#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৪
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
ক্লাসে নতুন স্টুডেন্ট দেখে সাবা জিজ্ঞাসা করলো,
— তুমি কি নতুন এসেছো?
টুসি দাঁড়িয়ে বললো,
— জ্বি মিস।
— কিন্তু এরকম মাঝ পথে আসার কারণ কি?
— মিস এখানে আমার…
টুসি সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগে মেহুল দাঁড়িয়ে বললো,
— মিস ও আমার ভাইয়ার বউ!
বিদ্যুৎপিষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠলো সাবা! আজকে একটা কারণে যতটা না খুশি ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ব্যাথিত হলো সাবা।তাও ভালো করে যাচাই করতে বললো,
— তোমার বড় ভাইয়া বিয়ে করেছেন?
— জ্বি মিস।
পুনরায় বুকটা হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুললো।যাকে ঘিরে তার স্বপ্ন, সেই মানুষটা আজকে অন্য কারো হয়ে গেল? কি দোষ ছিল তার? গরীব বাবার ঘরে জন্মানো এতোই দোষের? নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে ক্লাসে মনোনিবেশ করে সাবা।
এখানে পড়াশোনা করে নিজ গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে টুসি। সেসব বন্ধবস্ত করেছে সোহান।সে চায় না বিয়ের কারণে পড়াশোনার কোন রকম ক্ষতি হোক। তাছাড়া বয়স কম ধীরে ধীরে ঠিক বুঝতে পারবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। ততদিন না হয় অপেক্ষা করবে সোহান।
.
.
এটা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এখানে পড়াশোনার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে। প্রতিবছর বোর্ড পরীক্ষায় পনেরো থেকে বিশ জনের মতো গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে স্টুডেন্ট। তাছাড়া অন্যান্য স্টুডেন্টের রেজাল্ট গ্রেড পয়েন্ট থাকে। চুড়ান্ত টেষ্ট পরীক্ষায় যেসকল স্টুডেন্ট সব বিষয়ে উত্তিন্ন হতে পারে না, সেসকল স্টুডেন্ট দের বের করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট’রা এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। সেখানে সাবা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত আছে শুধুমাত্র তার বাবার দৌলতে।
মনিরুল হক এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন,সাত মাস হলো তিনি পরলোকগমন করেছেন।তার পরিবারের কথা চিন্তা করে সাবা কে এ স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। সেই থেকে বাবার আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষকতা করে যাচ্ছে সাবা। পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সোহান বা তার মা জানেন না যে সাবা এই স্কুলে কর্মরত আছে।মেহুল তার মায়ের ভয়ে কখনো বলেনি সাবা’র কথা, এমন কি সোহান কে ও না।সাবা মাঝে মাঝে খবর নেয় মেহুলের থেকে সোহানের ব্যাপারে। সেকথা মেহুল কখনো বলেনি সোহান কে।
বেশ কিছুদিন পর,
ক্লাস শেষে সাবা টুসি কে বললো,
— টিফিন পিরিয়ডে অফিস কক্ষে দেখা করো আমার সাথে!
— জ্বি মিস।
যথাসময়ে টুসি অফিসে যাবে বলে, সাথে মেহুল কে যেতে বললে মেহুল বলে,
— মিস তোমাকে একা যেতে বলেছে, আমি সাথে গেলে যদি বকা দেয় তখন? না বাবা তুমি ই যাও।
অতঃপর, ভয়ে ভয়ে অফিস কক্ষের সামনে এসে অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকে টুসি।সাবা নিজের টেক্সট বই পড়ছিল,টুসি কে দেখে বই বন্ধ করে বললো,
— বসো।
টুসি সামনে থাকা চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসে মাথা নিচু করে থাকে। তখন সাবা,টুসি’র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
— এতো কম বয়সে বিয়ে করার কারণ কি?
— মিস আমি বিয়ে করতে চাইনি!দ্যান আব্বু আম্মুর কথায় রাজি হই।
— কিভাবে পরিচয় তোমার হাসবেন্ড এর সাথে?
— উনি আমার ফুফাতো ভাই।
— আই সি।তো দাম্পত্য জীবনে খুশি তুমি?আই মিন শ্বশুর বাড়িতে ভালো লাগছে? হাসবেন্ড অনেক কেয়ার করে বুঝি?
টুসি মন খারাপ করে বললো,
— আমার এখানে একদম ভালো লাগে না মিস। আব্বু আম্মু দাদি ভাইয়াদের কথা খুব মনে পরে। আমি আমার গ্রামেই আনন্দে ছিলাম, ইচ্ছে করে ছুটে চলে যাই।
সাবা ভ্রু কুঁচকে তাকায় টুসির দিকে।টুসি’র কথা শুনে যা বোঝার বুঝে গেছে সে।তাই টুসির আড়ালে বাঁকা হাসি দেয় সে!তারপর কিছু একটা ভেবে বললো,
— তোমাকে যদি গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তুমি যাবে?
অবাক নয়নে তাকায় টুসি, তারপর হাসি মুখে বললো,
— খুব খুশি হবো আমি। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয় মিস। আমাকে তারা যেতে দিবে না কখনোই।
সাবা টেবিলের উপর থাকা কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
— আচ্ছা তাসনুভা তোমার বাবা কি করেন?আই মিন তার পেশা কি?
— আব্বুর মাছের প্রজেক্ট আছে অনেক গুলো, সেখানে কর্মচারী দিয়ে সমস্ত কাজ পরিচালনা করা হয়। আব্বু ভাইয়ারা শুধু পরিকল্পনা করে লোকজনদের মাধ্যমে কাজ করান।
এবার সাবার কাছে সবটা ক্লিয়ার হয়, মাছের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা মানে অনেক মোটা অংকের টাকা।আর তাই রোকেয়া বেগম তার ছেলের জন্য কম বয়সী মেয়ে বেছে নেন! মহিলার লোভ মাত্রাতিরিক্ত এতেই বোঝা যাচ্ছে। না হয় এতো ছোট একটা মেয়েকে বউ করে আনেন?
সর্বশেষ সাবা টুসি’কে বললো,
— তোমার হাসবেন্ড কে আমার আমার সাথে দেখা করতে বলবে, এখন ক্লাসে যাও।
টুসি জ্বি মিস বলে বলে ক্লাসে চলে যায়। এদিকে সাবা টেবিলের উপর মাথা রাখে,আর কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়।এর কিছুক্ষণ পর সাবা’র সিনিয়র শিক্ষক মাহফুজ আনাম দরজায় নক করে বলে,
— ম্যাডাম আসতে পারি?
সাবা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে মাহফুজ আনাম এসেছেন।তাই সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বললো,
— জ্বি স্যার অবশ্যই।
মাহফুজ আনাম ভিতরে ঢুকলে,সাবা সম্মান করে বসতে বলে। মাহফুজ আনাম মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে।সাবা প্রশ্ন করে বলে,
— জরুরি কোন প্রয়োজন স্যার?
— প্রয়োজন ছাড়া বুঝি আসতে নেই?
— না তা নয়, আসলে…
সাবা যতটা সম্ভব পর পুরুষে থেকে এরিয়ে চলে। কোন শিক্ষকদের সাথে,কাজ ব্যাতিত অন্য কোন আলোচনা করে না। এদিকে মাহফুজ আনাম পছন্দ করে সাবা’কে! কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।যদি সাবা নিষেধ করে দেয়..
.
.
রাতের বেলা,
দু’জন স্বামী স্ত্রী দুই পাশ ফিরে শুয়ে আছে, মাঝে কোলবালিশের দেওয়াল বিদ্যমান। হঠাৎ টুসি বললো,
— শুনছেন?
সোহান শুনেও না শোনার ভান ধরে রইলো, কোনরকম সাড়া শব্দ করলো না।টুসি করো কয়েকবার ডাক দিয়ে ব্যর্থ হলো। শেষ মেষ না পেরে নিজের ডান হাতটা সোহানের উন্মুক্ত কাঁধে রেখে ঝাকানি দিয়ে বললো,
— কথা ছিল আপনার সাথে? শুনুন না?
এবার সোহান পাশ পরিবর্তন করে শুলো।লাল রঙা ড্রিম লাইটের আলোয় পিচ্চি টুসি’র মুখ খানি বেশ আবেদন ময় লাগলো সোহানের কাছে, নিজের অবাধ্য বাম হাতটা টুসি’র গালে রেখে তারপর বললো,
— কি বলবে বলো?
আকস্মিক এমন কর্মকান্ডে শুকনো ঢুক গিলে টুসি। তারপর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
— মিস আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।
হাতটা সরিয়ে দেওয়ায় ব্যথিত হয় সোহান তাই আবারো পাশ পরিবর্তন করে বলে,
— নাম কি উনার?
— উম্মে মেহরিন সাবা।
সোহান আর কোন উত্তর দিল না, এদিকে টুসি তাকিয়ে আছে সোহান কিছু বলবে এই আশায়। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন সোহান কিছু বললো না তখন নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।
.
.
আজকে মেহুল আর টুসি’কে পৌঁছে দিতে সোহান সাথে এসেছে। উদ্দেশ্য ওদের পৌঁছে দিয়ে ম্যাডামের সাথে দেখা করা। তারপর নিজের কাজে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে সোহান। স্কুলের কেরানি কে ম্যাডামের নাম বলতেই তিনি অফিস রুম দেখিয়ে দিলেন। সোহান সেই মোতাবেক এগিয়ে গেল, তারপর দরজায় নক করে বললো,
— আসতে পারি?
সাবা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
— আসুন মি.সোহান রাজবি!
সোহান সাবা কে দেখে পিলে চমকে উঠলো, গতকাল যখন টুসি তার ম্যামের নাম উম্মে মেহরিন সাবা বললো তখন নামটা অতো আমলে নেয়নি সোহান।কারণ সোহান সাবার পুরো নাম জানতো না। শুধু ডাক নাম সাবা জানতো।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সোহান,সাবা বললো,
— বসেন। কি খাবেন বলেন চা নাকি কফি?
সোহান বসে বললো,
— ধন্যবাদ। আমি কিছু খাবো না, আমাকে এখানে ডেকে পাঠানোর কারণ বললে উপকৃত হবো।
— তা তো অবশ্যই বলবো, তার আগে বলুন কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
— আমার ভালো থাকা হারিয়েছে সেই কবেই তবুও আলহামদুলিল্লাহ।
তো বৈবাহিক জীবনে সুখী আপনি?
— হুম আলহামদুলিল্লাহ খুব সুখী।
সাবা কিছুটা রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
— মিথ্যা বলছেন আপনি! আপনি কখনই সুখী না। তারপর ও কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না এই মেয়ে’কে?ডিবোর্স দিয়ে দিন!
সাবা’র এরকম চিৎকার শুনে,আয়া এবং কেরানি দরজার কাছে ভির করলো।তারা আসেপাশে ছিল বলে শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে, কি হয়েছে দেখার জন্য।যা দেখে নিজেকে শান্ত করে সাবা, তার পর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি কি আপনাদের ডেকেছি? তাহলে এখানে আসার কারণ কি? এখন আসতে পারেন আপনারা,আর যার যার কাজে মন দিন গিয়ে।
তারপর সবাই চলে যেতে,সাবা বললো,
— আমি আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি,সে চায় না আপনার সাথে সংসার করতে।তাকে ডিবোর্স দিয়ে চলুন আমরা বিয়ে করি?
সোহান মনোযোগ দিয়ে সাবা’র সবগুলো কথা শুনলো। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
— এই বিষয়ে এক মাস পর কথা বলবো তোমার সাথে, আজকে উঠি।
তারপর সোহান চলে যায় নিজ কাজে।আর সাবা বিজয়ের হাসি হাসে আর ভাবে এই বার বুঝি সে তার প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পেতে চলেছে!…..
#চলবে….. ইনশা আল্লাহ।