ভালোবাসি বলে পর্ব-১৪

0
737

#ভালোবাসি_বলে(১৪)
#Jannat_prema

বাসার দরজার সামনে আসতেই কাচুমাচু করে দাড়িয়ে আছি। আম্মু আমাকে এই অবস্থায় দেখলে নিশ্চয় কুরুক্ষেত্র বাধাবে। আর এখন যদি আমি এভাবে ভিজা গায়ে দাড়িয়ে থাকি, তাহলে ঠান্ডা লাগতে বেশিক্ষণ লাগবে না। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে কলিং বাজালাম। পাঁচ মিনিট পর আম্মু দরজা খুলে আমার দিকে তাকাতেই চিল্লিয়ে উঠলেন,

” ওহ আল্লাহ! তুই এভাবে ভিজলি কিভাবে? দেখো দেখো কিভাবে ভিজে আসছে! একটু আগে আশরাফ একটা ভিজে আসছে আর এখন তুই। চোখ মুখের কি অবস্থা করেছিস বৃষ্টিতে ভিজে৷ ”

” এখন কি ভিতরে ঢুকতে দিবেন না? ”

আমার কথায় আম্মু বকতে বকতে চলে গেলেন কিচেন রুমে। ড্রয়িং রুমে আসতে দেখলাম ভাইয়া টিভি দেখছে। আমাকে দেখে গম্ভীর সুরে বললো,

” ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আসবি। ”

ভাইয়ার এমন গম্ভীর স্বর শুনে অবাক হলাম। ভাইয়া কখোনো এভাবে আমার সাথে কথা বলেনি৷ হাজার খানেক চিন্তা নিয়ে রুমে এসে সোজা ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম আদা চা নিয়ে আম্মু আমার রুমে হাজির। আমাকে দেখে বলে উঠলো,

” গরম গরম আদা চা টা খেয়ে নে। যে ভাবে ভিজেছিস যদি জ্বর আসে না, তোর খবর আছে৷ দেখি এদিকে আয়, মাথাটা ভালো করে মুছে দেই। ”

আমি এগিয়ে আসতেই আম্মু তোয়ালে দিয়ে আমার মাথাটা মুছতে মুছতে বললো,

” আশরাফের কি হয়েছে বলতে পারবি? ছেলেটা আসছে ধরেই দেখছি কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। খেতে বললাম, বললো এখন খাবো না। ”

আমি মাথা ঘুরিয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

” কই আমি তো জানি না কি হয়েছে। আমাকে বললো ফ্রেশ হয়ে ওর রুমে যেতে। ”

আম্মু বারান্দায় তোয়ালেটা নেড়ে দিলো। এখন বৃষ্টি নেই। যেতে যেতে আম্মু বলে উঠলো,

” বুঝি না বাবা। তোদের মাথায় কি চলে সেটা তোরাই জানিস। চা টা গরম থাকতে খেয়ে ফেল। আমি একটু সিমা আপাদের বাসা থেকে আসছি।”

চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম৷ মনে পড়ে গেলো সেদিন রাতে ঠিক এখানেই আরহাম ভাইয়ের পাশে দাড়িয়ে কফি খাচ্ছিলাম৷ মানুষটা দুদিন পর কেমন ব্যাস্ত হয়ে যাবে। একদিকে নিজের জব আবার অন্যদিকে এক্সাম। সব মিলিয়ে হিমশিম খাবে না? খাওয়ার এক ফাঁকে ভাইয়ার কথা মাথায় আসতে কপালে ঈষৎ ভাজ পড়লো। আকাশে এখনো কালো মেঘেদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে৷ ঝটপট চা টা শেষ করে ভাইয়ার রুমে দিকে হাটা ধরলাম।

.

আরহাম কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। যদি কিছু একটা হয়। শেষ পর্যন্ত আইরিশকে নিজের করতে পারবে তো। এতো এতো চিন্তায় মাথার রগগুলো দপদপিয়ে উঠলো। কাজের মেয়েটাকে সেই কখোন বললো এক কাপ কফি দিয়ে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা এখনো কফি নিয়ে আসলো না। মাথায় কারো হাতের উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো৷ মাকে দেখে বিস্তর এক হাসি দিলো আরহাম৷ মায়ের হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে বললো,

” শিফাকে না বললাম কফি দেওয়ার জন্য। তুমি আনলে যে? ”

নিহা খান মুচকি হেসে ছেলের পাশে বসে বলে উঠলো,

” প্রতিদিন তো শিফা দিয়ে যায়। আজকে নাহয় আমি নিয়ে আসলাম। ”

কফির মগটা টি টেবিলের উপর রেখে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আরহাম। নিহা খান ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ তিনি খেয়াল করছেন কিছুদিন যাবত আরহাম কিছু একটা নিয়ে টেনশনে আছে। এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে বলেও করা হলো না। আজকে সুযোগ পেতেই চলে আসলেন। মায়ের হাতের মমতার ছোঁয়া পেতেই আরামে চোখ মুদে আসে আরহামের। মায়ের পর তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটা হলো আইরিশ। মেয়েটা যে কিভাবে এতো জড়িয়ে গেলো তার সাথে। একদিন যদি আইরিশকে না দেখে, তাহলে নিজেকে কেমন উম্মাদের মতো লাগে৷ আরহাম চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

” আব্বু কোথায় মা? ”

” আজকে তো এখনো আসেনি। কেনো বলতো? ”

নিহা খান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এক মায়া জড়িয়ে আছে আরহামের চেহারায়। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে উনার সারাদিনের চিন্তা সব দুর হয়ে যায়। আরহাম যে তার নাড়ি ছেড়া ধন৷ তার কলিজার টুকরো। আরহামের কথার আওয়াজে নিজের ভাবনার সুতো ছিড়ে তাকালেন৷ আরহাম বললো,

” আমি আর বেশি দেরি করতে চাই না, মা৷ পরিক্ষা শেষ হলেই আমার আর আইরিশের এনগেজমেন্টটা সেড়ে ফেলতে চাই৷ আব্বু আসলে তাকে বলবে, খুব শিঘ্রয় বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যেনো তাকে দেখতে ওদের বাসায় যায়। আমি আর দেরি করতে চাই না। আমার একটা ভালো চাকরি হলে নাহয় বিয়েটা সেড়ে ফেলা যাবে। ”

ছেলের কথা শুনে নিহা খান হোহো করে হেসে উঠলেন। ছেলেটা মায়ের সামনে কেমন বিয়ে বিয়ে করছে। আরহাম মাকে হাসতে দেখে উঠে বসলো। মাকে বলে উঠলো,

” হাসছো কেনো? ”

নিহা খান আরহামের পিঠে চাপড় মেরে বললো,

” নির্লজ্জ ছেলে। মায়ের সামনে কেউ এমন বিয়ে বিয়ে করে। দেখো আমার ছেলে কেমন বিয়ে পাগল হয়ে গেলো। ”

আরহাম মুচকি হাসলো। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো,

” তোমার ছেলের হওয়া বউটাই এমন যে, তাকে না পেলে তোমার ছেলে বেঁচে থাকার মতোও বাচবে না, মা। ”

.

দুরুদুরু বুক নিয়ে ভাইয়ার রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মনের ভিতর কেমন এক অজানা ভয় কাজ করছে৷ ভাইয়া যেমন তেমন গম্ভীর ভাবে ডাকেনি, গুরুতর ভাবে গম্ভীর হয়ে ডেকেছিলো৷ যার কারণে এতটা ভয় হচ্ছে আমার। ভাইয়া কি কিছু টের পেয়েছে? না না, আইরিশ বি পজিটিভ। ভালো কিছু ভাব। এতটা নেগেটিভলি ভাবিস না। বিরক্ততিতে ‘ চ ‘ সুচক শব্দ করে ভাইয়ার রুমের দরজার সামনে দাড়ালাম। দরজায় টোকা দিতেও কেমন ভয় লাগছে৷ এতো ভয় লাগছে কেনো আমার! তুই যেটা ভাবছিস তা নাও হতে পারে, আইরিশ। দরজায় টোকা মেরে বললাম,

” ভাইয়া আছিস? ”

” ভিতরে আয়! ”

আবারো ভাইয়ার গম্ভীর আওয়াজ শুনে বুক কেঁপে উঠল। দরজা ঠেলে ভিতরে আসতে দেখলাম ভাইয়া পড়ার টেবিলে বইয়ের ভিতর কিছু একটা করছে৷ জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,

” কিছু বলবি ভাইয়া? ”

” বস আগে। ”

ভাইয়ার কথায় বিছানায় বসলাম। কি বলবে ভাইয়া? হাত পা রীতিমত খানিকটা ঘেমে গেছে আমার। ভাইয়া এখনো বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বইয়ের ভাঁজে চোখ রেখেই ভাইয়া ঠান্ডা সুরে বলে উঠলো,

” কত দিন ধরে চলছে এসব? ”

পুরো শিউরে উঠলাম। কোনো মতে ঢোগ গিলে বললাম,

” কিকিসের কদিন চচলছে, ভাইয়া? ”

ভাইয়া আমার দিকে শক্ত চাহনিতে তাকালো। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম৷

” আরহামকে ভালোবাসিস? ”

চমকে দাড়িয়ে গেলাম৷ ঠিক যেটার ভয় পেয়েছিলাম এতক্ষণ সেটাই হলো। আমার হাত পা কাপঁতে লাগলো৷ কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে আমার। ভাইয়াকে এখন কি বলবো৷ আচমকা ভাইয়া ধমকে উঠলো,

” বলছিস না কেনো? আরহাম কে ভালোবাসিস?”

ভাইয়ার ধমকে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি৷ চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে৷ আজ পর্যন্ত একটা ধমক না দেওয়া ভাইটা কেমন ধমকে কথা বলছে৷ ভাইয়ার জন্য মনে অভিমান জমলো। ভাইয়াকে আজকে কেমন অচেনা লাগছে৷ মনে হচ্ছে এটা আমার আশরাফ ভাইয়া হতেই পারে না।

” ভালোবাসলে, ভালোবাসার কথাটা বলার সৎ সাহসও প্রয়োজন হয়, আইরিশ। ”

ডুকরে কেঁদে দিলাম৷ আমার কান্না দেখে যে ভাইটা দৌড়ে আসতো, আমাকে হাসানোর জন্য। সে এখন কেমন স্থীর হয়ে দাড়িয়ে আছে৷ আমি মাথা নিচু করেই মাথা নেড়ে বললাম,

” হুহুম। ”

” তোদের থেকে এমনটা আশা করিনি। বিশেষ করে আরহামের কাছ থেকে তো নয়। ”

আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে ভাইয়াকে ব’লে উঠলাম,

” আরহাম ভাইয়ের কোনো দোষ নেই ভাইয়া। ”

” তোকে আমি সাফাই গাইতে বলেনি৷ চলে যা এখান থেকে। ”

ভাইয়ার হুংকারে দু পা পিছিয়ে গেলাম। ভাইয়াকে ব’লে উঠলাম,

” আমার কথাটা একবার শুন ভাইয়া। ”

ভাইয়া বিরক্ত হয়ে চেচিয়ে উঠলো,

” তুই যাবি। আরহাম নিশ্চয় বলেছে দু’দিন পর থেকে এক্সাম আছে৷ তার মানে আমারো এক্সাম আছে৷ পড়তে বসবো আমি৷ এখন আর ভাইকে কি প্রয়োজন। ভাই তো এখন পর। এখন যা আমার সামনে থেকে।”

বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো। ভাইটা আমার কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পারলাম। দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম৷ ভাগ্যিস আম্মু এখন সিমা আন্টির বাসায় গেছেন। মনটা আমার আজকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে৷ ভাইয়া খুব রাগ করেছে আমার উপর। যদি আরহাম ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেয়!

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে