ভালোবেসে ঘর বাঁধবো পর্ব-০২

0
4827

#ভালোবেসে_ঘর_বাঁধবো (২)

আরমান চেঁচিয়ে উঠে, ‘ কথা কি কানে যাচ্ছে না, না-কি আমি বুঝাতে পারছি না?’

আরমানের এমন ভয়ার্ত চিৎকারে মেহের কেঁপে উঠলো। ভয়ে সে জড়োসড়ো হয়ে চোখের জল ভেজা শাড়ি দিয়ে মুছবার বৃথা চেষ্টা করে চলছে। নিস্তব্ধতা নীরবতার বাঁধ ভেঙে আরমান বললো, ‘ আমি অপরিচিত কারোর সাথে আমার বেড শেয়ার করি না, দয়া করে তোমার নাটক বন্ধ করে এই রুম থেকে বের হও।’

বিবাহের তিন দিন আগে থেকেই মেহেরের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধিগ্নতায় সে কিছুই খেতে পারতো না। যার ধরুন দূর্বল শরীর নিয়ে উঠবার কোনো শক্তি পাচ্ছে না সে। তবুও বহুকষ্টে দূর্বল শরীরকে টেনে ওঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। পা পিছলে পড়ে যেতেই আরমান হাত ধরে ফেললো।

ঝাপসা চোখে একবার আরমানের দিকে তাকালো। মেহের নিজেকে আর আটকাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত আরমানের শেরওয়ানিতে বমি করে দিলো।

মেহের নতজানু হয়ে কাঁপছে। নিজের এমন কান্ডে নিজেই হতবিহ্বল।

আরমান মেহেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। মেহের ক্লান্ত হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। কাঁটা ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে।

আরমান চোখ লাল করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। আরমানের ইচ্ছে করছে এই গেঁ*য়ো মেয়েকে গলা টি*পে এখুনি পরপারে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু সে তা করবে না, কেননা সে চায় না এই মেয়ের জন্য তার লাইফের বাকি জীবন জে*লে বসে কাটাতে। সে সবকিছুই করছে তার বাবার জন্য। কেননা তার বাবা তাকে ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছে, মেহেরকে বিয়ে না করলে সব সম্পত্তি বাবা এ-ই গেঁ*য়ো মেয়ের নামে লিখে দিবে। আরমান মেহেরকে তেড়ে গিয়ে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বললো, ‘ তোর বাপের জন্মে এতো দামী শেরওয়ানি দেখেছিস! সারাজীবন তো নুন আর পান্তা খেয়েই বড় হয়েছিস বুঝবি কি করে ব্রান্ডের পোশাকের মর্ম!’

মেহের ইচ্ছে করলেই পারে আরমানের সাথে খারাপ আচরণ করতে কিন্তু সে তা করবে না। নবীজির বলা হাদিসটি খুব ভালো করেই মনে আছে। নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন, ‘ তোমাদের মধ্যে যার আচার ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে। ‘ ( সুনানে তিরমিজি)

মেহের নরম স্বরে বললো,
-‘ আপনি আমাকে যা গালি দেওয়ার দিতে পারেন কিন্তু আমার মৃ*ত বাবার নামে কোন কিছু নয়। ‘

-‘ মুখে তো দেখি খইও ফুটছে। তোমার মতো মেয়ের সাথে কথা বলে আমিও আমার ক্লাস নষ্ট করতে চাই না।’

এই বলে আরমান চলে গেল ওয়াশরুমে।

শাড়ির সাথে পা লেগে মেহের পড়ে যেতেই আরমান ধরে ফেলে। কটমট করে তাকালো মেহেরের দিকে। কর্কশ গলায় বলল,
‘অভিনয় বন্ধ করো।’

মেহের এই প্রথম কোনো পুরুষের ছোঁয়া পেলো। সেই সুপুরুষটি যদি হয় তাঁর স্বামী তাহলে তো আর কথাই নেই এমন মধুময় স্পর্শ। এ অনুভূতি খুব বেশিক্ষণ থাকেনি মেহেরের।

আরমান মেহেরের হাত ঝাঁকুনি মেরে বললো, ‘ তোমাদের মতো সস্তা গরীব মেয়েদের আমার খুব করে জানা আছে কিভাবে ফাঁ*দে ফেলে বিয়ে করে নিজের আরাম আয়েশের কথা চিন্তা করো। আমার বাবা তোমার চাচা হতে পারে কিন্তু আমার কিছুই নও তুমি। তোমাকে এই জীবনে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। কাজেই পর পরের মতো থাকো।

মেহের রুম পরিষ্কার করে শাড়ি চেঞ্জ করবার জন্য লাগেজটা খুলতেই বাবার একটা ছবি দেখতে পেলো। মুহুর্তেই মনে পরলো এটা তো সেই ছবিটা মেহের যখন প্রথম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলো তখন বাবা মেহেরকে কোলে নিয়ে ছবিটা তুলেছিলো।আজ বাবা নেই কিন্তু স্মৃতিগুলো আজও মেহেরকে মনে করিয়ে দেয় বাবা নামক মানুষটির মর্ম। নীল একটা শাড়ি বের করে ভেজা শাড়িটা পাল্টে নিলো। স্বামী- স্ত্রী বাসর রাতে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ার ব্যাপারে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদিস পাওয়া না গেলেও এ ব্যাপারে সাহাবী এবং পূর্বসূরীদের আমল রয়েছে। সূতরাং কেউ যদি তা পড়ে তাহলে তাতে আপত্তি নেই। অনেক আলেম এ দু রাকাতকে মুস্তাহাব বলেছেন। মেহের তা স্মরণ করেই অজু করতে ওয়াশরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরমান বের হতেই মেহেরকে দেখে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ জ্বা*লানোর আরো বাকি আছে? ‘

আমতা আমতা করে মেহের বলল, ‘ বিয়ের রাতে শুকরিয়া নামাজ ( নফল) পড়লে ভালো।’

-‘ যে বিয়েকে আমি মানি না তার জন্য শুকরিয়া! বরং আমি আল্লাহকে বলি এ আমার জন্য এক গ*জব নাযিল হয়েছে।’
এই বলে আরমান বিছানায় চলে গেল। মেহেরকে সোফা দেখিয়ে বলল, ‘ তোমার জায়গা আমার পাশে নয়, আমার থেকে বহুদূরে ঐ সোফায় শোবে।’

এই বলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরলো।

মেহের আরমানের রুমে অনেক খুঁজেও একটা জায়নামাজ পেলো না। অবশেষে সে নিজের লাগেজের প্রিয় সবুজ রঙের জায়নামাজটা বের করে নিলো। মেহের আগে থেকেই তার বোন হুমায়রাকে বলে রেখেছিলো তার প্রিয় জায়নামাজটা যেনো সাথে করে দিয়ে দেয়। সিজদাহ্ তে গিয়েই চোখে অশ্রু ফোয়ারা নামতে লাগলো। এমন সময় মেহেরের মনে নবী মূসা ( আঃ)- এর হৃদয়ছেঁড়া দু’আটি স্মরণে আসলো। দু’আটি ছিলো এমন – ‘ হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার উপর যে কোনো কল্যাণই অবতীর্ণ করবেন, আমি তার অত্যন্ত মুখাপেক্ষী। ‘
[ সূরা ক্বাসাস-( ২৮):২৪]

নবী মূসা ( আঃ) এর মতো করেই মেহের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট দোয়া করলেন। যা তাঁর জন্য কল্যাণকর সব কিছুর জন্য মহান রবের উপর নির্ভর করলেন। মেহের এমন পরিস্থিতি তে আছে তার জন্য কোনটা ভালো তা জানা নেই। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার উপর তাঁর এই আস্থা আছে যে কোনটা তাঁর জন্য ভালো, তা আল্লাহ ঠিকই জানেন। মনে মনে মেহের তৃপ্ত বোধ করছে দুআটি করে। মেহেরের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হৃদয়ে প্রশান্তি বইছে।

নতুন জায়গা, নতুন বিয়ে, নতুন সম্পর্কগুলো নিয়ে ভাবছে সে। মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। সোফায় বেশ কিছুক্ষণ এ পাশ ও পাশ করেও ঘুম আসছে না মেহেরের। নিস্তব্ধ রাতটুকু নির্ঘুমে কেটে গেল মেহেরের।

চলবে–
( আফরিন ইভা)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে