#ভালোবেসে_ঘর_বাঁধবো (৭)
মেহের গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ক্লান্ত মনের সাথে শরীরটাও কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে তার।
আরমান মেহেরের দিকে একটু ঝুঁকতে কপালের সাথে কপাল গিয়ে স্পর্শ লাগলো। মেহের চোখ খুলে তড়াক গাছ।আরমান কে এতো কাছে আসতে দেখে সে লম্বা শ্বাস নিয়ে নড়েচড়ে বসলো। আরমান কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল,
‘নিজে ভালোটাও বুঝতে শেখো। ‘
এই বলে সে সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। গাড়ি এসে থামলো পাঁচ তলা বিশিষ্ট মঞ্জিলের সামনে। মেহের বাসায় আসতে না আসতেই শাশুড়ি অনেক কথা শুনিয়ে দিল।
-‘নিষেধ করেছিলাম এসব বস্তা পড়ে না যেতে। হয়েছে তো এবার সবার সামনে আমাদের নাক কা’টতে। কি সর্বনাশ করলাম!খাল কে’টে কু’মির ঘরে নিয়ে আসলাম। সব বান্ধবীর এক এক করে ফোন করে করে আমার মাথা খাচ্ছে।’
বাহির থেকে আসলে যে কারোর মন মেজাজ এমনিতেও গরম থাকে। তার উপর আবার কমিউনিটি সেন্টারে এলাহী কান্ড। বাসায় ফিরে মায়ের আঁকাবাঁকা কথা শুনে আরমানের মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। কপাল কুঁচকে সে মাকে বলল, ‘আহ! মা কি বলছো এসব, আমরা হয়তো দ্বীন মানি না ; তবে কারোর দ্বীন পালনে এমন বাঁধা দেওয়াটাও ঠিক না!’
মা ছেলের কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো। মা মিথ্যা চোখের জল এনে আরমানের হাত ধরে বলল, ‘ এসব কী বলছিস? সেকেলে মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে তুইও সেকেলে হয়ে যাচ্ছিস!’
আরমান মায়ের হাত সরিয়ে বেশ কটু স্বরে বলল, ‘ মায়েরা সব সন্তানদের ভালো কিছু শেখায় আর আমার মা শয়’তানের আবিষ্কারক।’ এই বলে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল
আজমল সাহেব মা ছেলের এমন কান্ডে কিছুই বললেন না। উনি বেশ ভালই জানেন আরমানের এমন বিপথে যাওয়ার একমাত্র কারণ তার মা। সবাই চলে যেতেই স্ত্রীর কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘যে আ’গুন নিজে তৈরি করেছো সেই আগুনে আজ নিজেই পুড়ে মরছো!’
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ তাঁর সব দুঃখগুলো প্রকাশ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বারান্দায় দাঁড়াতেই মেহেরের শরীরে আলাদা ভালো লাগার ছোঁয়া লাগলো। আরমান মেহেরকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে বলল, ‘ বাচ্চাদের মত দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঠান্ডা লেগে জ্বর হবে।’
মেহের ফিরে তাকালো। আরমানের হঠাৎ এমন কেয়ার দেখে হাতে চাঁদ পাওয়ার মত খুশি খুসি লাগছে। রুমে আসতেই মেহের একের পর এক হাঁচি দিচ্ছে। আরমান ঠান্ডার ওষুধ এগিয়ে দিল। মধ্যরাতে কারো গোঙ্গানির শব্দে আরমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
মিনিট দুয়েক পর আরমান বুঝতে পারে শব্দটা মেহেরের কাছ থেকে আসছে। আরমান এগিয়ে গিয়ে আলোটা জ্বালালো। গুটিশুটি মেরে মেহের কাঁপছে। আরমান বেশ অবাক হলো। কাছে গিয়ে কপাল স্পর্শ করতেই বুঝতে পারল মেয়ে সত্যি জ্বর বাঁধিয়েছে। আরমান ভেবে দেখলো ঘুমের ঘোরে যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে। তাই সে মেহেরকে কোলে করে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিল। গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিল।আরমান সরে যেতেই মেহের আরমানের হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।
যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সে। আরমান হাত ছুটাতে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। ড্রিম লাইটের নিভু নিভু আলোতে আরমান তাকিয়ে আছে মেহেরের মায়াভরা মুখপানে।গোলাপি ঠোঁটজোড়া অনবরত কাঁপছে। শরীরের টেম্পারেচার কমে পুরো শরীর জমে যাচ্ছে। আরমান ভয় পেয়ে গেল। সে তেল গরম করে মালিশ করতে লাগলো। কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে সে ভাবতে লাগলো এত রাতে ঠিক কি করা যায়! তার উপর আবার ঝড় বৃষ্টির রাত। আরমান আর কোন উপায় না পেয়ে নিজের উষ্ণতায় মেহেরকে জড়িয়ে নিলো। আরাম বোধ হতেই মেহের আরো বেশি কাছাকাছি এলো। আরমান আজ আর বাঁধা দিচ্ছে না মেয়েটাকে। অজানা ভালো লাগা স্পর্শ করছে আরমানের হৃদয় কে। মেহের আরো কাছে আসাতে মন মাতানো খুশবু আসছে আরমানের নাকে।আরমান হারিয়ে যাচ্ছে ঘুমের রাজ্যে।
মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে মেহেরের। চোখ মেলতেই ক্লান্তি এসে ভর করছে পুরো শরীরে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকু নেই। আচমকা সে বুঝতে পারলো কারোর শক্ত বাহুর বাঁধনে সে আঁটকে আছে । আরমানকে নিজের এতো কাছে দেখে বেশ অবাক হলো।লজ্জায় লজ্জাপতি গাছের মতো নুইয়ে যাচ্ছে।হাতের বাঁধন আলগা হতেই মেহের যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মেহের আস্তে করে বেড থেকে পা নিচে নামাতেই বলিষ্ঠ পুরুষালি কন্ঠে কে জিজ্ঞেস করল, ‘ এখন শরীর কেমন? মেহের অবাক হয়ে তাকালো তার শরীর তো ঠিকঠাক লাগছে, তবে কেমন জানি একটু ক্লান্ত লাগছে। নিজের শরীরে কি হলো সে কিছুই তো জানে না আর আরমান জানলো কী করে?’
গতরাতে তোমার জ্বর এসেছে। আবোল তাবোল বকেছো অনেক। সেজন্যই তো এই গরমে তোমার গায়ে কম্বল দিতে হয়েছে।
মেহের তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তো, এই গরমেও তার গায়ে কম্বল জড়ানো ছিলো।
মেহের আর কিছু না ভেবে লম্বা চুলগুলো সামলে মাথায় কাপড় টেনে নিচে চলে গেল। মেহের চলে যেতেই আরমান বুঝতে পারলো মেয়েটা একটু একটু করে তার কাছে চলে আসছে। সময় থাকতে তাকে দূরে সরানো দরকার। এই বলে সে বালিশটা নাকে মুখে দিয়ে আবারও শুয়ে পরলো।
বাসা থেকে আরমান আজ এখনো বের হয়নি। সকালের পর থেকে মেয়েটা যে আরমানের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে সেটা আরমান খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। না চাইবার সত্তেও এটা সেটা বলার অপেক্ষা ছাড়া এগিয়ে দিচ্ছে। আরমান যতটা পারছে মেয়েটাকে এড়িয়ে চলছে। দুপুরে সে অফিস চলে গেল সন্ধ্যায় বাসা ফিরে নিজের রুমে গিয়ে দেখল অগোছালো রুমটা একদম গুছিয়ে রাখা। অফিসের ফরমাল ড্রেস খুলে সে নিচে নামলো, এদিক সেদিক তাকালো। বাসাটা কেমন জানি নীরব বলে মনে মনে হচ্ছে তার কাছে।মা-বাবার সাথে ডিনার করতে বসলো। রান্নাঘরে চোখ নিবদ্ধ রাখলো। কাউকেই দেখতে পেলো না। কাউকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটার কথা এমন সাহসও হচ্ছে না। আচমকা আজমল সাহেব বলে উঠলেন, ‘ মেহের বাবার বাড়ি গেছে। তার মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় আমি দিয়ে আসলাম। আরমান মনে মনে ভাবলো, ‘ কেউ একবারও আমাকে বলবার প্রয়োজন বোধ করেনি।’ অল্প খেয়ে আরমান নিজের রুমে চলে গেল।শার্টটা খুলে বেডের উপর ফেলে দিলো। ভীষণ গরম লাগছে তাঁর। সোফায় চোখ পরতেই কেমন জানি শূন্যতা এসে তাকে গ্রাস করলো।কাভার্ড খুলে দেখলো মেয়েটা কোনো জামাকাপড় রেখে যায়নি। মনে হচ্ছে যেনো একেবারে চলে গিয়েছে মহারাণী । এটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠলো। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলো। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও তার আজ আর ঘুম হলো না। ঘুম না হওয়ার কারণ সে মনকে বলতে চায় না। নয়তো আরমান চৌধুরীর ব্যক্তিত্বে ভাটা পড়ে যাবে যে।
এদিকে মেহের অস্বস্তিতে ভুগছে। আরমানের কাছে বলে আসনি বলে। আজমল সাহেব বারবার তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, মেহেরের আসবার কথা উনি আরমানকে জানিয়ে দেবেন। এদিকে মায়ের শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভালো।
অফিস শেষে বাসায় ফিরে আজও একই অবস্থা। আজও মেয়েটা ফিরে আসেনি। আরমানের ইচ্ছে করছে আচ্ছা করে মেয়েটাকে বকতে। অনেক বাড় বেড়ে গেছে সে। এমনকি আরমান কেও সে তোয়াক্কা করছে না আজকাল। নিজের রুমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলো হঠাৎ মাথায় এলো বাবাকে বলে সে মেহেরের বাসায় যাবে।
বাবাকে গিয়ে বলল, ‘ মেহেরের মায়ের শরীর কেমন এখন? ‘
আজমল সাহেব জবাবে বললেন, ‘ ভালো।’ উনি আর কিছু না বলে পত্রিকায় আবার মুখ গুঁজে মনোযোগ দিলেন। আরমান চলে যেতেই উনি ডেকে বললেন, ‘ তুই গিয়ে মেহেরকে নিয়ে আয় আর তোর শ্বাশুড়িকেও দেখে আয়। বিয়ে হওয়ার পর তো একবারও যাসনি।’
আরমান যেন এ কথাটার অপেক্ষায় ছিল। সে আর দেরি না করে নিজেকে পরিপাটি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।আরমানের গাড়ি এসে থামলো মেহেরের বাড়ির উঠোনে। মেহেরদের তিন রুম বিশিষ্ট ছোট একটা টিন শেডের বিল্ডিং। বাড়ির চারিপাশে টিন দিয়ে ঘেরাও করা।বাড়ির উঠোনে বিশাল আম গাছটি আমে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে এক গ্রামের সব আম এই গাছেই ধরেছে। বাহির থেকে এক রুমে আলো দেখা যাচ্ছে। আরমান দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে কে বলে উঠলো। আরমান বুঝতে পারলো মেহেরের ছোট বোন হবে।কেননা আরমান মেহেরের কন্ঠ ঠিক চেনে।
-‘আরমান চৌধুরী।’
নাম বলার সাথে সাথে দরজা খুলে গেল।
আরমানকে দেখে সবাই যেন ভূত দেখার মত অবস্থা। সবার থেকে বেশ আশ্চর্য হল মেহের। তবে মুখে কিছুই প্রকাশ করলো না। আরমান এখন তাদের বাড়ির মেহমান। [১]
মেহের আরমানের জন্য রাতের খাবার রেডি করলো।মায়ের কড়া নির্দেশ উনার জামাইয়ের যেনো জামাই আদরের কমতি না হয়। মাটির উনুনে গিয়ে মেয়েটা রান্না বসিয়েছে দেখে আরমানের সুক্ষ কষ্ট হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারদিক ছেয়ে আছে। কবুতরগুলো একটু পর কুতকাত করে ডেকে ওঠছে। মেহেরকে আরমানের কাছে স্বচ্ছ পানির মতো লাগছে। যার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। যাকে যেভাবে রাখা হয় সেটাই যেনো তার অবস্থান। আসলেই মেয়েটা সব পরিবেশকে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আরমান তা পারে না। নিজের একটা ব্যর্থতা আজ তার চোখে পরলো। রান্না শেষ করে মেহের ঘরে আসতেই আরমান মেহেরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ তোমাদের টয়লেটটা কোথায়? ‘ মেহেরের পাঁচ বছরের বোনটা বোনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আরমান আবারও জিজ্ঞেস করলে জবাবে আনজুম ( ছোট বোন) বলল, ‘ দুলাভাই আমাদের টয়লেট তো বলে জঙ্গলে যেখানে বাঘ ভাল্লুকের বসবাস, যখন তখন কাপড়হীন হয়েও দৌড় দিতে হয়।ঐ যে আমাদের বাড়ির পেছনের দিকটায়।’
আরমান ঢোক গিললো।
আরমানের এমন নার্ভাসনেস দেখে দু’ বোন হাসিতে লুটিয়ে পরলো।
চলবে-
রেফারেন্স_নবীজি সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন মেহমানদের সমাদর করে।
( বুখারী-৬১৩৬)
আফরিন ইভা
এইটা কেমন হইলো…… গল্প তো শেষ হয় নাই,,,,,,