ভাঙা বাড়ি পর্বঃ ০২
– আবির খান
হঠাৎ আমার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি পিছনে তাকিয়ে এমন কিছু দেখি যা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি দেখি দুটো চোখ। কোনো দেহ নেই। কিন্তু সেই চোখ থেকে রক্ত ঝরছে। আমি এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে জোরে চিৎকার করে উঠি। আর সেই সাথে আমার ঘুম ভেঙে যায়। একলাফে উঠে বসি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমি কেবিনেই আছি। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি লঞ্চ এখনো চলছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি ৪.১৫ বাজে। ভয়ে ঘেমে অবস্থা খারাপ। গলাটাও শুকিয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছিনা এসব কি হচ্ছে আমার সাথে। পাশের জগ থেকে পানি ঢেলে একগ্লাস পানি খেলাম। জানে যেন জান আসলো। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে। তাই ফোনটা হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। বাহিরে এসে চেয়ারে বসলাম। কেউ নেই করিডরে। সবাই সবার কেবিনে ঘুমাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস এসে আমাকে স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে। বেশ ভালোই লাগছে এখন একটু। এতোক্ষণ ভিতরে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কি হচ্ছে আমার সাথে এসব বুঝতে পারছিনা। কোনো দিন এমন খারাপ অবস্থায় পরিনি। আমি চেয়ারে বসে অাছি হঠাৎ লঞ্চের করিডোরের শেষভাগে অর্থ্যাৎ ওয়াশরুমের ওখানে আমার নজর যায়। আমি দেখছি, কেমন জানি এক কালো কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। জিনিসটা স্পষ্ট না। আমি ভালো করে চোখটা মুছে আবার তাকালাম। এখন মনে হচ্ছে সেই কালো অবয়বটা ধীরে ধীরে আমার কাছে আসছে। আমার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। হাত-পা কেমন জানি নিথর হয়ে আসছে। মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। জিনিসটা আমার অনেক কাছে এসে পরেছে। আমার হাত পা সমানে কাঁপছে। অবয়ব যেইনা আমার একদম কাছে আসলো ঠিক তখনই,
— আল্লাহু আকবর….আল্লাহু আকবর।
আজান পড়লো। সাথে সাথেই অবয়বটা হাওয়ায় মিলে গেলো। আমার শরীরটাও এখন কেমন জানি হালকা হালকা লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে রুম লক করে ওযু করতে চলে গেলাম। ওযু করে নামাজ পড়ে আসলাম। নামাজ শেষ হতেই লঞ্চ পৌঁছে গেলো বরিশালে। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলাম যেন সকল বিপদ আপদ থেকে তিনি রক্ষা করেন। কারণ আল্লাহ ছাড়া আমাদের বাঁচানোর ক্ষমতা আর কোরো নেই। ৫ টার দিকে লঞ্চ পৌঁছালেও আমরা লঞ্চ ছাড়ি ৭ টার দিকে। কারণ ওই অন্ধকারে গ্রামের বাড়ি যাওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না। লঞ্চ থেকে নেমে ব্যাগ নিয়ে সোজা সিনজিতে উঠে আমাদের গ্রামে চলে গেলাম। মেইনরোডে নেমে পরলাম আমরা৷ মেইনরোড থেকে একটা রাস্তা ভিতরে গেছে। এই রাস্তার শেষ মাথায়ই আমার দাদা বাড়ি। আমি ব্যাগ নিয়ে একটা রিকশায় উঠলাম। আর বাবা-মা এক রিকশায়। তারা আগে আমি তাদের পিছনে। রিকশা চলছে আর আমি আশেপাশে দেখছি। রাস্তার দুই ধারে বিশাল মাঠ। কি সুন্দর আমাদের বাংলার সৌন্দর্য্য। বড় বড় গাছ। অপরূপ সৌন্দর্য্যের সমাহার। আমি মুগ্ধ হয়ে সবটা দেখছি। অনেক বছর পর গ্রামের মাটির ঘ্রাণ পাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। আস্তে আস্তে এই সৌন্দর্য্য কেমন জানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর ঘন জঙ্গলের মতো রাশিরাশি গাছে ঢাকা চারপাশ। এখন কেমন জানি ভয় হচ্ছে। এই ঘনঘটার মাঝে একটা ভাঙা বাড়ি চোখে পরলো। কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে। বাড়িটা দিকে তাকাতেই গা’টা কেমন শিহরণ দিয়ে উঠছে। বাড়িটা কালো আঁধারে ঢেকে আছে। কিছু সময়ের জন্য মনে হলো বাড়ি থেকে আমাকে কেউ ডাকছে।
— রুমেল…..
আমি ওই বাড়ির দিকে আর না তাকিয়ে সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। একটু পরই দাদা বাড়ি পৌঁছে গেলাম। সেখানে চাচারা আর ফুফিরা আছেন। সবাই আমাদের দেখে অনেক খুশি হলেন। বিশেষ করে আমাকে। আমি সবার সাথে কথা বললাম। আমার দাদা বেঁচে নেই। খালি দাদি আছেন। তিনি নাকি ঘুমাচ্ছেন তাই আর তার সাথে দেখা করতে যাইনি। আমার দাদা বাড়িটা চারদিকটা কেমন জানি ভূতুড়ে। আমাকে একটা রুম দেওয়া হলো। আমি ভিতরে গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম। মাথার উপর ফ্যানটা তার আপন গতিতে ঘুরছে৷ আমি ক্লান্তিতে চোখ বুজে ছিলাম। হঠাৎ কি যেন ভেবে চোখটা খুলে দেখি সেই কোলো অবয়ব টা ছাদের সাথে লেগে আছে। আমি আঁতকে উঠে ভয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেলি। গলা শুকিয়ে গেছে মুহূর্তেই। আমি মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চাচ্ছি। তারপর আস্তে করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি কিচ্ছু নাই উপরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
— এসব কি হচ্ছে আমার সাথে!!! এসব আর নিতে পারছি না আমি। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো।
এরপর ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে নাস্তা করে গেলাম দাদির সাথে দেখা করতে। সবাই দাদির কাছে বসে ছিলো। আমি একটু পরেই দাদির কাছে যাই। সবাইকে ঠেলে যখন দাদির সামনে গিয়ে দাঁড়াই বাবা পাশ থেকে বলেন,
— মা, মনে আছে আমার ছেলে রুমেল। তুমি যাকে সবসময় বেশি বেশি আদর করতে।
সবাই দাদির দিকে তাকিয়ে আছে। দাদি অত অসুস্থ না। শুধু দূর্বল। দাদি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দাদি ইশারায় আমাকে কাছে ডাকে। আমি দাদির কাছে গিয়ে বসি। দাদি আমার ডান হাতটা ধরে চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকে। তারপর কি যে হলো দাদির, দাদি অস্থির হয়ে বাবাকে যা বলল তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না,
— তুই ওকে নিয়ে এলি কেন??? ওতো আসতে চায় নায়। কেন ওকে জোর করে আনলি??? রাগী ভাবে।
— না মানে মা, তুমি অসুস্থ তাই। (বাবা)
— কেনো মা কি হয়েছে??? (মা)
— ওর যে অনেক ক্ষতি হতে পারে এখানে।(দাদি)
উপস্থিত সবাই চুপ করে আছে। প্রায় ১৫/১৬ জন ওখানে ছিলো। দাদি ওই অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে বসেন।
— রফিক(বড় চাচা), পানির বোতলটা দে। (দাদি)
চাচা একটা পানির বোতল আর মগ দিলেন। দাদি সেই পানি মগে ঢেলে তার গলায় থাকা একটা তাবিজ খুলে সেই পানিতে ভিজালেন। তার পর একটা দোয়া পড়তে পড়তে আমাকে পরিয়ে দিলেন। বড় চাচা পাশ থেকে বললেন,
— মা, ও এত্তো বড় বিপদে আছে???
— হুম, তোরা সবাই ওকে চোখে চোখে রাখবি। (দাদি)
— মা, ওর কি হয়েছে?? (বাবা)
— কিছুনা। তবে হতে পারতো। কিন্তু এখন আর হবেনা আল্লাহ ভরসা। বাবা রুমেল, এটা ভুলেও গলা থেকে খুলবে না। (দাদি)
— জ্বি দাদি। (আমি)
আমি হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করলাম। আমি এই বাসায় ঢুকার পর থেকেই আমার গা’টা কেমন ভারী ভারী লাগছিলো। কিন্তু এখন বেশ হালকা লাগছে। এখন আমার একটু চিন্তা মুক্ত লাগছে। আমার দাদি খুবই পরহেজগার মানুষ। শুনেছি তিনি নাকি জ্বিনের সাথে কথা বলেন। তাদের পালেন। দাদি আমার হাতটা ধরে আছেন। আমিও তাদের কথা শুনছি। কি যেন হঠাৎ করে একটা কথা কানে ভেসে আসলো,
— তুই বাঁচবি না…তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না…
আমি আমার হাতে শক্ত চাপ অনুভব করি। আমি ঠাস করে দাদির দিকে তাকাই। দেখি দাদিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদি বলল,
— কিচ্ছু হবে না। এটা সাথে থাকলে তোর কিচ্ছু হবে না।
আমি কি করবো কি বলবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কথা শেষে বাইরে বের হতেই আমার চাচাতো দুটো ভাই এসে আমাকে ধরে।
— রুমেল, চল তোকে নিয়ে ঘুরে আসি। সেই যে গিয়েছিল আর আজ আসলি। চল গ্রামটা ঘুরে দেখবি। (শুভ)
আমিও রাজি হয়ে গেলাম। কারণ দাদির দেওয়া ওটাতো আছেই। এরপর ওদের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পরলাম। আমরা তিন ভাই একসাথে ঘুরছি। গ্রামের পরিবেশটা ঢাকার মতো না। কোনো সোরগোল হৈচৈ নাই। একদম চুপচাপ শান্ত। আমরা একটা গাছের নিচে গিয়ে দাড়ালাম। অনেকক্ষন যাবত হাঁটছি তাই ক্লান্ত। শুভ(চাচাতো ভাই) বলে উঠলো,
— ভাই মনে আছে আজ থেকে ৪/৫ আগে আমরা কি মজা করছিলাম এখানে। ওইযে চাচার সাথে ২ মাসের জন্য আসছিলি ঘুরতে।
— আমার মনে পরছে না রে। (আমি)
— আরে ওইযে ভাঙা বাড়িতে আমরা খেলতাম। মনে নাই???(নাঈম)
— না ভাই আমার কিছু মনে পরছে না। আর ভাঙা বাড়িটা কই??(আমি)
— তুই আসার সময় দেখিস নি রুমেল??(শুভ)
— হ্যাঁ। ওইটা…
— হ্যাঁ। যাবি রুমেল ওখানে?? (নাঈম)
— না না থাক।
— আরে চল মজা হবে। (শুভ)
— হ্যাঁ হ্যাঁ চল। (নাঈম)
— আচ্ছা চল তাহলে। এতো করে বলছিস যখন। (আমি)
চলবে…
কি হতে পারে রুমেলের সাথে সেই ভাঙা বাড়িতে?? জানতে হলে সাথে থাকুন। আর কেমন লেগেছে জানিয়েন কিন্তু। সবার ভালো সাড়া চাই।
– গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।