“ভালোবাসার প্রান্ত”(পর্ব-২১)
চোখ মেলে দেখলাম আমি কেবিনে শুয়ে আছি। প্রথমেই আমার দৃষ্টি পড়লো সীমান্তর দিকে। হৃদয় মন্দিরে লুকিয়ে রাখা মানব দেবতা আমার হাত ধরে বসে আছে। কাজী নজরুলের চোখের মতো আমার বরের চোখ দুটো। চুলগুলোও কাজী নজরুলের মতোই বাবরি। বেচারি কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছে। এখনও চোখের পাপড়িগুলো ভিজে জপজপে হয়ে আছে। আমি যে কী বলবো তা বুঝে পাচ্ছি না। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে যেন অনেক প্রার্থনায় তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তার চোখদুটো কত কী বলে চলেছে অথচ তার মুখে কোন শব্দ নেই। একটা মানুষকে কী ভয়াবহ আকর্ষণে কাছে টেনে আনে ভালোবাসা নামক বিস্ময়কর অনুভূতিটা। ভালোবাসা শুধুই এক অনুভূতিই নয়, ভালোবাসা হলো অসীম শক্তির খনি। সেই শক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। যেমন তার ভালোবাসার শক্তির প্রার্থনায় আমি আজ ফিরে এলাম। মূলত আমার ফিরে আসার কথা ছিল না।
আমরা দুজন নির্বাক দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। কোথায় থেকে শুরু করবো সেই ভাবনায় আমরা দুজনই নিশ্চুপ।
সে তার আরেকটা হাত গভীর মমতায় আমার চুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার টুনা মন বলল, “কতটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলেছিলে আমায়। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তবে এই আমিটা যে একটাও শ্বাস নিতে পারতাম না। তুমি আমার হৃদস্পন্দন। তুমি থেমে যাওয়া মানেই তো প্রাণহীন লাশ আমি। ফিরে এসে বাঁচিয়ে দিলে আমায়।”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/
তার টুনা মনের কথা শুনে আমার টুনি মন বলল, “তোমার বুকের বা পাশে কবর রচনা করতে গেছিলাম। অথচ তোমার বুকের প্রতিটা লোমের গোড়ায় গোড়ায় পৃথিবীর সব শান্তি জমে আছে। সেই বুকটার ঠিক বাম পাশের পাজরে আমার ছোট্ট কুটির আছে, যেটা আমার ঘর বসতি। সেখানেই হয়ত আমার সামাধি রচিত হতো। কিন্তু ভালোবাসার শক্তি দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনলে তুমি। নতুন করে শুরু হলো আমার জীবন। আমাকে যে ফিরতেই হতো সাহেব। তোমার হৃদয়ের গন্ডির ভেতরে মৃত্যুও যে ঢুকতে পারেনি।”
আমি তার হাতটা আলতো চেপে ধরে বললাম-
__কথা রেখেছি কিন্তু।
সে অভিমানের সুরে বলল-
__কতটা যন্ত্রণাময় যে ভালোবাসা হয় তা তোমায় ভালোবেসে বুঝেছি। আর কখনও আমাকে ভয়ানক কোনো পরিস্থিতিতে ফেলবে না। এখনি আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও!
তার গলার স্বর একদম ভেঙে গেছে। জানি না কতটা কেঁদেছে পাগলটা। আমি তার গালে হাত ছুঁইয়ে বললাম-
__কথা দিলাম। তুমি কেমন আছো? আমার প্রান্ত কোথায়?
রুমের ভেতরে সবাই আছে অথচ এতক্ষণ আমি কাউকে খেয়ালই করিনি। মামনি হাসিমুখে আমার সামনে এসে প্রান্তকে আমার পাশে শুইয়ে দিলেন। আমি নিষ্পলক আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার টুনটু পাখিটার চোখ দুটো সীমান্তর চোখের মতো হয়েছে। ঠোঁটও অবিকল। টপটপ করে আমার চোখ থেকে জল পড়ছে। এই অশ্রু খুব মূল্যবান। আমি আমার সীমান্তকে জীবনের সেরা উপহার দিতে পেরেছি, সেই আনন্দ অশ্রু এটা। একটা সন্তান পৃথিবীতে আনার জন্য একজন মা মৃত্যুর সাথে কতটা লড়াই করে তা নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। আমি তাকে আমার বুকে জড়িয়ে নিয়ে শ্বাস নিলাম। এটাকেই হয়ত মাতৃসুখ বলে।
তানি রুমে ঢুকে ডাক্তারনি ভাব নিয়ে বলল-
__সবাই এখন রুম থেকে বের হন। এখন বেবিকে ফিডিং করাতে হবে।
আমি সারাঘর তাকিয়ে দেখলাম, বাড়ির সবাই রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও সবার আতঙ্ক কাটেনি বোঝাই যাচ্ছে। আমার আব্বু আম্মুকেও দেখছি। তারা কখন এসেছে তাও আমি জানি না।
তানির কথামতো সবাই এক এক করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সীমান্ত আমার পাশে ঠায় বসেই থাকলো। নানান বেরিয়ে যেতেই দরজায় দাঁড়িয়ে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন-
__এই যে শিশুর পিতা, তোমাকে রুম থেকে বের করার জন্য কী উকিল নোটিশ পাঠাতে হবে?
__আমি থাকলে কী প্রবলেম? আপনি বাইরে যান।
তানি মুচকি হেসে সীমান্তকে বলল-
__প্রবলেম আছে। বাড়ি গিয়ে দেখিস বাচ্চারা কীভাবে ফিডিং করে। এখন বাইরে যা।
সীমান্ত করুণ চোখে তাকিয়ে বাইরে গেল। যেন তার ফাঁসির হুকুম হয়ে গিয়েছে। পাগল একটা!
⭐
হাসপাতাল থেকে আজ বাড়ি ফিরেছি। আজ আবার সেই চাঁদের হাট বসেছে। তবে আজকে ঘরে আমার চাঁদ উপস্থিত আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত সে বেজার মুখে সোফায় বসে আছে। খাট জুড়ে সবাই চাপাচাপি করে বসে আছে। খাটের এককোণে আমি শুয়ে আছি। নানুন প্রান্তকে কোলে নিয়ে বসে আছেন খাটের মাঝখানে। আর তাকে ঘিরেই বসে আছে সবাই। শুধু আমার বেচারা বরটাই খাটে বসার জায়গা পায়নি। সে মুখ বেজার করে একা একা সোফায় বসে আছে। কেউ যেন তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বাবা তো প্রান্তকে ছেড়ে অফিস যাওয়াও বাদ দিয়েছেন। আমার খাওয়ার অত্যাচার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
তানি রুমে ঢুকে বলল-
__এখন সোনাভাবীর ঘুম জরুরি। সবাই এই রুমে বসে হৈচৈ করলে সে ঘুমাবে কী করে?
তানির ভাবসাব আজকাল সারাক্ষণ ডাক্তারনির মতো। মাঝে মাঝে আমার হাসি পায়। অথচ এই আমি ছোটবেলায় ইনজেকশন এর ভয়ে ডাক্তারদের আশেপাশেও যেতাম না। ইনফ্যাক্ট ডাক্তারদের আমার কখনও আমাদের মতো মানুষ মনে করতে পারতাম না। অথচ আমার কপালে ডাক্তার লেখা ছিল।
নানান তানিকে বললেন-
__আমরা তো কেউ কথা বলছি না। আমরা শুধু প্রান্তকে দেখছি। তুমি অযথা বাড়িটাকে হসপিটাল বানিও না তো! তারচেয়ে বরং প্রান্তকে দেখো।
কথাগুলো বলেই নানান প্রান্তর কপালে চুমু খেয়ে বললেন-
__দেখো প্রেয়সী প্রান্ত আমার মতো দেখতে হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে হিরো। আমি জানতাম আমার ছোট রাণীর ছেলে আমার মতোই হবে। আরে আলট্রাসনোগ্রাফির ছবি দেখেই তো আমি বুঝেছিলাম যে, সে আমার কপি হয়ে আসছে।
তানি হতবাক হয়ে নানানের দিকে তাকিয়ে রইল। নানান খুব খুশি খুশি চোখে তাকিয়ে আছেন।
হঠাৎ বাবা নানানকে বললেন-
__বাবা প্রান্ত তো তার দাদানের মতো দেখতে হয়েছে। মানে আমার মতো দেখতে। দেখেন ওর ভ্রু চোখ সব আমার মতো।
নানান হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বড় আব্বু বাবাকে ধমক দিয়ে বললেন-
__কী সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছো? প্রান্ত তো তার বড় দাদান মানে আমার মতো দেখতে হয়েছে। তার ঠোঁট চিবুক গায়ের রং সব আমার মতো। হাসলে তো মনে হয় আমিই হাসছি।
বড় আব্বু খুব খুশি। তিনি প্রান্তর কপালে চুমু খেলেন।
আমি সীমান্তর দিকে তাকালাম। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে আমার খুব হাসি পেলো। তবে সত্যি এটাই যে, আমার ছেলের চেহারার সাথে আমার কোনোই মিল নেই। এসব নিয়ে আমার কোনো আফসোসও নেই। চেয়েছিলাম সে তার বাবার মতো হোক, সেটাই হয়েছে। এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।
তানি সবাইকে রুম থেকে বের করে দিলো। নানুন প্রান্তকে নিয়েই অন্য রুমে গেলেন। এক এক করে সবাই তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু আমার বর ঠায় বসে রইল। নানান বললেন-
__আজকেও কী তোমাকে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে রুম থেকে বের করতে হবে?
__এখন তো ফিডিং চলছে না, আমি থাকলে কি প্রবলেম?
__ছোট রাণী এখন ঘুমাবে। তুমি রুমে থাকলে তার ঘুম হবে না।
__আমিও ঘুমাবো। আপনি এখন বাইরে যান। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পরপুরুষ থাকতে নেই।
__কিহ আমি পরপুরুষ?
সীমান্ত জবাব দেবার আগেই তানি নানানের হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে গেল। তিনি রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে থেমে গেলেন।
সবাই বাইরে যেতেই সীমান্ত আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। আমার মাথায় হাত রেখে বলল-
__আমার জন্য কেন এমন ঝুঁকি নিয়েছিলে পাগলি?
আমি তার বুকে মুখগুজে বললাম-
__ওসব তুমি বুঝবে না।
__তোমাকে তো কাছে পাওয়াই দুষ্কর। বড় আম্মু আর মামনিকে কতবার বললাম আমি তোমার কাছে শোবো। মামনি বললেন, রাতে অনেকবার প্রান্তর কাঁথা চেঞ্জ করতে হয়। তোমাকে জাগিয়ে তাকে ফিডিং করাতে হয়। এসব নাকি আমি পারবো না। বড় আম্মু তো আমার কথা শুনে খুব হাসলেন।
আমি বললাম
__ মামনি তো ঠিকই বলেছেন। তুমি এসব পারবে নাকি?
__আমার সাথে তো তারাও থাকবেন।
__থাকতে হবে না। তিন মাস তুমি আলাদা ঘুমাবে।
সে অভিমানের সুরে বলল-
__তোমার আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে না?
__না তো।
সে তীব্র অভিমান নিয়ে তাকিয়ে বলল-
__তা ইচ্ছে করবে কেন? আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি।
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম-
__হ্যাঁ গো।
সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল-
__যাও দূরে সরো। আমার বুকে কী বের হয়েছে? সরো তো সরো!
__কেন?
__ভেবেছিলাম তুমি আর একটু সুস্থ হলে তারপর সবাই যখন রাতে ঘুমিয়ে যাবে তখন তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম-
__কোথায় পালিয়ে যাবে? আর কেন?
__অন্য রুমে। তার তো আর দরকার নেই।
__কেন দরকার নেই?
সে মুখভার করে বলল-
__আমার বউ তো আমাকে চায় না। আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি।
আমি শব্দ করে হেসে বললাম-
__তুমি আসলেই আধা পাগল না, ফুলপাগল। সব আমার কপাল। শেষে কী না আমি একটা পাগলের বউ।
কথাটা বলেই আমি তার বুকে মুখ গুজলাম।
হঠাৎ নানান দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন-
__এই তোমাদের ঘুমের নমুনা?
সীমান্ত লাফ দিয়ে বসে বলল-
__আপনি এখানে কেন?
নানান বেশ ভাব নিয়ে বললেন-
__বিয়ের আগে ডুবে ডুবে জল খেয়েছো দেখার সুযোগ ছিল না। বিয়ের পরে তোমাদের দরজায় অনেকবার উকি দিতে গেছি কিন্তু তুমি দরজা লক করতে ভুল করো না। আজকের চান্সটা মিস করি কি করে বলো তো?
সীমান্ত বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল-
__আপনি আমার বেডরুমেও উকি দিতে গিয়ে ছিলেন?
নানান খুব সাহসী ভঙ্গিমায় বললেন-
__হ্যাঁ
সীমান্ত করুণ সুরে বলল-
__এসব দুঃখের কথা আমি কাকে বলবো আল্লাহ!
নানান দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বললেন-
__আচ্ছা তোমরা ঘুমাও আমি দরজায় পাহারা দিচ্ছি যেন কেউ এই রুমে না ঢুকে।
আমরা দুজন মাঝখানে একহাত দূরত্ব রেখে শুয়ে রইলাম। কী এক বিপদ! দূর্বল শরীরে সত্যিই ঘুম চলে আসছে। সীমান্ত কাঁথার নিচে আমার হাত ধরে শুয়ে রইল। তার স্পর্শ যেন বলছে, “ছুঁয়ে থাকার মধ্যেও শান্তি আছে। কিছু হোক না হোক তুমি তো পাশে আছো।”
আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখলাম। সে ফিসফিস করে বলল-
__বুড়ো কিন্তু আবার রুমে উকি দেবে।
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম-
__দিক না উকি।
__তোমার লজ্জা করবে না?
__না
__আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে, লজ্জা টজ্জা ওসব আমার বউয়ের নাই।
আমি মাথা উচু করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম-
__কিহ?
সে তার বুকের সাথে আমার মাথা হালকা চেপে ধরে বলল-
__কিছু বলিনি তো। তুমি চুপ করে ঘুমাও তো। তোমার অনেক ঘুম দরকার।
শেষ পর্ব আসছে…..
বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।
Written by- Sazia Afrin Sapna
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
▶ লেখকদের জন্য পুরষ্কার-৪০০৳ থেকে ৫০০৳ মূল্যের একটি বই
▶ পাঠকদের জন্য পুরস্কার -২০০৳ থেকে ৩০০৳ মূল্যের একটি বই
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/