“ভালোবাসার প্রান্ত”(পর্ব-১৯)

0
1725

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১৯)

আমার টুনটু পাখির বাবাই সোনা,

আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ কারণ তুমি সীমান্ত। তোমার জন্যই আমি সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি। কতটা নির্মল শুভ্র এই বেঁচে থাকা। কয়জন নারী এমন সীমান্তময় ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে বলো? সেই সৌভাগ্য নিয়ে আমি এসেছি। এরচেয়ে বড় স্বার্থকতা আমার জীবনে আর নেই। এই স্বার্থকতা আমি কখনও বিশ্লেষণ করে বোঝাতে পারবো না।

প্রথম প্রেমের অনুভূতির কথা তোমার মনে পড়ে সাহেব? আমার তো খুব পড়ে। সারাক্ষণ তোমার ভাবনায় মগ্ন থেকে কতদিন যে চা পুড়িয়ে ফেলেছি তার হিসেব আমার কাছেও নেই। কী অদ্ভুত সুখের এক অনুভূতি। থেমে থেমে মনে শিহরণ জাগিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে। সারাদিন তোমায় নিয়ে ভেবে ভেবে কখনও না ক্লান্ত হয়েছি, না বোর হয়েছি। ভালোলাগাটা যেন সেই প্রথম দিনের মতোই থেকে গিয়েছে। আর কতশত সহস্রবার যে ঘুরে ফিরে তোমার প্রেমেই পড়েছি তার হিসেব নেই।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/



জীবনের অনেক কঠিন সময় আমি পার করেছি। তখন আমাদের প্রেম চলছিল খুব গোপনে, কোনো কারণে আম্মু যখন আমাকে বকতো বা কেউ কিছু বলতো তখন তোমাকে ফোন করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেটে কেজি কেজি চোখের জল ফেলে অভিযোগের ডালি নিয়ে বসতাম। আমাকে কেউ বকলে বা দুটো কটু কথা বললে তুমি সহ্য করতে পারতে না, হোক সেটা আমার বাবা মা। তুমি প্রকাশ না করলেও তোমার টুনা মন চেঁচিয়ে বলে উঠতো, “আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কটু কথা বলার রাইট কারোর নেই। সে শুধুই আমার। আমি তাকে বকবো, রাগ দেখাবো, অভিমান করবো, কষ্ট দেবো। আবার আমিই তাকে আদর ভালোবাসায় সব ভুলিয়ে দেবো।”
তোমার এই অপ্রকাশ্য কথাগুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, এই পৃথিবীতে সবাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে একজন আছে, যে কখনও আমার দিক থেকে কোনো কারণে কোনো পরিস্থিতিতেও মুখ ফিরিয়ে নেবে না। যার মনের পৃথিবীর সবটা আমার দখলে। যার জীবনটা আমিময়। যে শত ব্যস্ততার ভীড়েও আমার কথা ভেবে উদাস হয়। যে আমার এতটুকু অসুস্থতার খবরে অস্থির হয়ে যায়। যার বন্ধ চোখের আঙিনায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
জানো সাহেব, এই বিশ্বাস ভরসা আর আস্থা আমাকে সব লড়াইয়ে জিতিয়ে দিয়েছে, আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি যখনই ভেঙে পড়তে চেয়েছি ঠিক তখনই তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়েছো। সেই তুমিটাকে ছাড়া আমার জীবনের একটা মিনিটও নেই। কিন্তু জীবনের এই বড় রিস্কটা আমাকে নিতেই হতো। প্রথমত আমি তোমাকে একটা সন্তান উপহার দিয়ে তোমাকে বাবা হবার স্বাদ অনুভব করাতে চাই। দ্বিতীয়ত, তোমার এই বিশাল রাজ্যে একটা রাজপুত্র দরকার। যে বংশের দীপ হয়ে জ্বলবে। খুশি আনন্দে ভরিয়ে দেবে বাবা আর মামনির জীবন। এর জন্য যদি আমি মরেও যাই তবুও আমি খুব আনন্দিত। তোমার সাথে কাটানো অল্প কয়েকটা বছরকে আমি অপ্রকাশ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলাম। এই সুখের দিনগুলোর অনুভূতি নিয়েই আমি হাসিমুখে পৃথিবী ছাড়বো।

আমার গর্ভে তোমার সন্তান বেড়ে উঠছে তোমার বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সে দেখতে হবে অবিকল তোমার মতো। তোমার চোখ, তোমার নাক, তোমার ঠোঁট, তোমার চুল, সব অবিকল তোমার মতো হবে। তাই তো তার এমন একটা নাম রেখেছি যে নামের অর্থ আর তোমার নামের অর্থ একই।
সে আমার কিছুই পায়নি বা পাবে না বলে, আমার কিঞ্চিত আফসোস নেই। কারণ আমি সবসময় চেয়েছি সে তার বাবার মতো হোক।
তোমার মতোই সে কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকবে। তার মন চাইবে তার মায়ের গল্প তোমার থেকে শুনতে। কিন্তু তোমাকে সেটা মুখফুটে বলতে পারবে না। তুমি আমার ছেলেটার মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করবে কিন্তু। তাকে তার ডাকুরানী বখাটে মায়ের সব গল্প রোজ একটু একটু করে শোনাবে। সব গল্প শেষ হবার পরেও তার মন আবার প্রথম থেকে তার মায়ের গল্প শুনতে চাইবে। তুমি তাকে আবার প্রথম থেকে শোনাবে। মানুষ প্রিয়জনের গল্প বারবার শুনতে চায়। শতবার শুনে মুখস্ত হয়ে যাবার পরেও শোনার তৃষ্ণা থেকেই যায়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
সাবধান! গল্প শোনানোর সময় তোমার চোখে যেন জল না আসে। তাহলে সে আর গল্প শুনতে চাইবে না, কারণ পৃথিবীর কোনো সন্তানই বাবার চোখের জল সহ্য করতে পারে না। তোমার কাঁন্নার কারণে সে তার মাকে জানতে না পারার আক্ষেপ তার ভেতরে পুষে রাখবে। হয়তো ভাবছো, এসব ভবিষ্যৎ আমি কেমন করে জানলাম? এই প্রশ্নটা যে কেউ করবে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই, নেই কোনো ব্যাখ্যা। তবে আধ্যাত্মিক বলেও কিছু একটা হয়। যেটার জোরে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আমি তোমার মন পড়ে এসেছি। প্রথম প্রথম তো তুমি ভীষণ অবাক হতে। তোমার না বলা কথা আমি নিখুঁত ভাবে বলছি কী করে এটা নিয়ে তোমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বারবার আমাকে প্রশ্ন করতে, আমি তোমার মনের কথা জানলাম কী করে। আমি বরাবরই বলে এসেছি, সব আমার টুনি মন বলে দেয়। আজকেও সেটাই বলছি সাহেব। আমার রাজপুত্তুরকে নিয়ে বলা ভবিষ্যৎ কথাগুলো আমার টুনি মন বলেছে। আমাদের ভালোবাসাও যে ঐশ্বরিক ছিল তা তোমার অজানা নয়। তার অসংখ্য প্রমান তোমার আমার কাছে আছে। এসব তুমি আর আমি ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না, করার দরকারও নেই। আর ওসব আমি কখনও প্রকাশ করতেও চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, দক্ষিণ বঙ্গের সীমান্ত আর উত্তর বঙ্গের এই আমিটার মিলন আধ্যাত্মিক ভাবেই হয়েছে।

তোমাকে রাগানোর জন্য অনেকবার বলেছি, আমার ছেলেকে ডাক্তার বানাবো না। তাকে নায়ক বা গায়ক বানাবো। তুমি বারবারই বলেছো, তোমার ছেলেকে তুমি ডাক্তারই বানাবে। আজ বলছি, আমাদের ছেলেটাকে তুমি তোমার মতো সৎ ডাক্তার বানাবে। সে যেন তোমার মতোই অসহায় দরিদ্র মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেও যেন তার বাবার মতো রোজগারের সব টাকা অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দেবার মানুষিকতা নিয়ে বড় হয়।

জানো সাহেব, তোমার সাথে আমার হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে। সূর্যটাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর সব ঘড়িগুলো নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করে, যেন সময় আমাদের জন্য একজায়গায় থেমে থাকে। তা তো বাস্তবিক ভাবে সম্ভব নয়। ইচ্ছে ছিল দারুণ একটা প্রবীণ জীবন হবে আমাদের। আমরা ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে হৈহৈ করে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে একসাথে সহমরণে যাব। যেন একজনের মৃত্যু আরেকজনকে কষ্ট দিতে না পারে। আসলে ভাগ্য বড্ড বেঈমান তাই মনের স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা গুলো অপূর্ণই থেকে যায়। জীবনটা কেন আমার লেখা গল্পগুলোর মতো সাজানো গোছানো হয় না? কেন গল্পের মতো চাইলেই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া যায় না? কেন সাহেব?
আমি আল্লাহর কাছে এতগুলো বছর ধরে প্রার্থনা করেছি যে, আমি আমার স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে চাই। সেই প্রার্থনা যদি কবুল হয়ে থাকে তবে আমি নিশ্চয়ই তোমার বুকে আবার ফিরে আসবো। তারপর কোনো এক শুভক্ষণে আমরা একসাথে পৃথিবী ছাড়বো। আর যদি ফিরে আসতে না পারি তবে ক্ষমা করে দিও তোমার সোনাবউকে।

__তোমার টুনটু পাখির মা

চিঠিটা ভাজ করে আমার ডায়েরির ভেতরে রাখলাম। আমি জানি সীমান্ত একদিন ঠিক এই ডায়েরিটা দেখবে। যদি ভাগ্য আমাকে ফিরিয়ে আনে তবে সে দেখার আগেই চিঠিটা ছিড়ে ফেলবো। আর যদি ফিরে না আসি তবে আমার টুনটু পাখির জন্য এই চিঠিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মনটা খুব বিচলিত আজ। শরীরটাও ঠিক লাগছে না। ডেলিভারির ডেট আসতে আরও দশ দিন বাকী আছে। এখন রাত বারোটা বাজে, সীমান্ত অল্পক্ষণেই রুমে আসবে। ইচ্ছে করছে আজ না ঘুমিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটা রাত পার করে দিই। কিন্তু আমার রাগী ভদ্রলোক বর সেটা কিছুতেই মানবে না।


রাত দুইটায় আমার হালকা ব্যাথার অনুভবে আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সীমান্ত ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সীমাহীন মায়া উপছে পড়তে শুরু করলো। তাকে ডাকতে বুক কেঁপে উঠছে। অন্য কাউকেও এতরাতে ডাকতে বিবেকে বাঁধা দিচ্ছে। ব্যাথা বাড়ছে, আমি আর শুয়ে থাকতে পারছি না। যেন আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে শুয়ে থাকতে। বিছানা থেকে খুব কষ্টে নামলাম। মেঝেতে হাটাহাটি করছি। এতে একটু ভালো লাগছে। ডেলিভারির ডেট আরও দশদিন পরে, তাহলে এমন করে পেটব্যাথা কেন করছে? এটা লেবার পেইন কী না বুঝতেও পারছি না। ঘুমন্ত সীমান্তর দিকে তাকালাম। কেমন শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে সে। মুখটাকে বড্ড নিষ্পাপ আর পবিত্র লাগছে। পেটব্যাথা থেমে থেমে খুব চাড়া দিয়ে উঠছে। তাকে ডাকতে মন চাইছে না কিছুতেই। অনেকদিন হলো মানুষটা ঠিকমতো ঘুমায় না। সারাক্ষণ আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে তটস্থ থাকে। আমাকে হারিয়ে ফেলবে সেই ভয়ে সে বাবা হবার স্বপ্নটাকে কবর দিয়েছিল সেই বিয়ের আগেই। আমাদের রিলেশন চলাকালীন আমি একবার অসুস্থ হয়েছিলাম। কিছু টেস্ট করানোর পর সেই রিপোর্ট গুলো সীমান্তই দেখেছিল। গর্ভধারণে আমার জীবনে ঝুঁকি আছে। আর বেবিটাও সুস্থ হয়ে জন্ম নেবার সম্ভাবনা খুব কম। এসব কিছু জানার পরে সে বাবা হবার স্বপ্নটাকে বলি দিয়ে দিলো। শুধু এই কারণেই সে আমার এই গর্ভধারণকে মেনে নিতে পারেনি। বিগত নয়টা মাস ধরেই সে দিনরাত আতঙ্কিত থাকে। হয়তো প্রথম দিন থেকেই সে আমার জীবনের শেষ প্রহরটা গুনে চলেছে।

আমি বেলকোণ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রুমের ভেতরে হাটাহাটি করলে তার ঘুম ভেঙে যাবে। রাতটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও, লাইট এর আলোতে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিরব নিস্তব্ধ শহর। এখানে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া পর্যন্ত আমাকে যেমন করেই হোক অপেক্ষা করতে হবে। আমি কী তবে জীবনের শেষ সকালটা দেখতে চলেছি? সত্যিই যদি আমি আর ফিরে না আসি তবে ঐ মানুষটাকে বাকী জীবন কে সামলাবে? সে কী নিজের খেয়াল রাখতে পারবে? রাখতে পারলেও রাখবে না জানি। তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দেবে। হে আল্লাহ জীবনে স্বামীর ভালোবাসা যখন এত উড়ার করেই ঢেলে দিলে আমার জীবনে, তবে আয়ু এত কম দিলে কেন?

পরের পর্ব আসছে…

বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।

Written by- Sazia Afrin Sapna

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

▶ লেখকদের জন্য পুরষ্কার-৪০০৳ থেকে ৫০০৳ মূল্যের একটি বই
▶ পাঠকদের জন্য পুরস্কার -২০০৳ থেকে ৩০০৳ মূল্যের একটি বই
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে