ভুলোনা আমায় পর্ব-০৬

0
1110

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৬
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে টুসি, রাস্তার পাশের গাছপালা গুলো যেন তাদের সাথে ছুটে চলেছে। সে এখনো অবধি জানে না তার গন্তব্য স্থান! সোহান কে কয়েক বার জিজ্ঞাসা করেও যখন উত্তর পায়নি তখন মলিন মুখশ্রী করে রাখে। তবে বাহিরে থেকে আসা প্রাকৃতিক ঠান্ডা হাওয়া মন ছুঁয়ে দিচ্ছে,বেশ ভালো লাগছে। পাশে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোহান ঘুমিয়ে আছে,টুসি’র কাঁদে বার বার মাথা হেলে পরছে আবার সরিয়ে নিচ্ছে। এরকম হ‌ওয়ায় টুসি বিরক্ত হয়ে সোহানের গালে হাত রেখে হালকা চেপে ধরে!যেন সোহান টুসি’র কাদেই মাথা রেখে শান্তি মতো ঘুমাতে পারে।এই কয়েক দিনে মানুষটার প্রতি তার একটা আলাদা মায়া জন্মিয়েছে,যত‌ই হোক স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনের শক্তি থাকবে না,তা কি করে হয়?

পাশাপাশি একটা বৃদ্ধ মহিলার পাশে বসেছে মেহুল।সেও বাহিরে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে।তার ভাইয়া বলেছিল,মাঝে মাঝে বিপদে আকাশের দিকে মাথা তোলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের কষ্টগুলো আল্লাহকে বলা সুন্নাত [১]যদিও মেহুলের কোন দুঃখ নেই আলহামদুলিল্লাহ। তবে আল্লাহ তা’আলার কাছে তার অনেক কিছু চাওয়ার আছে।
.
.
বিরতি সময়ে বাস থামালে, সোহান খাবার পানি কিনে আনে দোকান থেকে।টুসি খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়ে দেয় সোহান। তারপর টুসি এবং মেহুল উভয়কেই জিজ্ঞাসা করে তারা প্রাকৃতির কাজ সারবে কিনা?তারা দু’জনেই না করে। তারপর সময় মতো বিরতি শেষ হলে বাস চালু করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর সোহান কাউকে কল করে তাদের অবস্থান জানায়।

দীর্ঘ জার্নির পর স্টেশনে নামে তারা, রাস্তায় একপাশে টুসি আর মেহুল দাঁড়িয়ে আছে আর সোহান বাসের কন্ডাক্টর এর সাহায্যে টলি ব্যাগ নামায়। এদিকে টুসি রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোয় চারিদিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।এ যে তার চীরচেনা স্থান। এখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই যে তার মায়াময় গ্রাম।টুসি স্বপ্নেও ধারণা করেনি সে তার বাড়িতে আজ আসতে পারে..
সোহান পকেট হাতড়ে ফোন বের করে সময় দেখলো। তারপর টুসির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
— টুসি ম্যাডাম এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কি?

টুসি দিকপাশ না ভেবে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে সোহান কে। দৌড়ের গতিতে খানিকটা পিছিয়ে যায় সোহান। তারপর বোনের দিকে নজর দিতে দেখলো পিছন ঘুরে,ক্লান্ত হয়ে টলি ব্যাগের উপরে বসে আছে। তারপর টুসির দিকে দৃষ্টি দেয়।টুসি কেঁদে উঠে বলে,
— অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি কখনো ভাবিনি আজকে বাড়িতে আসবো।

সোহান টুসি’র মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— সব‌ই আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছে, তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি চেয়েছেন বলেই এখানে সুস্থ মতো পৌঁছাতে পেরেছি। ধন্যবাদ দিতে হলে তাকে দাও।
— কিভাবে দিব?
— আলহামদুলিল্লাহ বললেই তিনি খুশী হন। কেননা আলহামদুলিল্লাহ বলে তার প্রশংসা করা হয়। তাছাড়া খুব খুশি হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়া সুন্নাত।[২]এতে তোমার একটা সুন্নাত পালন করা হয়ে যাবে।
— আচ্ছা সিজদায় লুটিয়ে পড়া মানে কি?
— মানে শুকরিয়া আদায় করতে নফল নামায পড়বে, সাধারণত আমরা নফল নামায যেভাবে পড়ি সেভাবে।
— আচ্ছা পড়বো।
— উঁহু বলো, “ইনশা আল্লাহ”।আগাম কোন পরিকল্পনা করে “ইনশা আল্লাহ” বলতে হয়, কেননা আল্লাহ পাক চায়েতো কাজটি হবে, না হয় কখনোই সম্ভব না।
— ইনশা আল্লাহ পড়বো।

অতঃপর,টুসি’র দুই ভাই আসে তাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সোহান কুশল বিনিময় করে দুই ভাইয়ের সাথে। দুই ভাই ও অতি সম্মানের সহিত কুশল বিনিময় করে। তারপর বোনের কাছে গেলে,টুসি রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখে। দুই ভাই আহত স্বরে বললো,
— কিরে বোন ভাইদের সাথে কথা বলবি না?
— বোনকে তো বিদায় করে শান্তি মতো ঘুমাতে পারছো। একটিবার ও দেখতে গেলে না, তোমাদের বোন কিরকম আছে।বেচেই আছে নাকি মরে গেছে!

বোনের এরকম কথা শুনে বিচলিত হয়ে যায় দুই ভাই। মুখে হাত দিয়ে বলে,
— এরকম অলুক্ষনে কথা বলতে হয় না।জানিস তো আমাদের কত্তো কাজ থাকে। আমার কাছে না থাকলেই কর্মচারীদের ফাঁকিবাজি শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া সোহানের উপর আমাদের ভরসা আছে,আমরা জানি ও সবসময় আগলে রাখবে তোকে। তবে এবার যাবো তোর ভাবীদের নিয়ে তবেই যাবো।

টুসি সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— ভাবীরা কোথা থেকে আসল?

দুই ভাই থতমত খেয়ে গেল, পিছনে সোহানের দিকে তাকালে সোহান মুচকি হাসে। তারপর বুঝতে পারে টুসি’কে জানানো হয়নি।তাই বলে সে বাড়ি গিয়ে জানতে পারবি এবার চল। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিস নিশ্চিই ক্লান্ত লাগছে,চল চল…
.
.
বাসায় ফিরে সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর টুসি যখন জানতে পারলো তার ভাইদের বিয়ে তখন সে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। এবং জানিয়ে দিল,যে মেয়েদের পছন্দ করা হয়েছে টুসি’র তাদের পছন্দ না হলে বিয়ে ক্যান্সেল।এতে করে ভাইয়েরা পরেছে মহা বিপদে, সত্যি সত্যি যদি বোনের মেয়ে পছন্দ না হয় তাহলে কি হবে তাদের?তারা বোনের দুই পাশে দু’জন বসে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
— বোন তুই আমাদের একমাত্র আদরের মিষ্টি ছোট বোন….
— সে জন্যই তো আমার পছন্দ হলে, তবেই বিয়ে করবে না হয় নয়।
— বোন আমার এরকম কথা বলে না,জানিস তো বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়েদের অনেক হীন চোখে দেখে সমাজের লোকজন।
— তাতে আমার কি?হুহ বিয়ে ঠিক করার আগে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে কেন? বিয়ে হয়েছে বলে কি পর হয়ে গিয়েছি তোমাদের কাছে?
— আচ্ছা আমরা কানে ধরছি এমন ভুল আর কখনো হবে না।সরি সরি সরি…প্লিজ একসেপ্ট করে নে?

টুসি হাসে তার ভাইদের কর্মকাণ্ড দেখে, তারপর সরি একসেপ্ট করে নেয়।

বোন আর ভাইদের কর্মকাণ্ড দেখে, সামনে থাকা সোফায় বসে মেহুল সোহানের কাঁদে মাথা রাখে।আর সোহান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
.
.
রাতের শেষ তৃতীয়াংশে সোহানের রোজকারের অভ্যাস মতো ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজের সাথে ভারি কিছু অনুভব করতে পিট পিট করে চোখ খুলে তাকালো সে। তাকাতেই চোখ গুলো অটোমেটিক বড় বড় হয়ে গেল।কারণ টুসি সোহান কে ঝাপটে ধরে শুয়ে আছে। মাঝে থাকা কোলবালিশের কোন চিহ্ন টুকু নেই। তাদের দুই মুখশ্রীর মধ্যে কিঞ্চিৎ ফাঁক বিদ্যমান। সোহান পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। তারপর দুঃসাহসী কাজ শুরু করে দিল! বিরতিহীন ভাবে টুসি’র পুরো মুখশ্রী জুরে অজস্র আদরে ভরিয়ে দিতে নিজের অধরপল্লব দুটি ছুঁয়ে দিচ্ছে!যার ফলে টুসি’র ঘুম ভেঙ্গে যায়।

আজকে একটুও বিচলিত হলো না টুসি, বরং আগের ন্যায় চোখ বন্ধ করে বললো,
— নামায পড়বেন না? এখনো যে শুয়ে আছেন?

রাতের শেষ তৃতীয়াংশে সোহান তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে। এতো দিনে টুসি’র সেটা জানা হয়ে গেছে।প্রায় সময় ই ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশে সোহান কে দেখেতে না পেলে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতো সোহান নামায পড়ছে।তাই এ প্রশ্ন করলো।এর উত্তরে সোহান বললো,
— মানুষজন এভাবে জড়িয়ে ধরে রাখলে উঠি কি করে আমি? মনে হচ্ছে যেন আমি একটা কোলবালিশ..

সোহানের এমন কথায় তাকে ছেড়ে দিতে উদ্যত হয় টুসি। কিন্তু সোহান এবার আরো শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে,
— আমি কাউকে ছাড়তে বলিনি শুধু এমনি বললাম। আসলে জার্নি করে এসে খুব ক্লান্ত লাগছে,তার‌উপর শুয়েছি দুইটা নাগাদ।তাই আজকে পড়বো না।ফযরের আযান হলে তখন উঠে মসজিদে যাবো ইনশা আল্লাহ। তুমি ঘুমাও..

টুসি স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমিয়ে পরলো।এতে সোহান খুব খুশি হলো। মনে মনে আল্লাহ্ পাকের শুকরিয়া আদায় করে নিজেও চোখ বন্ধ করলো।
.
.
আজকে টুসি’র ভাইদের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান।যদিও ইসলামে গায়ের হলুদের নিয়ম নেই, তবুও গ্রামের মানুষজন এটা করেই। তাদের কে যদি বলা হয়, এই কাজ গুলো হাদীসের নেই বা করা উচিৎ নয়। তখন তারা বলে এগুলো যোগ যোগ ধরে করে আসছে সবাই এখন তোদের নতুন নতুন হাদীস বের হয়েছে! আল্লাহ মাফ করুন আমাদের।বোঝবান মানুষদের তো আর বোঝানো সম্ভব নয় তাই এমন অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় আমাদের। তবে টুসি’র দুই ভাই আনাস আর বুখারী’র যখন মেহেদী দেওয়ার কথা উঠে তখন সোহান বললো,
— পুরুষের জন্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি কল্পে হাতে বা পায়ে মেহেদি বা মেন্দি লাগানো জায়েজ নেই বরং মাকরূহ। তবে যাদি কোন ঔষধ হিসাবে যেমন হাতে বা পায়ের কোন ঘায়ের জন্য ব্যবহার করে তাহলে এটা ঔষধ হিসাবে ব্যবহারের কারণে মকরূহ হবে না। অনুরূপভাবে পুরুষের সাদা চুল বা দাড়িতে মেহেদী লাগানো জায়েজ আছে। আর মহিলারা সর্ব অবস্থায় যে কোন কারণে যে কোন জাগায় মেন্দি ব্যবহার করতে পারবে। আর বিয়ের সময় মেহেদী লাগানো শুধু মেয়েদের জন্যই জায়েজ হবে, পুরুষের জন্য নয়।[৩]

নতুন জামাইয়ের মুখের উপর কেউ কথা বলার বেয়াদবি করার সাহস করে উঠতে পারেনি কেউ।তাই গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় বাতিল হয়ে যায়।আনাস আর বুখারী ও সোহানের মত এক মত। তবে বিয়ের আনন্দে বাড়ির মেয়েরা মেহেদী দিবে বলে জানায় টুসি।মেহুল ভালো মেহেদী দিতে পারে বলে সবাই মেহুল কে ঘিরে বসেছে,মেহুল এক এক করে দিয়ে দিচ্ছে। এদিকে সোহান এক পিচ্চি কে দিয়ে টুসি কে ঘরে ডেকে নেয়….
____________
রেফারেন্স:-
[১]মুসলিম- ২৫৩১।
[২]মুখতাসার যাদুল মা’ আদ- ১/২৭
[৩]ফাতাওয়ে আলমগীরী
_____________

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে