন সহকারে পানি খাইয়ে দিত সোহান, অথচ আজকে ফিরেও তাকালো না।
খাবার শেষে চুপচাপ উঠে চলে গেল। সোহান চলে যেতে রোজিনা বেগম স্বপন তালুকদার কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— তোমার আধুরি মেয়েকে ভালো হয়ে যেতে বলো! না হয় ও যে বড় হয়েছে সে কথা আমি ভুলে যাবো।
— কেন কি করেছে আমার মেয়ে?যার জন্য তুমি এমন কথা বলছো?

টুসি’র আর বসে থাকলো না,সব কিছু তার কাছে অসহনীয় লাগছে তাই খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেল।এতে রোজিনা বেগম আরো ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
— দেখলে? তোমার মেয়ের তেজ দেখলে তুমি? সবাই মিলে মেয়েটা কে আদরে আদরে বাঁদর করে তুলেছো!যার কারণে এমন ধারা তৈরি হয়েছে।

ছেলেদের খাবার খাওয়া শেষে নতুন ব‌উ এবং তাদের সাথে আসা মেহমানদের খেতে দেওয়া হলো। এদিকে টুসি’র কাজিন রা মিলে দুই রুমের বাসর ঘর সাজাতে ব্যস্ত।টুসি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যাওয়া ধরলে সবাই মিলে ডাকাডাকি করে কিন্তু এসব আনন্দ কিছুই ভালো লাগছে না তার তাই দু’চালা নতুন ঘর’টাতে চলে আসে।
ঘরটা পুরো অন্ধকার ছেয়ে আছে।টুসি লাইটের সুইচ অন করলে সোহানের উন্মুক্ত শরীর চোখে পড়ে। সোহান উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে আছে।টুসি দরজা বন্ধ করে মশারি টাঙিয়ে লাইট অফ করে দিল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল খাটে,গত দু’দিনের মতোই জরিয়ে ধরে শুয়ে পরলো। কিন্তু সোহান হাত ছাড়িয়ে নিল।টুসি তা আমলে নিলো না পুনরায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সোহানের পিঠে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে আঁকিবুঁকি করা শুরু করে আর বলে,
— আপনি কি রেগে গিয়ে আমাকে ছেড়ে যাবেন?

এমন ধারা কথায় চোখ খুলে তাকায় সোহান। তবে কিচ্ছুটি বলে না।টুসি আবার বললো,
— আপনি আমার সাথে কথা না বললে আমার একদম ভালো লাগে না, খুব কষ্ট হয়। কেন এমন হয় বলেন তো? আমি না আপনাতে কেমন যেন অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি।

সোহানের প্রশান্তিতে ভরে গেল মনটা,সে তো এমন কিছুর অপেক্ষায় ছিল এতো গুলো দিন। সে তো তাই চাইতো যা আজকে নিজ মুখে শিকার করলো টুসি।
.
.
সাবা কে কোর্টে আসতে বলে টুসি কে নিয়ে কোর্টের উদ্দেশ্য র‌ওনা হয় সোহান!টুসি অনেক জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পায়নি। তবে তার মনটা ভিশন খারাপ গতকাল রাতে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছে,বার বার মনে হচ্ছে স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাবে না তো…
__________
রেফারেন্স:-
[১](বুখারীঃ ৬১২৬)
[২](সুরা লোকমান : আয়াত ১৪)
___________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে