#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১৫তম_পর্ব
লেখনীতে; নাহার সাইবা
দিবাকর বাবু ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন বারান্দার রকিং চেয়ারে, চাঁদের আলোয় তার চোখের চিকচিক করতে থাকা পানিগুলো আরো জ্বলন্ত মনে হচ্ছে।শ্রীলেখা দেবী নিঃশব্দে ভেজা দরজা ভেদ করে রুমে ঢুকলেন শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে নিজের কান্নাগুলোকে বেশ কিছু সময়ের জন্য আঁটকে নিলেন তারপর ধীর পদে এগিয়ে এলেন বারান্দায়, বাতাসে পর্দা উড়ছে।অতি নিরাপদে গিয়ে দাঁড়ালেন দিবাকর বাবুর পাশে তিনি হয়ত বুঝে গিয়েছেন তার উপস্থিতি তবুও কিছু বললেন না।বেশকিছুক্ষণ নিরবে কেটে গেলো কিছু মূহুর্ত। শ্রীলেখা দেবী দিবাকর বাবুকে কী বলবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না, এমন সময় হঠাৎ করেই অনুভূতিহীন কন্ঠে দিবাকর বাবু বলে উঠেন
~ আমায় ক্ষমা করে দিও শ্রী নিজের জীবনের এত বড় কথা এত বছর যাবৎ লুকিয়ে এসেছি তোমার থেকে। তোমার দৃষ্টিতে আমি পাপী হলেও হতে পারি তবে অনুরোধ ক্ষোভ চেপে রেখো না মনে। এই ক্ষোভ, রাগ,অভিমান সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করে মনে রেখো। ( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় শ্রীলেখা দেবী ধরা গলায় বললেন
~ এ তুমি কী বলছ দিবাকর!!তুমি ক্ষমা করার মতো কোনো কাজ করোনি আর তোমার প্রতি আমার ক্ষোভ কোনোকালেই ছিল না,আর থাকবেও না।তবে আজ তোমার আর রজনীর ভালোবাসার কথা শুনে না আমার ঈষৎ হিংসা হলেও তোমার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে আমার বহুগুণ ।( শ্রীলেখা দেবী)
শ্রীলেখা দেবীর কথায় দিবাকর বাবু কিছু বললেন না চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ অতঃপর আবারো প্রশ্ন করে বসেন
~ আকাশ বেড়িয়েছে?( দিবাকর বাবু)
~ হুম।
শ্রীলেখা দেবীর সহজ,সংক্ষিপ্ত উত্তর।আবারো সবকিছু নিশ্চুপ, দিবাকর বাবু হঠাৎ করেই আবগে উপচে পড়া কন্ঠে ভেজা গলায় বললেন
~ আমি কখনো ভাবিনি শ্রী আমাদের আকাশটা এমন হবে।ভেবেছিলাম সে আজ না হয় কাল সবটা মেনে নিবে ঠিক আমার মতো,কারণ ছোটবেলা থেকে যেই ছেলেটাকে আমার আদর্শে বড় করে এলাম সে যে এমন বিপরীতমুখী আচরণ করবে কল্পনা ও করিনি।আমার সিদ্ধান্ত আসলেই সঠিক ছিল না,দুটো জীবন হয়ত আমার কারণেই নষ্ট হয়ে গেলো।না পারলাম নিজের ভালোবাসাকে দেওয়া কথা রাখতে আর না পারলাম ভাগ্নের কাছে ভালো থাকতে।দিন শেষে আমি নিঃস্ব, আমি ব্যর্থ! ( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় শ্রীলেখা দেবী কিছু বললেন না কেবল নিরবে অশ্রুজল ফেলে গেলেন।
আকাশ বিদীর্ণ হিয়ায় বাড়ি ফিরল,কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত মেঘলা নামক মেয়েটার জন্য যে ক্ষোভ বা রাগ ছিল কিছু সময়ের মাঝেই তা গলে পানি হয়ে গেছে যেন।
এখন নিজেকে মেঘলার অপরাধী মনে হচ্ছে। আসলে মেয়েটার দোষ নেই সারাজীবন ভালোবাসা চেয়েও পাইনি সে তার থেকে ভেবেছিল হয়ত সেই প্রেমটা পাবে।তবে তাও না পেয়ে দিনদিন তার অবহেলার আগুনে দগ্ধ হয়ে যেকোনো মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়ে নিজের জীবন থেকে দেখা।
বরাবরের মতোই দরজাটা খোলা পেলো।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পেরে দেখল চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কোনো ঘরেই আলো জ্বালানো নেই।প্রথমেই ধারণা করে নিল হয়ত মেঘলা নিজের ঘরে আছে।ভাবনা মতো বেডরুমের দিকে এগোতে লাগল,মাঝপথেই পায়ের কাছে কিছু একটা বাঁধা প্রদান করল চমকে গেলো বেশ ঠান্ডা বস্তুটা।ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফ্লোরে আলো ফেলতেই হতভম্ব হয়ে গেলো।আরে এ তো মেঘলা!! সে দ্রুততার সঙ্গে মেঝেতে বসল।মেঘলার গালে হাত ছুয়ালো কেমন হিমশীতল ঠান্ডা, আকাশ আঁটকে উঠল।সে মেঘলার গালে বারকয়েক হালকা ঠাপ্পর দিল। নাম ধরে ডাকতে লাগল বেশ আস্তে
~ মেঘলা,এই মেঘলা।কী হয়েছে তোমার?উঠ তুমি দেখো আমি ফিরে এসেছি। ( আকাশ)
আকাশের কথায় মেঘলা সাড়া দিল না।আকাশের বুকের ভেতরের ভয়টা আরো বেড়ে গেলো।ভালো করে মেঘলার মুখে আলো ফেলে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা।সারা গাল, কপালে রক্তের ছড়াছড়ি। সে আরো জোরে দেখে উঠল
~ মেঘলা কথা বলছ না কেন?তোমার কী হয়েছে? এত..এত রক্ত কোথা থেকে এলো।( আকাশ)
আকাশ আর কিছু ভাবার সময় পেলো না মেঘলাকে কোলে তুলে নিল।
প্রথমেই তাকে স্থানীয় একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল আকাশ,তারা রাখেনি রেফার্ড করে দিয়েছে ন্যাশনাল হসপিটালে।বর্তমানে সেখানেই আছে আকাশ,মেঘলাকে এমার্জোন্সীতে নেওয়া হয়েছে। তার ফিজ্যিকাল কন্ডিশন সম্পর্কে এখনো কেউ কিছু বলেনি তবে ডাক্তার, নার্সদের মুখে চিন্তার ছাপ।তার দেওয়া খবরে মেঘলার মেসো,মাসি এসে পৌছেছে আগেই, তার মাসি দিশা দেবী এককোনায় বসে আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে চলছেন একাধারে তার কান্নার শব্দ যেন আকাশের বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।মাত্রই দিবাকর বাবু শ্রীলেখা দেবী সমেত হসপিটালে উপস্থিত হলেন।দিবাকর বাবুর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভীষণ রেগে আছেন বিশেষ করে আকাশের উপর যে তার আসল ক্ষোভ বা রাগ তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না।তিনি হন্তদন্ত হয়ে এলেন আকাশের সামনে তার কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন
~ তুই আবার মেয়েটার কী ক্ষতি করেছিস আকাশ?এতদিন মানসিক টর্চার করে শান্তি হয়নি এখন ওকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস!! তুই কী মানুষ নাহ তুই মানুষই না এক নরপশু।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবু ক্রোধে কাপছেন, শ্রীলেখা দেবী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন
~ আহ্ তুমি এত উত্তেজিত হও না,তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে।আকাশ এমন কিছুই করেনি ডাক্তার আসুক সব পরিষ্কার হবে।( শ্রীলেখা দেবী)
শ্রীলেখা দেবীর কথায় দিবাকর বাবু সামান্য হলেও শান্ত হলেন,আকাশের কলার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন
~ এই অসভ্য ছেলেটা আমাকে ভালো থাকতে দেবে না শ্রী।আমি নিশ্চিত ঐ নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে কিছু একটা করেছে এখন এমন একটা ভাব করছে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথার বিরোধিতা করে আকাশ বলে উঠে
~ আমি কিছুই করিনি মামা আমায় ভুলভাল অপবাদ দিতে পারো না তুমি।আর যদি আমি সত্যিকার অর্থেই মেঘলার ক্ষতি করতাম তাহলে নিশ্চয়ই তোমাদের মেঘলার অসুস্থতার কথা জানাতাম না বা তাকে হাসপাতালে আনতাম না।( আকাশ)
আকাশের কথায় দিবাকর বাবু তাচ্ছিল্য করে বললেন
~ হ্যা,নামকস্তে দায়িত্ব পালন করে তো তুমি মহান কাজ করে ফেলেছ।( দিবাকর বাবু)
আকাশ আর কিছু বলল না,চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কোনো একটা ভালো খবরের।
আকাশ আর দিবাকর বাবুকে সিনিয়র ডক্টর মাহসান চৌধুরী দেখে পাঠিয়েছেন আলাদা। আজ হাসপাতালে তিনিই ছিলেন এই সন্ধ্যায় তাই তার এমার্জেন্সি রোগীকেও তিনিই দেখেছেন।তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি খুব ভালো খবর দিবেন।দিবাকর বাবুই বলে উঠেন
~ ডাক্তার চৌধুরী চুপ করে আছেন যে আপনি?না মানে কিছু বলুন আমাদের বাড়ির বউয়ের কী অবস্থা ও ঠিক আছে তো?( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় মাহসান চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন
~ কোনোকিছুই ঠিক নেই। আপনাদের বাড়ির বউ অর্থ্যাৎ পেসেন্ট মেঘলার শরীরে এক ভয়ানক রোগ বাসা বেঁধেছে যা সবার সামনে বললে মহিলারা ভেঙে পড়ত ওখানেই তাই আপনাদের ডেকে এখানে আনলাম।( মাহসান চৌধুরী)
মাহসান চৌধুরীর কথায় দিবাকর বাবু কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল
~কী..কী হয়েছে মেঘলার?
~ ওর শরীরের বাসা বেঁধেছে খুব রেয়ার একটা ক্যান্সার যাকে আমরা বলে থাকি বোন ক্যান্সার অর্থ্যাৎ হাড়ের ক্যান্সার আর এটা ক্যান্সারের মধ্যে একটা বিরল ক্যান্সার যেটা শিশু,কিশোরদের বেশি হয়।আর আমাদের বায়োপসি রিপোর্ট বলছে ওর পায়ের হাটুর নিচে টিউমারটা ধরা পড়েছে তা তার শৈশব অথবা কৈশোর যেকোনো সময় থেকে বিস্তার লাভ করেছে।তবে অবহেলার কারণে কেউ ধরতে পারেনি রোগটা যার কারণে টিউমারটা ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। ( মাহসান চৌধুরী)
মাহসান চৌধুরী এতটুকু বলেই থামলেন।এতক্ষণ সবটা শুনে যাচ্ছিল আকাশ ক্রমেই তার মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করতে লাগল।তার মুখ চুপসে গেলো, সে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল
~ ডাক্তার, এই রোগের কী কোনো নিরাময় নেই?আমার মনে কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যান্সার কোষগুলো ধ্বংস করা সম্ভব তাই না?( আকাশ)
আকাশের কথাশ হতাশ স্বরে মাহসান চৌধুরী বলে উঠেন
~ তা যদি সম্ভব হত আমি কখনোই এতটা হতাশ হতাম না।আগেই বলেছি টিউমারটা বহুদিন আগেই শরীরে বাসা বেধেছে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছ আর তা যদি কেবল পায়ের মাঝে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে আমরা সেই অংশটুকু শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেও পারতাম। তবে আমাদের হাতে সেই সুযোগ ও নেই ক্যান্সারটি সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে এখন আমাদের এককথায় নিরুপায় চলা বলে।আসলে এত অল্প বয়সে মেয়েটার এত কঠিন রোগে ভুগছে দেখে আমারো কষ্ট লাগছে আর তুমি তো তার স্বামী তোমায় স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই।তবে সচেতন থাকলে আগেই যদি নিয়ে আসতে তাহলে হয়ত আমাদের কিছু চেষ্টা করার সুযোগ থাকত তবে বর্তমানে তাও নেই বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। ( মাহসান চৌধুরী)
মাহসান চৌধুরীর কথায় আকাশ এবং দিবাকর বাবু দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।আকাশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল দিবাকর বাবুর দিকে,দিবাকর বাবু উপলব্ধি করতে পারলেন ছেলেটার চেহারায় অনুতাপ,এক চাপা কষ্ট!!
চলবে…
#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১৬তম_পর্ব
লেখনীতে; নাহার সাইবা
~ আমি আর বেশিদিন বাঁচব না তাই না মাস্টারমশাই?
মেঘলার আবেগহীন ভাগ্যের উপর করা তাচ্ছিল্যের কথা শুনে আকাশ তার দিকে তাকালো,কিছুক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে রইল।মেঘলার আকাশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সময় থমকে গেলো,সে যেন হঠাৎ করেই ডুব আকাশ নামক মানুষটির চোখের গভীরতায়। কী আছে সেই দৃষ্টিতে? যার জন্য সে সবরকম অবহেলা,অপমান সইতে পারে।আগে কখনো এত ভালোবাসা নিয়ে তাকায়নি আজ হঠাৎ কী হলো ঠাওর করতে পারল না মেঘলা।মেঘলার চমক ভাঙলো আকাশের গম্ভীর কণ্ঠে
~ কে বলেছে তোমায় এসব বাজে কথা?সবসময় একটু বেশি ভাবা আর বোঝাটা বন্ধ কর।( আকাশ)
আকাশের কথায় ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো,সেই হাসিতে নিদারুণ কষ্টের ছাপ!!
~ মানুষ বুঝতে পারে যখন সে মৃত্যুর অতি নিকটে থাকে।আমিও বুঝতে পারছি মৃত্যু আমার দরজায় কড়া নাড়ছে যেন।যেকোনো সময় গ্রাস করে নেবে তার ছোঁয়ায়, অবসান ঘটবে একটা অপ্রয়োজনীয় প্রাণীর।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ নিশ্চুপ হয়ে গেলো আর কিছু বলার বা স্বান্তনা দেওয়ার পেলো না।
~ আচ্ছা, আমি যে কয়দিন হসপিটালে ছিলাম অনেক খরচ হয়েছিল তাই না?আবার যদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলেই অনেক টাকা, সময়ের অপচয়।।কেমোথেরাপি দেওয়ার খরচ তো আছেই।এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া একটা সমাধান দেই আমি?( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ কিছু বলল না,মেঘলাও আকাশের অনুমতি প্রত্যাশায় বসে রইল না হেঁসে বলল
~ মেরে ফেলুন আমায়।
মেঘলার তিনটি শব্দের বাক্যে আকাশ চমকে উঠল,সে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল মেঘলার দিকে।মেঘলার তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল।আকাশের বিস্ময় তখনো কাটল না মনে মনে ভাবতে লাগল
~ মেয়েটা নিজেকে এতটাই বোঝা মনে করে আর তাকে নিষ্ঠুর পাষাণ!?
মেঘলা আবারো বলে
~ দেখুন আমি শুরু থেকেই আপনার অপছন্দের, বিরক্তির পাত্রী।বহু আগে থেকেই চাইছিলেন আমার থেকে মুক্তি।ভেবেছিলাম হয়ত আসলেই আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাবে তবে আমার অসুখটা আবারো বাঁধা হয়ে দাড়ালো।জানি আপনি দয়ালু তাই আমায় দয়া দেখিয়ে শেষ কয়েকটি দিন আপনার সাথে থাকতে দিলে এমন ক্ষতি হবে না।তবে আমি চাই না বাড়তি বোঝা হতে।এভাবেই কোনো কাজে আসি না,খালি মাসি,আর মামা-মামীর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি আর আপনার সময়ের, অর্থের শত্রু হয়ে।তাছাড়াও আমার এই মরণব্যাধি ক্যান্সার শরীরে বহন করে অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে যাওয়ার মানসিক সাহস নেই।তার থেকে আমায় মেরে ফেলুন অন্তত শান্তি তো পাব কোনো রোগে নয় নিজের ভালোবাসার মানুষের হাতে মরেছিলাম।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশের ভেতরটায় এলোমেলো ঝড় শুরু হলো যেন,কেমন অস্বস্তি লাগছে তার।আসলেই ডাক্তার বলে দিয়েছে ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ কেমোথেরাপি দিয়ে আয়ু বাড়ানো যাবে হয়ত তবে মৃত্যু নিশ্চিত। এই কথাটা মাথায় আসতেই সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল।সত্যিই তাহলে কিছুদিন পর মেয়েটা থাকবে না?মেঘলার দিকে তাকাতেই দেখল তার চোখে জল কানায় কানায় ভর্তি হয়ত যেকোনো সময় ঝরে পড়তে পারে।আকাশ এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
~ মেঘলা উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা বাদ দেও।তোমায় কেউ মেরে ফেলে পাপী হবে না বিশেষ করে আমি তো নয়ই।তোমার জীবনের দাম আছে বোঝার চেষ্টা করো।আর তোমার জন্য অন্যরা কী করল কীসের ক্ষতি হচ্ছে তা ভাবার দরকার নেই।নিজের সুস্থ থাকার দিকে ফোকাস কর। ( আকাশ)
আকাশের কথায় মেঘলা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল
~ আচ্ছা আমি আর এসব ভাবব না আর এসব ভাবনা আপনাকে বলে বিরক্ত করব না।তবে আমার একটা শর্ত আছে।( মেঘলা)
~ কী শর্ত? বল মেনে চলার চেষ্টা করব।( আকাশ)
~ একজন মৃত্যপথযাত্রী হিসেবে আমি চাই আপনি আমার পাশে অন্তত যতদিন বেঁচে আছি থাকুন। আমার মৃত্যুর পর আমি আর বাঁধা সৃষ্টি করব না।তবে আমার জীবিত দেহ টার সম্মানে আমায় কষ্ট দিবেন না প্লিজ জানেন তো ভালোবাসার মানুষের অবহেলা কতটা দগ্ধ করে মানুষকে!! আর আমার আচরণে কখনো কষ্ট পেলে বা বিরক্ত হলে আমার সামনে তা প্রকাশ করবেন না।যতদিন আপনার সাথে ছিলাম ভালোবাসা দেখিনি কোনোদিন আমার জন্য। কেবল করুণা এবং বোঝা হিসেবেই গণ্য করেছেন আমায়।অন্তত আজ থেকে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমায় ভালোবাসার চেষ্টা করবেন,হয় অভিনয় তাও করবেন স্বান্তনা পাবো আমি, মৃত্যুটাও শান্তির হবে।( মেঘলা)
কথাগুলোর সাথেই মেঘলার চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল পানি,আকাশ বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে রইল ব্যথিত হৃদয়ে। এ-ও কী হতে পারে কোনো মানুষের চাওয়া-পাওয়া??
এরপর কেটে গেছে দু’মাস প্রায়।দিন যত যায় মেঘলার শরীর ততই খারাপ হতে লাগল তবে এর মাঝেও শান্তি আকাশ আগের থেকে বহুগুণে তার খেয়াল রাখে। তার কথায় ও কাজে বিরক্ত হয় না বললেই চলে।ক্যান্সার কোষের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে মেঘলার হাটু থেকে নিচ পর্যন্ত অপারেশনের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। শরীরের একটা অংশ নেই ভাবলেই মেঘলার বুকে চাপা হাহাকারের সৃষ্টি হয়।এখন সে হুইলচেয়ার আর আকাশের কাঁধে ভর করেই চলে আকাশ হয়ত বিরক্ত হয় তবে প্রকাশ করে না ঐ যে বলেছিল অভিনয় হলেও তাই করতে!!
গতকাল সন্ধ্যায় হসপিটালে ভর্তি হয়েছে কেমোথেরাপির জন্য, চুলগুলো প্রায় কাঁধের কাছে চলে এসেছে। আগে এভাবেই কুৎসিত ছিল এখন তার আকার প্রকট রূপ ধারণ করেছে। নিজের চেহারার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না।তবুও হুটহাট আকাশকে নিজের দিকে গভীর মমতায় তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় মেঘলা তবে মনের এককোণটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।
এইতো সেদিন রোশানি তার সাথে দেখা করে গেল হসপিটালে, তাকে স্বান্তনার সাথে সাথে উৎসাহ দিয়ে গেলো এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।রোশানির সাথে মেঘলার কথোপকথনের একাংশ মনে পড়ল
~ আমি সত্যিই চাইনি মেঘলা তোমার সংসার ভাংতে, আকাশের সাথে তোমার বিয়ের পর আমি সরে এসেছিলাম আকাশ কেও নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আকাশ তোমায় কষ্ট দিয়ে আমার কাছে বারবার আসার চেষ্টা করল বিশ্বাস করো ও যতবার আমার কাছে এসেছে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম যাতে করে তোমার অধিকার ক্ষুন্ন না হয়। তবে হয়ত আমি ব্যর্থ ছিলাম।( রোশানি)
রোশানি কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেঘলা স্মিত হেঁসে বলল
~রোশানি দি তোমায় কষ্ট পেতে হবে না।তুমিও নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছিলে আমার স্বার্থে যা আমার জানা আছে।তুমি তোমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছ।আসলে আমার ভাগ্যই খারাপ, আমার ভালোবাসা কোনো মানুষ চায় না।জীবনের শুরুতেই বাবা-মা কে হারানো অনাথ মেয়ে ছিলাম। চারপাশের মানুষগুলো থেকে ভালোবাসা চেয়েছিলাম তবে পাইনি।সেই আমি কী করে পাব আকাশ নামক মানুষটির ভালোবাসা যখন তার মনটাই অন্য জগতে পড়েছিল? ( মেঘলা)
মেঘলার কথায় রোশানির চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।রোশানি মেঘলার হাত নিজের মুঠোয়া বন্দী করে বলল
~ কষ্ট পেয়ো না মেঘলা,একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করো।আমার মনে হয় এখন আকাশ তোমার জন্য অন্তত কিছু হলেও অনুভব করে তা না হলে তোমার ক্যান্সারটি ধরা পড়ার পর থেকে আমার সাথে তার যোগাযোগ হয়নি আর খবর তো পেলাম অনিকের কাছ থেকে।আজ দেখা হলো তার সাথে কোনো কথা বলল না,কেবল পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।তবে চেহারা দেখে আমি যা বোঝবার বুঝে নিয়েছি। সেই চেহারায় ছিল দুশ্চিন্তা,কাউকে হারানোর ভয় এক অমলিন ক্লান্তির ছাপ।প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সামিল হয়ে যুদ্ধ করতে করতে যেন সেও বিধ্বস্ত। আসলে ভালোবাসা না সবসময় মুখে বলে কয়ে হয় না মেঘলা,বুঝে নিতে হয়।তার তোমার প্রতি ভালোবাসা আছে আর এই ভালোবাসাকে অবলম্বন করেই মনোবল বাড়াও মেঘলা। তোমায় বাঁচতে বাঁচার মতো করে আগেই ভেঙে পড়া চলবে না বুঝলে?( রোশানি)
মেঘলা নিজের ঠোঁট কামড়ে বলল
~ হুম,বুঝেছি দি।
আসলেই সেই দিনের কথাগুলো মেঘলার মনের শক্তির সঞ্চয় করেছিল।যদি সত্যিই আকাশ তাকে ভালোবেসে থাকে,তাহলে সেই ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করার জন্য হলেও সে বাঁচবে।
রাত হয়ে এসেছে। একেকদিন একেক বাড়ি থেকে খাবার পাঠায় হাসপাতালে। কখনো আকাশের মামী দুজনের খাবার রান্না করে পাঠায় আবার কখনো মেঘলার মাসি।আকাশই নিয়ে আসে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার।মেঘলা এই সময়টা একাই বিছানায় পড়ে থাকে,একজন নার্স এসে তাকে দেখে গেছে আর কিছু ঔষধ গুলে খাইয়ে গেলো খাওয়ার আগে খেতে হয়।সে এখন চোখ বুজে বেডে মরার মতো পড়ে আছে।শরীরে কোনো শক্তি নেই ক্ষীণ, পাতলা, ফিনফিনে শরীরটা দেখলে যেকোনো সুস্থ মানুষেরই দুঃখ লাগে আফসোস হয় অনেকেই তাকে স্বান্তনার বাণী শোনায়,সে কেবল শুনে।আসল শক্তি তো পায় সে আকাশের ফেরা ক্লান্ত মুখটা দেখে।সব দুঃখ-কষ্ট যেন এক নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়।
বেডের সাথে লেপ্টে শুয়ে ছিল,আজ বোধহয় জ্বর আসছে আবার শরীরে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে,কাঁপুনি উঠে গেছে শরীরে।এমন সময় ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেলো কেউ এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো আকাশের ফেরার কথা নয় তাহলে কে??সেই স্পষ্ট অবয়বটা দ্রুতই তার দিকে অগ্রসর হলো,তার মাথার সামনে দাড়িয়ে পড়ল।সে কাপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল
~ক..কে আপনি?
কোনো উত্তর দিল না,মেঘলা একটু ভালোভাবে তাকানোর চেষ্টা করল।বুঝতে পারল বেশ বয়স্ক একজন শার্ট -প্যান্ট পরিহিত।সে আর ঝুঁকে লোকটার মুখটা দেখতে গেলো না,আবারো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।লোকটা এবার তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল বিনা অনুমতিতে,সে বেশ আরাম অনুভব করল।মনে হতে লাগল লোকটা তার খুব কাছের কেউ হবে।তবে তাকে পুনরায় প্রশ্ন করার আগে কিছুক্ষণ অনুভব করে নিল সময়টা তারপর আবারো জিজ্ঞেস করল
~ কে আপনি বললেন না তো!! তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার খুব কাছের।কিন্তু কেন বলুন তো?আপনি কী আমায় চিনেন বা আপনাকে আমি চিনি?আপনার নাম কী?( মেঘলা)
মেঘলা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রশ্নগুলো করল।লোকটি এবার মুখ খুললেন, নতুস্বরে বললেন
~আমার নাম তথাগত মজুমদার। তুমি আমায় হত চিন না,তবে আমি তোমায় চিনি।
~ক..কোন তথাগত মজুমদার? এমন কাউকে তো আমি চিনি না..
~ বললাম তো চিনবে না,তবে পরিচয় দিলে খুব ভালো করে চিনবে।আমি সেই তথাগত যে তোমার কাছে এতদিন মৃত ছিল।মৃত রজনী মজুমদারের স্বামী এবং তোমার বায়োলজিক্যাল ফাদার তথাগত মজুমদার!!
কথাটা কানে আঘাত হানতেই মেঘলা ফট করে চোখ খুলে ফেলল তার দৃষ্টি একদম শীতল আর স্থির হয়ে পড়ল…
চলবে..