ভুলোনা আমায় পর্ব-০১

0
2607

#ভুলোনা আমায়
#সূচনা পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সোহান তার সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী টুসি’র কাছে যেতেই,হুরমুর করে দাঁড়িয়ে পরে টুসি!
ঘটনার আকস্মিকতায় বরকে যায় সোহান। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— বসো তোমার সাথে পরিচিত হই, তুমি যখন অনেক ছোট তখন দেখেছিলাম তোমাকে। তাছাড়া দেখা সাক্ষাৎ হয়নি!

টুসি খাটের উপর দাঁড়িয়ে থেকেই চৌওড়া গলায় বললো,
— আপনার সাথে পরিচয় হ‌ওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার। একটা মেয়ের ঘরে ঢুকতে লজ্জা করলো না আপনার? এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে!

নিজের বিয়ে করা স্ত্রীর মুখে এরকম বুলি শুনে খানিকটা হতবাক হয়ে তাকায় সোহান। তারপর হাসি দিয়ে টুসি’র হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়! কিন্তু নাছড়বান্দা টুসি চিৎকার করে উঠল! সাথে সমান তালে হাত পা ছুড়তে লাগল।এর ফলে সোহান’এর গায়ে আঘাত লাগছে কিছুটা। এদিকে টু’সির থামা থামির নাম নেই।সমান তালে তার কাজ করে যাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, চরিত্রহীন,লম্পট লোক!ছারুন আমাকে আমি বাহিরে যাবো।

সোহান ছেড়ে দেয় টুসি কে।
নিজেকে মুক্ত পেয়ে সোহান কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় টুসি!
রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার চাদর খামচে ধরে সোহান। আজকে তার এই অপমানের জন্য দায়ী তার আম্মা রোকেয়া বেগম। সে কথা স্মরণ করতেই মাথার চুল টেনে ধরে সোহান।

এদিকে ষোল বছরের কিশোরী মেয়ে টুসি এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যায় তার দাদির কাছে।রাত গভীর হয়েছে সারাদিন বিয়ের ঝামেলায় একটুখানি বিশ্রামের জন্য যার যার শয়নকক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সবাই।
দু’চালা নতুন ঘর’টাতে সোহান আর টুসি’র বাসর ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সেখান থেকেই দৌড়ে বড় ঘরে আসে টুসি। দরজায় সমান তালে কড়াঘাত করে চলেছে টুসি।
টুসির দাদি বৃদ্ধা মহিলা এতো বড় রাত শান্তি মতো ঘুমাতে পারেন না,বয়স হয়েছে কিনা।তাই একটু ঘুমান তো একটু জেগে থাকেন। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুনে কান খাড়া করে ওপাশের ব্যক্তির কন্ঠস্বর শুনতে। তখন শুনতে পান তার আদরের নাতনি বলছে,
— দাদি গো দরজা খুলো দাদি!আমারে তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো দাদি।

নাতনির আহাজারি শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল বৃদ্ধা! যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে দরজা খুলল বৃদ্ধা। দাদিকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে টুসি।
নিঃশব্দ এই রাতের অন্ধকারে এরকম চিৎকারে যে কারো ঘুম উড়ে যেতে যথেষ্ঠ। এরকম টাই হলো। বৃদ্ধা নাতনি কে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলেন, ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা হাজির হয়ে গেল। রোকেয়া বেগম হাই তুলতে তুলতে যখন ঠিক করে দেখতে পেলেন টুসি চিৎকার করে কাঁদছে তখন তার দুশ্চিন্তার আর অন্ত র‌ইলো না!বুঝে গেছেন তার ছেলেকে ঘিরেই ঘটনা। কি করেছে তার ছেলে?টুসি’কে মেরেছে! নাকি জোর,জবরদস্তি করেছে? কিন্তু তার ছেলে তো এই ধরনের না। তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার ফলে টুসি চিৎকার করে কাঁদছে?

টুসি’র আম্মা রোজিনা ইসলাম মেয়ে কে কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললো,
— কি হয়েছে মা আমার? এভাবে কাদছিস কেন? আম্মাকে বল কি হয়েছে?

টুসি হেঁচকি দিতে দিতে বললো,
— আম্মা ঐ লোকটা.. এইটুকু বলে আবার কাঁদতে শুরু করলো টুসি।

রোজিনা মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বললো,
— স্পষ্ট করে না বললে আমরা কিভাবে বুঝবো বল তো? আমাদের সবটা ক্লিয়ার করে বলবি তো?
— আম্মা ঐ লোকটা আমাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে আ্য আ্য আ্য,,,

এইটুকু বলে আবারও কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে টুসি। তবে বাড়ির সবাই যা বোঝার বুঝে গেছে। কেন তাদের আদরের দুলালি নাকের জল চোখের জল একাকার করে চলেছে।স্বপন তালুকদার বজ্র কন্ঠে বললেন,
— মেয়েকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠালে না কেন?যেমন মা তেমনি হয়েছে মেয়ে!

এই বলে গটগট পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে রওনা দিলেন তিনি।টুসি’র দুই ভাই তারা ও বললো,
— মেয়েকে আরো বেশি করে বিয়ে দাও! এখনো ওলগা পাতা পচে নাই আর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছ!

তারপর তারাও বাপ কে ফলো করে নিজেদের ঘরে চলে গেল। রোজিনা চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। স্বামী আর ছেলেদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন তিনি জোর করে একাই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
রোজিনা শুধু সুনাম করে বলেছিলেন, তোমার মেয়ে রোকেয়া আপার কাছে আদরে থাকবে। তুমি এই বিয়েতে অমত করো না। এইটুকু কথাতেই সব দোষ তার হয়ে যাবে কে জানতো?

রোকেয়া বেগম এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবটা শুনলেন। তারপর মন খারাপ করে ছেলের কাছে যেতে হাঁটা ধরলেন।
সোহান আগের ন্যায় বসে আছে শক্ত মুখ করে। তখন রোকেয়া বেগম এর উপস্থিতি টের পেয়ে বললো,
— আম্মা এবার নিশ্চয়ই খুশি হয়েছো? ছেলেকে বড় সড়ো অপমানের মুখোমুখি করতে পেরে নিশ্চ‌ই খুশি হয়েছো।

রোকেয়া বেগম দ্রুত পায়ে ছেলের কাছে এসে বললো,
— ছোট মেয়ে তো তাই একটু এমন করছে,দেখবি দু’দিন যেতেই ঠিক হ‌ইয়া যাইবো।
— তোমার একেকটা কথা বিষের মতো লাগছে আম্মা, তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও।

রোকেয়া বেগম আরো কিছু বলতে যাবে তখন সোহান গটগট পায়ে বেড়িয়ে চলে যায় ঘর থেকে। রোকেয়া বেগম দরজার কাছে আসতেই দেখলেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সোহান‌।
__________
একটা দীঘির পাড়ে বসে মাটির চাকা ছোড়ে ছোড়ে ফেলছে সোহান।রাগ গুলো যেন এভাবেই বিশর্জন দিচ্ছে সে। শুধু বার বার মনে পরছে আজকে আম্মার জন্য‌ই তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।অন্যদের মতো তার ও তো সুন্দর একটা জোছনা বিলাসময়ী রাত হতে পারতো? কেন হলো না, কেন হতে দিল না তার আম্মা? শুধু মেয়েটির বাবা গরীব মানুষ বলে? কি লাভ হলো বড়লোক বাপের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে? লাভের লাভ তো কিছুই হলো না উল্টো সম্মানহানি হলো।

আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগের কথা,
সোহান দের নিচ তলায় ভাড়াটিয়া আসে।এক স্কুল শিক্ষক তার পরিবার নিয়ে আসে ভাড়াটে হয়ে।আর দু’তলায় থাকে সোহান এবং তার পরিবার। অল্প কিছুদিনেই বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে রোকেয়া বেগম এর সাথে খালেদা বেগম এর। স্কুল শিক্ষক এর স্ত্রী হলো খালেদা বেগম।

খালেদা বেগম এর দুই মেয়ে এক ছেলে।বড় মেয়ে সাবা খুবই মিষ্টি একটা, দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। সোহান দের এখানে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন স্কুল শিক্ষক মনিরুল হক। জরাজীর্ণ নিচ তলায় খুব কম খরচেই থাকতে পারছেন বলে শুকরিয়ার শেষ নেই মনিরুল হকের। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কতো বা বেতন পান, এতে করে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।তাই দুই হাজার টাকায় বাড়ি ভাড়া পেয়ে সন্তুষ্ট তিনি।
এমনি করে দিন চলে যাচ্ছে তার পরিবারের। একদিন সাবা বারান্দায় বসে পাঠ্য বই পড়ছে, তো হঠাৎ এক মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসে তার
ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে।সাবা ব‌ই খানা চেয়ারে রেখে দৌড়ে যায় মেইন দরজার কাছে, চটপট দরজা খুলে বাহিরে উঁকি মেরে দেখল এক সুদর্শন যুবক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে! গায়ে তার ক্রিম রঙা পাঞ্জাবি,মুখ ভর্তি চাপা দাড়ি।
দেখতে দেখতে ছেলেটা উপরে উঠে গেল। উঁকি মেরেও আর দেখতে পেল না সাবা। তখন পেছন থেকে বাবার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল সাবা।
মনিরুল হক বললেন,
— এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুক্রবার দিন নামায পড়েছিস?
— জজ্বি আব্বু পড়েছি। তুমি কখন এসেছ?
— মাত্র‌ই এলাম।যা গিয়ে পড়তে বস, আগামীকাল না ক্লাস টেষ্ট পরীক্ষা।
— জ্বি, এক্ষুনি যাচ্ছি।

সাবা কোন রকম দৌড়ে এসে বারান্দায় বসে পরে। তারপর ভয় কাটানোর জন্য বুকে থুতু দেয়!একা একা বকবক করে বলে,
— ভাগ্যিস আব্বু দেখতে পাইনি না হয় আমার যে কি হতো আল্লাহ মালুম। কিন্তু ঐ ছেলেটা কে?এক সপ্তাহ ধরে তো দেখলাম না।বাড়ি ওয়ালা আন্টির বাসায় তো কোন ছেলে দেখিনি এতো দিন।নাহ আমাকে দেখতে হবে কে এই কিউট পোলা?

খালেদা বেগম এসে বললেন,
— এই সাবা পড়া শুনতে পাই না কেন তোর?ব‌ই ল‌ইয়া ব‌ইসা থাইকা দেখাস যে আমি পড়ে সব উদ্ধার করে দিচ্ছি?
— আম্মু তুমি কোন জনমেই আমার পড়াশোনা দেখতে পাও না।
— হুম হ‌ইছে,এহন খাইতে আয়। তারপর আবার পড়তে বসবি।
— উফফ আম্মু দুপুরে খাবার খাওয়ার পর ঘুমাতে হয়, এটা তুমি জানো না? এইটা ব‌ইয়ে লেখা আছে দেখবা?
— হ‌ইছে হ‌ইছে রাইত পোয়াইলে পরীক্ষা, তারপরেও তোর ঘুম শেষ হয় না।
.
.
প্রতিদিনের মত আজকেও মনিরুল হক সাবা কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে বলেছেন,
— ফজর নামাজ আদায় করে পড়তে বসবে।

সাবা নামায পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভোরের এই স্নিগ্ধ আবহাওয়া বেশ ভালো লাগে সাবা’র।তাই রোজ এই সময় এখানে দাঁড়িয়ে বাহিরের ছোট বড় গাছ গুলো কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। সেই সময় হঠাৎ, সেই সুন্দর সুগন্ধি
ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করে সাবা। তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে দেখল দুপুরের সেই ছেলেটি ঘরে ঢুকছে।সাবা দুপুরের মতোই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো।

আকস্মিক সামনে কেউ দাঁড়ালে সোহান মিনিট খানেকের জন্য থমকে দাঁড়ায়! তারপর আবার দৃষ্টি নত করে হাঁটা ধরে।
সাবা পিছন থেকে বলে উঠলো,
— মিষ্টার সুগন্ধি? না না মিষ্টার সুবাস? আপনার পারফিউম এর সুবাদে তো সেই মনমাতানো!

সোহান এরকম অবান্তর কথায় দাঁড়ালো ঠিকই কিন্তু পিছন ফিরে তাকালো না…
_________

দূরের মসজিদ থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারিদিকে।
সোহান তার ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। তারপর উঠে দাঁড়ায় মসজিদের উদ্দেশ্যে…
নামায পড়ে এসে দু’চালা ঘরটায় ঘুমিয়ে থাকে সোহান।এক সময় বাচ্চাদের চেঁচামেচি কানে পৌঁছাতে ঘুম ছুটে যায়। আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।সামনেই বড় ওঠোনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, আর এদের লিডার হচ্ছে টুসি ম্যাডাম!….

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে