“ভালোবাসার প্রান্ত”(পর্ব-১৭)

0
1430

“ভালোবাসার প্রান্ত”(পর্ব-১৭)

যখন দু’জন মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয় তখন থেকে শুরু করে স্বপ্ন দেখা আর ফিউচার প্ল্যান শুরু হয়ে যায়। বিয়ের সময় আসার আগেই একই স্বপ্ন লক্ষবার দেখা হয়ে যায়। একই প্ল্যান লক্ষবার করাও হয়ে যায়। রিলেশন চলাকালীন প্রথম যেদিন সীমান্তকে বলেছিলাম আমার বেবি চাই এখনই। সে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে শুরু করেছিল। মূলত তাকে নার্ভাস করার লক্ষ্যেই কথাটা বলেছিলাম। তারপর একডজন বেবি চেয়ে তাকে নার্ভাস করা শুরু করলাম। একটাও বেবি নিতে যে মানুষটা রাজী নয় সে এক ডজনের কথা শুনে শেষমেশ একটা বেবি নিতে রাজী হলো। কিন্তু আমার তো এক ডজনই চাই। সে বলল, আমাদের বাচ্চার নাম ডজন রাখবো তাহলেই তো তুমি ডজনের মা হয়ে যাবে। কী বুদ্ধিমান স্বামী আমার! তারপর সেই একটামাত্র ডজনই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল। আমার একটা ছেলে হবে, যে অবিকল হবে তার বাবার মতো। আমি তার নামটাও তার বাবার নামের সাথে মিল রেখে ঠিক করে ফেললাম। বাবার নামের মিনিং আর ছেলের নামের মিনিং সেম। নামটাও সুন্দর। নামটা এখন গোপনেই থাকুক। তবে আমি তার আরেকটা নাম রাখলাম আমাদের দুজনের লুকিয়ে রাখা নামের সাথে মিল রেখে। আমি অনেক বছর আগে আমার ভেতরের মনের নাম রেখেছিলাম টুনি। সীমান্তর সাথে রিলেশন হবার পরে তার ভেতরের মনের নাম রাখলাম টুনা। আমাদের এই টুনা টুনির সাথে মিল রেখে আমাদের ছেলের নাম রাখলাম টুনটু পাখি। যে নামে শুধুই আমি তাকে ডাকবো। সীমান্তকেও টুনটু পাখির বাবাই বলে ডাকতাম। আমি চোখ বন্ধ করে দিনরাত আমার টুনটু পাখিটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এক সময় আমি রিয়্যালাইজড করলাম যে, আমি যেন সত্যিই মা হয়ে গিয়েছি আর আমার সেই অনাগত সন্তানের বাবা সীমান্ত। অথচ তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। তারপর একটা প্লাবণ এলো আর সব স্বপ্ন ভেসে গেল। মানুষটা বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছে। সন্তানের বিনিময়ে আমাকে হারাতে চায়নি। কী আজব ভালোবাসা তার! সীমান্তর মন জুড়ে সন্তানের স্বপ্ন আর নেই। কিন্তু আমি খড়কুটোর মতো আমার স্বপ্নটাকে খুব গোপনে বাঁচিয়ে রাখলাম। আমাদের বিয়ে হলো সংসার হলো, কিন্তু যখনই আমি বেবির জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছি তখনই সীমান্ত চুপসে গিয়েছে। দিনে দিনে আমিও থেমে গেছি। তাকে আর কখনও বলা হয়নি যে, আমি বেবি চাই এখনি! কিন্তু আমার টুনি মন খুব গোপনে সহস্রবার বলেছে “আমার টুনটু পাখিটাকে চাই।” একজন পুরুষ কখনও বাবা ডাক শুনবে না, এটা মেনে নিয়েও সে আমাকে ভালোবেসেছে। আমি স্বার্থপরের মতো কখনও তাকে বলিনি যে, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। আমার শুধু মনে হয়েছে সীমান্ত আমার শুধুই আমার। সে মরলেও আমার সাথেই মরবে আর বাঁচলেও আমার সাথেই বাঁচবে। আমাদের মাঝে আর কেউ ঢুকবে না। দরকার নেই আমাকে ছাড়া তার সুখী হবার। আমি সত্যিই বড্ড স্বার্থপর। আমার জীবন রক্ষার জন্য যে মানুষটা বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিতে পেরেছে, তাকে বাবা বানানোর জন্য আমি জীবন দিতে পারবো না, তা কী করে হয়? ভালো কী শুধু সে-ই বাসতে পারে? আমি পারি না? নিঃসন্তান নারীর সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো, সে মা হতে পারবে না এটা নয়। বরং সে তার স্বামীকে বাবা বানাতে পারবে না এটাই বড় কষ্ট।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/



গর্ভধারণের পরে যে কথাগুলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয় যেমন, ছেলে চাই নাকি মেয়ে চাই, সন্তানকে ডাক্তার বানাবো নাকি ইঞ্জিনিয়ার বানাবো, তার কী নাম রাখা হবে, সে দেখতে কার মতো হবে, কার বৈশিষ্ট্য পেলে ভালো হবে ইত্যাদি। এই সব কথাই আমাদের বিয়ের আগে কয়েকশ বার বলা হয়ে গিয়েছে। তখন আমাদের জীবনে একটা সন্তানের স্বপ্ন ছিল। এখন তাই আর এসব কথা বলা হয় না। বলতে ইচ্ছে করলেও সাহস পাই না। তবে এখন এমন কিছু হয় যেটা আমাদের বিয়ের আগে দেখা স্বপ্নের ভেতরে ছিল না। শরীর ঠিক নেই বলে চুল চিরুনি করতে ইচ্ছে করে না, শ্যাম্পু করতেও ইচ্ছে করে না। কাজল টিপ পরা তো অনেক দূরের কথা। ফ্যাকাশে এই চেহারা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ইচ্ছে করে না। মনে হয় এটা আমি নই। মামনি আমাকে শ্যাম্পু করিয়ে গোসল না করালে হয়তো আমার গোসল শ্যাম্পু কিছুই হতো না।

আমার বর একদিন চিরুনি হাতে আমার পাশে বসে বলল-
__মা হবার সাধ ছিল, হয়েছো। তাই বলে নিজের একটুও যত্ন করবে না?

__তুমিই তো আমাকে খাট থেকে নামতেই দাও না।

সে কিছু না বলে আমার পেছনে বসে চুল চিরুনি করতে শুরু করলো। আমি তো হতভম্ব হয়ে হা করে বসে রইলাম। হঠাৎ সে আমার চুলে নাক ডুবালো। আমি চোখ বন্ধ করে বললাম-
__গর্ভবতী বউয়ের চুলে নাক ডুবাতে নেই।

সে বিস্ময়ের স্বরে বলল-
__কেন?

আমি দুষ্টুমি করে বললাম-
__নেশা ধরে যাবে।

__নতুন করে কী আর নেশা ধরবে? এসব নেশার বশীকরণ তাবিজ করেই তো রেখেছো।

আমি অবাক হয়ে বললাম-
__কীসের নেশার বশীকরণ করেছি?

__চুলের ঘ্রাণের নেশা, হাসির শব্দের নেশা, চোখের চাহনির নেশা। আরও কত নাম না জানা নেশা।

__তাহলে তো আমি তান্ত্রিক হয়ে গেছি দেখছি।

__কবিরাজ তো আগে থেকেই ছিলে। বিয়ের আগে ফোনে দোয়া পড়ে ফু দিতে, মনে আছে? ডাক্তারকেও তুমি ঝাড়া দিতে ছাড়োনি ডাকাত মেয়ে।

আমি হাহা করে হাসলাম। সে সুন্দর করে চুল আচড়ে বেনিও করে দিলো। আমি এবার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে বললাম-
__এই তুমি বেনি করা শিখলে কার কাছে থেকে?

__গত সাত দিন ধরে ইউটিউবে বেনি করার ভিডিও দেখছি। চুল তিন ভাগ করে কার মধ্যে ঢুকিয়ে কোন দিক দিয়ে বের করলো সেটা বুঝতে আমার সাত দিন লেগেছে। আসলেই তোমরা মেয়েরা খুব পেঁচুক। তাই তো এমন কঠিন প্যাঁচ দিয়ে তোমরা চুল বাঁধতে পারো।

আমি হেসে বললাম-
__তুমিও তো মেয়েদের মতো পেঁচুক হয়ে গেছো দেখছি।

__বউয়ের জন্য বাধ্য হয়েই হতে হলো।

__এরপর সবাই তোমাকে বউ পাগল বলবে।

__যার যা ইচ্ছে বলুক।

__তুমি কী বউ পাগল?

__আমি বউ পাগল কী না জানি না, আমি শুধু জানি আমি আমার বউকে ভালোবাসি।

__আমি কিন্তু মোটেও বর পাগল না, বুঝলে?

__সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

কথাটা বলেই সে আমার বেনির ভাজে ভাজে কাঠগোলাপ গুজে দিলো। তারপর আমার কপালে ছোট্ট একটা টিপ পরিয়ে দিয়ে বলল-
__এমন সেজে থাকবে সব সময়। এখন চলো তোমাকে আকাশ দেখাবো।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-
__মানে?

সে আমার হাত ধরে বলল-
__চলো তো।

সে আমাকে ধরে ধীরে ধীরে ছাদে নিয়ে গেল। আমি আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে বিকেলের হালকা মিষ্টি বাতাসের গন্ধ নিলাম। এই বিকেলটা স্নিগ্ধ নয়, সীমান্ত বিকেলটাকে স্নিগ্ধ করে দিয়েছে। আচ্ছা সবার স্বামীই কী এমন করে বউকে ভালোবাসে? সব মেয়ের স্বামীই কী সীমান্তর মতো ভালোবাসার হিমালয়? সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছাদেই থাকলাম। সে আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো। বর সাহিত্য প্রেমী হলে এই একটা সুবিধা। আল্লাহ আমার কপালে সুবিধা লিখেছেন, কি আর করা!

সেদিন থেকে আমার বরের ডিউটি হয়ে গেল, আমার চুল বেনি করে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে তারপর ছাদে আকাশ দেখাতে নিয়ে যাওয়া। আর আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, তার বেনি করতে এতই ভালোলাগে যে, সে কম পক্ষে দশবার বেনি করবে আর খুলবে। শেষমেশ আমার কপালে আধা পাগল বর জুটলো আল্লাহ!


শুনেছি প্রেগনেন্ট হলে প্রতি মাসে চেকআপ করতে হয়। খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ পর পর করা যায়। তাই বলে প্রতিদিন চেকআপটা আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে। আমার ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির বাহিরে তানি আর আমান ভাইয়ের রাত্রিবাস নিষিদ্ধ করেছেন বাবা। ডাঃ তানিয়া রোজ রাতে আমাকে চেকআপ করে তবেই সে ঘুমায়। কতবার বলেছি, সপ্তাহে একবার করলেই তো হয়। কে শোনে কার কথা! বাড়িতে দুইজন ডাক্তার থাকলে সেই বাড়ির প্রেগনেন্ট অবলা মেয়েটার কী হাল হয় তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। স্বাস্থ্যকর আর অস্বাস্থ্যকর এর বিড়ম্বনায় আমার তো মাঝে মাঝে হাসফাস লাগে।

এদিকে আমার বর আমাকে বেড থেকে একা নামতে দিতে চায় না। সে অফিসে বেরিয়ে গেলে তবেই আমি একা একটু হাটাচলা করার সুযোগ পাই। তাও একটু জোরে হাটা যাবে না। নানুন সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখেন। এসব নিয়েই যেন বাড়িতে রোজ আমাকে ঘিরে উৎসব হয়। আমি অবশ্য এটা আগে থেকেই জানতাম। বংশের একমাত্র সন্তানের সন্তান আসতে চলেছে, উৎসব হওয়াটাই স্বাভাবিক। নানান তো ইদানিং বাহিরে যেতে ভুলেই গিয়েছেন। আমাকে রোজ নিয়ম করে জিজ্ঞেস করেন, “নড়াচড়া টের পাচ্ছো ছোট রাণী?”
আমি লজ্জা পাবার চেয়ে বেশি অবাক হই। তিন মাসে কী এমন নড়াচড়া হবে? কিন্তু নানানের যেন তর সইছে না। তার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, বাচ্চা আজকেই নড়ুক আর কালকেই ডেলিভারি হোক তবেই তার শান্তি। নড়াচড়া টের পাই না শুনে তিনি হতাশ চোখে চেয়ে থাকেন।

ভালোবাসার অনুভূতিগুলো সত্যিই অদ্ভুত। কাছের এই মানুষগুলোর এত ভালোবাসা, এত যত্ন ছেড়ে কোন মানুষটা মরতে চাইবে? তবুও মা হবার এই ভয়ানক ভাগ্য পরীক্ষায় আমরা মেয়েরা অবলীলায় দাঁড়িয়ে যাই। মা হবার সুপ্ত বাসনার কাছে মৃত্যুভয় যেন পরাজিত। কিন্তু সীমান্ত তার স্ত্রী হারানোর ভয়টাকে পরাজিত করতে পারেনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যখন দেখি স্বামী নির্ঘুম দুশ্চিন্তায় বিভোর হয়ে শুয়ে আছে, তার চোখদুটো ভিজে চুপসে আছে তখন যে ভয়টা পাই তা কিছুতেই পরাজিত করতে পারি না।
তার ইচ্ছের বাহিরে আমার এই মা হতে চলাটাকে সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। অথচ আমি ঘুমিয়ে গেলে সে আমার পেটে হাত রেখে তার সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে। চুপিচুপি চুমু খায়। আমি চুপচাপ ঘুমের ভান করে থাকি। তার এই প্রকাশ্য কষ্ট আর অপ্রকাশ্য সুখের রহস্যটা আমি আর সে ছাড়া কেউ জানে না।

বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।

পরের পর্ব আসছে…
Written by- Sazia Afrin Sapna

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

▶ লেখকদের জন্য পুরষ্কার-৪০০৳ থেকে ৫০০৳ মূল্যের একটি বই
▶ পাঠকদের জন্য পুরস্কার -২০০৳ থেকে ৩০০৳ মূল্যের একটি বই
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে