ভুলোনা আমায় পর্ব-০২

0
1539

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

রাগ কে শংবরন করতে না পেরে এগিয়ে গেল সোহান।তার কথা হলো,
— এতো বড় মেয়ে হয়ে এভাবে লাফালাফি করবে কেন?মেয়ে’রা থাকবে পর্দার আড়ালে,যেন কোন পরপুরুষের নজর না পরে।অথচ এই মেয়ে এভাবে ওঠোনের মধ্যে এসে বাচ্চাদের মত করে বাচ্চাদের সাথে লাফালাফি করছে। যেখানে বাড়ির পাশে রাস্তা রয়েছে। মানুষজন যাচ্ছে আর চোখ তুলে তাকাচ্ছে। কতোটা দৃষ্টি কটু ছিঃ!

এদিকে টুসি চোখ বাঁধা অবস্থায় দৌড়ে দৌড়ে সঙ্গীদের ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছে না।এক পর্যায়ে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঝাপটে ধরে বললো,
–ধরেছি ধরেছি,বলতে বলতে হঠাৎ সামনে থাকা ব্যক্তিকে অদ্ভুত ঠেকলো! তুলনা মূলক মোটা, লম্বা অনুভব হলো। তাই ছেড়ে দিয়ে,ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল উত্তোলন করে স্পর্শ করে বোঝার চেষ্টা চালালো।যখন সন্দেহ জনক মনে হলো এক টানে চোখের বাঁধন খুলে ফেলল। দুই হাতে চোখ কচলে যখন সামনে তাকালো তখন শুকনো ঢুক গিলে খানিকটা পিছিয়ে গেল টুসি।

সোহান চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব নিয়ে বললো,
— কি হচ্ছে এসব?বয়স কি দিন দিন বাড়ছে না কমছে? এভাবে বাচ্চাদের মত লাফালাফি কি তোমার সোভা পায়?আজ থেকে মনে রাখবে তুমি আর মিস ন‌ও, মিসেস। মিসেস তাসনুভা ইসলাম টুসি।যাও ঘরে যাও,,

টুসি এক পা ও নড়লো না।যা দেখে সোহান গর্জে উঠে বললো,
— কি বললাম শুনতে পাওনি?

এবার টুসি চোখ মুখ কুঁচকে আ্য আ্য করে কান্না শুরু করে! তারপর ফুফি বলে দৌড়ে যায় ঘরের দিকে..

আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সোহান। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
— নাহ ওর সাথে রাগারাগী করলে চলবে না।যথা সম্ভব কোমল ব্যাবহার দিয়ে বোঝাতে হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। কাজেই নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও।[১]

ভাবতে ভাবতে সোহান বাথরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
.
.
আজকে সকালে,
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রোজিনা বলেছেন,
— মা’রে বিবাহ (আরবি: نِكَاح‎, প্রতিবর্ণী. নিকাহ‎) হল বিবাহযোগ্য দুইজন নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রনয়নের বৈধ আইনি চুক্তি ও তার স্বীকারোক্তি।[২]

এখন তুই তার স্ত্রী, তোর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে,
— আর এই কর্তব্যের মূল হলো স্বামীর প্রতি তোর দায়িত্ব। তোর উপর তোর স্বামীর অধিকার অনেক বড়, যা আমাদের (পিতা-মাতার) অধিকারের চেয়েও বেশি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অধিকারের (হকের) পরেই তার অধিকারের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। আর এই অধিকারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এসেছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
• “পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।[৩]
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “নারীদের যে কেউ মারা যাবে এমতাবস্থায় যে তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।[৪]

মেয়েকে যতটা সম্ভব বুঝানোর বুঝিয়েছেন রোজিনা।টুসি’র মুখ দেখে বোঝার জো নেই সে কতটুকু কথা আমলে নিয়েছে। তবে মাকে কথা দিয়েছে সে কখনো বেয়াদবি করবে না তার স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে।
.
.
খাবার টেবিলে রোজিনা মেয়েকে ইশারা করে বোঝালেন সোহান এর প্লেটে আরো পিঠা তুলে দেওয়ার জন্য। তখন টুসি,ডাল পুরি পিঠার ঝুড়িটি নিয়ে কাছে গিয়ে পিঠা দিতে গেলে সোহান পাশের চেয়ারে ইঙ্গিত করে বললো,
— বসো এখানে।

টুসি বসতেই, সোহান নিজ হাতে পিঠা নিয়ে টুসি’র মুখের সামনে ধরল।যা দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল টুসি।
সোহান তার বাম হাত দিয়ে টুসি’র চোখের কোণায় লেগে থাকা ময়লা মুছে দেয়। তারপর আবার পিঠার দিকে ইশারা করে বললো,
— হা করো?

টুসি আর দ্বিধা না করে, সোহানের হাতে খেয়ে নিল পিঠা।যা দেখে রোজিনা এবং রোকেয়া আনন্দের হাসি হাসেন।
টুসি’র দাদি মশকরা করে বলেন,
— আইজ্জা তিনি নাই বলে খাওয়াইয়া দেওনের কেউ নাই।হের লাইগা অন্যের ভালোবাসা ব‌ইয়া ব‌ইয়া দেহন লাগে।

তখন সোহান হাসি দিয়ে বললো,
— দাদা পরলোকগমন করেছেন তো কি হয়েছে? তুমি চাইলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি আছি আমি। এবার বলো কবুল?

বৃদ্ধা আফসোসের স্বরে বললো,
— এমনে এমনে তো কমু না,টুসি’র শাড়ি গয়না গুলান ফইরা তয় কমু! তোমার ফত্তম ব‌উ রাজি কিনা জিগাউ?

টুসি বৃদ্ধার কথা শুনে রেগে মেগে অস্থির হয়ে বললো,
— বুড়ি তোমার শখ কতো? আমার শাড়ি গয়না জীবনেও কাউকে দিমু না আমি।এ আমি বলে রাখলাম।

তারপর গটগট পায়ে প্রস্থান করে এখান থেকে।যা দেখে সোহান হাত তুলে বৃদ্ধা’কে ইঙ্গিত করে হাত মিলিয়ে হাইফাই করার জন্য। চট করে হাত মিলিয়ে,খলবলিয়ে হাসি দেয় বৃদ্ধা, এতে করে তার বাম পাশের ফাঁকা মারি গুলো সহজেই নজরে পরে।যা দেখে আময়িক হাসে সোহান।
.
.
বিকাল বেলা যখন পরিবেশটা শুনশান নীরবতা পালন করছে। সূর্য মামা তার গতিতে পিছিয়ে চলছে পশ্চিমা সীমান্তে তখন সোহান তার মায়ের আহাল্লাদি বৌমা’মা কে আবদারের সুরে বললো,
— তোমার গ্রাম’টা ঘুরিয়ে দেখাবে আমায়?

টুসি রশি হাতে নিয়ে “ধরির লাফ” খেলতে যাচ্ছিল।তাই সোহানের কথায় খানিকটা বিরক্ত বোধ করলো। পরক্ষনেই মায়ের কথা গুলো মনে পরতেই বললো,
— চলুন..

বাড়ির পশ্চিম দিকে হাঁটা ধরলো। যেখানে নদী বয়ে গেছে। নদীর পাশে সোনালী ধানের জমি,মা শা আল্লাহ এবার খুব ধান হয়েছে জমিতে।যা দেখে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে শুকরিয়া আদায় করলো সোহান।
টুসি বড় বড় পা ফেলে আনমনে হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে ধানের শীষ গুলো নরম মখমলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে চলেছে। সোহান মুগ্ধ নয়নে দেখছে তার সহধর্মিণী কে।কালো কামিজের সাথে লাল ওরনা, সেলোয়ার পরেছে টুসি।এতে করে পুতুলের মতো মিষ্টি লাগছে তাকে।
আসার পথে সোহান ওরনা দিয়ে টুসি’র সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়েছে। তাই তার মাথায় ঘোমটা বৃদ্ধমান। ঠিক লাল টুকটুকে বউ লাগছে টুসি’কে। লোকমুখে শোনা যায়, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমনটা সোহানের মনে হচ্ছে।তার মা বিয়ের পূর্বে টুসি’র ছবি দেখিয়েছিল, তখন এক পলক দেখলেও সোহানের মনে হচ্ছে এখন বেশী সুন্দরী লাগছে তার ব‌উ’কে। “মা শা আল্লাহ” বলতে ভুললো না সোহান।
.
.
দূরের যাত্রা বলে বিয়ের পর দু’দিন শ্বশুর বাড়ি কাটালো সোহান। এবার বাড়ি ফেরার পালা। নাছোড়বান্দা টুসি সেকি কান্না,সে কিছুতেই বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবে না।বাবা’কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আমাকে খাওয়ানোর সামর্থ কি নেই তোমার আব্বু? তাহলে কেন এভাবে তারিয়ে দিতে চাইছো? আমি আমার এই মায়াময় গ্রাম ছেড়ে কিভাবে থাকবো আব্বু? কেন এই নিষ্ঠুরতা করছো আমার সাথে? খুব তো মাথায় করে রাখতে, তবে এখন কেন অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইছো?

মেয়ের বাঁধ ভাঙা চিৎকারে নিজেকে আর শক্ত করে রাখতে পারলো না স্বপন তালুকদার। অবাধ্য হয়ে ঝরে পরলো চোখের নোনা জল। সোহানের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে বললেন,
— বাবা আমার একমাত্র মেয়েটা এখন তোমার দায়িত্ব, সামলে রেখো বাবা..

সোহান টুসি’র হাত শক্ত করে মুঠো বন্দি করে বললো,
— আমাদের জন্য দো’আ করবেন বাবা। আমি যেন ওর ছায়া সঙ্গিনী হতে পারি।একে অপরের পরিপূরক হতে পারি।
— আমার দো’আ সব সময় থাকবে তোমাদের জন্য।

অদূরে দাঁড়িয়ে রোজিনা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে, এই প্রথম মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবেই বুকটা শূন্যতায় হাহাকার করছে তার। বৃদ্ধা দাদিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো টুসি, বৃদ্ধা ও চোখের পানি রোধ করতে পারছেন না। দুই ভাইয়ের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে, ছেলে বলে হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না। কেননা ছেলেদের যে মেয়েলি কান্না সোভা পায় না।
সবশেষে নিষ্ঠুর নিয়মের কাছে নত হয়ে বাড়ি ছাড়তেই হলো টুসি’র। কিছুদূর এগিয়ে ব্রিজের কাছে এসে রেলিং ধরে চিৎকার করে উঠল সে।তখন সোহানের ভাই আরমান মস্করা করে বললো,
— ভাবি এখানে কি আপনার প্রেমিক পুরুষের সাথে দেখা হতো নাকি?

আরমানের এমন কথায় চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব করে তাকায় সোহান।যার ফলে ভয়ে চুপসে যায় আরমান। দুই ভাইয়ের নিরবতার মাঝে টুসি বলে উঠল,
— এখানে বিকাল বেলা এসে সবাই মিলে দুষ্টুমি করতাম। আমি কিভাবে থাকবো শহরের চার দেওয়ালের ঘরে?

গ্রামের ছেলে মেয়েরা ও কাঁদছে টুসি’র জন্য। তাদের খেলার সঙ্গী যে চলে যাচ্ছে।
.
.
ট্রেনে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে,টুসি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সোহান গলা জেরে বললো,
— কার্টুন দেখবে? খুব সুন্দর কিন্তু তোমার মন ভালো হয়ে যাবে নিমিষেই।

টুসি’র আগের মতই র‌ইলো। তখন কর্ণধারে পৌঁছালো,
“শুনো শুনো কানিজ ফাতেমার কথা, ভালো মেয়ে কানিজ ফাতেমার কথা”…..
___________
রেফারেন্স:-
[১]সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩৩৩১
[২] হাদিস,দ্যা বুক অফ মেরিজ।
[৩] সূরা আন-নিসা: ৩৪
[৪] ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন
_____________

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে