ভালোবাসার রূপান্তর পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
587

ভালোবাসার রূপান্তর (শেষাংশ)

অন্য এক শহরে থাকত দিয়ার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন। দূরত্বের কারণে তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ তেমন একটা হয়নি, মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হত। কিন্তু এই বিপদে কেন জানি তার কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ল দিয়ার। সব শুনে নাজিয়া এসে দিয়া আর রিনিকে নিয়ে গেল। নিঃসন্তান নাজিয়া ও তার স্বামীর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে দিয়া। কারণ এর কয়মাস বাদে যখন সে লেখাপড়া আরম্ভ করল, তখন রিনিকে দেখে রাখার দায়িত্ব নিল নাজিয়া। এর মাঝে রুদ্র বহুবার ফোন করেছে, দেখা করতে চেয়েছে কিন্তু দিয়ার সেই যে চোখ থেকে রঙিন চশমা খসে পড়েছিল, সেটাই কায়েম থাকল। প্রাথমিক নিস্পৃহ ঠান্ডাভাবের পর রুদ্রকে দেখলে অন্ধরাগে সে শুধু ফুঁসতে থাকত। রুদ্র তার সুন্দর স্বপ্নটাকে চুরচুর করে ভেঙে দিয়েছে। কিছুতেই মন থেকে মাফ করতে পারল না সে রুদ্রকে, দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তবে যোগাযোগ বজায় থাকে রিনির জন্য।
রিনি একটু বড় হতে রুদ্র মাঝে মাঝে এসে নিয়ে যেত তার কাছে। দুজনের জয়েন্ট কাস্টডি ছিল।

দিয়া মনপ্রাণ ঢেলে দিল লেখাপড়ায়। এত মনোযোগ দিয়ে সে কখনো পড়াশোনা করেনি। দুবছর বাদে এক কোর্সে গ্রুপ প্রেজেন্টেশন করতে গিয়ে পরিচয় হয় রেহানের সাথে। সেও কিছুদিন আগে কানাডায় এসেছে। বয়সে দিয়ার থেকে বছর পাঁচেকের বড়, অবিবাহিত। দিয়াকে দেখে প্রথম দর্শনেই রেহানের ভালো লেগেছিল। দিয়ার দিক থেকে অবশ্য সেরকম কিছুই ছিল না। সে রেহানকে পাত্তাই দিত না। তার মাথায় তখনো আগুন জ্বলছে। রুদ্রর সুবাদে পৃথিবীর সব পুরুষকে সে বিশ্বাসঘাতক মনে করছে। কিন্তু রেহানের সবচাইতে বড়গুণ তার ধৈর্য্য ও তার একনিষ্ঠতা। আর সেটা দিয়ে সে দিয়ার প্রতিটা প্রতিরোধ, প্রতিটা অজুহাত ভেঙে দিতে থাকে।

রেহানের শান্ত সমাহিত ইনফ্লুয়েন্সে দিয়ার ক্ষতবিক্ষত মনে ধীরে ধীরে প্রলেপ পড়তে থাকে, হৃদয় শান্ত হয়ে আসে। কোর্স শেষ হয়ে যাবার পর দুজনে এক অফিসে কো-অপ করে। সেখানে রেহান বহু সাহায্য করতে থাকে। এভাবেই সে একসময়ে দিয়ার মনজয় করে নেয়। গতদুই বছর ধরে তারা সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করছে রিনিকে নিয়ে। আর রুদ্র উইকেন্ডে উইকেন্ডে এসে রিনিকে নিয়ে যায়। দিয়া এখন আগের চেয়ে অনেকটা শান্ত, রুদ্রর সাথে সে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলে। আগের রাগ সে পুষে রাখেনি।

দূর থেকে রুদ্রকে দেখে এগিয়ে গেল দিয়া। রুদ্রকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে প্রচন্ডভাবে উত্তেজিত, নার্ভাসও। নার্ভাস হলে সে যে বা হাঁটু নাচাতে থাকে সেটা দিয়ার থেকে ভালো আর কে জানবে? সম্পর্ক বহু আগেই ছিঁড়ে গেছে কিন্তু এসব ছোটখাট জিনিস তো বহু পরিচিত। সেসব ইচ্ছা করলে ভোলা যায় না।

দিয়া রুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ায়- এত জরুরী তলব কেন? কি কথা তোমার?
দিয়াকে বেঞ্চে বসতে ইঙ্গিত করে রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে আরম্ভ করে। একবার পকেট থেকে সিগারেট বের করে, পরমুহূর্তে সেটা ঢুকিয়ে ফেলে। হয়ত তার মনে পড়ে যে দিয়া সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। এনিয়ে তাদের বহু বাদানুবাদ, মান অভিমান হয়েছে।
বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকে দিয়া। রুদ্রকে এই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। একটু পরে সে নিজে থেকেই বলতে আরম্ভ করবে। ও কোনো কথা পেটে রাখতে পারেনা। আগের দিয়া হলে হয়ত এই মুহূর্তেই খোঁচাখুঁচি আরম্ভ করে দিত। কিন্তু এখনকার দিয়া অনেক পরিণত।

অনেক্ষণ পায়চারী করবার পর রুদ্র দিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়—দিয়া, আমি একটা ভালো চাকরী পেয়ে গেছি।
দিয়ার স্কুলে ঢোকবার একবছরের মাথায় বহু কান্ডকীর্তি করে রুদ্রও অবশেষে স্কুল আরম্ভ করে। মাসকয়েক আগে শেষ করেছে।
শুনে আন্তরিকভাবে খুশী হয় দিয়া। -এ তো খুব ভালো খবর, রুদ্র।
-তবে চাকরীটা এখানে না। আমাকে এলবার্টায় যেতে হবে।
-ওহ। দিয়া কী বলবে ভেবে পায় না। চাকরীর খাতিরে তো যেতেই হবে।
এবারে রুদ্র ঝপ করে বলে বসে- দিয়া, আমাদের বিয়েটা করে ফেলা দরকার।
দিয়া যেন শুন্য থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল- কী বললে তুমি?
মরিয়া দেখায় রুদ্রকে- ঠিকই বলছি আমি। তোমার তো এই চাহিদাই ছিল, না? যে আমি একটা চাকরী পাব, ভাল চাকরী। তো সেটা তো আমি পুরণ করেই দিলাম। এখন তাহলে আর কিসের আপত্তি তোমার?

দিয়া থ মেরে বসে থাকল। সে কি হাসবে না কাঁদবে? শুধু চাকরি পাওয়া না পাওয়া তাদের সমস্যার মূলে ছিল বলে মনে হয়েছে রুদ্রর কাছে? তারমানে রুদ্রর মেন্টাল ম্যাচিউরিটি এতটুকু বাড়েনি। দশবছর আগে সে যে জায়গায় ছিল, সেখান থেকে সে একচুলও আগায়নি।
ফ্যাঁকাসে হেসে দিয়া কথা শুরু করে- রুদ্র, তুমি কি পাগল হলে? আমাদের যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেটা কি তোমার মনে আছে? আর আমি যে এখন অন্যের স্ত্রী সেটাও কি তোমার খেয়াল আছে?
রুদ্র অবুঝের মত বলে- সব মনে আছে, দিয়া। কিন্তু আমি তোমাকে চাই, আমি হাজারবার স্বীকার করছি যে আমি ভুল করেছি। আর এমন হবে না, দিয়া। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

আগেকার দিয়া হলে গলে যাবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু এখনকার দিয়া অনেক পরিণত। উপরন্ত সে একজন মা। মা হলে মেয়েরা যে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।
-রুদ্র, তুমি কি বলছ সেটা কি তুমি ভেবে বলছ? কিভাবে সম্ভব এটা? তাছাড়া তুমি রেহানের কথা ভুলে গেলে? তারও তো একটা দাবী আছে আমার উপরে, নাকি?
একটু থমকে যায় রুদ্র। তারপরে করুণমুখ করে বলে- তুমি আমাকে আর ভালোবাস না, দিয়া?

থমকে যায় দিয়া। এর কী জবাব দেবে সে? কিন্তু আজ তাকে জবাব দিতে হবেই। নাহলে রুদ্র এক অলীক কল্পনা নিয়ে বসে থাকবে, আর কিছুদিন পরপর তাকেও জ্বালাবে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে দিয়া বলতে আরম্ভ করে- অবশ্যই ভালোবাসি, রুদ্র। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। তুমি আমার সন্তানের বাবাও। তাই চাইলেও তোমাকে আমি ভালো না বেসে থাকতে পারব না। কিন্তু এখন সে ভালোবাসার পরিবর্তন এসেছে। আগেকার যে আমি তোমাকে অন্ধভাবে ভালবাসতাম, তোমাকে নিয়ে অবসেসড ছিলাম, এখনকার আমি আর তা নই। এখন আমার চোখে তোমার দোষগুণ সব ধরা পড়ে। তোমার গুণের পরিমাণ যেমন প্রচুর, তেমনি তোমার দোষের পরিমাণও কম না। আর এই দোষগুণ মিলিয়ে যে পরিপূর্ণ মানুষ তুমি, তাকে আমি ভালবাসি, তার ভালো চাই। তবে এই ভালবাসাকে তুমি প্রেম বলে ভুল করোনা। আমি আর তোমাকে সেভাবে ভালবাসি না। ভালোবাসি আমার একসময়ের ভালবাসা হিসেবে, আমার সন্তানের বাবা হিসেবে।
-কিন্তু আমি তো তোমাকে চাই। গোঁয়ারের মত বলে রুদ্র।

এবারে একটু কঠোর হয় দিয়া। রুদ্রকে প্রশ্রয় দিলে সে আরো পেয়ে বসবে।— চেয়ে লাভ নাই, রুদ্র। তুমি সেই আগের রুদ্রই রয়ে গেছ। আর আমি মানসিকভাবে তোমাকে পেছনে ফেলে বহুদূর এগিয়ে গেছি। আমি এখন জানি প্রকৃত ভালবাসা কাকে বলে। আর আমার এখনকার জীবন নিয়ে আমি পুরোপুরি সন্তষ্ট।
হতাশভাবে রুদ্র বলে- তুমি কি রেহানকে ভালোবাস?
কিছুক্ষণ চুপ থাকে দিয়া।– হ্যাঁ, রুদ্র। আমি রেহানকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসাটা আমার আগের সেই সর্বস্ব উজাড় করে নিজের জন্য কিছু না রেখে ভালোবাসা না। অনেকটা শান্ত সমাহিত একটা ভালোবাসা। আমি জানি আমার জন্য রেহান আছে, আমিও ওর জন্য আছি। কিন্তু আমরা পরস্পরকে প্রচুর জায়গা দিয়ে রাখি। একে অপরকে গ্রাস করতে চাই না। আর রিনির ব্যপারেও আমরা খুব সিরিয়াস।
মনে শঙ্কা নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকায় দিয়া। রুদ্র কি বুঝবে সে কি বোঝাতে চাইছে? সে রুদ্রর ভালো চায়। তাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সে ভালবাসার এখন অন্য রূপ।
কোমলস্বরে এবারে দিয়া বলে- দেখ রুদ্র। আমি তোমার ভালো চাই। একসময়ে তোমার উপরে আমার যে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ছিল সেগুলি আমি মুছে ফেলেছি। কেন জানো? রিনির জন্য। রিনি যেন না দেখে যে তার বাবা মার পরস্পরের জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নাই। আর তোমার ভাল চাই বলেই তোমার ভালো চাকরীর খবর পেয়ে আমি আন্তরিকভাবে খুশী হয়েছি।
-আমি তো তোমাকে ভালবাসি, দিয়া।
-প্লিজ রুদ্র, এই কথাটা আর বলোনা। আমিও তোমাকে ভালবাসি কিন্তু সে ভালবাসার রুপান্তর ঘটেছে। সেজন্য তোমাকে বলছি যে এই অবাস্তব কল্পনা ধরে বসে থেকো না। আমি চাই তুমি স্বাভাবিক জীবন যাপন কর। আর দশটা সাধারণ মানুষের মত বিয়ে কর, থিতু হও। জীবনকে উপভোগ কর, অসম্ভব জিনিসের পিছে মিথ্যে ছুটে বেড়িও না।

ভেঙ্গে পড়া মানুষের মত রুদ্র বেঞ্চিতে ঝপ করে বসে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে দিয়ার সেল ফোনটা বেজে উঠে। রেহান।
রুদ্রকে সামলে নেবার জন্য সময় দিতে দিয়া উঠে দাঁড়ায়- রুদ্র, আমাকে এই কলটা নিতে হবে।
একটু দূরে সরে এসে বলে- রেহান?
-হুম, আমি। রিনির ক্লাস শেষ। ওকে তুলে নিয়ে বাসায় ফিরছি আমরা। তুমি কোথায়?
-রুদ্রর সাথে কিছু দরকারী কথা ছিল। সেটাই সারছি এখনো।
-আচ্ছা। রেহানের কাছ থেকে এর বেশী শোনা যায় না, রেহান এর বেশী জানতেও চাইবে না।
একটু ভাবে দিয়া। তারপরে বলে- রেহান, একটা কাজ করতে পারবে? রোজেটা পার্কে চলে আসো প্লীজ। আমি আর রুদ্র এখানেই আছি। রিনি আজ রুদ্রর সঙ্গে থাক। রুদ্র নতুন চাকরী পেয়েছে। বাপ-বেটি মিলে সেলিব্রেট করুক না হয়।
একমুহূর্ত চুপ থেকে রেহান বলে- বেশ তো। বাপ বেটি সেলিব্রেট করবে এ তো ভালো কথা। কিন্তু আমার কি হবে?
-তোমার আবার কি হল?
-এই যে আমি সারা দুনিয়া ড্রাইভ করছি, আমাকে তার জন্য কাউকে এতটুকু ধন্যবাদও দিতে দেখলাম না। রেহানের স্বরে কৌতুক ঝরে পড়ল।
-বেশ, দিলাম ধন্যবাদ। হাসিমুখে বলে দিয়া।
-শুকনা ধন্যবাদ আমি নেই না!
-আচ্ছা, আচ্ছা। সাথে ডিনারও জুড়ে দিলাম না হয়। তোমার প্রিয় রেস্তোরাতে, আমার ট্রিট।
-শুধু ডিনার? হতাশ গলায় জানতে চায় রেহান।
-আর কি চাও? মুভি?
-দূর, ওসব টিনেজ ডেটিং আমার পোষাবে না।
-তবে কি চাও?
-ভেবে দেখো। মেয়ে পাশে আছে, বেশি বলতে পারছিনা।
এবারে খিলখিল করে বাচ্চা মেয়েদের মত হেসে ওঠে দিয়া।
বললো- আচ্ছা, বিবেচনায় থাকল। এসো তো আগে।
(সমাপ্ত)

বি দ্রঃ আমার লেখা দ্বিতীয় ছোটগল্প। প্রচুর বানান ভুল দেখলাম,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে