ভবঘুরে পর্বঃ ১৯
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আবিদ কথাটার সত্যতা বুঝতে পারলে দিঘির পাড়ে পা দিতেই। উরবির বেহুদা চিৎকার-চেঁচামেঁচিতে যে দু-তিনজন আবিদের সঙ্গে সোৎসাহে দিঘির পাড়ে এসেছিল—দিঘির পাড়ে উরবির অবস্থান দেখে তাদের সমস্ত উৎসাহ বাষ্পীভূত হয়ে মুহূর্তেই উবে গেল। অন্ধকারের শামিয়ানা ভেদ করে টর্চের তীব্র আলো ফেলল ওদের একজন। আশপাশটা আগের মতোই বিরান কিন্তু অদূরেই অধীর উরবির হাতে বাঁশের কঞ্চি বাঁধাই করা বর্শি। বর্শির মাথায় শক্ত মাটির ওপর তড়পাচ্ছে একটা মাঝারি আকারে মৃগেল মাছ। সেটাকে মুঠোয় আয়ত্ত করার বৃথা চেষ্টা নিয়েই এমন চিল্লাপাল্লা জুড়ে দিয়েছে সে। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! পেছনের ছেলেগুলো কৌতুকভরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল একবার। আবিদ তিতিবিরক্ত হয়ে মাটিতে পা ঠুকে অস্ফুট বিরক্তি-সূচক শব্দ করল।
অকস্মাৎ টর্চের আলো পড়ার কারণে আবিদকে দেখামাত্রই উরবি চেঁচিয়ে ওকে ডাকল,
– ‘এদিকে আসেন তাড়াতাড়ি। মাছটা ধরেন।’
আবিদ খানিকটা দূরে ওর কাণ্ড দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এতকিছুর পরও তার মুখে বেল্লিক কথা শুনে চরম বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে গেল সে। এরপর একবার ক্রোধভরে একপলক উরবির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ কুজো হয়ে খুব সহজেই মাছটাকে বর্শি থেকে আলাদা করল। কটাস করে মাছের মাথাটা টিপে অবলা মাছের ভবলীলা সাঙ্গ করা হল এবং উরবির দুইহাত তুলে মাছটাকে ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে সরে এলো সেখান থেকে। তার সঙ্গে আসা ছেলেগুলোকে অতিক্রম করার সময় বলে গেল,
– ‘অন্যদিন একবার আসব।’
এই পুরো ঘটনাকালে আবিদের মুখমণ্ডলের ওপর যেন কার্ফিউ জারি হয়েছিল! উরবি মাছ- হাতে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ‘আরে আমাকে নিয়ে যান’ বলে সে নিজেও দৌড় দিল। মাছটা হাতেই রইল। একেই বলে, ইল্লত যায় না ধুলে,স্বভাব যায় না ম’লে।
……………
– এই যে, এই যে, এটা কী করলেন? ঐ মদখোরগুলোর হাতে রেখে এলেন আমাকে?
থপাস-থপাস করে পা ফেলে আবিদের পাশ ঘেঁষে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলল উরবি। রাগের আলোড়নে আবিদ হাঁটছে খুব দ্রুতগতিতে। বাচ্চার মতো ছোট ছোট পদে হেঁটে ওর সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না উরবি। যার কারণে অল্প-সল্প দৌড়াচ্ছে সে। কিন্তু আবিদ নিরুত্তর গমগম করে হেঁটে যাচ্ছে অন্ধকার কেটে। উরবি আবার বলল,
– কী হল? কথা বলেন না ক্যান্। আমার জুতা ফেলে আসছি ওখানে।… পানির শব্দ শুনে দিঘিতে নামছিলাম। পরে দেখি বর্শিতে মাছ আটকাইছে।… কী হল। আসেন না জুতা নিয়ে আসি।
আবিদ ওর কথার বিন্দুবিসর্গও শুনলে বলে মনে হল না। চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগল। এদিকের রাস্তায় ম্লান চাঁদের আলো বিদ্যমান। গাছপালার নিবিড়তা কমে এসেছে দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে। ভাটার টান পড়েছে আবিদের রাগেও। তবু আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করল না সে। কিন্তু উরবি থেমে নেই। বিরামহীন বকরবকর করেই যাচ্ছে সে। তার গলায় রাগও অনুতাপও নেই আছে শুধু জুতা হারানোর শোক আর ফিরে পাবার অসম্ভব আকুতি।
– কথা বলেন, নাহয় আমি বাবাকে বলব যে আপনি আমাকে জোর করে গাঁজা খাওয়াইছেন।
আবিদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উরবির দিকে তাকাল, সন্দিগ্ধ গলায় ধীরে ধীরে বলল,
– আমি খাইয়েছি?
– না, কিন্তু এভাবে রাগ দেখালে এটাই বলব বাবাকে।
আবিদ চোখ ঘুরিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
– দারুণ চিজ আপনি।
– ওকে মানলাম আমি দারুণ চিজ,আমি ভালো না। বাচাল,লাফাই বেশি, মানুষ পিটাই। এক্সেটরা এক্সেটরা এক্সেটরা… বাট এখন চলুন,এই মাছটা ফ্রাই করে খাব।
একখণ্ড বিশাল কালো মেঘ এসে আলিঙ্গন করে নিল চাঁদকে। তল্লাটের পথঘাট নিমেষেই ঘুরঘুট্টি অাঁধারে ঢেকে গেল। তিমিরে সতর্কে পথ চলতে চলতে আবিদ বলল,
– কোথাকার কোন্ দিঘির মাছ নিয়ে আমি ফ্রাই করে আপনার সঙ্গে খাব সেটা আপনি ভাবলেন কী করে?
– এরপরের ডায়লগটা বলুন না ঐ যে,বামুন হয়ে চাঁদে হাত!— আমি এতো বুঝি না। আমার শখ হইছে সো খেতেই হবে।
আবিদ সুপ্ত রাগটা আবার নবোদ্যমে চাড়া দিয়ে উঠল,
-‘দ্যুৎ—খাব না, কী করবেন? যান আপনার বাবাকে বলে দিন। তারপর কী হবে? আমাকে তোমাদের বাসা থেকে বের করে দিবে এই তো? বেশ,আমিও বেরিয়ে যাব। আই ডোন্ট কেয়ার।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
উরবি হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ ধাক্কা মেরে হৃৎস্পন্দন দুরন্ত হয়ে উঠল। কেউ যেন খামচে ধরে আবার ছেড়ে দিল। কেন এমন হল? আগে তো লোকটা বিতাড়িত হলেই প্রশান্তি মিলতো তার। এ কোন্ মায়া ছেঁকে ধরল উরবির অন্তঃসারশূন্য হৃৎপিণ্ডটাকে? তার মনে পড়ে গেল, লোকটা যে এখানে অস্থায়ী! যেকোনো মুহূর্তে ঐ আস্তানার মিশন আর যেকোনো মুহূর্তে সে লাপাত্তা! তখন কোন্ অধিকারে সে লোকটাকে এখানে কিছুদিন থেকে যেতে বলবে? তার মনটা তো চায় আবিদ আজীবন এখানে থাকুক আর এভাবেই উরবি তাকে জ্বালিয়ে মারে! সে হবে না— হবেই না যখন যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত আবিদকে তার চঞ্চলতায় দগ্ধ করবে সে। ভালো না হোক, খারাপ হয়েই তার মনোমন্দিরে শক্ত আসন গেঁড়ে নিবে । এই উরবির মনপ্রসূত সংকল্প। কিন্তু নিজের মনের ভাবনার নলের মুখে বাধ সেধে সে স্বভাবসুলভ বলল,
– হুহ, যান না। ধরে রাখছে কে?
আবিদ গম্ভীরস্বরে বলল,
– আপনার অত্যচারে টিকা দায় বুঝলেন? চলেই যেতাম। এই তো অল্প কয়দিন। আমি চাইলে যেকোনো দিন আস্তানায় অভিযান চালানোর প্রস্তাব করতে পারি। কিন্তু…শুধু ঐ আস্তানা নির্মূল করলেই তো আর এলাকার মাদক গ্রহণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না!যাদের নেশা হয়েছে একবার তারা তামাম পৃথিবী ঘুরে হলেও এসব জোগাড় করে খাবে। মাদক খুব খারাপ একটা অভ্যাস। যাকে একবার ধরে তাকে ঝাঁঝরা নিঃস্ব করে ছাড়ে। তো যারা এরই মধ্যে উচ্ছনে গেছে তাদের ফেরানো তো একপ্রকার অসম্ভব। ওরা না খেতে বললেই মারতে উঠবে। কিন্তু যারা এখনো ওতোটা পাক্কা হয়নি ওদের সঙ্গে আমি কথা বলে ওদের ফেরাতে চাই আলোর পথে। পূব পাড়ার কিছু ছেলেদের পেছনেও সময় দিয়েছি এভাবে। ফল এসেছে ভালো। এবার এদের পালা। তারপর আস্তানা উঠিয়ে নিব। তারপর বোধহয় আপনার থেকে আমার মুক্তি।
উরবি একটু আঘাতপ্রাপ্ত হল ওর কথায়। কিন্তু অতোটা আমলে নিল না। আর যা-হোক, ভালো মানুষের থেকে তো কেউ মুক্তি চায় না! মাথা ঝেড়ে আবারো জোরপূর্বক কিছু বলতে যাচ্ছিল উরবি, তখনি পেছন থেকে চটচট হুড়োহুড়ির শব্দ পাওয়া গেল। ঘাড় ফেরানোর আগেই আচমকা জোর টান পড়ল উরবির ডান হাতে। দমকে মাটিতে আছড়ে পড়তে চাইলে বুঝতে পারল সে কারো বজ্রকঠিন হাতের মুঠোয় বন্দি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাল, কাজে এল না। এদিকে আচমকাই আবিদের প্রশস্ত পিঠের ওপর পড়ল চটাস শব্দে লাঠির আঘাত। মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে ঝোঁক সামলে নিল সে। পুন উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবারো মাথায় আঘাত করা হল পেছন থেকে! রণাঙ্গনের বীর যেভাবে পরাজিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেভাবেই ধপাস করে মাঠিতে ধরাশায়ী হল আবিদের বিশাল দেহ। রাস্তার তপ্ত ধুলো উড়িয়ে গেল এক ভারাক্রান্ত নিঃশ্বাস।বেশ কিছুক্ষণ সমস্ত নীরব— ঝিমঝিম করছে আবিদের এলোমেলো চুলভর্তি মস্তক৷ মাথার পেছন দিকে আঘাতের ফলে মুহূর্ত কয়েক স্মৃতিভ্রংশ হয়ে রইল সে। চাঁদের ওপর থেকে বিশাল মেঘটা সরে গিয়ে আবছা দ্যুতিতে আলোকিত হল চারিপাশ। কিন্তু আবিদের চোখে সবকিছু অদ্ভুতরকমের ঘোলাটে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করা উরবিকেও চিনতে পারল না সে। মিনিট কতক এভাবেই ঢুলুঢুলু অবস্থায় কাটার পর একটা অপরিচিত কণ্ঠে তার পুরোপুরো চৈতন্য ফিরে এল,
– দ্যাখতো,বেডা আছে না গ্যাছে।
ততক্ষণে আবিদের বেদনা প্রশমিত হয়ে দিগজ্ঞান ফিরে এসেছে কিছুটা। কিন্তু উঠে বসার শক্তি পেল না।
কথামতো একজন কাছে আসতেই আবিদ তার পা আঁকড়ে ধরে কোমরে গোঁজা লাইসেন্স-কৃত পিস্তলটা তড়িৎগতিতে বের করে পায়ে ঠেকালো। এরপর সেকেন্ডের নিমিত্তে সরিয়ে নিয়ে একটা ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো সে। হট্টগোল করার শক্তি এবং অভিপ্রায় কোনটিই তার নেই। গুলির শব্দ শুনেই ছিঁচকে সন্ত্রাসেরা পালাবে এই ক্ষীণ বিশ্বাস আবিদের। আবিদের হাতের আবদ্ধ ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠল,
– জাফর,ব্যাডার হাতে বন্দুক, বাঁচা ভাই বাঁচা।এই ছাড়—
এই বলে আবিদ হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য চুলবুল করতে লাগল সে। আবিদ চিনতে পারল কণ্ঠস্বরটা। ঐ গাঁজার আসরে এই গলাতেই কেউ একজন দু’একটা বাচ-বচন করেছিল। নেপথ্যে তবে ওরাই? ছোকরাটা যেন আবিদের মনোভাব বুঝতে পেরে মাটিতে তড়পাতে তড়পাতে হাউমাউ করে বলল,
– খোদার কসম ভাই, আর করুম না এমুন। আমাগোরে ঐ মনসুর কাকা পাঠাইছে।
আবিদ আবারো একটা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ছেলেটার পা ছেড়ে দিল প্রবল ধাক্কায়৷ এতক্ষণ টানাহ্যাঁচড়ার ফলে সে হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়ে ভোঁ দৌড় দিল। তার সহচরেরা আগেই আতান্তর দেখে পালিয়েছে। আবিদ তীব্র ঘৃণ্য কণ্ঠে ‘ শালার তাল পাতার সেপাই কোথাকার, কাপুরষ পেছন থেকে আঘাত করে…’
বলে উঠে কুজো হয়ে বসল ধূলিকীর্ণ মাটির রাস্তায়। উরবির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এর আগে সরাসরি গুলির শব্দ সে শুনেনি,বিধায় একটু ভ্যাবড়ে গিয়েছিল সে। হাত ধরা ছেলেটা রেহায় পায়নি উরবির কবল থেকে।ধস্তাধস্তির সময় ছেলেটার হাত কামড়ে, চুল টেনে, বাঁ হাতের বড়বড় নখে মুখ খামচে ছেলেটাকে পরাভূত করেছিল সে। পরে ঠাস ঠাস গুলির শব্দে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে,এই বুঝি লোকটা কাউকে খুন করে ফেলল! সেরকম কিছুই হয়নি— এবার বিপদমুক্ত হয়েছে ভেবে আবিদের কাছে ছুটে এল সে।
– ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে আবিদের পাশে বসে ব্যকুল-নরম গলায় বলল উরবি।
আবিদ দুই হাঁটুর মধ্যিখানে প্রখর বেদনায় মাথা গুঁজে বসে ছিল। উরবি কথা শুনেও কোনো উত্তর করল না।
দূর থেকে ভীমনাদে “ডাকাত, ডাকাত” জনরব ভেসে আসতে শুরু করল। কারো হাতে টর্চ আবার কারো হাতে চার্জার লাইট আর কারো হাতে স্মার্টফোন; এবং সবারই অন্য হাতে চুরি,চাপাতি কিংবা বটি-লাঠি নিয়ে ধাবিত হচ্ছে এদিকে। ভবিতব্য দুর্দশা দেখে উরবি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ল। আবিদের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
– আরে কথা বলুন, ঐ যে লোকজন আসতেছে। গুলির শব্দ শুনে মনে করছে ডাকাত পড়ছে গ্রামে। আপনি গ্রামে কম পরিচিত— আপনার হাতে পিস্তল, চলেন তাড়াতাড়ি।
আবিদ জানু থেকে মাথা তুলে চোখ রগড়ে জড়িত গলা বলল,
– কোথায় যাব?
উরবি চতুর চোখে আশেপাশে তাকাল। এরপর আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
– পাইছি, ঐ…যে খোলা মাঠের এককোনায়, শালবন আর জঙ্গল। ওটা নিরুদের জমি। ওখানে নিরাপদ, চলুন।
আবিদ বুঝতে না পেরে বলল,
– জঙ্গলে যাব কেন?
– আরে বাল, আপনি জংলী তাই জঙ্গলে যাবেন—দেখেন না লোকজন আসতেছে পিটাবে আপনাকে।
আবিদ ভীষণ রাগে ভরা গলায় বলল,
– আরো চারটা গুলি আছে ভিতরে। চারটা লাশ পড়লেই আর কেউ কাছে ঘেঁষবে না। আপনি চলে যান। মাথা গেছে আমার।
শেষের কথাটা বলে উরবিকে দূরে ঢেলে দিয়ে আবারো করতলে মাথা চেপে ধরল আবিদ। উরবি বেহায়ার মতো আবারো এগিয়ে এসে ওর হাত জাপটে ধরে অধীর গলায় বলল,
– আরে পাগল হয়ে গেছেন নাকি। চলুন।
আবিদ এবার উঠে দাঁড়াল বাধ্য ছেলের মতো। পাছে টলে পড়ে যায় এজন্য উরবির হাতটা ধরাই রইল। মেঠোপথের একপাশে কচুরিপানা ভর্তি জলাশয়, অন্যপাশে বিস্তীর্ণ তেপান্তরের অদূরবর্তী ডান কোনে উরবির দেখানো সেই ঝোপঝাড়-শালবন। মাঠের দিকে নামার আগে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে খানিক দূর থেকে মৃগেল মাছটা সানন্দে হাতে তুলে নিল সে। এরপর দ্রুতপায়ে দু’জনে নেমে গেল মাঠে। গ্রামের লোকজন হল্লা করে পাতিপাতি করে খুঁজেও ডাকাতের কোনো সন্ধান পেল না।
……………
– ‘আপনার কী বেশি খারাপ লাগছে আবিদ?’ আবিদের চুলে চিরুনির মতো আঙুল চালিয়ে স্নিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল উরবি।
আবিদ শুয়ে আছে সারি সারি শালগাছের ফাঁকের এলোমেলো ছোট-বড় আকারের তৃণের ওপর। প্রচণ্ড গরমে শীতল ঘাসের ওপর শুয়ে থাকলে আলাদা একটা স্বস্তি মেলে। বনের এফোঁড়ওফোঁড়ে শাঁ শাঁ করে খেলে বেড়াচ্ছে অস্বাভাবিক হিম শীতল একটা মায়াবী বাতাস। নাম না জানা রাডচরা পাখি খানিক পরপর ডেকে চলেছে টিঁ টিঁ করে। আবিদের শিথানে হাঁটু ফেলে বসে আছে উরবি। ডাকাত সন্দেহে লোকজন আসার ভয় আর আবিদের বেদনাক্রান্ত আচরণে তার চোখে ঝরছে নিদারুণ ব্যাকুলতা। হাত আঙুলগুলো বাদ্যযন্ত্রের মতো আবিদের নরম ঝরঝরে চুলে খেলছে। অন্ধকারে আবিদের চোখ খোলা কি বোজা বুঝার জো নেই। উত্তর না পেয়ে উরবি আবার শুধাল,
– আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
আবিদ বেদনা-ক্লিষ্ট গলায় জবাব দিল,
– নাহ, মাথার পেছনে আঘাত হয়েছে তো! তাই মাথাটা ব্যথা করছে আর ভারী ভারী লাগছে।
উরবি সমবেদনা জানানো গলায় বলল,
– ইশঃ জায়গাটা অনেক সেনসিটিভ আসলে। আমার একবার আঘাত লাগছিল মাথার পেছনে। ঈদের সময় ছিল তখন। কয়েক ঘন্টা স্মৃতি ড্যামেজ হয়ে গেছিল। পরে আবার ঠিক হয়ে গেছিল।
– ঠিক হয়নি,এখানো সমস্যা আছে আপনার মাথায়।…
উরবির হাতের মুঠোয় খেলা-করা চুলগুলো মৃদু টান দিতেই আবিদ মুখে যন্ত্রণাসূচক শব্দ করে হালকা হাসল। এরপর সমস্ত শক্তি এক করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল সে। ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে কুটুস কুটুস করে ঘাড় ফুটিয়ে নিজেকে ঝরঝরে করার চেষ্টা করল সে। এরপর জোরপূর্বক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দীপ্ত গলায় বলল,
– চলুহ,এবার যাওয়া যাক।
শুনে উরবি একটু সতর্ক দৃষ্টি মেলে ধরল আশেপাশে। বলল,
– একটু পর যাই৷ ঐযে দূরে এখনো আলো দেখা যাচ্ছে। সবাই সরে গেলেই আমরা বেরোব।
আবিদ ডাকাবুকো গলায় বলল,
– আরে আজব তো! আমরা কি ডাকাত নাকি যে এভাবে ডাকাতের মতো লুকিয়ে থাকব?
উরবি তর্কের সুরে বলল,
– আপনার বন্দুকে চারটা গুলি আছে,ওখানে শতখানেক মানুষ । তাছাড়া ভাবুন একবার,ওদের সঙ্গে তো মনসুরের লোকও থাকতে পারে! আর এমনটাও তো হতে পারে যে,মনসুরই আপনাকে মারার জন্য গ্রামের মানুষকে ফুসলিয়ে ডাকাতের গুজব তুলে দা- বটি নিয়ে পাঠিয়েছে। এভাবে ঘাড়ত্যাড়ামি করলে কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে না৷ উল্টো ঝামেলা হয়ে যাবে!
আবিদ খানিক সময় আঁধারে বিহ্বল দৃষ্টিতে উরবির মুখপানে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পেরে নির্লজ্জ উরবি অভূতপূর্ব লজ্জায় অনবত হয়ে পড়ল। আবিদের ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসি ব্যাপ্ত হয়ে গেল,
– ‘বাহ্, সুদূরপ্রসারী ভাবনা তো আপনার! ভাবতে ভালো লাগে আজকাল আমার কাজ নিয়ে আমাকে নিয়ে কেউ একজন হলেও মাথা ঘামাচ্ছে। অনুপ্রাণিত হলাম। হাঃহাঃ’
আবিদের মুচকি হাসিটা আরো পরিব্যাপ্ত হল। যখন কাউকে আপন মনে হয় আঁধারে অনুভবে হাসির বিস্তৃতি কত হচ্ছে তাও বোঝা যায়! কিন্তু উরবি শ্লেষোক্তি করে অস্বীকার করে বসল,
– আপনাকে নিয়ে ভাবার টাইম নাই আমার। আমি আদালত দেখতাম প্রচুর, এজন্য এমনিই এসব মাথায় ঘুরে।
আবিদ আবার হাসল। পরক্ষণেই হাসিটার ঠোঁটের কোনেই সমাধি হল খুব কাছাকাছি কল্পনাতীত কিছু শব্দে, অযাচিত কথোপকথনে।অনেকটা মা আর ছোট বাচ্চার আদুরে সম্ভাষণের মতো। মা ছেলেকে ডাকছে আর ছেলে কি এক আনন্দে খিলখিল করে হেসে চলেছে৷ আবিদ খানিক ভীত হলেও উরবি উৎকর্ণ হয়ে শব্দোৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। ঝিরিঝিরি শীতল মোহ জাগানিয়া বাতাসটা আচমকাই স্তব্ধ হয়ে গেল এবং দাবানলের মতো উৎকট উত্তপ্ত বাতাসে পুরো তল্লাট আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এদিকে অদৃশ্য ছেলেটা এবার অদ্ভুতস্বরে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মরা কান্না।
চলবে….