ভালোবাসার রাত পর্ব ১৬

0
1823

#ভালোবাসার-রাত

#রোকসানা রাহমান

পর্ব (১৬)

তিল মুখটা ভেংচি কেটে কানে হাত দিয়েই দাড়িয়ে রইলো। রিদ কলটা রিসিভ করে কথা শেষ না করেই তিলকে রেখে বেড়িয়ে পড়লো,

“” কোথায় যাচ্ছেন?””

তিলের কথার উত্তর দেওয়ারও যেন সময় নেই!

রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো তিল। তখনো কানদুটো ধরে আছে। হুট করে কে কল দিলো যে এভাবে চলে গেলো? খারাপ কিছু নাতো?? তিল পিছু পিছু আসতে চেয়েও কেন জানি আসলোনা।

পড়ায় কিছুতেই মন বসছেনা। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। পড়া কমপ্লিট না হলে যদি উনি বকেন সে ভয়ে বইয়ে মুখ গুজে আছে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে ১১ টায় ঠেকলো। আম্মুর ডাকে খাবারের টেবিলে চলে গেলো তিল।

ভাতের প্লেটে হাত রাখতে রাখতে জানতে পারলো সিজাতের আব্বু হুট করেই অসুস্থ হয়ে গেছে। হসপিটালে ভর্তি। সেখানেই নাকি গিয়েছে রিদ। সবাইকে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে,আসতে লেট হবে!

বড় আব্বুর কথা শুনে কিছুটা সস্তি পেলেও খাবারটা কেন জানি খেতে পারলোনা তিল। মনে হচ্ছে রিদ ভাইয়াকে ছাড়া এই প্রথম সে খেতে বসেছে। অথচ এতোটা বছর তো উনাকে ছাড়াই খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাহলে আজ এমন লাগছে কেন??? এতো বেশি একা একা লাগছে কেন? ভাতের দু তিন দলা মুখে দিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে তিল। কিছু ভালো লাগছেনা। এক অস্থিরতা ভর করছে শরীরে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই শরীরের ওজনটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিল শোওয়ার জন্য বিছানা ঝারতে ঝারতে ঘড়ির দিকে তাকালো। ১২ টা বেজে ২৫। সিজারের আব্বু কি খুব বেশি অসুস্থ এখনো এলো না যে?? উনি কি ডাক্তার যে উনাকে ওখানেই থাকতে হবে???

তিলের মেজাজ গরম হতে লাগলো। কয়দিন আগেই তো সিজারকে মেরে বাসা থেকে বের করে দিলো এর মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেছে যে এখন উনাদের জন্য উনি আমাকে টেনশনে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন??? ইশ! কিছু ভালো লাগছেনা!

তিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশওপাশ করছে,চোখে ঘুমের কোনো দেখা নাই। বারবার মনের ভেতর খারাপ চিন্তারা উকি দিচ্ছে। এমনি এমনি তো দিচ্ছেনা। ঐদিনের ঐ খারাপ স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কেমন জানি খারাপ চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করে। আচ্ছা উনার সাথে খারাপ কিছু ঘটবেনা তো???

তিলের শরীর ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো একটা কল দিয়ে দেখবে নাকি। পরক্ষনেই মনে হলো ওর কাছে তো রিদানের নাম্বার নাই তাহলে কিভাবে কল দিবে???

সামান্য একটা নাম্বারও আমার কাছে নাই?? এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ নাম্বারটাই নেওয়া হলোনা??? রিদ ভাইয়া ঠিকই বলে আমার মাথায় আসলেই বুদ্ধীর ছিটেফোটাও নেই। থাকলে নিশ্চয় উনার নাম্বারটা আমার ফোনে থাকতো। একটা নাম্বার যে কতটা ইম্পর্ট্যান্ট হতে পারে তিল এখন বুঝতে পারছে। নিজের ফোনটা ঢিল মেরে বিছানায় ফেলে দিলো।

অবশ্য নাম্বারের প্রয়োজন কখনো পড়েইনি তাহলে নিবে কিভাবে??? তিলের প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবসময় তো উনাকে পাশেই পেয়েছে। ফোনে কখনো কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। রিদও তো কখনো ওকে কল দেয়নি তাহলে নাম্বারটা আসবে কিভাবে??? আচ্ছা উনার কাছে কি আমার নাম্বার আছে???

হঠাৎ করেই তিলের মনে পড়লো রিদের সাথে তাদের কখনো ফোন প্রেম হয়নি। ইশ! কি মিসটাই না করেছে। শুনেছি ফোনে কথা বলার সময় নাকি রোমান্টিকতার ছোয়া থাকে কন্ঠে। সেটাতো তিল পেলোইনা। এই ব্যাপারটা মাথাতে কখনো আসেনি। তিলের আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। তার রিদ ভাইয়ার সাথে সে ফোনে একটুও প্রেমালাপ করলো না! তিলের ইচ্ছে হলো এখনি যদি একটু উনার ফোন ভয়েস শুনতে পারতো!

ভাবনায় ভাবনায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৩ টা বেজে ৫। মাঝরাত! রিদ ভাইয়াতো এখনো আসলোনা। তিলের ভেতরের অস্থিরতা এখন দ্বিগুন গুনে বাড়ছে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। উনি কি একটুও বুঝতে পারছেননা আমি কতটা চিন্তায় আছি?? আমাকে একটা কল দিলে কি এমন হয়???

তিল কাথা নিয়ে শুয়ে পরে আবার। ঘুমানোর চেষ্টা করে। হয় তো ঘুম ভেংগে দেখবো উনি আমার পাশে! এমন তো প্রতিরাতেই হয়। আজ কেন হবেনা? আজকেও হবে। উনি ঠিক আমার পাশে আসবেন। এসে বলবেন, তুই পড়া শেষ করিসনি কেন? যা কানে ধরে উঠবস কর। নাহলে বিয়ে ক্যানসেল।

এতো টেনশনে কি ঘুম আসে? আর ঘুম না আসলে রিদ ভাইয়া কিভাবে আসবে??? তিল আবার বিছানা ছেড়ে আম্মু আব্বুর রুমের সামনে চলে যায়। হালকা টুকা দিতেই রহমত আলী ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলেন।

“” তুই এখনো ঘুৃুমুসনি মা? কিছু হয়েছে?””

বাবার কথার উত্তর না দিয়েই টুপ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে তিল। আব্বুর ফোনটা নিয়ে রিদের নাম্বার খুজতে থাকে।

“” কি হয়েছে,তিল?””
“” কিছুনা,আব্বু। তুমি ঘুমাও। আব্বু তোমার মোবাইলটা একটু নিতে পারি?””

তিল নিজের রুমে এসে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে রিদের নাম্বারে। প্রথম কয়েকবার রিং বাজলেও ঐদিক থেকে কোনো রেসপন্স আসেনি। তিল পুনরায় কল করতে গিয়ে দেখে ফোন সুইচঅফ! তিলের ভয় হচ্ছে,সাথে খুব খারাপভাবে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদবেনা৷ মনে হচ্ছে কাঁদলেই খারাপ কিছু ঘটবে। তিল নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে নিজের আব্বুর ফোন থেকে নাম্বারটা নিজের ফোনে টুকে নিলো।নিজের নাম্বার থেকে কল দিয়েও যখন ফোনটা অফ পেলো,তিলের হাত পা কাঁপুনি উঠে গেলো। কিছুতেই আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা। বারবার শুধু কল দিয়ে যাচ্ছে।

~~
সকালে বড় আব্বুর চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে তিল। কাল রাতে রিদকে কল দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার জানা নেই। কিন্তু বড় আব্বু এভাবে চিল্লাচ্ছে কেন? উনি তো সচরাচর এমন চিল্লাচিল্লি করেনা। আর বাড়ি ভর্তি মেহমান সেখানে তো প্রশ্নই উঠেনা। রিদ ভাইয়ার কিছু হয়নি তো??? তিল দৌড়ে বড় আব্বুর রুমের কাছে চলে আসে।

“” বিয়ে হবেনা মানে? তোর মাথা কি ঠিক আছে রিদ? আজ তোদের গায়ে হলুূদ। বাড়ি ভর্তি মেহমান আর বলছিস বিয়ে হবেনা???””

রিদ চিৎকার করে বাবার উদ্দশ্যে বললো,
“” বিয়ে হবেনা সেটা কখন বললাম আব্বু? আমি বলেছি এখন হবেনা। তিলের পরীক্ষার পরে হবে!””

রিদের কথায় আমির সাহেব প্রচন্ড ক্ষেপে যান।

“” তোর কাছে কি বিয়েটা ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? তুই যখন চাইবি তখন বিয়ে হবে? তোর ইচ্ছেতেই সব? আমাদের ইচ্ছের কোনো মুল্য নেই?””

রিদ নিজের সামনে থাকা শোকেসটায় লাথি মেরে বললো,

“” হ্যা, হ্যা,হ্যা, আমার ইচ্ছেতেই সব। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন বিয়ে হবে। বেড়িয়ে যাও আমার রুম থেকে এখখুনি!””

রাগে আমির সাহেবের শরীর কাঁপছে। বাসা ভর্তি মেহমান। একটু পরেই গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে। বিয়ের কনে আর বর যেহেতু এই বাসারই সেহেতু আয়োজনটাও সেরকমই করা হচ্ছে। তার উপর এই বংশের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, যাকে পেয়েছেন তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যাদের সাথে কোনোদিন যোগায়োগ ছিলোনা তাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬০% মেহমান অলরেডি চলে এসেছে। অনেকেই রাস্তায় আছে। গায়ে হলুদ শুরু হতে হতে চলেও আসবে। আর এখন কিনা বলছে বিয়ে হবেনা। এটা কি হাতের মুয়া যে যখন তখন চিবিয়ে খেলে ফেলবে? আমির সাহেবের ইচ্ছে হলো ছেলেকে কয়েক গা বেত দিয়ে পিটাতে। নিহাত এতো বড় হয়েছে বলে এখনো নিজেকে বশে রেখেছে। সেই ছোট্ট রিদ হলে এতক্ষনে পিঠের ছাল তুলে বিয়ে পড়িয়ে দিতো।

আমির সাহেব ছেলেকে কঠিন কথা শুনাতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিল সামনে এসে দাড়িয়েছে। চোখের ইশারায় বুঝাতে চাচ্ছে,বড় আব্বু আপনারা রুমে যান আমি দেখছি উনার কি হয়েছে!

রিদ তখনো উল্টো হয়ে দাড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তিল ঠিক বুঝতে পারছে খুব রেগে আছে। খুব বেশিই মনে হয়। তিল গুটি গুটি পায়ে রিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তাতে রিদের উপর যেন প্রভাবই পড়লোনা। তিল আদুরী গলায় বললো,

“” কি হয়েছে আপনাল? কাল বাসায় আসেননি কেন? জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিলো? এতো কলে কল দিলাম ধললেনও না। আবাল এখন বলছেন বিয়ে কলবেননা। কি হয়েছে বলুননা, আমি কি কিছু ভুল কলছি? তাহলে আমাকে শাস্তি দিন!””
“” তিল,ছাড় আমাকে!””
“” না,আগে বলুন আপনাল কি হয়েছে? এমন কলছেন কেন? আল বিয়েটাই বা কেন কলবেননা?””

তিলকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো রিদ। সাথে সাথে তিলের চোখ ভিজে এলো।

“” আমি কেন বিয়ে করবো না তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে? তুই কি জবাবদিহির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছিস? করবোনা আমি বিয়ে কি করবি তুই? আমাকে পুলিশে দিবি? ফাঁসিতে ঝুলাবি??? একটু ভালোভাবে কথা বলেছি দেখে খুব সাহস বেড়ে গেছে না? এখন আবার জবাবও চাস? আর তোর না কিছুদিন পর পরীক্ষা? তুই এখানে কি করছিস? যা পড়তে যা। খবরদার যদি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে তোর বই খাতা সব ছিড়েছুড়ে তোকে খায়িয়ে দিবো। পরীক্ষা রেখে বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে। পা কেটে ফেলে দিবো তখন দেখবো তুই কিভাবে এতো লাফাস। এখনো যাসনি তুই? আরেকটা চড় খাবি?””

আজ অনেকদিন পর রিদকে এমন আচরন করতে দেখে তিল শকড হয়ে যায়। কাল রাতেও তো ঠিক ছিলো। হঠাৎ করে কি এমন হলো?

তিল গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এলো।

~~
নিজের জেদী ছেলের কাছে হার মানতেই হলো আমির সাহেবের। লজ্জায় যেন মাথা কাটা যাচ্ছে। সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বিদেয় করেছেন। নতুন করে বিয়ের কার্ড ছাপানো হচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলেও শুধু বিয়ের ডেটটা চেন্জ হয়েছে ১৭ মার্চের জায়গায় ৩ মে। রিদ কেন এমন করলো কেউ জানতে পারলোনা। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও তার দিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। শুধু এটাই বলেছে তিলের পরীক্ষার পরেই বিয়ে করবে।

এদিকে তিল পড়ার থেকে বেশি কান্নাতে মনোযোগ দিচ্ছে। আজ কয়েক দিন যাবত রিদের সাথে তার কোনো কথা হচ্ছেনা,শুধু কথা বলা বললে ভুল হবে সেদিনের থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে তার সাথে দেখাও হচ্ছেনা। রুম থেকে বের হচ্ছেনা,যা লাগে সব রুমেই দিয়ে আসা হচ্ছে। সবাই ঐ রুমে যেতে পারলেও তিলের যাওয়া মানা। খুব কঠিন করে মানা করা হয়েছে!

রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পায়না তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছি,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে