#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১১তম_পর্ব
লেখনীতে ; নাহার _সাইবা
রাত সাড়ে এগারোটার উপর বাজছে এখনো আকাশের আগমনের নাম গন্ধ নেই।মেঘলা সমানে পায়চারি করে যাচ্ছি বেশ কয়েকবার আকাশের নাম্বারে ফোন করেছিল বারবারই বন্ধ বলছে।তার বুকে অজানা ভয় হামাগুড়ি দিচ্ছে লোকটার কিছু হলো না তো আবার?? একবার ভেবেছিল মামা-মামীকে ফোন দিবে তবে এখন তাদের এত রাতে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না ভেবে আর দিল না।
বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর যাচ্ছে তার।সময় পেড়িয়ে গেলেও অজানা ভয় মনের থেকে দূর হচ্ছে না বরং সময় যত গড়াচ্ছে তার ভয় ততই বেড়ে যাচ্ছে। আকাশের কোনো কলিগের সাথেও মেঘলার জানাশোনা নেই তাহলে না হয় খোঁজখবর নিতে পারত।নাইট ডিউটি থাকলেও তো এগারোটার আগেই ফিরে আজ তো তাও ছিল না তবুও এত দেরি কীসের?কোনোকিছু মাথা মগজে ঢুকছে না।একসময় ভয় থেকে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল শরীরের। ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে পাশার বাসার ভাবির বাড়িতে নক করবে সেই সাহস টুকু পেলো না।হঠাৎ করে দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের শব্দ, মেঘলার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল।সে হাতের ফোনটা বুকে চেপে এগিয়ে গেলো।কয়েকবার চেঁচালো দরজার ভেতর থেকেই
~ কে?কে দরজার বাহিরে?মাস্টারমশাই আপনি?( মেঘলা)
মেঘলার প্রশ্নের বিপরীতে জবাব এলো না,বরং গোঙানির শব্দ শুনা যাচ্ছে। মেঘলার ভয়গুলো যেন জমাট বেঁধে শক্ত পিন্ডের ন্যায় বুকে আঘাত হানছে।তবুও সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলো।আবারো বলে উঠল
~ মাস্টারমশাই আপনি যদি হয়ে থাকেন দয়া করে সাড়া দিন।আমার খুব ভয় করছে।( মেঘলা)
এবারো কোনো সদুত্তর এলো না,কেবল গোঙানির মাঝ থেকে মেঘলা নিজের নামটা শুনতে পেলো। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেলো।দরজার সিটকিনি টা নামিয়ে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ধীরে ধীরে দরজাটা খুলতেই কেউ একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল।মেঘলা ভয়ে দূরে সরে গেলো বুকে হাত দিয়ে তবে ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলো এ তো আকাশ!!
এযেন সে অন্য এক আকাশকে দেখতে পাচ্ছে যার নিজের মাঝে কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই।কী বাজে একটা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে তার নাক কুঁচকে গেলো মেঘলার।আকাশের চোখের রং লাল,চুলগুলো এলোমেলো। নিজের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে এলো মেঘলার দিকে,ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।মেঘলা যতটা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল
~মা..মাস্টার.মশাই, আপনি এত দেরি করে বাড়ি ফিরলেন!আর আপনাকে এমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে কেন?আপনার কী কিছু হয়েছে? ( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ যেন হঠাৎ করেই মেজাজী হয়ে গেলো সে মেঘলার সন্নিকটে আসতে আসতে বলে উঠে
~ কেন রে তোকে এখন কৈফিয়ত দিতে হবে?বাড়ির মালকিন তুই নাকি আমি?আমার বাড়ি,আমার ঘর যখন মন চায় আমি আসব তোর কী তাতে?আমার জীবনে এসে তো জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছিস।আমার জিজ্ঞেস করিস অস্বাভাবিক লাগছে কেন??আরে তোর মতো কাল নাগীন কারো জীবনে থাকলে সে কী সুস্থ থাকতে পারে নাকি?( আকাশ)
আকাশের হুংকারে মেঘলা কেঁপে উঠল।আকাশ তার দিকে যতই এগোচ্ছে মেঘলা ততই পেছায়।আকাশ আগেও বহুবার দুর্বব্যাবহার করেছিল তবে আজকের এমন পাগলাটে আকাশকে মেঘলার ভয় হচ্ছে!! কেমন অচেনা লাগছে তাকে!!
তবুও মেঘলা বলল
~ আ..আমি..আবার কী করেছি??আ.আমায় কীসের রাগ দেখাচ্ছেন? আমি তো কোনো ভূল করিনি।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশের রাগের পারদ আরো বেড়ে গেলো,সে পাগলের মতো আচরণ করতে লাগল।গর্জে বলে উঠল
~ তুই কী করেছিস জানিস না?তুইই তো আসল সমস্যাটা তৈরি করেছিস।তুই যদি আমার জীবনে না আসতি তাহলে রোশানি আমায় ছাড়তে পারত না আর আমার সামনে দিয়েই অন্য ছেলের হাত ধরতে পারত না।শুধুমাত্র তোর মতো ক্লাসলেস মেয়েকে বিয়ে করে আমি সব হারিয়েছি।ভালোবাসা, সম্মান,মর্যাদা,পরিবার সব!!
( আকাশ)
আকাশ এবার মেঘলার চুলের মুঠি ধরে গাল দুহাতে পিষ্ট করে বলল।মেঘলা ব্যাথায় ককিয়ে উঠল সেই অবস্থায় বলল
~ আপনি আমায় ভূল বুঝছেন।আমি কিছুই করিনি।আর আমার জন্য আপনি সব হারাতে যাবেন কেন?আমি তো আপনাকে আমায় বিয়ে করতে বাধ্য করিনি নিজ ইচ্ছায় করেছেন।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশের রাগ তড়িৎ গতিতে বেড়ে গেলো কয়েকগুণ।নিজের সাথে মেঘলাকে একেবারে মিশিয়ে দু’হাতে চেপে ধরল মেঘলার চোখের কোণে স্পষ্ট পানির কণা তবুও আকাশের পাষান্ড হৃদয়ে এতটুকু দয়া মায়ার উদয় ঘটল না।সে পুনরায় মেঘলার কোমল হাত পেছনে মুড়ে দিয়ে বলল
~ আবারো এক কথা বলছিস! একবার বলেছি না তোকে বিয়ে করেছি শুধুমাত্র মামা-মামীর কথায়।আর আমি কী হারিয়েছি তোর জন্য? জিজ্ঞেস করছিস?বল কী হারাইনি। শুধুমাত্র তুই আমার জীবনে আসার পর আমি যেই মামার সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলিনি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি,তার সাথে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আর আর তোর জন্যই আজকে রোশানি সম্পূর্ণ অন্যকারো হয়ে গেলো।ওকে পাওয়ার শেষ রাস্তাটুকুও রাখল না।এতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করে এখানে সাধু সাজা হচ্ছে?? ( আকাশ)
আকাশের বাঁধন ক্রমেই শক্ত হতে লাগল,মেঘলা হাস পাস করতে করতে বলল
~ দয়া করুন আমায় দয়া করুন। ছেড়ে দিন লাগছে আমার হাতে।( মেঘলা)
মেঘলার আর্তনাদ যেন আকাশের বুকের আগুন সামান্য নিভিয়ে দিলেও জ্বলতে থাকল ঠিকই। ক্রুর হাসি হেঁসে আকাশ বলল
~ তোর লাগছে খুব তাই না?আমারো লেগেছিল যখন দেখেছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষটা অন্যকারো হয়ে গেছে আমার অনুপস্থিতিতে।আমার তো লেগেছিল বুকের ভেতর যেখানে কোনো ঔষধ লাগানো যায় না তোর হাত তো দু’মিনিট এভাবেই ঠিক হয়ে যাবে আর আমার হৃদয়ের কী হবে?তার রক্তক্ষরণ বন্ধ করবে কে শুনি?( আকাশ)
আকাশের কথার সাথে সাথে তার শক্তির খরচ হতে লাগল ধীরে ধীরে বাঁধন আলগা হতে লাগল এক পর্যায়ে কোনোমতে মেঘলা নিজেকে ছাড়িয়ে দাড়ালো দূরে সরে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল একসময় শ্বাস – প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো।আকাশ তখন তার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুতভাবে নেশায় ভরা দৃষ্টি তার। মেঘলা সন্দিহান কন্ঠে বলল
~ এই বেদনায় আপনি ড্রিংক করেছেন?( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর হঠাৎ হাসতে লাগল,হাসতে হাসতেই বলে উঠে
~ হুম করেছি ড্রিংক। কেন তোর কোনো সমস্যা আছে নাকি??সমস্যা থাকলেও আমার কিছু করার নেই।যখন একের পর এক গ্লাসে মদ ঢেলে খাচ্ছিলাম না আহা!! কী শান্তি! সব দুঃখ যেন ঐ তরল গুলোই ভুলিয়ে দিচ্ছিল।কিন্তু.. কিন্তু তোর কাছে এসে আবার দুঃখগুলো চাঙা হয়ে উঠছে।আসল সমস্যার কান্ডারি হলি তুই!! বেড়িয়ে যা,বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে এক্ষুনি বলছি বেড়িয়ে যাবি তুই।( আকাশ)
এই বলে মেঘলার হাত টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে এলো,মেঘলা অনেক চেষ্টায় নিজেকে ছাড়ালো।আকাশ যেহেতু মদ্যপান করায় সম্পূর্ণ ভারসম্যহীন তাই তার সাথে শক্তিতে মোটামুটি কুলিয়ে উঠল।থুতনি বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জলটা মুছল মেঘলা, চোখে যেন তার আগুন জ্বলছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠে
~ কেন আমি বেড়িয়ে যাব এই বাড়ি থেকে?কখনো যাব না আমি।এটা আমার স্বামীর বাড়ি।বাকি দশটা স্ত্রীর মতো আমারো অধিকার আছে এখানে থাকার।আপনার যদি এতই অসুবিধা হয় মামা-মামীকে ডাকুন তারপর তাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে বলুন।ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি বেড়িয়ে যাব এখান থেকে তখন যার সাথে মন চাইবে তার সাথে থাকবেন।তবুও যেই মুহুর্ত পর্যন্ত আপনার নামের সিঁদুর আমার সিঁথিতে থাকবে ততক্ষণ আপনার সকল কিছুতে আমার অধিকার আছে এবং অধিকার ক্ষুন্ন হতে দেব না বুঝেছেন?( মেঘলা)
মেঘলা কথাগুলো বলেই হুহু করে কেঁদে উঠল। আকাশ এবার সদর দরজা আঁটকে মেঘলাকে টানতে টানতে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। ছুড়ে মারল বিছানার উপর তার গায়ের ওড়না একটানে সরিয়ে দিল।মেঘলা কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল
~ আ..আপ..নি কী.. কী করছেন এসব?ছাড়ুন আমায়।আমার ওড়না ফিরিয়ে দিন।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ কর্ণপাত করল না।সে মেঘলার খাটের সাথে চেপে ধরল এক হাতে গাল টিপে ধরে বলল
~ খুব তো বলছিলি একটু আগে অধিকার অধিকার। এবার তোর সব অধিকার দিব আমি তোকে সব।তাহলে চল আজ থেকেই শুরু হোক তোর অধিকার আদায়ের পালা।( আকাশ)
আকাশের কথায় মেঘলার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সে ভীতকন্ঠে বলে
~ না,মাস্টারমশাই আপনি এমন কিছু করবেন দয়া করে আমি রেডি না।( মেঘলা)
মেঘলার এবারো কথায়ও আকাশ আমলে নিল সে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল,মেঘ অস্ফুটস্বরেই বলে
~ ছাড়ুন আমায় প্লিজ। আপনি এখন মাতাল,মাতাল দের কোনো হুঁশ থাকে না।পরে আপনাকে আমাকে সবাইকে আফসোস করতে হবে।প্লিজ ছেড়ে দেন।( মেঘলা)
তবে মেঘলার আহবান আকাশের কান পর্যন্তই গেল মস্তিষ্কে নয় তাই সে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটালো না,একজন নরপশুর ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ল মেঘলার উপর ক্রমেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে লাগল..
চলবে…
#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১২তম_পর্ব
লেখনীতে ; নাহার_সাইবা
এরপর কেটে গেছে প্রায় এক সপ্তাহ। দিন যত এগোচ্ছে আকাশ আর মেঘলার সম্পর্কের অবনতি ঠিক ততই ঘটছে।সেরাতের ঘটনা আজো মনে পড়তেই শিউরে উঠল মেঘলা আরেকটু হলেই হয়ত পরিস্থিতি সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে যেত।আকাশ মেঘলার সাথে কথা বলে না গোটা দিনে একবারের জন্যও বাসায়ই থাকে বলতে গেলে রাতের সময়টুকু বাকি সময় বাহিরে বাহিরে কাটিয়ে দেয়। মেঘলা এতকিছুর পরও আকাশকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে যতোই হোক সে একজন মেয়ে তার উপর অনাথ,এই মুহুর্তে তার স্বামী ব্যতিত আশ্রয়ের আর কোনো স্থান নেই।তাই পঁচে, গলেও তাকে এই বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে। সে দেখতে চায় আকাশ তাকে কতদিন পর্যন্ত এভাবে প্রত্যাখান করতে পারে সেও ঠিক ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাবে আকাশের জন্য না হয়।আজ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আকাশ কিছু খেলো না, ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুম পেড়িয়ে নিজের জুতো পড়তে লাগল।টেবিলে নাস্তা দেওয়ার পরেও আকাশ না খাওয়ায় মেঘলা স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করল
~ খেয়ে যাবেন না আজ?না মানে নাস্তা তো রেডিই ছিল তবুও চলে যাচ্ছেন যে কিছু না খেলে পড়ে তো শরীর খারাপ করবে।তাই বলছিলাম আরকি।( মেঘলা)
মেঘলা কথা শুনেও যেন আকাশ শুনল না,নিজের স্যু’র ফিতা লাগিয়ে উঠে দাঁড়ালো সোজা হয়ে,অফিস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়তেই পেছনে ফিরে তাকালো মেঘলার দিকে স্বাভাবিক গলায় বলল
~ তুমি সে রাতে আমার থেকে ডিভোর্স চেয়েছিলে তাই না?( আকাশ)
আকাশের হঠাৎ এমন কথায় মেঘলা চমকে উঠল।আমতাআমতা করে বলল
~ না..মানে আ.. আমি কেন ডিভোর্স চাইব?আমি তো…( মেঘলা)
আকাশ মেঘলাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
~ থাক,তোমায় আর আমতাআমতা করতে হবে না।আমি সেই রাতে ড্রাংক অবস্থায় থাকলেও কথাগুলো ঠিকই মনে আছে।তুমি তো বলেছিলে ডিভোর্স দিয়ে আমি যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে জীবন কাটাতে পারি।তাহলে রেডি থাক কিছু একটা এসপারওসপার হবেই এই বিষয়ে পারলে তোমার মেসো-মাসিকেও জানিও তারাই তো তোমার গার্ডিয়ান।আমি আমার মামা-মামীকে ঠিক সামলে নেব।( আকাশ)
আকাশ চলে গেলো,মেঘলা ধপ করে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল তার সামনে কেবল আধার- অন্ধকারে ঘেরা।কী করব কিছুই বুঝতে পারছে না আকাশের বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠল।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা অশ্রু।
বিকেলে সারাঘর গুছিয়ে এক কাপ চা বসিয়েছিল মেঘলা চুলায়,দুপুরে রান্না করা হয়নি।আকাশ তো থাকেই না আজ তারো খাওয়ার মর্জি হয়নি তাই এই বেলা অভুক্ত। চায়ের পানি ফুটে আসছিল এমন সময় ঘরের ডোরবেল বেজে উঠায় মেঘলা অবাক হলো। এ সময়ে এ বাড়িতে কে এলো?আকাশের তো এখন ফেরার কথা নয় তার ফিরতে সন্ধ্যার পর হবে তাহলে কে এলো?
মেঘলা চুলার আচঁ কমিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো, দুর্বল হাতে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো তার মাসি দিশা দেবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ।মাসির দেখা এমন হঠাৎ পেয়ে মেঘলা ভরকে গেলো,তাহলে কী উনি মাসিকেও সবটা বলে দিয়েছে? কিন্তু যদি তাই বলত তবে তো মাসি এমন হাসিমুখে থাকত না তবে ব্যাপারটা কী?মেঘলাকে নিজের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসলেন দিশা দেবী মিষ্টি সুরে বললেন
~ কী রে মেঘু অবাক হয়ে গিয়েছিস তাই না মাসিকে হঠাৎ এভাবে দেখে?আরে তোকে সারপ্রাইজ দিতেই এভাবে চলে এলাম বাকিটা পড়ে বলছি আগে ভেতরে তো ঢুকতে দে।( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলার ঘোর কাটলো, সে সামান্য দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো, মাসিকে ভেতরে আসার জায়গা করে।দিশা দেবী ভেতরে ঢুকে কয়েকবার তাকালেন ঘরটার দিকে,ফ্ল্যাটটা ছোট তবে মেঘলার দক্ষতায় খুব সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো থাকায় এই ছোট্ট নীড়টাই প্রশান্তি দিচ্ছে। মেঘলার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললেন
~ মেঘলা,ঘর তো সুন্দরই ছিমছাম টোনাটুনির সংসারের জন্য একদম পারফেক্ট। আর তুই যা লক্ষীমন্ত মেয়ে আমার সব একদম সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিস।ঘরটা দেখেই যেন শান্তি লাগছে।( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলা মুচকি হেঁসে বলল
~ মাসিমণি,তুমি ভেতরের রুমে চল তোমায় পাখা চালিয়ে দিচ্ছি তোমাকে দেখেও টায়ার্ড মনে হচ্ছে। ( মেঘলা)
এরপর মেঘলা দিশা দেবীকে নিয়ে তার ঘরে বসালো,ফ্যানটা চালিয়ে দিল।দিশা দেবী বিছানার উপর বসে একটু জিরাতে লাগলেন।মেঘলা দিশা দেবীকে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে দিল।দিশা দেবী এক ঢোকে তা শেষ করে গ্লাসটা এগিয়ে দিল মেঘলার দিকে তারপর তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল
~ মেঘলা মা,আমায় একটা কথা বলবি?( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর এমন অনুরোধ আশ্চর্য হলো মেঘলা তার হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল তবুও যথাসম্ভব নিজেকে সামলে দিশা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল
~ জ্বি বল না কী জিজ্ঞেস করবে?( মেঘলা)
মেঘলার কথায় দিশা দেবী নিজের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল
~ তুই একটু আমার পাশে বসবি মেঘলা?( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর এমন আবদারে মেঘলা অবাক হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তার পাশে বসল।দিশা দেবী মেঘলার দুটো হাত নিজের কোলের মাঝে রেখে তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল
~ আকাশ বাবা তোকে ভালোবাসে তো?তোর প্রাপ্য সম্মান তোকে দেও তো?নাকি তুই আমার সামনে মিথ্যে অভিনয় ভালো থাকার সত্যিকার অর্থে তা নয় না তো?আমাকে মিথ্যে বলিস না মা আমি কিন্তু তোর মায়েরই মতো।( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বে এমন দশা,গলার কাছে নিশ্বাস আটকে আসছিল তবুও হাসিমুখে বলল
~ কী যে বল না মাসি তুমি!! আমি ভালো আছি খুব ভালো আছি।আকাশ লোকটা খুব ভালো আর আমায় ভালোবাসে কিনা জানি মা তবে আমার যথেষ্ট যত্ন নেয়।( মেঘলা)
মেঘলার উত্তরে দিশা দেবীর মনের সংশয় দূর হয়ে গেলো নিজে যা ভেবেছিলেন তা মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।মেঘলা উঠে দাঁড়ালো মাথা নিচু করে বলল
~ মাসিমণি,তুমি বস এখানে একটু আমি আসছি তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে।( মেঘলা)
মেঘলা একপ্রকার ছুটেই দিশা দেবীর দৃষ্টির আড়ালে চলে এলো তাতে যেন দিশা দেবী অবাক হলেন বৈকি।মেঘলা রান্নাঘরে এসেই সিংকের কলটা জোড়ে ছেড়ে দিল আর নিজেও হুহুস্বরে কাঁদতে লাগল।তার কান্নার শব্দ যাতে দিশা দেবীর কান পর্যন্ত না যায় তাই এই ব্যবস্থা।তার খুব ইচ্ছে করছিল আসল সত্যিটা দিশা দেবীকে বলতে তবে বলতে যেয়েও পারেনি আকাশ নামক মানুষটার সম্মানের কথা ভেবে কারণ এখনো সে বিশ্বাস করে হয়ত তার সুদিন ফিরবে।
প্রায় দশমিনিট পর হাসিমুখে মেঘলাকে ফিরে আসতে দেখে দিশা দেবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
~ এতক্ষণ কী করছিলি রান্নাঘরে? এত শব্দ হচ্ছিল কেন?যুদ্ধ করছিলিস নাকি সেখানে? ( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলা হাসলো, তারপর বলল
~ আরেহ না তেমন কিছু না।তোমার জন্য নুডলস করব ভেবেছি,তাই সিদ্ধ করতে দিয়ে এলাম চুলোয়। আর চায়ের পানিও বসিয়ে এসেছি। ( মেঘলা)
মেঘলার কথায় দিশা দেবী বললেন
~ আরে পাগল মেয়ে আমার জন্য তোকে এত আয়োজন করতে কে বলেছে?আমি এখনই চলে যাব,সন্ধ্যা নামার আগেই তোর মেসো অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে যাবে আমায়। এখন কিছু খাওয়ার সময় নেই,অন্যদিন সময় করে এসে খাব।তবে তোর সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর মাঝে ক্রমেই সিরিয়াসনেস বেড়ে গেলো,মেঘলা বলল
_ তা না হয় বলো কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কেন?উনি আসলে দেখা করে যেও।( মেঘলা)
~নারে সেই সময় হবে না। জামাই এই সময়ে থাকবে না বলেই এসেছি অন্য সময় তার সাথে দেখা করব।তবে আজকে আমি যা বলব মেঘলা তা শোনার জন্য হয়ত তুই প্রস্তুত নস,তবুও বলব যা বলব এখন ঠান্ডা মাথায় শুনবি উত্তেজিত হয়ে পড়বি না।কেননা কথাগুলো আমি এতদিন চেপে যেতে পারলেও আর পারছি না আমার মনে হয় এবার তোর জানা উচিত তোর জীবনের কিছু সুপ্ত সত্য। ( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলার মনের অজানা ঝড়ের সংকেত দেখা মিললেও সে হাসার চেষ্টা করল তারপর মাসিকে উদ্দেশ্য করে বলল
~ কী এমন বলবে মাসিমণি যা আমার জীবনের অজানা সত্য? এমন সত্য আদৌও আছে আমার জীবনে?( মেঘলা)
মেঘলার প্রশ্নে দিশা দেবী কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন তারপর বলতে লাগলেন
~ আমি যদি বলি এমন সত্যি আছে তোর জীবনে তা হলে তার কী হবে?তাহলে শোন এতদিন তুই যে জানিতস না তোর বাবা-মা দুজনেই বেঁচে নেই।তা ভূল জানতিস তুই।তোর মা তোকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেও তোর বাবা বেঁচে আছে এবং সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করছেন তিনি তার প্রেমিকার সাথে। ( দিশা দেবী)
দিশা দেবীর কথায় মেঘলার চোখ দুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করল,সে হা করে রইল দিশা দেবীর দিকে তার কথা যেন বোধগম্য নয় তার।সকল কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে!! দিশা দেবী মেঘলাকে তার দিকে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললেন।
চলবে…