#ভালোবাসি_বলে(১১)
#Jannat_prema
আরহাম গলার টাই ঢিলে করতে করতে বাসায় প্রবেশ করে দেখলো তার বাবা আর স্নেহার বাবা সোফায় বসে কথা বলছে৷ সেদিকে এক পলক তাকিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই মাহতাব খান বলে উঠলো,
” ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। জরুরি কথা আছে। ”
আরহাম কিছু না বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে৷ কি এমন জরুরি কথা বলবে তার বাবা? আরহাম যেতেই স্নেহা কিচেন রুম থেকে বের হয়ে গেলো। নিহা খান স্নেহার কাহিনি দেখে হালকা হাসলো। তবে আবারো মাথায় চিন্তার পোকারা কিলবিল করে উঠলো। স্বামীর কথায় একদম দ্বিমত তার। স্নেহা একবার চোখ বুলালো দোতালায়। পরপরই চোখ নামিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলো। নিহা খানের হাত থেকে চায়ের ট্রেটা নিতে নিতে সুধালো,
” তুমি বস আন্টি। আমি দিচ্ছি। ”
.
রুমে আসতে কপাল কুঁচকে গেলো আরহামের। বিছানার উপর তার,জামা কাপড় সাজিয়ে রাখা৷ মেয়েলি পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে আসতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আরহামের৷ তার বুঝতে বাকি নেই স্নেহা তার রুমে এসে এমন কারসাজি করেছে। বিছানার উপর তার জন্য স্নেহার রাখা জামা কাপড়গুলো ওয়াশরুমে নিয়ে ভালো করে পাউডার দিয়ে ভিজিয়ে রাখলো৷ পানি ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করতে ভেসে উঠলো একটি মায়াবি চেহারা। শ্যামকন্যার হাসির ঝলকে কেপে উঠে আরহামের বক্ষপিঞ্জর। ডাগর ডাগর চোখ যখন লজ্জায় চুপসে যায়, তখন আরহাম অপলক তাকিয়ে থাকে। গোলাপি ঠোঁট দুটো নেড়ে যখন কথা বলে তখন নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। হুট করেই আরহামের মনটা শান্ত হয়ে গেলো। এতোক্ষণের খিট*খিটে মেজাজটা শান্ত হয়ে গেলো। আরহাম মুচকি হাসলো৷ বিরবির করে বললো,
” আমার হৃদয়ের রানি! আমার মনের প্রশান্তি! আমার মায়াবী আইরিশ। ”
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই মাহতাব খান কথা থামিয়ে তাকালো ছেলের দিকে। আরো তিন জোড়া চোখ তার দিকে দৃষ্টি দিলো। স্নেহাকে দেখতেই বিরক্তিতে ভরে উঠলো মন৷ পুরো শরীর যেনো তীক্ততায় ভরে গেলো।
” এদিকে এসে বসো। ”
বাবার কথায় এগিয়ে এসে সোফায় বসলো সে। স্নেহা মুখ ভাড় করে বসে আছে৷ এতোক্ষণের আনন্দটা ভেস্তে গেলো তার। সে আরহামের জন্য যে জামা কাপড়গুলো রেখেছিলো, আরহাম সেটা পড়েনি। আারহাম পড়েছে ডার্ক ব্লু কালারের টিশার্ট আর কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। স্নেহা রেখেছিলো বেগুনি রঙের টিশার্ট আর সাদা প্যান্ট। স্নেহা ভাবলো, আজকে পড়েনি তো কি হয়েছে। সারা জীবন তো তার পছন্দ মতো পড়তেই হবে।
আরহাম বিরক্ত হলো। কেউ কিছু বলছে না দেখে নিজেই ব’লে উঠলো,
” জরুরি কথাটা বলার সময় কি এখনো হয়নি? ”
ছেলের প্রশ্নে মাহতাব খানের কপালের মাঝ বরাবর ভাজ পড়লো। ওই দিনের কথাটা মনে করলেন। বন্ধু মাসুদ ইকবালের দিকে তাকালেন। মাসুদ ইকবাল অভয় দিয়ে ইশারায় বললো, বল কথাটা। বন্ধুর ভরসা পেয়ে গলা ঝেড়ে মাহতাব খান বলে উঠলো,
” আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি স্নেহার সাথে। ”
কথাটা কানে যেতেই চিবুক শক্ত করে উঠে দাড়ালো আরহাম। নিহা খান ভয়ে ছেলের হাত নিজের মুঠোয় ধরলেন। তার গম্ভীর ছেলে একবার রাগলে, তাকে থামানো মুশকিল। আরহামকে এভাবে দাড়াতে দেখে স্নেহা ভয় পেলো খানিকটা। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি কপাল কুঁচকে আরহামের দিকে তাকিয়ে। মাহতাব খান ছেলের এমন আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে ব’লে উঠলো,
” এভাবে দাড়িয়ে গিয়েছো কেনো? ”
আরহাম জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে ব’লে উঠলো,
” আংকেল আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। এই বিয়েটা আমি করতে পারবো না। ”
ঝট করে মাহতাব খান দাড়িয়ে গেলেন। হুংকার ছেড়ে বলে উঠলেন,
” আরহাম! একদম বেয়াদবি করবে না। ”
বাবার হুংকারে রক্ত লাল চোখে তাকালো। আরহাম কন্ঠে তেজ মিশিয়ে ব’লে উঠলো,
” চেঁচাবেন না, আব্বু৷ আমি কোনো বেয়াদবি করছি না, সেটা খুব ভালো করেই জানেন। আর আপনার চিল্লানোতে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না।”
মাহতাব খান কিছু বলবে, তার আগেই স্নেহার বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। তিনি নরম সুরেই বললেন,
” তোমার কি স্নেহা কে অপছন্দ, আরহাম। ”
আরহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
” আমি আইরিশকে ভালোবাসি! ”
আরহামের কথাটা শুনে স্নেহা মনে মনে রেগে গেলেও উপরে নিজেকে শান্ত দেখালো। স্নেহার বাবা হেসে উঠলেন আরহামের কথায়। সবাই উনার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। মাসুদ ইকবাল সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন,
” বেশ তো! তুমি ভালোবাসতেই পারো। তবে তোমার বাবা চেয়েছিলেন বলেই আমি রাজি হয়েছিলাম। ”
এরপর মাহতাব খানের দিকে তাকিয়ে ব’লে উঠলেন,
” ছেলের মতামত না জেনে তোর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি, মাহতাব৷ তবে খুব শীঘ্রয় ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিবি। ”
মাহতাব খান বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ তিনি ভেবেছিলেন, তার বন্ধু কষ্ট পাবেন। অথচ তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কি সহজ ভাবে বিষয়টা সামলে নিলো। মনে মনে ছেলের উপর কিছুটা চটে আছেন৷ আরহাম মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো মাসুদ আংকেলের প্রতি।
স্নেহারা যেতেই মাহতাব খান গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” মেয়েটা কে আরহাম? ”
সোফায় আরাম করে বসে আপেল খাচ্ছিলো আরহাম। বাবার কথা শুনে বাঁকা হাসলো। আপেলে এক বাইট নিয়ে বলে উঠলো,
” আপনার বউয়ের বান্ধুবির মেয়ে আর আমার বন্ধুর বোন। ”
মাহতাব খান হা করে তাকিয়ে আছে৷ তিনি যেটা ভাবলেন সেটাই ঠিক। উনি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” আশরাফের বোন? ”
” হুম! ”
আরহামের সহজ সরল স্বীকার। মাহতাব খান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য তাকাতেই নিহা খান ঝটপট কিচেন রুমে ঢুকে গেলেন৷ স্ত্রীর কান্ডে মাহতাব খান তব্দা খেয়ে বসে আছেন।
.
রেস্টুরেন্ট থেকে আসার পর থেকেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। কতবার যে নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি হিসেব ছাড়া। ফোনে রেস্টুরেন্টে তুলা ছবিগুলো দেখতেই মনে পড়ে গেলো আরহাম ভাইয়ের যত্ন করে আমার ঠোঁট মুছে দেওয়া। খাওয়ার ফাঁকে কখোন যে ঠোঁটের কাছে একটুখানি খাবার লেগে গিয়েছিল খেয়ালই করিনি। হুট করে কথার মাঝে আরহাম ভাই উনার বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে আমার ঠোঁটের কাছে লেগে থাকা খাবারটুকু মুছে দিলেন৷ এই যে আরহাম ভাইয়ের এমন ছোট ছোট যত্ন নেওয়ার বিষয়গুলা মনে দাগ কেটে রাখে। আনমনে হাসতে হাসতেই মনে পড়ে গেলো আশরাফ ভাইয়ার কথা। মোবাইলটাকে বিছানার উপর রেখে তাড়াতাড়ি ওড়না গায়ে জড়িয়ে হাটা ধরলাম ভাইয়ার উদ্দেশ্যে। ভাইয়ার রুমের সামনে আসতেই দেখলাম, ভাইয়া পড়ার টেবিলে৷ সে যে পড়ছে তা না। একবার বই খুলে তো আরেকবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই গলা ঝেরে বলে উঠলাম,
” কি করছিস ভাইয়া? ”
আমাকে দেখা মাত্রই ভাইয়া বই খুলে পড়ার মিথ্যা নাটক করছে। আমি মিটমিট করে হেসে বলে উঠলাম,
” জানিস ভাইয়া আজকে ভার্সিটিতে কি হয়েছিলো? ”
ভাইয়া আমার দিকে তাকাতেই আমি বিছানায় বসে চেহারাটাকে দুঃখী করে ফেললাম৷ বইটা বন্ধ করে ভাইয়া বলল,
” কি হয়েছে? ”
” আজকে একটা আপুকে দেখলাম, বুঝলি। মাঠের এক কোনায় বসে বসে কান্না করছিলো। ”
ভাইয়া কপালে ভাজ ফেলে বলে উঠলো,
” তাতে কি হয়েছে? ”
আমি মুখটাকে আরেকটু দুঃখী করে বললাম,
” তাতে তো অনেক কিছু হয়েছে। ”
” কেমন কিছু? ”
ভাইয়া এবার কিছুটা উৎসুক হলো জানার জন্য। নিজের হাসি কোনো রকম চেপে উদাস হয়ে আবারো ব’লে উঠলাম,
” ওই আপুটার নাম ছিলো সিমি। সিমি আপুর কান্না দেখে আমরা সবাই উনার কাছে গিয়ে দেখি বেচারা না মানে বেচারি কাঁদতে কাদঁতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলো। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলে উঠলো, উনার প্রেমিক পুরুষ উনার সাথে রাগ করেছে। আবার নাকি সব জায়গা থেকে ব্লকও মেরে দিয়েছি। আহারে বেচারি মনে হয় প্রেমিক পুরুষের বিরহে সকালে কিছু খেয়ে আসেনি । তার জন্যই তো দুপুরে জ্ঞান হারিয়ে ভরা মাঠে পড়ে গিয়েছিল। ”
আড় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেচারা ঘেমে গেছে। হাত পাও খানিকটা কাঁপছে। মনে মনে পাগলের মতে এক দফা হেসে নিলাম। বাকিটা নাহয় রুমে গিয়ে হাসবো। আচমকা ভাইয়া চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার কাজ শেষ। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মুচকি হেসে বললাম,
” এতো নাটক না করে সিমি আপুর সাথে কথা বল, গরু! ”
বলেই চলে আসলাম৷ আমি জানি ভাইয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে৷ এখন হয়ত সিমি আপুকে কলও দিয়ে দিয়েছে। ভাইটা আমার অনেকটা চাপা স্বভাবের। দুই বন্ধু একই রকম৷ বুক ফাটবে তবু মুখ ফাটবে না।
চলবে!