#ভালোবাসি_বলে(৩)
#Jannat_prema
বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আরহাম ভাইয়ের হাতে থাকা খাবারের খালি প্লেটটার দিকে। যে প্লেটটাতে কিছুক্ষণ আগেও খাবার ছিলো। সেটা এখন খালি! তার মানে আমি যেটা ভাবছি সেটা কি সত্যি! আরহাম ভাই উনার কথার জালে আমাকে ফাসিয়ে খাবারটা নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। যে আমি কিনা যদি একবার বলি আমি খাবো না সেই আমিকে উনি উনার কথার জালে, প্রশ্নের জালিয়ে ভুলিয়ে খাইয়ে দিলো।
” তোকে কাদঁলে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগে, আইরু! ”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছি আরহাম ভাইয়ের যাওয়ার দিকে। আরহাম ভাইয়ের কথায় পুরো শরীরে কেমন শিহরণ বয়ে গেলো। আরহাম ভাই কি বললো এটা! সত্যি আরহাম ভাই এমন একটা কথা বললেন।
.
রাতে আম্মু অনেক বার ডাকলো খাওয়ার জন্য। কিন্তু আজকে যে আমার আর খাওয়ার ইচ্ছা নেই। শুধু আজকে কেনো, আগামি তিনদিনও না খেয়ে পার করে দিতে পারবো। আরহাম ভাই নিজ হাতে খাইয়ে দিবে জানলে আমি এই রকম হাজারো রাগ করে খাওয়া ছেড়ে চলে আসতাম। উনি আবারো উনার কথার মায়াজালে ফাসিয়ে আমাকে খাইয়ে দিবে। রুমের দরজা লক করে গায়ের ওড়নাটাকে দু’দিকে মেলে ঘুরতে লাগলাম। কিযে খুশি লাগছে! হঠাৎ কিছু মনে হতেই থেমে গেলাম। মনে পড়ে গেল আরহাম ভাইয়ের বলা শেষের কথাগুলো।
” তোকে কাঁদলে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগে, আইরু! ”
আইরু! এই প্রথম উনার মুখে নিজের এমন ডাক শুনে পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পুরো শরীরে যেনো ভালো লাগা ছেয়ে গেলো। হুট করে ইচ্ছে হচ্ছে আরহাম ভাইকে এক পলক দেখার। উনার ওই মায়াবী মুখখানা তৃপ্তি মাখিয়ে দেখার ওই অদম্য ইচ্ছে হতেই বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে ঝটপট করে গ্যালারিতে ঢুকলাম । আমার গ্যালারিতে আমার ছবি যতটা না আছে তার থেকে বেশি আরহাম ভাইয়ের ছবি আছে।
কিছুদিন আগে তোলা আরহাম ভাইয়ের ডার্ক রেড কালারের শার্ট পড়া ছবিটা দেখতে লাগলাম। সুদর্শণ এই পুরুষটার উপর কিভাবে যে মন দিয়ে বসলাম! আরহাম ভাইয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আরহাম ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতির কথা।
.
” ওহে শ্যাম তোমারে আমি,
নয়নে নয়নে রাখিবো।
অন্য কাউরে না আমি,
চাইতে দিবো।
ওহে শ্যাম! ”
নাচ শেষ করে স্টেজ থেকে নিচে নামতেই আমার ফ্রেন্ড রা সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো। সবাই বেশ প্রশংসা করলো আমার নাচের।ক্লাস ওল্ড টেনদের বিদায় উপলক্ষে আমরা অনেকে মিলে নাচে নাম দিয়েছিলাম। হঠাৎ অদুরে চোখ যেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো আমার। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আশরাফ ভাইয়া আর আরহাম ভাইয়ের কাছে। ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে বলে উঠলাম,
” আমি ভাবিনি ভাইয়া তুমি আমার নাচ দেখতে আসবে। ”
ভাইয়া আমাকে এক হাত দিয়ে আগলে ব’লে,
” তুই আসার জন্য আবদার করলি, আর আমি আসবো না। তবে এখানে আসার জন্য আরহামই আমাকে বলেছিলো। ”
আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালাম আরহাম ভাইয়ের দিকে। উনি চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে আমাদের থেকে একটু দুরেই ফোন চাপছেন। ভাইয়াকে ‘ আসছি ‘ বলে এগিয়ে গেলাম আরহাম ভাইয়ের দিকে। আরহাম ভাইয়ের সামনে দাড়াতেই উনি চোখ তুলে চাইলেন আমার দিকে। সহসা স্থির হয়ে জমে গেলাম। শরীরের ভিতর এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। আরহাম ভাইয়ের চাহনিতে কিছু একটা ছিলো। কই আরহাম ভাইতো কতবার আমার দিকে তাকিয়েছে, কথা বলেছেন তখন তো এই রকম অনুভুতি হলো না, নাকি আজকে উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
” কিছু বলবি? ”
পুরুষালি কন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে গেলাম। নিজের ভাবনার সাগরে সমাপ্তি ঘটিয়ে আরহাম ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম। এভাবে বেহায়ার মতো উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ভাবতেই অসস্তি ঘিরে ধরলো। আরহাম ভাইয়ের দিকে আড় চোখে তাকালাম। উনি কপাল কুচকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমাকে কিছু বলতে না দেখে উনি ধমকে উঠলেন।
” এভাবে বো’বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেনো? কিছু বলবি? ”
কেনো জানি আরহাম ভাইয়ের ধমকে মনের কুঠুরিতে অভিমানের মেঘ জমেছে। আমি থমথমে মুখে বললাম,
” ধন্যবাদ দিতে এসেছিলাম। ”
” কেনো? ”
উনার এই রকম প্রশ্নে আমি আবারো দৃষ্টি তুলে তাকালাম। বললাম,
” ভাইয়াকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। ”
আরহাম ভাইয়া স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন কতক্ষণ। এরপর দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললেন,
” ধন্যবাদ দেওয়া শেষ হলে যেতে পারিস। ”
আমি তৎক্ষনাৎ পা ঘুরিয়ে হাটা শুরু করলাম বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। মাথা ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চাইলাম এক পলক। আশরাফ ভাইয়া তখন আরহাম ভাইয়ের পাশেই ছিলেন। ভাইয়া হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো। আর আরহাম ভাই! উনার দৃষ্টি ছিলো তখন আমার দিকে। আমি মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকালাম। আবারো আরহাম ভাইয়ের সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। বুকের ভিতর অজানা এক কষ্টে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিলো। তবে সেটা কেনো ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।
.
কিছুক্ষণ আগেই স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ করে যে যার বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম। শশি আর রাইহানের বাসা কিছুটা পাশাপাশি বলে বলদ দুইটা একসাথে গেলো। এদিকে আরিফা বাসা আমার বাসা থেকে বেশ সামনেই। তাই আমরা দুজন একসাথে গেলাম। আরিফা ওর বাসার সামনে আসতেই বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। তবে ও বলেছিলো আমাকে একটু এগিয়ে দিবে। আমি নিষেধ করায় আর আসলো। এদিকে আকাশের সূর্যটা কিছুটা ঢ’লে পড়েছে পশ্চিম দিকে। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। এখন প্রায় সাড়ে পাঁচটার মতোন বাজে। ভাইয়াকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম, কিন্তু সে নাকি একটু ব্যাস্ত আছে তবে আরহাম ভাই নাকি আসবে নিতে। আরহাম ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই আবারো মনের ভিতর ধকধক করছে। উনার মায়াবি চোখে তাকানো, আমাকে ধমকে উঠা, কপাল কুঁচকে তাকানো। উফ! এমন কেনো হচ্ছে আমার। আগে তো কখোনো হইনি, তাহলে আজকে কেনো এমন হচ্ছে। নাকি আমি কখোনো আরহাম ভাইকে ভালো করে খেয়ালই করিনি।
” ওই সুন্দরী! সেজেগুজে কই গেছিলা শুনি? ”
পাশ থেকে এমন উটকো কথা শুনে দাড়িয়ে পরলাম। ভাবনার সুতো ছিড়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের এলাকার বখাটে কয়েকটি ছেলে। প্রতিদিন বিকালে এরা এখানে দাড়িয়ে মেয়েদের বিরক্ত করে। তেমন কোনো গুরুতর খারাপ আচরণ না করলেও প্রচুর বিরক্ত করে। আমি একবার আশেপাশে তাকালাম। আজকে এই রাস্তায় তেমন কোনো মানুষ নজরে এলো না। হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি একা একটি মেয়ে আর ওরা ছয় সাতটা ছেলে। যদি এই নির্জন রাস্তার সুযোগ বুঝে গায়ে হাত দিয়ে ফেলে। যেই তাড়াতাড়ি করে ওদের পার করে পা ফেলবো ওমনি সবগুলো আমার সামনে এসে হাজির। ভয়ে আমার আত্না ছলকে উঠলো। সবগুলো কি বিশ্রি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেগুলোর মাঝে সবার সামনেরটা ব’লে উঠলো,
” তোমরা মেয়েরা আমাদের দেখলে এমন পালাই পালাই করো কেনো, সুন্দরী! ”
বলেই আমার হাত ধরতে যাবে, তখনি পাশ থেকে এক শক্তপোক্ত হাত এসে ছেলেটার হাত রোধ করে ফেললো। আমি হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললাম। আরহাম ভাইকে দেখে মুহুর্তে বুকের ভিতর প্রশান্তি বয়ে গেলো। কি সুন্দর ভাবে একদম ঠিক টাইমে উনি এন্ট্রি নিয়ে নিলো। এই বিষয়টা আমার একদম সিনেমার মতো লাগলো। ছেলেগুলো আরহাম ভাইকে দেখে কিছুটা ভয় পেলো। ছেলেগুলো বয়সে আরহাম ভাইয়ের থেকেও ছোট৷ এই জন্যই হয়তো ভয়ে গুটিয়ে গেছে।
” পিছনে যা! ”
আরহাম ভাইয়ের এমন কঠিন স্বর শুনে চটপট পিছনে সরে গেলাম। উনি কঠিন চাহনিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। যে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে এসেছিলো, সেই ছেলেটার হাতটা মনে হয় এখুনি ভেঙ্গে যাবে এমনভাবে তিনি ধরেছেন। ছেলেটা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে ব’লে উঠলো,
” ভাইয়া মাফ করুন। আর কখোনো এমন করবো না। ভাইয়া হাতে ব্যাথা লাগছে। এই কসম কাটছি, আর কোনো মেয়েকে বিরক্ত করবো না। ”
আরহাম ভাই এবার উনার শক্ত চোয়াল একটু শিথিল করে বললেন,
” কথাটা মনে থাকবে? যদি কোনো মেয়ের আশে__”
” থাকবো না, থাকবো না ভাই। ”
ছেলেটা আরহাম ভাইকে বলতে না দিয়ে নিজেই পাগলের মতো কথাটা বললো। কেনো জানি ছেলেটার এমন ভিতু ফেস দেখে খুব হাসি পেলো। ফিক করে হেসে দিতেই আরহাম ভাই আমার দিকে একপলক তাকালেন। আমি হাসি বন্ধ করে উনার দিকে তাকালাম। উনি ছেলেটার হাত ছেড়ে আমার দিকে এক আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলে উঠলো,
” বিশেষ করে ওর আশপাশে যাতে না দেখি। মাইন্ড ইট!”
চলবে!