#ভালোবেসে_ঘর_বাঁধবো (৬)
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে আরমানকে দেখতে পেয়ে মেহের বেশ খুশি হলো। মেহেরের দিকে চোখ পড়তেই আরমান অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,
‘ আমার কিছু কাজ আছে। রুমে আলো জ্বালানো থাকলে কারোর কোনো সমস্যা হবে!’
আপনার কোন কিছুতেই আমার সমস্যা হবে না যদি পাশে থাকেন কাছে থাকেন।
-‘কিছু বললে?’
-‘না তো!’
কথাগুলো বেশ আস্তে বলাতে আরমান শুনতে পাইনি কিছু।
আরমান ল্যাপটপে বসে কাজ করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। মেহের আয়নার সামনে বসে বসে সাজগোজ করছে। হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে আরমান একটু আধটু মেহেরের দিকে তাকাল অবাক হলো। এটা ভেবে, যে মেয়ে সারাদিন রেশমী কালো চুল ঢেকে রাখে হিজাবের আড়ালে সেই মেয়ে চোখে মোটা কাজল পরছে। আরমান টাইপ করতে গিয়ে কিবোর্ডে আঙ্গুল থামিয়ে সামনে থাকা মোহনীয় নারীর সৌন্দর্য দেখছে। মেয়েটার চোখ দুটো এমনিতেও বেশ বড় এবং মায়াবী কাজল পড়াতে চোখ দুটো যেন বশ করতে চাইছে তার হৃদয়কে। কালো চোখের মায়া মন্ত্র মুগ্ধ করে নিয়ে যাচ্ছে অন্য ভুবনে। নজর পড়লো গোলাপি লিপিস্টিক পরিহিত পাপড়ির মত ঠোঁট দুটোতে। ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে সম্ভাষণ করবার জন্য যেন আহবান করছে। মেয়েটা এত রাতে এত চমৎকার সেজেছে কেন সেটাই যেন বারবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় মেহেরের মোবাইলে কেউ বলে উঠলো – স্ত্রী যেন ঘরেও স্বামীর জন্য সর্বোত্তম সাজসজ্জা করে থাকে স্বামীর উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা করা ইবাদত। আজীবন সঙ্গী অথবা সবসময় দেখছে বলে তার সামনে একেবারে অগোছালো থাকা ইসলামী শিক্ষা বিরোধী। [২]
হুজুরের বড় চিৎকারে আরমানের হুঁশ ফিরলো। বুঝতে পারল মেহের ওয়াজ শুনছে আর নিজেকে সজ্জিত করছে।তাও আরমানের জন্য যে তাকে কথায় কথায় অপ’মান করে।
মেহের আয়নায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল,
‘ কিন্তু যে স্ত্রী এত কষ্ট করে সাজলো কিন্তু স্বামী তাকাচ্ছে না তখন সেই স্ত্রীর কি যদি হুজুর একটু বলতেন। শুনেছি বশ করার উপায়ও আছে কিন্তু একটা সমস্যা আছে। আর তা হল সারাদিন বউয়ের আঁচল ধরে রাখে, তখন তো মানুষ তাকে বউ পাগল বলে।’
আরমান অবাক হয়ে শুনছে মনে মনে বলছে, ‘ সত্যি এমন কিছু আছে! সে নিজেকে কল্পনা করতে লাগলো মেহেরের আঁচল ধরে ধরে পেছন পেছন ঘুরছে। মেহের কে এক মুহূর্তের জন্য দেখতে না পেলে ঘরের সব জিনিসপত্র ভা’ঙছে।
না বলে চিৎকার দিতেই মেহের অবাক চোখে তাকালো।
মেহের এসে আরমানকে পানির গ্লাস এড়িয়ে দিয়ে নরম স্বরে বলল, ‘ আপনার কি শরীর খারাপ করছে, ক্লান্ত লাগছে?’
আরমান এই প্রথম নিজের জন্য কোন রমণীর দুশ্চিন্তার এমন গভীরতা দেখছে।যা সে ঠিক মাপতে পারছে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ কপালে স্পষ্ট। ঘেমে নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ মায়াবি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে।
-‘ আপনার কিছু লাগবে?’
-‘তোমাকে।’
-‘মানে!’
-‘এক কাপ কফি চিনি ছাড়া।’
-‘ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।’
মেহের চলে যেতেই আরমান ভাবছে অপ্সরা তার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর সে আর কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবেনি। কোন মেয়ের মোহে ডুবে যায়নি। নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালো।
-‘এই নিন আপনার কফি।’
আরমান কফিটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই থুথু করে নাক সিটকালো। এটা কফি নাকি ম’রণকফি। এমন স্বাদহীন কফি এই প্রথম খেলাম, এই বলে সে কাপটা সজোরে টেবিলে রাখলো। চোখের কোণ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে মেহেরের। আরমানের এমন ব্যবহারে চুপসে গেল সে। বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পেল না।
আরমান রাগ দেখিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
মেহের অতটাও খারাপ কফি বানায়নি, যার কারণে আরমান এমনটা করতে পারে।
মেহের ব্যাকডেটেড বলেই আরমান এমনটা করেছে বলে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। মনে অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল হারিয়ে গেলে শান্তির রাজ্যে।
বন্ধুর বিয়ে আজ। কমিউনিটি সেন্টারে আরমান ও মেহেরের নিমন্ত্রণ রয়েছে। মেহের যাবে না বলে ভেবে থাকলেও আরমানের কড়া নির্দেশ যেতেই হবে তাকে। মেহের রেডি হচ্ছে তবে শরীয়ত মেনে। সে বোরকায় নিজেকে আবৃত করে নিজেকে ঢেকে নিল।
আরমানের নিজের সব ঠিক আছে কিনা দেখতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মেহেরের দিকে চোখ পড়ল তাঁর। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পরখ করে দেখলো কিন্তু কিছুই বললো না তাকে।
গাড়ির দরজা খুলতেই মেহের নিজের নিকাবটা ঠিকঠাক করে বের হলো। কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকতেই মেহের বেশ অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকালো। বেগানা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা দেখে সে সত্যি আশ্চর্য হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো মানুষের মৃত্যু আছে সেটা হয়তো এই মানুষগুলোর স্মরণে নেই। আসলে একজন মানুষের মুসলিম হওয়ার জন্য শুধু জ্ঞান নয় সমর্পণ প্রয়োজন। কেননা জ্ঞান তো মু’না’ফিকদেরও রয়েছে। আমরা কতটা আল্লাহর ভয়ে নিজেদেরকে আত্মসমর্পণ করছি সেটাই মুখ্য বিষয়। মনে মনে সে ওদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করলো।
ওয়েটারকে বলে আরমান মেহেরের জন্য আলাদা রুমে খাওয়ার ব্যবস্থা করলো। কয়েকজন বয়স্ক মহিলা আরমানের বউ দেখতে চাইলো। মেহের তাদেরকে দেখে বেশ অবাক হলো। মাঝ বয়সী কয়েকজন মহিলা মুখে একগাদা মেকআপ করে লাল লিপস্টিক দিয়ে নারকেলের ছোলার মতো চুল কালার করে শাড়ি পরে রঙ্গিন সাজ সজ্জা করে পর পুরুষের সামনে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে হেসে হেসে কথা বলছে। একজন তো তাচ্ছিল্য করো বলেই ফেলল, ‘ কি ব্যাপার আরমান তোমার বউ তো দেখছি সবার চেয়ে আলাদা তাই তো তাকে আলাদা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছো! আরেকজন বললো, ‘ জ’ঙ্গি টঙ্গী না তো আবার! বোরকার আড়ালে বো*ম নিয়ে ঘুরছো না তো! এই বলে তারা উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।’
আরোকজন খোঁচা মেরে বলল, ‘ আরমান একি সর্বনাশ করলে। নিজে এমন স্মার্ট হয়ে ব্যাকডেটেড মেয়ে বিয়ে করলে? যাকে তোমার সাথে নিছক, অবহেলিত বলে মনে হচ্ছে। জীবনটা তোমার রসাতলে গেল। আমার ছেলেকে দেখো কতটা সুন্দর স্মার্ট মেয়ে বিয়ে করেছে যাকে হাজার হাজার মানুষজন দেখছে আর বাহবা দিচ্ছে।’
মেহেরের চোখের কোণে জল চিক চিক করছে, এটা ভেবে সে কষ্ট পাচ্ছে আরমান কোন প্রতিবাদ করছে না বলে। মেহের পানির গ্লাসটা খুব স্বাভাবিকভাবে টেবিলে রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আরমানও মেহেরের পেছন পেছন গেল। মেহের বারবার করে গাড়ির পেছনের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। অভিমান এসে মনের আসমানে জমা হয়েছে। আল্লাহর কাছ থেকে প্রদত্ত কাছের মানুষটিও তাকে আজ সাপোর্ট করেনি। আজ অ*শ্লীল পোশাক পড়েনি বলেই তাকে অ*পদস্ত হতে হয়েছে। গাড়ির সামনের দরজা খুলে চোখ সামনে রেখে বলল, ‘ পেছনের সিট ব্লক করা চেষ্টা করে লাভ নেই। উঠে বসো।’
মেহের আর কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে সামনেই বসে গেল। কেউ আর কারো সাথে কথা বলল না।
গাড়ি এসে থামলেো বিশাল এক সমুদ্র পারে। আরমান সমুদ্রের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মেহের গাড়ি থেকে নেমে সমুদ্রের কাছে যেতেই কষ্টগুলো তার উগ্রে বের হতে চাইছে। কান্না তার বুক চেপে ধরেছে। চোখ তার কষ্টগুলো বের করতে বাহানা খুঁজছে। এর জন্য প্রয়োজন প্রিয়জনের বিশ্বস্ত একটা হাত। যে হাত আগলে রাখবে তাকে। কাঁদলে কারণে-অকারণে মুছে দিবে চোখের জল। মেহের নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। সব ভুলে আরমানকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো এবং বলতে থাকলো,
‘ বিশ্বাস করুন তারা আমাকে নানান কটু কথা শোনালেও আমি একটুও কষ্ট পাইনি কেননা আমি জানি যে যেমন সে বলেও তেমন। মানুষের মুখের ভাষা দিয়েই বুঝা যায় চরিত্র কেমন। পবিত্র কুরআনেও পর্দার বিধান রয়েছে। পর্দা আমাদের জন্য সুন্নত নফল নয় শুধু পর্দা আমাদের মহিলাদের জন্য ফরজ ইবাদত। পর্দা কে হালকাভাবে নেওয়া মোটেও ঈমানদের পরিচয় নয়। কষ্ট পেয়েছি তখন যখন তারা বলছিলো আর আপনি শুধু শুনছিলেন। কোনো প্রতিবাদ করেননি। আসলে আপনিও চেয়েছিলেন যেনো তারা আমায় অপমান করে, আজ নিশ্চয়ই আপনার সব প্রতিশোধ শোধ হয়েছে!’
বেশ মনোযোগ সহকারে আরমান মেহেরের বলা কথাগুলো শুনল। লাস্ট কথাগুলো শুনে তার নিজের ভীষণ খারাপ লাগছে। ভেতরে ভেতরে গিল্টি ফিল হচ্ছে। বুঝতে পারলো মেহের এখনো কাঁদছে এর ফাঁকে ফাঁকে আরমানের শার্টে নাকের জল চোখের জল এক করে মুছছে। আরমান তাতে বাঁধা দিলো না। কেঁদে একটু হালকা হোক মেয়েটা। তখন সত্যি এমন করে ভাবেনি সে। আসলে মেয়েটা অনেক অপমানিত হয়েছে তারও কিছু বলাটা উচিত ছিল।’
আরমান আস্তে আস্তে মেহেরের নিকাবটা খুলে দেখলো, সূর্যের নিভু নিভু আলো এসে এই ব্যাকডেটেড মেয়েটাকে কেমন যেনো মোহনীয় করে তুলেছে। রূপকথার সেই সিন্ড্রেলার মতো লাগছে। যেনো জগতের সেরা অপরূপার ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। আলতো হাতে চোখের জল মুছে দিয়ে আরমান কান ধরে বলল, ‘ সত্যি দুঃখীত আমি, এমন একটা পরিবেশে তোমাকে নেওয়াটা আমার একদম উচিত হয়নি, আর না ছিলো তোমাকে অপমান করবার ইচ্ছে।’
চলবে-
®আফরিন ইভা)