#ভালোবাসি_বলে(১৩)
#Jannat_prema
ভার্সিটিতে যেতেই দুরে দাড়িয়ে থাকা আরহাম ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি থমকে গেলো৷ তার মানে আজকে আরহাম ভাই অফিসে জাননি। আরহাম ভাই বন্ধুদের সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। উনার এই প্রাণ খোলা হাসিটা আমি এতো বছরে এই প্রথম দেখলাম। সবসময় মুচকি হাসি লেগে থাকতো উনার ঠোঁটে। আরহাম ভাই হাসির মাঝেই হুট করে আমার দিকে তাকালেন। আমি লজ্জায় চোখ সরিয়ে মুচকি হেসে হাটা ধরলাম ক্লাসের উদ্দেশ্যে। ক্লাসে এসে দেখলাম, শশি ফোনে কথা বলছে, আরিফা আর রাইহান ফুসুরফাসুর করছে তো আবার হাসছে। আমি গিয়ে চট করে ওদের মাঝখানে বসে পড়লাম৷ আমাকে এভাবে বসতে দুজনে ছিটকে সরে গেলো। আহা! মনে মনে অনেক শান্তি অনুভব করলাম। দুটোর মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে খুব ভালো লাগছে। রাইহান মাথায় টোকা মেরে বলে উঠলো,
” এখানে বসেছিস কেনো? জায়গার অভাব পড়েছে তোর? ”
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,
” সেটা না৷ আসলে তোদেরকে বিরক্ত করতে আমার ভালো লাগে। ”
রাইহান বিরক্ত হয়ে নিজের সিটে চলে গেলো। আরিফা আমার দিকে কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে ছিলো। তাতে আমার কি! আমার তো শান্তিইইই লাগছে।
.
ক্লাস শেষে গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। আজকেও ভাইয়াদের দেখতে পেলাম না। হুট করে পরিষ্কার আকাশটা কেমন মেঘলা হয়ে গেলো৷ চারদিকে খানিকটা বাতাসও হচ্ছে। এদিকে একটাও খালি রিকশা না পেয়ে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে আছি।
” বেশ ভালোই তো পটিয়ে ফেলেছো, আরহামকে।”
স্নেহা আপুকে দেখতেই বিরক্ত হলাম৷ মুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বললাম,
” কিছু বলছেন আপু? ”
আমি যে উনার কথাটা শুনেও না শুনার ভান করছি, সেটা মনে হয় বুঝেনি। স্নেহা আপু কিছুটা রেগে বলে উঠলেন,
” আমি কি বলেছি, সেটা তুমি ভালো করেই শুনেছো, আইরিশ। এখন কথাটার উত্তর দাও। ”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। বিরক্তির স্বরে বলে উঠলাম,
” দেখুন, আমি কাকে কিভাবে পটাবো না ফাটাবো সেটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার নয় কি! ”
” তুমি আরহামকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারোনা। ”
স্নেহা আপুর কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,
” উনি আবার কবে আপনার ছিলো? ”
আমার কথা শুনে স্নেহা আপু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
” এই জন্যই তো বলি তোমার মতো কালো মেয়ের মধ্যে আরহাম কি এমন দেখলো যে সে একদম দিওয়ানা হয়ে গেলো। নিশ্চয় তুমি কিছু করেছো। জাদু টাদু করোনি তো? করতেই পারো, আরহাম দেখতে সুন্দর, তার স্ট্যাটাসও হাই লেভেলের, আবার হ্যান্ডসাম বয় এই সব দেখে তো পাগল হবেই। আর সত্যি করে বলোতো তোমার সাথে কি আরহাম কে মানায়? আয়নায় একবার নিজের চেহারাটা ভালো করে দেখেছো? কোথায় তুমি আর কোথায় আরহাম। মানে বানরের গলায় মুক্তর মালা! হাহাহা!”
দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছি। স্নেহা আপুর কথাগুলো আমার আত্মসম্মানে লাগলো৷ আমাকে নিরব থাকতে দেখে স্নেহা আপু তৃপ্তির হাসি হাসলেন৷ উনাকে অবাক করে দিয়ে চোখের কোণে আসা পানিটুকু মুছে হেসে বলে উঠলাম,
” তা আপনি তো আমার থেকেও সুন্দর। আপনার স্ট্যাটাসও তো হাইইই লেভেলের। তাহলে আরহাম ভাই আপনাকে পছন্দ করেনি কেনো। আসলে কি বলুন তো, সবার পছন্দ তো আর এক না। আর কে বা চাইবে সেধে সেধে পঁচা জিনিস ঘরে তুলতে। আপাতত আমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি কেমন! ”
অপমানে থমথমে খেয়ে গেলো স্নেহা আপু। সেটা তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আমি মিষ্টি করে হেসে সামনের দিকে হাটা ধরলাম৷ ইতিমধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আজকে আর রিকশা ডাকলাম না। পুরো মুডটাই খারাপ করে দিলো ওই শাঁকচুন্নি। মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে বেয়াদবটাকে অপমান করে। আরো কিছুক্ষণ অপমান করতে পারলে শান্তি লাগতো। আরহাম ভাই তো আর এমনি এমনি স্নেহাকে পছন্দ করেন না। হুট করে মনটা কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। বৃষ্টির কারণে রাস্তা আপাতত ফাঁকা। তিব্র ইচ্ছে জাগলো মন খুলে একটু কান্না করার। স্নেহা আপুর কথাটা আমার কানের ভিতর যেনো বেজেই যাচ্ছে,
” এই জন্যই তো বলি তোমার মতো কালো মেয়ের মধ্যে আরহাম কি এমন দেখলো যে সে একদম দিওয়ানা হয়ে গেলো। নিশ্চয় তুমি কিছু করেছো। জাদু টাদু করোনি তো? ”
এই কথাগুলো কাটার মতো ফুটতে লাগলো পুরো শরীর জুড়ে। ভার্সিটি থেকে একটু দুরেই একটা পার্ক। সেখানে একটা বেঞ্চে বসতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। না চাইতেও মাথায় বারবার একটা কথা আসছে,
” আরহাম ভাই কেনো আমার মতো একটা কালো মেয়েকে ভালোবাসে। আমার সাথে উনাকে সত্যি মানায় না। কিন্তু আমি যে আরহাম ভাইকে সত্যি বড্ড বেশি ভালোবাসি। ”
আনমনেই বিরবির করে উঠলাম, আপনাকে অনেক ভালোবাসি আরহাম ভাই।
” আইরু! ”
মুখ থেকে হাত সরিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটার দিকে তাকালাম। আরহাম ভাই দাড়িয়ে আছেন। বৃষ্টির কারণে কপালের উপরে থাকা চুল চুইয়ে পানি পড়ছে৷ উনাকে দেখতে মনটা কেমন আহ্লাদী হয়ে আসছে৷ আরহাম ভাই হাটু মুড়ে আমার সামনে বসলেন। আমার গালে এক হাত রেখে বলে উঠলো,
” কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো?
ব্যাস উনার এই কথাগুলো শুনে আমার এতোক্ষণ আটকে রাখা কান্নাটা বেরিয়ে গেলো। আচমকা উনাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম। আমার কান্ডে আরহাম ভাই ভড়কে গেলেন। উত্তেজিত হলেন কিছুটা। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
” কি হয়েছে বল! এভাবে কাঁদছিস কেনো? তোর কান্না দেখলে আমার বুক পুড়ে আইরু! ”
উনার কথায় কান্না কিছুটা কমলেও হেঁচকি থামলো না। উনার বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমাকে ভালোবাসেন কেনো, আরহাম ভাই? ”
আমার মাথায় বুলানো আরহাম ভাইয়ের হাতটা স্থির হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে বৃষ্টির তোড়টা অনেকটা কমে গেলো। আমি মাথা তুলে আরহাম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। বৃষ্টিতে ভিজার কারণে উনার গায়ের আকাশি রঙের শার্টটা উনার শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। যার কারণে উনার প্রশস্ত বুকটা স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে। আমি উত্তরের আশায় উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আরহাম ভাই আমার কপালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে না আইরু। যে ভালোবাসাতে কারণ থাকে, সেটা ভালোবাসা না। তবে আমি তোর মায়ায় খুব বাজে ভাবে ফেসে গেছি আইরু। ”
” কিন্তু আমার মতো কালো মেয়েকে যে আপনার পাশে মানায় না, আরহাম ভাই! ”
আমার কথা আরহাম ভাই উনার বুকে আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
” তুই তো আমার শ্যামারানি৷ কে বললো তুই কালো? আমি একটু আগেই বলেছি, আমি তোর মায়ায় জড়িয়ে গেছি, তোর রুপে নয়। ”
” কিন্তু রুপ দেখেই তো ভালোবাসাটা জন্ম নেয়। ”
আরহাম ভাই কিছু বললেন না। আমার মুখটা উনার দুহাতে আজলে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিলেন। আমার বাম হাতটা উনার ডান হাতে আগলে নিয়ে হাটতে হাটতে বললেন,
” এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। এই কয়েকদিন আমি ব্যাস্ত থাকবো কিন্তু।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো?
আরহাম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ব’লে উঠলেন,
” দুই দিন পর থেকে আমার ফাইনাল এক্সাম। তোকে পেতে হলে আমাকে ভালো কিছু করতে হবে, আইরু। আমি চাই না, তোর আর আমার মাঝে কোনো তৃতীয় কিছু আসুক। তোর ভাই, বাবার সামনে নিজেকে তোর জন্য উপযুক্ত করতে হবে তো। তোকে আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে না! ”
আরহাম ভাইয়ের কথায় বুকের মাঝে অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করলাম। উনার হাতটা শক্ত করে আকড়ে ধরলাম৷ মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম৷ এমন একটা মানুষকে আমার জীবনে আনার জন্য।
চলবে!