#ভালোবাসি_বলে(৯)
#Jannat_prema
আমি আরহাম ভাইয়ের কাধে মাথা দিয়ে দাড়িয়ে আছি। দুজনেই লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরপর আসা হিমেল হাওয়ায় মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠে৷ আরহাম ভাইয়ের পার্ফিউমের ঘ্রাণে কেমন মাদকতা মিশে আছে। আমি চাঁদটার দিকে তাকালাম৷ এই নির্জন পরিবেশ প্রিয় মানুষের কাধে মাথা রেখে চন্দ্র বিলাস করার মজাই আলাদা৷ চাঁদটাও কিছুক্ষণ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, আবার আমাদের আলোকিত করতে বেরিয়ে আসে। বিষয়টা দারুন লাগলো আমার কাছে। আমি মনে জমানো প্রশ্নটা করে ফেললাম,
” আচ্ছা আরহাম ভাই, তখন আপনি আর স্নেহা আপু রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন কেনো? মানে বলতে চাইছি স্নেহা আপু আপনার সাথে কেনো ছিলো? ”
আরহাম ভাই নড়েচড়ে দাড়ালেন। আমি মাথা তুলে উনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। আরহাম ভাই আমার হাতটা উনার হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার মাথাটা আবারো উনার কাধে রেখে বললেন,
” মাথা উঠাবি না৷ স্নেহা হলো আব্বুর বন্ধুর মেয়ে। ওর মা নেই। স্নেহা ছোট থাকতেই ওর আম্মুর টাইফয়েড হয়েছিলো। অনেক চিকিৎসার পরেও উনি বাচলেন না। আমি ঠিক জানি না সঠিক কারণটা। আর আংকেলও বিয়ে করেন নি। উনি চিকিৎসার জন্য নানা জায়গায় গেলে স্নেহাকে আমাদের কাছে রেখে যেতেন। স্নেহা ছোট থেকেই কেমন খাপছাড়া ছিলো। যেমন, একরোখা, জেদি, একটু অহংকার টাইপের। ও ছোটবেলা থেকে যখন যা চাইতো আংকেল তখন তা এনে দিতো৷ আর এখন তো আমার পিছে লেগে আছে৷ এতে আমার আব্বুও সায় দিচ্ছে। দুপুরে আব্বু ফোন দিয়ে বললো স্নেহাকে নিয়ে ঘুরে আসতে। তাই তখন তুই রেস্টুরেন্টে দেখেছিলি৷ ”
আমি শান্ত চোখে তাকিয়ে আছি আরহাম ভাইয়ের মুঠোয়া ধরে রাখা আমার হাতটার দিকে। এটা হলো আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করার একটু ছোট প্রচেষ্টা। আরহাম ভাইয়ের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, স্নেহা আপুর প্রতি চরম বিরক্ত উনি। প্রথমে কষ্ট লাগলেও এমন ছ্যাচড়ামির জন্য আর কষ্ট লাগছে না আমার।
” আব্বু চাইছে স্নেহাকে আমার সাথে বিয়ে দিতে।”
আমি চমকে আরহাম ভাইয়ের দিকে তাকালাম। বুকের ভিতর প্রচন্ডরকম ধুকপুক করছে। আমি আতংকিত স্বরে বললাম,
” তাহলে কি আপনি স্নেহা আপুকে বিয়ে করবেন?”
আরহাম ভাই তপ্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমার কাতর দৃষ্টি দেখে উনি নজর শান্ত করলেন। আমার গালে হাত রেখে চোখে চোখ মিলিয়ে বললেন,
” আমি তো তোকে ভালোবাসি। ওই ছ্যাচড়া মেয়েকে বিয়ে করতে যাবো কেনো? ”
আরহাম ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলাম। আমি উনার বাহু জড়িয়ে ধরে বললাম,
” যখন এতোই ভালোবাসেন তাহলে আগে বলেন নি কেনো? ”
আমার কথা শুনে আরহাম ভাই চুপ করে থাকলেন। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি।
” আশরাফ মনে হয় আমাদের সম্পর্ক মানবে না, আইরু! ”
অবাক হয়ে বলে উঠলাম,
” হঠাৎ এই কথা বলছেন কেনো, আরহাম ভাই? ”
আরহাম ভাই কিছু না বলে অপলক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
.
আজকে সকাল সকাল উঠে গেলাম। কালকে রাতের প্রায় পৌনে দুইটা বাজে আরহাম ভাই আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলেন৷ আরহাম ভাই যাওয়ার পরে রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তেই চোখ বন্ধ করে আরহাম ভাইকে কল্পনা করতে করতে কখোন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাইনি। আম্মু আমাকে এতো সকাল বেলা কিচেন রুমে দেখে অবাক হয়ে আছেন৷ আম্মুর হাত থেকে খুন্তি নিয়ে রুটিটা উল্টে বললাম,
” কি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? ”
আম্মু কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
” ফজরের নামাজ পড়েছিস? ”
” হ্যাঁ পড়েছি। ”
” কোনদিন থেকে এতো ভালো হলি! সকাল বেলা একটু তাড়াতাড়ি উঠে তো আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করতে পারিস। ”
” আজকে উঠেছি না! ”
আমার কথা শুনে আম্মু চটে গেল। ক্যাট*ক্যাটিয়ে উঠলেন,
” আজকে উঠে তো আমাকে উদ্ধার করে ফেলেছিস। সর এখান থেকে। নাস্তা খেয়ে কলেজে যা। ”
” আম্মু কলেজ না ভার্সিটি। ”
আম্মু এমন ভাবে তাকালেন আমি আর এক মিনিটও কিচেনে না দাড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসলাম৷ আর এক মিনিট যদি দাড়াতাম তাহলে আমার গোলগাল গালটা আর গোল থাকতো না৷ সেটা চ্যাপ্টা হয়ে যেতো। রুম থেকে মোবাইলটা এনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি চালিয়ে কার্টুন দেখতে লাগলাম। আরহাম ভাইয়ের কথা মনে হতেই ঝটপট মেসেজ পাঠালাম৷
” কি করছেন? ”
পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ আমার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে উনি মেসেজ দিলেন,
” মাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলাম। আজকে অফিসে যাবো। ”
মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার৷ তাহলে আরহাম ভাইয়ের সাথে আজকে দেখা হবে না। ভাবলাম আজকে একটু সেজেগুজে ভার্সিটি যাবো৷ উনাকে একটু জ্বালাবো, এখন দেখি নিজেই জ্বলছি।
” একদম সেজেগুজে ভার্সিটিতে যাবি না। ঠোঁটে তো লিপবাম ভুলেও লাগাবি না। ”
মেসেজটা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম৷ সাজবো না কেনো? আর আমি তো কোথাও গেলে ঠোঁটে লিপবাম না লাগিয়ে যাই না। তাই আমিও মেসেজ দিলাম।
” কেনো, কেনো, কেনো? সাজবো না কেনো? ”
” তোকে নিষেধ করেছি সাজতে। আমি চাই না তোর ওই গোলাপি ঠোঁটে কারো কু নজর পরুক, আমি চাই না তোর ওই কাজল কালো চোখে কারো নজর লাগুক। ওগুলো আমার জিনিস। ”
হৃদয় জুড়ে শিতল রক্ত বয়ে গেলো আমার৷ আমি বারবার মেসেজটা পড়ছি। হৃদয় কাড়া এই মেসেজটার কথা আমি কখোনো ভুলবো না। কখোনো না।
” সকাল বেলা টিভি ছেড়ে বসে আছিস কেনো? কারেন্ট বিল কি তোর জামাই দিবে! ”
মাথা ডলে নাক মুখ কুচঁকে ভাইয়ার দিকে তাকালাম৷ মাথা থেকে হাত নামিয়ে ব’লে উঠলাম,
” তোর কি তাতে? আমার পিছনে এভাবে লাগবি না ভাইয়া। ”
” তোরা পিছনে না লাগলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না, বুঝলি! ”
আমি রেগে ভাইয়ার চুল টেনে ধরতেই চেঁচিয়ে উঠলো ভাইয়া,
” আইরু খচ্চর! আমার চুল ছাড়। আমি মাত্র চুল আচড়িয়ে আসছি। ”
” আর রাগাবি আমাকে, বল? ”
” কি করছিস তোরা? ”
আব্বুকে দেখে আমরা দুইজন থেমে গেলাম৷ আমি আব্বুর কাছে গিয়ে ন্যাকা স্বরে ব’লে উঠলাম,
” আব্বু দেখেন ভাইয়া আমার সাথে মারামারি করছে। ”
আব্বু চোখ গরম করে ভাইয়ার দিকে তাকালো। ভাইয়া আমার দিকে রেগে তাকিয়ে বললো,
” তুই আগে মেরেছিস আমাকে৷ এখন আব্বুকে দেখে ঢং করছিস। ”
” তুই চুপ থাক। ছোট বোনের সাথে কোউ মারামারি করে। যা খেতে যা। ”
আব্বুর ধমকে ভাইয়া কটমট করে তাকালো৷ আর আমি শয়তানি হাসি দিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
.
ভার্সিটিতে প্রবেশ করতেই চলে গেলাম আমতলায়। সেখানে আসতেই থমকে দাড়িয়ে গেলাম। আরিফ আর রাইহান মারামারি করছে। ওদেরকে থামাতে প্রানপন চেষ্টা করছে শশি। এদিকে আমি ভাবছি এরা না একে অপরকে ভালোবাসে। সেদিন না কি ঢলাঢলি করছিলো। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
” তোরা থামবি। আমি জানতাম তোদের দ্বারা আর যাই হোক প্রেম কখোনো হবে না৷ ”
আমার কথা শুনে ওরা থেমে গেলো। শশি ধপাস করে বসে পড়লো। আরিফা আর রাইহান দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। আমি গিয়ে শশির সাথে বসতেই আরিফা বলে উঠলো,
” আইরিশ ওকে বলে দিবি, আমি আর ওর সাথে কথা বলবো না। আজ থেকে আমাদের ব্রেকআপ। ”
এরপর রাইহানের কানের কাছে এসে চেচিয়ে ব’লে,
” ব্রেকআপ মানে ব্রেকআপ। ”
আরিফার দেখাদেখি রাইহানও সমস্বরে বললো,
” হাহ! আমারো কোনো ইচ্ছে নেই কোনো ঝগড়াটে মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে যাওয়ার। ”
আরিফা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চোখের চশমাটাকে ঠেলে বললো,
” আমি ঝগড়াটে? ”
” কোনো সন্দেহ আছে! ”
” রাইহান তোকে আমি___”
” এক্সকিউজ মি! ”
আরিফা আর রাইহান থেমে গেলো৷ আমি আর শশি তাকালাম শব্দের উৎসের দিকে। ছিমছাম গড়নের ফর্সা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে৷ আমরা সবাই একে অপরের দিক তাকালাম। এরপর সবাই একসাথে বলে উঠলাম, ‘ জ্বি! ‘
চলবে!
( গঠনমূলক মন্তব্য করবেন সবাই।)