#ভালোবাসি_বলে(৫)
#Jannat_prema
আরহাম ভাই ড্রাইভ করছেন। তারপাশেই আশরাফ ভাই বকবক করেই যাচ্ছে। অবশ্য তাতে আমার মনোযোগ কোথায়। আমার ধ্যান জ্ঞান সব তো আমার সামনে বসা সুদর্শন পুরুষটার দিকে।
এই যে, সানগ্লাস লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, বাইরের ওই মুক্ত হাওয়া এসে উনার চুলগুলো কপালের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে সাথে উড়িয়ে নিচ্ছে আমার মন। আরহাম ভাইকে এখন বড্ড আকর্ষন লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে একটু ছুয়ে দেই, মন ভরে দেখি যতক্ষণ না তৃষ্ণা মেটে ঠিক ততক্ষণ। নিজেকে কল্পণা করতে লাগলাম।
আরহাম ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন, আমি তার পাশেই বসে আছি। উনি কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে মুচকি হেসে তাকাচ্ছেন৷ কি সুন্দর সেই হাসি! ভালোবাসলে বুঝি ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই সুন্দর লাগে! আমিও মুচকি হেসে আলতোভাবে উনার কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। আরহাম ভাই মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রশান্তির হাসি হেসে আমার হাতে চুমু খেলেন। আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেনো ধাকাচ্ছে। আমাদের এমন রোমান্টিক মোমেন্টে কোন ছাগল এই রকম ছাগলামি করছে! হঠাৎ দেখলাম আরহাম ভাই আমাকে ধমকাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। উনি এইরকম করছেন কেনো বুঝতে পারছি না৷
” এই আইরিশ শুনছিস? এই শুনতে পাচ্ছিস না, বয়রা! ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালাম আশরাফ ভাইয়ের দিকে। আমি ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম গাড়িটা থেমে আছে। আশরাফ ভাইয়া সামনের সিট থেকে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তেমনি আরহাম ভাইও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। নিজের অবস্থার কথা ভাবতেই কিছুটা লজ্জায় অভিভূত হলাম। কখন যে নিজের কল্পনায় এতোটা বিভোর হয়ে পড়লাম খেয়ালই করিনি।
” তুই কি আজকে এখানেই বসে থাকবি? ”
আরহাম ভাইয়ের কথায় চমকে ব’লে উঠলাম, “মানে?”
” ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামিয়েছি প্রায় বিশ মিনিট হতে চললো। তোকে ডাকতে ডাকতে আমার গলা প্রায় অকেজো হয়ে যাচ্ছিলো। এখন যদি দয়া করে নামতি, অনেক উপকার হতো। ”
আশরাফ ভাইয়া এমন করে কথাটা বললো যেনো সত্যি ভাইয়ার গলা অকেজো হয়ে গেছে। আমি বোকার মতো হেসে ঝটপট নেমে পড়লাম। আমি নেমে পড়তেই সবাই একসাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্য হাটা দিলাম। আগেই বলে রাখি, আশরাফ ভাইয়া আর আরহাম ভাই এবার মার্স্টাস ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আবার তার পাশাপাশি দুইজনে পার্টটাইম জবও করছে৷ এদিকে আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ফাইনাল দিবো কয়েক মাস পর।
.
ভার্সিটিতে প্রবেশ করে হাটা ধরলাম আমাদের আড্ডাখানা মানে প্রিয় আম তলায়। আরহাম ভাইরা চলে গেলেন নিজেদের আড্ডায়। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম এখনো ঢেড় সময় আছে ক্লাস শুরু হওয়ার। আম তলায় যেতে না যেতেই কয়েকজন আমায় ঘিরে ধরলো। শশি মাথায় আলতো থাপ্পড় মেরে ব’লে উঠলো,
” আজকে এতো তাড়াতাড়ি কেমনে আসলি, বইন! আমরা তো আরো কত কি মনে করেছি। ”
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে আরিফা ব’লে উঠলো,
” আইরিশ তো তাও তাড়াতাড়ি আসছে। কিন্তু ব্যা’টা রাইহান এখনো আসেনি। ”
আরিফার কথা শুনে আমি আর শশি মিটমিটিয়ে হাসছি। সেতো আর জানে না তার আশিক আজকে কি করবে। আমি নিজেকে সামলে ব’লে উঠলাম,
” ইশ দোস্ত! তোকে তো বলতেই ভুলে গেছি। ”
আমার কথা শুনে আরিফা আর শশি উৎসুক নয়নে তাকালো আমার দিকে। এদিকে আমি কথাটা বলার আগেই শশি ফিসফিস করে ব’লে,
” কি বলতে ভুলে গেছিস, আইরিশ? তোর অন্তত আমাকে মনে করে বলা উচিত ছিলো। তুই এমনটা করতে পারিস না। ”
আমি কটমট করে শশিকে ব’লে উঠলাম,
” তোর বুঝা উচিত, কথাটা যখন তোকে বলিনি মানে কাউকে বলিনি তারমানে আমি মিথ্যা বলছি। বুঝেছিস! এখন সর তোর গায়ের থেকে তোর জামাইর গায়ের পার্ফিউমের ঘ্রাণ আসছে। ”
মুখটা ছোট করে শশি, ‘ ওহ ‘ বলে সরে গেলো। আরিফা আমার আর শশির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ব’লে উঠলো,
” তোরা কি নিয়ে এমন ফুসুরফাসুর করছিস? ”
আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,
” আসলে কি বলতো আরিফা, আমি আর শশি ভাবছিলাম যে কথাটা তোকে বলবো কি বলবো না। তাই না শশি? ”
শশিকে গুতো দিয়ে বললাম। শশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
” হ্যাঁ! হ্যাঁ! ”
আরিফা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
” এতো প্যাচিয়ে না বলে সোজাসাপটা কথাটা বল। আমার আর ধৈর্য হচ্ছে না। ”
” আসলে রাইহানের একটা ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে। ”
আমার কথাটা শুনতেই শশি আর আরিফা হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওদের দুইজনকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছে আমার। তবুও দম খিচে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছি। শশি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আরিফার চোখ মুখ মুহূর্তে লাল হয়ে উঠলো। আমি, শশি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। আরিফার ফর্সা বদন মুহুর্তে কেমন হয়ে গেলো। চশমার আড়ালে থাকা চোখগুলো মুহুর্তে পানিতে ভরে উঠলো। নিজের চোখের চশমা ঠিক করে আরিফা কাঁপা কন্ঠে ব’লে উঠলো,
” মমজা করছিছিস তোরা? আমমার সাথে সসত্যি মজা করকরছিস? ”
আমি বা শশি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমাদের নিরবতা দেখে আরিফা ধপ করে আম গাছটার নিচে বসে কেঁদে দিলো। আরিফার কান্না দেখে আমাদের দু’জনেরও চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি ভাবিনি আমার এই ছোট্ট মজাটা আরিফা সিরিয়াসলি নিয়ে নিবে। শশি যেই আরিফাকে কিছু বলতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে ভেসে আসলো পরিচিত কন্ঠ স্বর।
” কি হয়েছে আরু? ”
ততক্ষণাৎ আমরা পিছনে তাকালাম। আরিফাও ঝট করে মাথা উঠিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে৷ কাধে ব্যাগ জড়িয়ে অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে রাইহান। রাইহান আমার হাতে নিজের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে অস্থির পায়ে এগিয়ে হাটু মুড়ে আরিফার সামনে বসে ব’লে উঠলো,
” কি হয়েছে আরু? তুই কাঁদছিস কেনো? কি অবস্থা করে ফেলেছিস নিজের। এ্যাই শশি বলতো কি হয়েছে ওর? ”
রাইহানের প্রশ্নে শশি থতমত খেয়ে গেলো। আমি নিজেও ভড়কে গেছি। শশি আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি এক অপ্রত্যাশিত কান্ড করলো আরিফা। রাইহানকে শক্ত করে ধরে কেঁদে দিলো আরিফা। রাইহানও কিছুটা অবাক হয়ে আছে। আরিফা শুকনো ঢোক গি*লে ব’লে উঠলো,
” তুই ঠিক আছিস? আইরিশ আর শশি দেখ কি আবোল তাবোল কথা বলছিলো। কি বলছিলো জানিস, বলছিলো তোতোর নাকি এক্সএক্সিডেন্ট হয়েছে। ”
রাইহান এক কঠিন চাহনিতে আমাদের দিকে তাকালো। এতে আমি, শশি কাচুমাচু করে দাড়িয়ে আছি। রাইহান আরিফার মাথায় হাত বুলিয়ে ব’লে,
” যদি হতো তখন কি করতি? ”
আরিফা নাক টেনে ব’লে,
” তাহলে কান্না করতাম। ”
” কেনো? ”
রাইহানের প্রশ্নে আরিফা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এদিকে আমরাও উৎসুক হয়ে আছি জানার জন্য। উত্তেজনায় আমি শশি দুইজনের হাত শক্ত করে ধরে আছি। আরিফা রাইহানে কাঁধে মুখ লুকিয়ে ব’লে উঠলো,
” তোকে ভালোবাসি বলে! ”
বিস্ময়ে জমে গেলাম আমরা। রাইহান যেনো স্থীর হয়ে গেলো। আমরা সপ্নেও ভাবতে পারিনি আরিফা এমন কিছু বলতে পারে। যেখানো রাইহানের আজকে প্রপোজ করার কথা ছিলো। সেখানে আরিফা আগে নিজের অনুভূতির কথা বললো। বিষয়টা আসলেই চমকানোর মতো। খুশিতে কি প্রতিক্রিয়া করা উচিত কেউই ঠাহর করতে পারলাম না। রাইহান নিজের থেকে আরিফাকে ছাড়িয়ে অবাক স্বরে বললো,
” আবার বল, আরু। ”
আরিফা এবার রাইহানকে ছেড়ে রাইহানের চোখে চোখ রেখে ব’লে উঠলো,
” ভালোবাসি রাইহান। অনেক অনেক ভালোবাসি তোকে। ”
রাইহান সবাইকে চমকে দিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে দিলো। সেই অবস্থায় আরিফার হাত দুটো মুঠোয় ধরে বলে,
” আমিও তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি, আরু। তোকে আমি হারাতে চাই না, আরু। তুই থেকে যা আমার হয়ে আজীবন। ”
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি ওদের। আসলে বলে না, ভালোবাসা সুন্দর সেটা দেখতেও সুন্দর। হঠাৎ মনে পড়লো হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটি কথায়,
” যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনো কিছু পরিকল্পনা মতো হয় না ”
– হুমায়ূন আহমেদ।
তিনি ঠিকই বলেছেন। আমরা পরিকল্পনা করলাম কি আর হলো কি। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল ভালোবাসার মানুষগুলো।
চলবে!